logo
মতামত

ইমিগ্রেশন সমস্যা

মঞ্জুর চৌধুরী. ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র৬ দিন আগে
Copied!
ইমিগ্রেশন সমস্যা

সেদিন শুনি এক বাংলাদেশি ছেলের সুডেন্ট ভিসা বাতিল হয়েছে। কারণ সে স্টুডেন্ট ভিসা পেয়েই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জানতে চেয়েছিল, আমেরিকায় গিয়ে ওকে যেহেতু রেস্টুরেন্টে বা গ্যাস স্টেশনে কাজ করতে হবে, তাই কোনো বড় ভাই আছেন কি না, যিনি ওকে এইসব চাকরি পেতে সাহায্য করবেন।

বেচারার মাথাতেই ছিল না যে, আমেরিকায় স্টুডেন্ট হিসেবে এলে লিগ্যালি ওর ক্যাম্পাসের বাইরে কাজ করার কথা না। এইসব কাজ গোপনে করতে হয়। কর্তৃপক্ষ ভালো করেই জানে, ওরা শুধু না দেখার ভান করে। কিন্তু এমন বোকামি করলেতো ওদেরও বাধ্য হয়ে ব্যবস্থা নিতেই হবে। সেটাই করেছে।

২.

সেদিন আমার এক আপু জানাল, ওদের স্টেটে একটা বাংলাদেশি স্টুডেন্টের ভিসা বাতিল করে ঘাড় ধরে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। কারণ সে নাকি গ্যাস স্টেশনে (যেখানে সে চাকরি করে) randomly এক অচেনা স্বর্ণকেশী সুন্দরিকে জোর করে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করছিল। আসলে সে গোপনে দুষ্টু সিনেমা দেখে এতদিন শিখেছে আমেরিকা ফ্রি সেক্সের দেশ। কাজেই ও একটু ফ্রি সার্ভিস নিতে গিয়েছিল।

মাঝে দিয়ে ওর পরিবার পথে বসে গেছে। জায়গা জমি বিক্রি করে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছিল লেখাপড়া করে শিক্ষিত হতে। ছেলে লেখাপড়া না করে ইমরান হাশমি বা উদিত নারায়নের মতোন ‘চুম্বন দেব’ হতে চেয়েছিল। কী আর করার।

৩.

ইদানিং দেখছি ‘গেরামের কাজিন হঠাৎ বিদেশে আইসা পড়ছে’ টাইপ লোকজন ধুমায়ে ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন, মানে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার হবার ধান্দা করছেন। যা তা ভিডিও পোস্ট করে।

‘গাইজ! এইটা আমার বাড়ি। এখানেই আমি থাকি। এ বাড়ির ভাড়া বাংলাদেশি টাকায় মাসে ১ লাখ টাকা। বেশি বেশি করে লাইক আর শেয়ার করে ছড়িয়ে দিবেন।’

‘গাইজ! এইটা আমাদের রাস্তা আর আমরা এইভাবে রাস্তা “ক্রস” করি। লাইক দিয়ে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন।’

আচ্ছা, এরা ‘গাইজ’, ‘গাইজ’ করে কেন? স্মার্ট হতে হলে কি সারাক্ষণ গাইজ গাইজ বলতে হয়?

সমস্যা এটাতেও ছিল না। ভুলভাল কথাবার্তা বলে অন্যকে বিপদে ফেলে এরা। যেমন সেদিন একটা ভিডিও এল আমার ফিডে, যার শিরোনাম ‘আমেরিকার হাসপাতাল এত খারাপ জানলে কখনই আসতাম না।’

আমি ভাবলাম আহা–রে, বেচারার সাথে নিশ্চই কোনো অন্যায় হয়েছে। দেখি সাহায্য করতে পারি কি না।

ভিডিও খুলে দেখি ঘটনা পুরাই উল্টা। ওর সদ্যজাত বাচ্চাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ৩ দিন আলাদা করে রেখেছে, এই সময়ে কাউকে বাচ্চা কোলে নিতে দেয় নাই। তাই আমেরিকান হাসপাতাল খারাপ হয়ে গেছে।

