
রহমান মৃধা

বিশ্বে গণতন্ত্রের যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে একদিন জাগরণ ঘটেছিল, সেই স্বপ্ন আজও পূর্ণ হয়নি। ২০২৪ সালে যে গভীর উদ্বেগ আমাকে গ্রাস করেছিল, বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতা সেই উদ্বেগকে আরও তীব্র করে তুলেছে। পৃথিবী আজ প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতিতে রূপান্তরিত—ডিজিটালাইশনের ছোঁয়ায় মানুষের জীবনযাত্রা বদলে গেছে, তথ্যপ্রবাহের গতি অভাবনীয়। কিন্তু গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি—স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, স্বচ্ছ শাসন, মানুষের অধিকার—এসব ক্ষেত্রে কোনো উন্নতি নেই।
আজও বহু দেশে স্বৈরাচারী শাসন টিকে আছে; পরিবারতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র আরও গাঢ় হয়েছে। শাসন আর শোষণ যেন একই স্রোতে মিশে গেছে। বক্তব্যের স্বাধীনতা প্রতিনিয়ত আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে, ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার পরিণত হয়েছে নিছক প্রহসনে।
এর মধ্যেই রয়েছে জাতিসংঘের মতো অচল ও নিষ্ক্রিয় একটি সংগঠন—যার নীরবতা আজ বিশ্বের সামনে এক অবিশ্বাস্য লজ্জা। কোথাও কোনো সাড়া নেই; নেই দায়বদ্ধতা, নেই জবাবদিহি। যেন মানবজাতির দুর্দশা, যুদ্ধ, অস্থিরতা কিছুই তাদের বিবেকে আঘাত করে না।
আজ সাধারণ দিনমজুর মানুষ নিজের সবকিছু দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রাণ দিচ্ছে। অথচ যাদের আমরা এলিট শ্রেণি বলি—তারা বিশ্বের আরামদায়ক দেশে নিরাপদ জীবন কাটাচ্ছে, পরিবারকে পাঠিয়ে দিচ্ছে শান্তিপূর্ণ দেশে। ওদিকে ক্ষুধার্ত মানুষ হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে মাতৃভূমির জন্য। এ কি সেই গণতন্ত্র, যার স্বপ্নে একদিন মানবজাতি আলোড়িত হয়েছিল? এই লজ্জা, এই ঘৃণা কোথায় রাখি?
গাজা, ইউক্রেনসহ বহু দেশে চলছে যুদ্ধ। অথচ কিছুদিন আগে মিসরে গিয়ে দেখলাম—সেখানে অনেক দেশের এলিট শ্রেণি নিশ্চিন্তে ছুটি কাটাচ্ছে। তাদের দেশের মানুষ যখন মরছে, তারা তখন সমুদ্রের নীল জলে আনন্দে ডুবে আছে। আমরা খবর দেখি, সাহায্য পাঠাই, অর্থ দিই—কিন্তু সেই অর্থ কতটা সত্যিকারের অসহায় মানুষের কাছে পৌঁছায়? আর কতটা দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের পরিবারে জমা হয়, যারা দূর দেশে বিলাসী জীবন যাপন করে? একসময় ভাবতাম এ জঘন্যতা শুধু বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এখন দেখি—এ ভণ্ডামি ছড়িয়ে গেছে সারা পৃথিবীতে। কিন্তু কেন? জাতিসংঘ কোথায়? তারা কী করছে—বা আদৌ কিছু করতে পারছে কি?
