logo
মতামত

ভোট বিদেশে, দায় দেশে: প্রবাসীদের ভোট ও গণতন্ত্রের পরীক্ষা

রহমান মৃধা, সুইডেন
রহমান মৃধা, সুইডেন৩ দিন আগে
Copied!
ভোট বিদেশে, দায় দেশে: প্রবাসীদের ভোট ও গণতন্ত্রের পরীক্ষা
প্রতীকী ছবি। ফ্রিপিক

প্রবাসীরা কখনোই কেবল অর্থ পাঠানোর জন্য বা ভ্রমণের কারণে দেশের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন থাকেন না; তাদের মধ্যে অসীম আবেগ, রাজনৈতিক উদ্বেগ এবং দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রত্যাশা থাকে। এই প্রত্যাশার ফলে যখন বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন (ইসি) ঘোষণা করেছে যে, বিদেশে থাকা বাংলাদেশিরাও দেশের জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপ প্রকল্পের মাধ্যমে। তখন এটি কেবল প্রশাসনিক উদ্যোগ নয়, বরং একটি রাজনৈতিক ও নৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।

বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতা বলে, অনেক দেশে প্রবাসী নাগরিকেরা দূতাবাসে গিয়ে আগেভাগে ভোট দেন বা ডাক-ভোটের ব্যবস্থা ব্যবহার করেন। তাতে ভোটারদের আইনগত অধিকার রক্ষা পায়, কিন্তু অংশগ্রহণের হার সাধারণত স্থায়ী বসবাসকারী ভোটারদের তুলনায় কম থাকে। সুইডেনের মতো দেশগুলোর ক্ষেত্রে নাগরিকেরা বিদেশে থাকলেও কনস্যুলেটে আগেভাগে ভোট দিতে পারেন অথবা স্পেশাল পোস্টাল-মেটেরিয়াল অর্ডার করে পোস্টাল ভোট ব্যবহার করেন। কিন্তু নির্বাচনের দিন সরাসরি অন্য দেশে বসেই ভোট দেওয়া সম্ভব নয়; আগেভাগে ভোটই গৃহীত হয়।

বাংলাদেশ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় এই নতুন অধ্যায়টি ঘোষণা করেছে এবং ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ নামে একটি অ্যাপ বানিয়ে প্রবাসীদের নিবন্ধন ও ভোট প্রদান সহজ করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। অ্যাপটি নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে চালুর কথা বলা হয়েছে এবং ইসি ইতিমধ্যে প্রবাসী ভোটারের নিবন্ধন ও ভোটিং প্রক্রিয়ার রূপরেখা প্রকাশ করেছে। তবে বাস্তবায়নতন্ত্র, নিরাপত্তা প্রটোকল ও পর্যবেক্ষণের বিস্তারিত এখনো প্রকাশিত হওয়া বাকি।

ইসি জানিয়েছে, প্রতি পোস্টাল ব্যালটে আনুমানিক ৭০০ টাকা খরচ হবে এবং প্রবাসী ভোটারকে এ খরচ বহন করতে হবে না। এ ছাড়া, ৫০ লাখ প্রবাসী ভোটারকে অন্তর্ভুক্ত করার কথাও বলা হচ্ছে। ফলে মোট বাজেট বড় অঙ্কে বেড়ে যেতে পারে। এসব সংখ্যা ও খরচ দেশের জন্য একটা বাস্তব আর্থিক দায় তুলে ধরে। প্রশ্ন জাগে, একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশে এই খরচের বিকল্প ব্যবহার (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গণপরিবহন) কি আরও প্রাথমিক ও জরুরি নয়?
অন্যদিকে নিবন্ধন ও যোগ্যতার শর্তগুলোও সমস্যা ছুঁতে পারে। নির্বাচন কমিশন স্পষ্ট করে দিয়েছে, যাদের এনআইডি 'লক' বা 'সাসপেন্ড' রয়েছে, তারা বিদেশ থেকে নিবন্ধন করে ভোট দিতে পারবেন না—এটি বাস্তবে কীভাবে প্রয়োগ করা হবে, কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ক্ষেত্রে তা ইতিমধ্যেই বিতর্কের কারণ হয়েছে। এ সম্পর্কিত জটিলতা দ্রুত সমাধান না করা হলে অনেক প্রবাসী ভোটারের অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হবে।

প্রকৃত চ্যালেঞ্জ শুধুমাত্র প্রযুক্তি নয়; সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো 'কাদের জন্য' ও 'কাদের পক্ষে' ভোট দেওয়া হবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় মনোনয়ন বাণিজ্য, নির্বাচনী তহবিলের অসম সুযোগ এবং ক্ষমতা ও অর্থের ঘনিষ্ঠ সংযোগ ব্যাপকভাবে তথ্যভিত্তিক গবেষণায় ও প্রতিবেদনগুলোতে উঠে এসেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের বিশ্লেষণে। বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদন এমপিদের সম্পদের অতি-বৃদ্ধি এবং নির্বাচনে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দেখিয়েছে। এ ছাড়া, অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণে দেখা গেছে প্রার্থীরা মনোনয়ন অর্জনের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন। এই বাস্তবতা প্রবাসীদের সামনে এক কঠিন নৈতিক প্রশ্ন উত্থাপন করবে। তাদের সময় ও দেশের অর্থ ব্যয় করে কি এরকম 'অযোগ্য' বা 'দুর্নীতিগ্রস্ত' প্রার্থীর পক্ষে ভোট দেওয়া যুক্তিসংগত হবে?