এই ফ্যাক্ট জেনে নিন, আমেরিকায় কোনো হসপিটাল আপনাকে বিনা কারণে একটা ঘন্টাও বেশি রাখবে না। কারণ ওদেরকে বিল নিয়ে ইনস্যুরেন্স কোম্পানির সঙ্গে দেনদরবার করতে হয়। শুধু শুধু অ্যাডমিট করলে ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ওদেরকে টাকা দেয় না। হসপিটালের বিল কী পরিমান আসে সে সম্পর্কে হালকা ধারণা দিই। আমার বাচ্চাদের জন্ম হয়েছে সি সেকশনে। প্রতিবার হসপিটালে গিয়েছি, যেদিন বাচ্চা হবে সেদিন এবং পরের দিনই বাচ্চাসহ মাকে রিলিজ করে দিয়েছে। বিল এসেছে প্রতিবার ৫০ হাজার ডলারের বেশি। ৫০ হাজার ডলার অনেক পরিবারের বার্ষিক ইনকামও না। মাত্র ২ দিনের বিল! আমাকে ইনস্যুরেন্স ডিডাকটিবল হিসেবে ৬ হাজার দিতে হয়েছে, আর বাকিটা ইনস্যুরেন্স কোম্পানি থেকে আদায় করতে হয়েছে। ইনস্যুরেন্স কোম্পানি নানান প্যাঁচ খোঁজে। কেন এত বিল এল। কী করেছে যে এত বিল এল। এইটা না করলে কি হতো না? ইত্যাদি, ইত্যাদি।

তাহলে বুঝে নিন, কেন হসপিটাল কর্তৃপক্ষ আপনাকে শুধু শুধু তিন দিন হসপিটালে বসে বসে খাওয়াবে? যে ভ্লগার, সে নিউইয়র্কে ‘গরিব’ হিসেবে সিটির ইনস্যুরেন্স পায়, মানে ওর পকেট থেকে একটা পয়সাও দিতে হয় না। পুরোটাই ইনস্যুরেন্স কোম্পানি থেকে আদায় করা হয়। তাই শুধু শুধু এতদিন হসপিটালে কাউকে রাখার প্রশ্নই উঠে না।

তিন দিন রাখার মূল কারন ছিল নিশ্চিত থাকুন, বাচ্চাটার জটিল কোনো রোগ ছিল, যে কারণে ওকে ওভাবে নিবিড়ভাবে পরিচর্যা করতে হয়েছে। এই লোক উল্টা ওদেরই বিরুদ্ধে একটা ভিডিও পোস্ট করে ফেলল। তার চেয়েও বড় সমস্যা, এই ভিডিও দেখে আরও কিছু লোক নিজের বউকে হসপিটালে নিতে টালবাহানা করবে। এর ফলে হয়তো কোনো মা বা শিশুর মৃত্যু ঘটতে পারে।

এরাই দেশে ডাক্তার ভুল চিকিৎসা করেছে, কসাই ডাক্তার ইত্যাদি হট্টগোল করে ডাক্তারকে মারধর করে, হসপিটাল ভাঙচুর করে।

৪.

এমনই আরও কিছু বাংলাদেশি পোস্ট করে বেড়াচ্ছে আমেরিকায় এসে কীভাবে ভিজিটর ভিসা পাল্টে এসাইলাম নিতে হয়। মানে সাধারণ মানুষের গাধামির সীমা যেখানে গিয়ে শেষ হয়, এদের শুরুটা তারও বহু সামনে থেকে। ইদানিং দামি ব্র্যান্ডের দুই নম্বরি চাইনিজ পণ্য যেভাবে ফলাও করে বিক্রি করছে, তেমনিভাবে ফলাও করে এসাইলাম ভিসা বা দুই নম্বরি পথগুলো খুললাম খুলে ফেসবুকে শেয়ার করছে এরা। এদের কি মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি নেই? মাথায় কি ভরা থাকে? এরা কি মনে করে আমেরিকান ইমিগ্রেশনের লোকজন কলা খেয়ে গাছে ঝুলে বেড়ানো পাবলিক? এইসব ওদের নজরে এলে সাধারণ বাংলাদেশিদেরও ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।

লেখক
লেখক

৫.