বাংলাদেশে স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটেছে। কিন্তু সেই স্বৈরাচার পরিবারের কেউ দেশে নেই; তারা বিপুল অর্থে বিদেশে নাগরিকত্ব কিনে সুরক্ষিত। অথচ দেশের মানুষের পেটে ভাত নেই, দেখার কেউ নেই। দেশে যখন আইনের স্বচ্ছতা ফিরে এলো, বিচারব্যবস্থা সক্রিয় হলো—তখনই তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে প্রতিবাদ করছে। কী আশ্চর্য অভিনয়! আর সবকিছুর ওপরে জাতিসংঘের নীরবতা।
যে দেশে নব্বই শতাংশ মানুষ দিনমজুর, সেখানে এলিট শ্রেণি কীভাবে নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়? তারা কি কখনো ভেবেছে সাধারণ মানুষের জীবন কতটা কঠিন? ভাববে কেন? বুঝতে চেষ্টা করলে দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করা যায় না! তবে এবারের এনসিপির মনোনয়ন ফর্ম বিক্রির দৃশ্য দেখে মনে হলো—তারা অবশেষে এক সত্য উপলব্ধি করেছে: বাংলাদেশের পরিচয় শুধু দুর্নীতি, স্বৈরাচার বা পরিবারতন্ত্র নয়। এ দেশের ১৭ কোটি মানুষের ভেতর আছে এক বিশাল শক্তি—যারা জীবনের বিনিময়ে দেশের উন্নয়নকে এগিয়ে নেয়। এ দেশ রিকশাওয়ালার দেশ; অতএব রিকশাচালকের ভোট, তার কণ্ঠস্বর, তার প্রতিনিধিত্বই হওয়া উচিত সরকারের ভিত্তি।
বাংলাদেশ ৫৪ বছর পেরিয়েছে। কিন্তু শাসিত হয়েছে এলিট শ্রেণির হাতে। এটা চলতে পারে না।
যে রিকশাওয়ালা তরুণদের আন্দোলন দেখে রাস্তায় ছুটে আসে—যে সাধারণ মানুষ দেশের ভবিষ্যৎ রক্ষায় নিজের জীবন পর্যন্ত দিতে দ্বিধা করে না—সেই মানুষই প্রকৃত নায়ক। তাই এবারের জাতীয় নির্বাচন তারই প্রাপ্য। কারণ সেই মানুষই পারে স্বৈরাচার, দুর্নীতি এবং চাঁদাবাজির দুষ্টচক্র ভেঙে ১৭ কোটি মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনতে।
আমি দেখতে চাই—বাংলাদেশ হোক বিশ্বের প্রথম দেশ, যেখানে জনগণ নতুন বিপ্লবের মাধ্যমে প্রকৃত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করবে। আর সেই উদাহরণ থেকে বিশ্ব শিখবে—কীভাবে শত বছরের প্রতিজ্ঞা, যার নাম গণতন্ত্র, পুনরুদ্ধার করা যায়।
জাগো বাংলাদেশ, জাগো।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
*লেখক গবেষক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। ইমেইল: [email protected]

বিশ্বে গণতন্ত্রের যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে একদিন জাগরণ ঘটেছিল, সেই স্বপ্ন আজও পূর্ণ হয়নি। ২০২৪ সালে যে গভীর উদ্বেগ আমাকে গ্রাস করেছিল, বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতা সেই উদ্বেগকে আরও তীব্র করে তুলেছে। পৃথিবী আজ প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতিতে রূপান্তরিত—ডিজিটালাইশনের ছোঁয়ায় মানুষের জীবনযাত্রা বদলে গেছে, তথ্যপ্রবাহের গতি অভাবনীয়। কিন্তু গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি—স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, স্বচ্ছ শাসন, মানুষের অধিকার—এসব ক্ষেত্রে কোনো উন্নতি নেই।
আজও বহু দেশে স্বৈরাচারী শাসন টিকে আছে; পরিবারতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র আরও গাঢ় হয়েছে। শাসন আর শোষণ যেন একই স্রোতে মিশে গেছে। বক্তব্যের স্বাধীনতা প্রতিনিয়ত আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে, ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার পরিণত হয়েছে নিছক প্রহসনে।
এর মধ্যেই রয়েছে জাতিসংঘের মতো অচল ও নিষ্ক্রিয় একটি সংগঠন—যার নীরবতা আজ বিশ্বের সামনে এক অবিশ্বাস্য লজ্জা। কোথাও কোনো সাড়া নেই; নেই দায়বদ্ধতা, নেই জবাবদিহি। যেন মানবজাতির দুর্দশা, যুদ্ধ, অস্থিরতা কিছুই তাদের বিবেকে আঘাত করে না।
আজ সাধারণ দিনমজুর মানুষ নিজের সবকিছু দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রাণ দিচ্ছে। অথচ যাদের আমরা এলিট শ্রেণি বলি—তারা বিশ্বের আরামদায়ক দেশে নিরাপদ জীবন কাটাচ্ছে, পরিবারকে পাঠিয়ে দিচ্ছে শান্তিপূর্ণ দেশে। ওদিকে ক্ষুধার্ত মানুষ হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে মাতৃভূমির জন্য। এ কি সেই গণতন্ত্র, যার স্বপ্নে একদিন মানবজাতি আলোড়িত হয়েছিল? এই লজ্জা, এই ঘৃণা কোথায় রাখি?
গাজা, ইউক্রেনসহ বহু দেশে চলছে যুদ্ধ। অথচ কিছুদিন আগে মিসরে গিয়ে দেখলাম—সেখানে অনেক দেশের এলিট শ্রেণি নিশ্চিন্তে ছুটি কাটাচ্ছে। তাদের দেশের মানুষ যখন মরছে, তারা তখন সমুদ্রের নীল জলে আনন্দে ডুবে আছে। আমরা খবর দেখি, সাহায্য পাঠাই, অর্থ দিই—কিন্তু সেই অর্থ কতটা সত্যিকারের অসহায় মানুষের কাছে পৌঁছায়? আর কতটা দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের পরিবারে জমা হয়, যারা দূর দেশে বিলাসী জীবন যাপন করে? একসময় ভাবতাম এ জঘন্যতা শুধু বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এখন দেখি—এ ভণ্ডামি ছড়িয়ে গেছে সারা পৃথিবীতে। কিন্তু কেন? জাতিসংঘ কোথায়? তারা কী করছে—বা আদৌ কিছু করতে পারছে কি?
