logo
মতামত

আজীবন শেখা ও স্বপ্ন দেখার শক্তি: মানুষকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়

সহিদুল আলম  স্বপন, জেনেভা, সুইজারল্যান্ড
সহিদুল আলম স্বপন, জেনেভা, সুইজারল্যান্ড৩ দিন আগে
Copied!
আজীবন শেখা ও স্বপ্ন দেখার শক্তি: মানুষকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়
ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য নিহিত তার শেখার ক্ষমতা ও স্বপ্ন দেখার সামর্থ্যে। জন্মের পর থেকেই মানুষ শেখে প্রথমে হাঁটতে, কথা বলতে, পরে লিখতে ও চিনতে। কিন্তু জীবনের প্রকৃত শিক্ষা কোনো পরীক্ষার ফলাফলে শেষ হয় না। বরং যারা আজীবন শেখার অভ্যাস গড়ে তোলে এবং নিজেরা স্বপ্ন দেখতে শেখে, তারাই একসময় সমাজে, জাতিতে এবং মানবসভ্যতার ইতিহাসে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যায়।

বর্তমান পৃথিবী দ্রুত বদলে যাচ্ছে। জ্ঞানের স্রোত প্রতিনিয়ত নবায়িত হচ্ছে, প্রযুক্তি প্রতিদিন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। এই যুগে শেখার সীমা টেনে দেওয়া মানে নিজেকে পিছিয়ে ফেলা। আর স্বপ্নবিহীন মানুষ দিকহারা নাবিকের মতো—যার শেখার কোনো অর্থই থাকে না।

শেখা: জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা

শেখা মানে শুধু বই পড়া বা ক্লাসে পাঠ শোনা নয়; বরং জীবনকে বোঝা, অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং নিজেকে প্রতিনিয়ত নবায়ন করা। প্রকৃতি, সমাজ, মানুষ—সবাই আমাদের শিক্ষক।

একজন কৃষক যেমন মাটির ভাষা পড়ে শেখেন, একজন চিকিৎসক রোগীর অভিজ্ঞতা থেকে শেখেন, একজন শিক্ষকও শিক্ষার্থীর প্রশ্নে নতুন কিছু জানতে পারেন। অর্থাৎ শেখা একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটি থেমে গেলে মানুষের উন্নয়নও থেমে যায়।

বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘Once you stop learning, you start dying.’ অর্থাৎ, ‘যখন তুমি শেখা বন্ধ করো, তখনই তুমি ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছ।’ এই উক্তিটি প্রতিটি মানুষের জীবনের জন্যই সত্য।

প্রযুক্তির যুগে শেখার প্রয়োজনীয়তা

একুশ শতক হলো তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর যুগ। আজকের কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার সংজ্ঞা প্রতিদিন পাল্টে যাচ্ছে। যে জ্ঞান বা দক্ষতা আজ প্রয়োজনীয়, আগামীকাল তা অচল হয়ে যেতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), রোবোটিক্স, ডেটা অ্যানালিটিকস—এসব এখন পৃথিবীর প্রতিটি শিল্পে প্রভাব ফেলছে। ফলে যারা টিকে থাকতে চায়, তাদের নিয়মিত নতুন কিছু শেখা জরুরি।

আজীবন শেখা মানে ‘learning, unlearning, and relearning’—অর্থাৎ শেখা, ভুলে যাওয়া এবং আবার নতুনভাবে শেখা।’ এই চক্রই মানুষকে পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে সাহায্য করে।

স্বপ্ন: পরিবর্তনের প্রথম ধাপ

স্বপ্ন মানুষকে দিক নির্দেশনা দেয়। শেখা আমাদের যোগ্য করে তোলে, আর স্বপ্ন শেখায় কেন শেখা দরকার। ইতিহাসে দেখা যায়, প্রতিটি বড় সাফল্যের পেছনে থাকে এক সাহসী স্বপ্ন।

ওয়াল্ট ডিজনি দরিদ্র ছিলেন, কিন্তু স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন এক আনন্দভূমির যেখানে শিশুরা হাসবে। ফলাফল—ডিজনিল্যান্ড।

থমাস এডিসন শতবার ব্যর্থ হয়েও আলো জ্বালানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন। ফলাফল—বাল্ব।

মুক্তিযোদ্ধারা স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের। ফলাফল—আজকের আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি।