ডাক-ভোট পদ্ধতিতে প্রযুক্তিগত ও লজিস্টিকের ঝুঁকি থাকবেই। ব্যালটের চেইন অব কাস্টডি কীভাবে বজায় রাখা হবে, কোন কুরিয়ারের মাধ্যমে নিরাপদ প্রেরণ নিশ্চিত করা হবে, আন্তর্জাতিক ডাক বিভাগে বিলম্ব হলে ভোটপত্র হারানো বা দেরিতে পৌঁছানো কি রকম প্রভাব ফেলবে—এসব প্রশ্ন প্রকাশ্যে আছে। সঙ্গে আছে অ্যাপভিত্তিক নিবন্ধন ও ভেরিফিকেশনের সাইবার-ভূমি: ডেটা সুরক্ষা, আইডি-চুরি বা ম্যালওয়্যার আক্রমণ প্রতিরোধ করতে ইসি কেমন নিরাপত্তা গ্রহণ করবে, সেটা জানা প্রয়োজন। আরেকটি ঝুঁকি হলো 'ভোট বিক্রি' বা টিকিট বাণিজ্য। প্রবাসীর ভোটকে যখন আর্থিকভাবে প্রবেশযোগ্য করে তোলা হবে, তখন অনৈতিক অর্থের প্রভাব বজায় থাকা খুব সহজ। এইসব ঝুঁকি সম্পর্কে সংবাদ ও বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষণগুলো সতর্ক করেছে।

অর্থনৈতিক ন্যায্যতার প্রশ্নও গুরত্বপূর্ণ। যদি একটি গরিব দেশের সরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে প্রবাসী ভোট চালু করে এবং ফলাফল হিসেবে রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তিত না হয়—অর্থাৎ যদি মনোনয়ন-বাণিজ্য বেড়ে যায়, দুর্নীতির তদন্ত ও জবাবদিহি না অক্ষত থাকে—তাহলে এই ব্যয় কি নৈতিকভাবে প্রাসঙ্গিক হবে? এখানে দুটি দিক বিবেচ্য—(ক) নাগরিক অধিকার ও প্রতিনিধিত্ব। প্রবাসীরাও নাগরিক; তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গণতান্ত্রিক ন্যায্যতার অংশ; (খ) সুযোগ-খরচ। তথ্য-স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা ছাড়া এই ব্যয় দেশের যেখানে বেশি দরকার সেখানে অন্য সামাজিক খাতে ব্যবহৃত হলে বেশি ফলপ্রসূ হত। ফলে প্রয়োজন একটি পরিমিত, স্বচ্ছ ও পর্যায়ক্রমিক বাস্তবায়ন কৌশল।
এই বাস্তবতায় আমাকে যে সুপারিশগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় সেগুলো হলো—প্রধানত: (১) প্রার্থী-স্বচ্ছতা ও ভেটিং মেকানিজম বাধ্যতামূলক করা, যাতে প্রত্যেক প্রার্থীর সম্পদ, মামলা, ট্যাক্স ও সরকারি দায়-দায়িত্বের ইতিহাস অনলাইন পোর্টালে খোলা থাকে; (২) দলীয় মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করা, টাকার ভিত্তিতে মনোনয়নকে বন্ধ করা; (৩) ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপ চালুর আগে ছোট পাইলট পরিচালনা করা। নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশে পরীক্ষা করে সমস্যা উঠে এলে তা ঠিক করা; (৪) ব্যালট প্রেরণ ও গ্রহণ পর্যায়ে ব্লক-লেভেল চেইন অব কাস্টডি ও ট্র্যাকিং নম্বর প্রয়োগ করা; (৫) স্বাধীন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দলকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ দেওয়া; (৬) প্রবাসীদের তথ্য-সচেতনতা বাড়াতে দূতাবাস, কমিউনিটি সংগঠন ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা। এগুলো না করলে প্রবাসী ভোট কেবল খরচসাপেক্ষ পরিবর্তে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতায় অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি তৈরি করবে।
প্রবাসীরা, বিশেষ করে সুইডেনে থাকা বাংলাদেশিরা, যা করতে পারেন তা হলো নিজ এনআইডি/ভোটার স্ট্যাটাস এবং পাসপোর্টের কাগজ রাখুন। দূতাবাস/কনস্যুলেটের ঘোষণাগুলো অত্যধিক সতর্কতার সঙ্গে অনুসরণ করুন; স্থানীয় কমিউনিটি গ্রুপের মাধ্যমে প্রার্থীর ইতিহাস যাচাই ও আলোচনা চালান এবং ভোট দেওয়ার আগে প্রার্থীর নীতিবোধ ও অধিকার/দায়িত্বের রেকর্ড দেখে বিবেচনা করুন। সুইডেনের প্রথা যেখানে আগেভাগে ভোট ও কনস্যুলেট-ভোট প্রচলিত, সেখানে বাংলাদেশি প্রক্রিয়াও যদি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়, তবে অংশগ্রহণ সম্ভব; কিন্তু শেষ কথা সবসময়ই বিশ্বাস ও স্বচ্ছতার ওপর নির্ভর করবে।