বাংলাদেশে স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটেছে। কিন্তু সেই স্বৈরাচার পরিবারের কেউ দেশে নেই; তারা বিপুল অর্থে বিদেশে নাগরিকত্ব কিনে সুরক্ষিত। অথচ দেশের মানুষের পেটে ভাত নেই, দেখার কেউ নেই। দেশে যখন আইনের স্বচ্ছতা ফিরে এলো, বিচারব্যবস্থা সক্রিয় হলো—তখনই তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে প্রতিবাদ করছে। কী আশ্চর্য অভিনয়! আর সবকিছুর ওপরে জাতিসংঘের নীরবতা।
যে দেশে নব্বই শতাংশ মানুষ দিনমজুর, সেখানে এলিট শ্রেণি কীভাবে নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়? তারা কি কখনো ভেবেছে সাধারণ মানুষের জীবন কতটা কঠিন? ভাববে কেন? বুঝতে চেষ্টা করলে দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করা যায় না! তবে এবারের এনসিপির মনোনয়ন ফর্ম বিক্রির দৃশ্য দেখে মনে হলো—তারা অবশেষে এক সত্য উপলব্ধি করেছে: বাংলাদেশের পরিচয় শুধু দুর্নীতি, স্বৈরাচার বা পরিবারতন্ত্র নয়। এ দেশের ১৭ কোটি মানুষের ভেতর আছে এক বিশাল শক্তি—যারা জীবনের বিনিময়ে দেশের উন্নয়নকে এগিয়ে নেয়। এ দেশ রিকশাওয়ালার দেশ; অতএব রিকশাচালকের ভোট, তার কণ্ঠস্বর, তার প্রতিনিধিত্বই হওয়া উচিত সরকারের ভিত্তি।
বাংলাদেশ ৫৪ বছর পেরিয়েছে। কিন্তু শাসিত হয়েছে এলিট শ্রেণির হাতে। এটা চলতে পারে না।
যে রিকশাওয়ালা তরুণদের আন্দোলন দেখে রাস্তায় ছুটে আসে—যে সাধারণ মানুষ দেশের ভবিষ্যৎ রক্ষায় নিজের জীবন পর্যন্ত দিতে দ্বিধা করে না—সেই মানুষই প্রকৃত নায়ক। তাই এবারের জাতীয় নির্বাচন তারই প্রাপ্য। কারণ সেই মানুষই পারে স্বৈরাচার, দুর্নীতি এবং চাঁদাবাজির দুষ্টচক্র ভেঙে ১৭ কোটি মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনতে।
আমি দেখতে চাই—বাংলাদেশ হোক বিশ্বের প্রথম দেশ, যেখানে জনগণ নতুন বিপ্লবের মাধ্যমে প্রকৃত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করবে। আর সেই উদাহরণ থেকে বিশ্ব শিখবে—কীভাবে শত বছরের প্রতিজ্ঞা, যার নাম গণতন্ত্র, পুনরুদ্ধার করা যায়।
জাগো বাংলাদেশ, জাগো।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
*লেখক গবেষক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। ইমেইল: [email protected]
আজও বহু দেশে স্বৈরাচারী শাসন টিকে আছে; পরিবারতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র আরও গাঢ় হয়েছে। শাসন আর শোষণ যেন একই স্রোতে মিশে গেছে। বক্তব্যের স্বাধীনতা প্রতিনিয়ত আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে, ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার পরিণত হয়েছে নিছক প্রহসনে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো সোনার বিপরীতে নিজেদের মুদ্রার মান স্থির করত। কিন্তু যুদ্ধের খরচ মেটাতে গিয়ে সেই সোনার ভাণ্ডার দ্রুত কমে যায়। বিপরীতে আমেরিকার ভাণ্ডারে সোনার মজুত বেড়ে যায় এবং ডলার হয়ে ওঠে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মুদ্রা।
প্রবাসীরা দীর্ঘদিন থেকে জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হতে আইনি বিধানের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। নানা সময়ে তাদের আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। চব্বিশ পরবর্তী নতুন নির্বাচনী প্রেক্ষাপটে এই দাবি বাস্তবায়িত হবে বলে আশা ছিল প্রবাসীদের।
ইতিহাস এখানে মার্বেলের মতো ঠান্ডা,/ তবু তার ভিতরে বেজে ওঠে উষ্ণ নদীর ধ্বনি।/ একজন ভিয়েনীয় কবি জিজ্ঞেস করেন/ “তোমার নদীগুলো কি আজও গান গায়?”/ আমি হেসে বলি—/ “তারা এখনো ভালোবাসে, কিন্তু মুখে কিছু বলে না।”