শেষটা করি হাস্যকর ঘটনার মাধ্যমে।

তবে তার আগে আরেকটি ঘটনা বলি।

প্লেনে বা বাংলাদেশ দূতাবাসে, ঠিক মনে নেই কোথায়, আমি একটা ফরম ফিলাপ করছিলাম। আমার পাশে একজন বাংলাদেশি যুবক, যাকে দেখেই বুঝতে পারছিলাম যে, সে জানেই না কীভাবে ফরম পূরণ করতে হয়। আমাকে বলে দিতে হচ্ছিল এখানে আপনার নামের প্রথমাংশ লিখুন, এখানে মধ্যমাংশ, এখানে বংশ।

লোকটা জিজ্ঞেস করল, তার নামের প্রথমাংশ কী?

বললাম, ‘আমি কীভাবে বলব? আপনি আপনার নিজের নাম জানেন না?”

‘জ্বি, আমার নাম রকিব। রকিব লিখি?’

‘রকিব কী?’

‘শুধু রকিব।’

‘রকিব উদ্দিন, আহমদ, মোহাম্মদ, খান কিছু নাই?’

‘না, এটা আমার ডাক নাম। পুরা নাম মোহাম্মদ ফয়জুর রহমান।’

‘ভালো, তাহলে মোহাম্মদ হবে আপনার প্রথমাংশ।’

‘কিন্তু ভাই নামের শুরুতে এ কে এ আছে।’

‘সেটা কী?’

‘আবুল কালাম আজাদ।’

‘তাহলে AKA মোহাম্মদ লোখেন।’

‘কিন্তু ভাই, নামটা আকামোহাম্মদ হয়ে যাবেতো।’

‘মাঝে ডট দেবেন, হবে না।’

‘বংশের ওখানে কী লিখব, চৌধুরী" লিখি?’

‘আপনি কি চৌধুরী?’

‘না।’

‘তাহলে চৌধুরী লিখবেন কেন?’

‘আপনি যে লিখেছেন?’

‘আমি চৌধুরী তাই লিখেছি। আপনি রহমান লেখেন।’

মনে হলো কথাটা উনি বিশ্বাস করেননি। স্কুলে পরীক্ষায় কোনো হারামজাদা টাইপ বন্ধু যেমন ইচ্ছা করেই অন্য বন্ধুকে ভুল উত্তর লিখতে বলে মার্ক কমিয়ে দিত, ও আমাকে সেইরকম কোনো বন্ধু মনে করছে।

মনের বিরুদ্ধে লড়াই করে ফরম পূরণ করতে লাগলেন। তারপরে একটা জায়গায় এসে জানতে চাইলেন, ‘এখানে কী লিখব?’

মনে নেই ঠিক কী ছিল, কিন্তু ওটা ওনার জন্য এপ্লিকেবল ছিল না। তাই বললাম, ‘NA লিখুন।’

দেখি উনি বাংলায় ন আকার না লিখলেন। আমি বললাম, ‘NA লিখতে বলেছি, না লিখলেন কেন?’

‘বাংলায় লিখলে দোষ কোথায়?’

এই হঠাৎ জন্ম নেওয়া ভাষা সৈনিককে কীভাবে বোঝাই NA আর না এক না? বললাম, ‘কিছুই লেখার দরকার নেই। ব্ল্যাংক রেখে দিন।’

তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘শুধু শুধু খালি রাখব কেন? কিছু একটা লিখে দেই।’

‘কিছুই যদি লেখার না থাকে, তাহলে কেন শুধু শুধু লিখবেন?’

‘কিছুই যদি না লিখি, তাহলে কেমন কেমন লাগে! যে ফরম দেখবে, সে কি মনে করবে?’