পরিশেষে, আমি মনে করি, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এটি যেন কেবল আনুষ্ঠানিক অধিকারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে। ভোট দেওয়ার সুযোগ ও সময়, দেশের অর্থ এবং প্রবাসীদের আবেগীয় বিনিয়োগ—সব মিলিয়ে যদি ফলপ্রসূ প্রতিনিধিত্ব না আসে, তাহলে সেই সুযোগ শেষপর্যন্ত জনগণের কল্যাণে কাজে লাগবে না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই, তবে এখনো নিবন্ধন করিনি। কারণ আমি বিশ্বাস করি, যোগ্য ও নীতিবান ব্যক্তি যদি মনোনয়ন না পান, তবে দুর্নীতিবাজ বা অযোগ্য প্রার্থীদের ভোট দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
ভোট শুধু একটি অধিকারের প্রয়োগ নয়; এটি বিবেকেরও প্রকাশ। তাই আমি চাই, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী বাছাইয়ে স্বচ্ছতা ও নৈতিকতার মানদণ্ড স্পষ্ট করুক, যাতে প্রবাসী নাগরিকেরা আস্থার সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে পারেন।
দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ প্রবাসীদের সচেতন, বিবেক–নির্ভর অংশগ্রহণের ওপরও নির্ভরশীল। তাই প্রবাসীদের ভোট কেবল এক দায়িত্ব নয়, এটি তাদের নৈতিক অবস্থানের প্রতিফলনও হতে হবে।

*লেখক গবেষক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। ইমেইল: [email protected]

আরও পড়ুন

আত্মীয়তা রক্তে নয়, আত্মায়—সম্পর্কের প্রকৃত মানে

আত্মীয়তা রক্তে নয়, আত্মায়—সম্পর্কের প্রকৃত মানে

আত্মার আত্মীয়তা জোর করে হয় না। এটি সময়, অভিজ্ঞতা ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। কখনো কোনো কথায়, কখনো এক মুহূর্তের সহানুভূতিতে—মন থেকে মন যুক্ত হয়।

১৪ ঘণ্টা আগে

প্রবাসীদের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা

প্রবাসীদের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা

জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র চার মাস বাকি আছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে সবকিছু সম্পন্ন করা নির্বাচন কমিশনের জন্য কঠিন একটা কাজ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। পাশাপাশি এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক ভুলভ্রান্তিও হতে পারে। কিন্তু তাই বলে, এটার অজুহাতে প্রবাসীদের ভোটাধিকারে বঞ্চিত করা কি সংগত হবে?

১৫ ঘণ্টা আগে

ভোট বিদেশে, দায় দেশে: প্রবাসীদের ভোট ও গণতন্ত্রের পরীক্ষা

ভোট বিদেশে, দায় দেশে: প্রবাসীদের ভোট ও গণতন্ত্রের পরীক্ষা

বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতা বলে, অনেক দেশে প্রবাসী নাগরিকেরা দূতাবাসে গিয়ে আগেভাগে ভোট দেন বা ডাক-ভোটের ব্যবস্থা ব্যবহার করেন। তাতে ভোটারদের আইনগত অধিকার রক্ষা পায়, কিন্তু অংশগ্রহণের হার সাধারণত স্থায়ী বসবাসকারী ভোটারদের তুলনায় কম থাকে।

৩ দিন আগে

আজীবন শেখা ও স্বপ্ন দেখার শক্তি: মানুষকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়

আজীবন শেখা ও স্বপ্ন দেখার শক্তি: মানুষকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়

শেখা মানে শুধু বই পড়া বা ক্লাসে পাঠ শোনা নয়; বরং জীবনকে বোঝা, অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং নিজেকে প্রতিনিয়ত নবায়ন করা। প্রকৃতি, সমাজ, মানুষ—সবাই আমাদের শিক্ষক।

৩ দিন আগে