এই ছিল ঘটনা। এখন আরেক ঘটনার সাথে কীভাবে মিলে সেটাই বলি।

সেদিন জানলাম, এক নারী তার বাবা মায়ের ইমিগ্রেশনের জন্য অ্যাপ্লাই করেছিলেন। দূতাবাস তাদের ডেকেছে এবং বলেছে, ‘আপনারাতো ২০০২ সালেই মারা গেছেন।’

বাপ=মা তো আঁতকে উঠলেন। ঘটনা কী? আমরা মারা গেছি, অথচ আমরাই খবর পেলাম না? মরে গেলে এখানে আসলাম কীভাবে?

ভিসা অফিসার তখন তাদের অ্যাপ্লিকেশন কাগজ দেখিয়ে বললেন, ‘এই যে দেখেন, ফর্মের Date of death এ তারিখ বসানো আছে।’

এখন সেই বাবা–মাকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা জীবিত।

আমাদের দেশের কিছু মানুষ form fill up–এর সময়ে এই বোকামিটা করে। যেহেতু শূন্যস্থান আছে, তাই কিছু একটা লিখে একে পূরণ করতেই হবে। নাহলে যদি পরীক্ষায় মার্ক কাটে? তাই যা মনে আসে তাই লিখে দেয়। লাগলে লাগল, না লাগলে নাই!

এখানেও নিশ্চই ঘটনা একই ঘটেছে। ফরম পূরণের সময়ে মৃত্যু তারিখের শূন্যস্থান ছাড়তে ইচ্ছা করে নাই।

মাঝে দিয়ে বাবা–মা আপসেট! আমেরিকান অ্যাম্বেসির সাদা চামড়ার নারী যেহেতু বলছেন তারা মৃত, তাই নিশ্চয়ই তারা মৃত। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মৃত্যু হলে তাদের নিশ্চয়ই কুলখানি হয়েছে। তাদের নিজেদের কুলখানি! অথচ তাদেরকেই কেউ দাওয়াত দিল না!

**প্রিয় পাঠক, বিডিজেন২৪-এ গল্প, কবিতা, ভ্রমণকাহিনি, সুখ–দুঃখের স্মৃতি, প্রবন্ধ, ফিচার, অনুষ্ঠান বা ঘটনার ভিডিও এবং ছবিসহ নানা বিষয়ের লেখা পাঠান। মেইল: [email protected]

আরও পড়ুন

চিকিৎসা ছাড়া যিনি অন‍্য কিছু নিয়ে মাথা ঘামাননি

চিকিৎসা ছাড়া যিনি অন‍্য কিছু নিয়ে মাথা ঘামাননি

একটা রোগীর প্রপার ডায়াগনোসিস করা এবং চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলার মতো মেধা আল্লাহ সবাইকে দেন না। কিছু ক্ষণজন্মা মানুষকে বিধাতা পুরো পৃথিবীতে এমনই মেধা দিয়েছেন। ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ এমনই একজন মেধাবী ও মানবিক মানুষ।

৬ দিন আগে

পৃথিবী চলছে, সেই সাথে আমিও

পৃথিবী চলছে, সেই সাথে আমিও

এই আমেরিকায় আসার পর থেকে সময়ের আর কোনো খোঁজই পাই না। কখন সকাল হয় আর কখন রাত তাও টের পাই না। অন্তরের দুটা অন্তরকথা কাউকে বলব, সেই সময়ও যেন নেই। তার ওপর ডেট এক্সপায়ারি মানুষ, অনেকটা দাবা খেলার ওই ক্ষমতাবান রাজার মতো, মাত্র এক ঘর যেতে পারি।

৬ দিন আগে

ইমিগ্রেশন সমস্যা

ইমিগ্রেশন সমস্যা

মাঝে দিয়ে ওর পরিবার পথে বসে গেছে। জায়গা জমি বিক্রি করে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছিল লেখাপড়া করে শিক্ষিত হতে। ছেলে লেখাপড়া না করে ইমরান হাশমি বা উদিত নারায়নের মতোন ‘চুম্বন দেব’ হতে চেয়েছিল। কী আর করার।

৬ দিন আগে

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন এখন সময়ের দাবি

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন এখন সময়ের দাবি

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে চিকিৎসকদের যোগ্যতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে, নতুন রোগের আবির্ভাব হচ্ছে এবং আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলছে।

১২ দিন আগে