এ রকম হাজারো উদাহরণ দেওয়া সম্ভব এবং সাহসই মানুষকে অসম্ভবকে সম্ভব করতে শেখায়।

শেখা ও স্বপ্ন: একে অপরের পরিপূরক

শুধু শেখা নয়, শুধু স্বপ্নও নয়—দুইয়ের মিলেই তৈরি হয় সাফল্যের গল্প।

যদি কেউ কেবল স্বপ্ন দেখে কিন্তু শেখে না, তাহলে সেই স্বপ্ন কেবল কল্পনা হয়ে থাকে। আবার কেউ যদি কেবল শেখে কিন্তু স্বপ্ন না দেখে, তাহলে তার শেখার দিক হারিয়ে যায়।

যেমন, একজন তরুণ যদি স্বপ্ন দেখে উদ্যোক্তা হওয়ার, তবে তাকে ব্যবসার কৌশল, প্রযুক্তি, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি শেখা প্রয়োজন। অন্যদিকে, একজন শিক্ষক যদি নিজের পাঠদানের ধরন আপডেট না করেন, তাহলে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবেন না। অতএব, শেখা ও স্বপ্নের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই সাফল্যের আসল চাবিকাঠি।

শেখা ও স্বপ্ন: জাতি গঠনের মেরুদণ্ড

একটি জাতির অগ্রগতি নির্ভর করে তার নাগরিকদের শেখার মনোভাব ও স্বপ্ন দেখার সাহসের ওপর। বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা দেখেছি, দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং অশিক্ষার সীমা পেরিয়ে আজ দেশটি বিশ্বে উন্নয়নের দৃষ্টান্ত। এর পেছনে কাজ করেছে শেখার মানসিকতা ও বড় স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা।

আজ বাংলাদেশের তরুণেরা প্রযুক্তি, শিল্প, কৃষি ও উদ্যোক্তা খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে। এ প্রজন্ম যদি শেখার ধারা অব্যাহত রাখে এবং স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে রাখে, তাহলে আমাদের জাতি আরও দূর এগিয়ে যাবে।

শেখার পথে বাধা ও তার মোকাবিলা

আজীবন শেখার পথে নানা বাধা আসে। অলসতা, ব্যর্থতার ভয়, আত্মবিশ্বাসের অভাব, সময়ের সংকট ইত্যাদি। কিন্তু শেখার ইচ্ছা থাকলে এই বাধা অতিক্রম করা সম্ভব।

ব্যর্থতাকে ভয় না পাওয়া শেখার প্রথম ধাপ। ব্যর্থতা আমাদের শেখায় কোথায় ভুল হচ্ছে। সময় ব্যবস্থাপনা জরুরি। প্রতিদিন অল্প সময় হলেও কিছু শেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। বই, মানুষ, প্রকৃতি ও ইন্টারনেট—সবই শেখার উৎস। কৌতূহল ধরে রাখা শেখার মূল চাবিকাঠি। যে প্রশ্ন করতে জানে, সে-ই প্রকৃত শিক্ষার্থী।

স্বপ্নপূরণের যাত্রা: ধৈর্য ও পরিশ্রমের সমন্বয়

স্বপ্ন পূরণের পথ কখনো সহজ নয়। যারা বড় স্বপ্ন দেখে, তাদের জীবনে আসে সংগ্রাম, প্রত্যাখ্যান ও চ্যালেঞ্জ। কিন্তু যারা শেখার মাধ্যমে নিজেদের তৈরি করে, তারাই শেষ পর্যন্ত সফল হয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূস একদিন স্বপ্ন দেখেছিলেন দারিদ্র্যহীন বাংলাদেশের। শেখা ও গবেষণার মাধ্যমে তিনি তৈরি করেন মাইক্রোক্রেডিট মডেল—যা আজ বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচনের রোল মডেল। স্বপ্ন পূরণে শেখা কেবল একটি হাতিয়ার নয়, বরং মানসিক অনুশীলন। প্রতিদিন শেখা মানে স্বপ্নের আরও এক ধাপ কাছে পৌঁছে যাওয়া।

ভবিষ্যতের পথে

আগামী পৃথিবী হবে জ্ঞাননির্ভর সমাজ। সেখানে সফলতা নির্ভর করবে কার কাছে কত তথ্য আছে, তার ওপর নয়—বরং কে কত দ্রুত শিখতে পারে এবং কে কত বড় স্বপ্ন দেখতে পারে, তার ওপর। যে জাতি আজ শেখাকে অগ্রাধিকার দেবে, আজীবন শিক্ষাকে রাষ্ট্রনীতিতে স্থান দেবে, সেই জাতিই টিকে থাকবে। আর যে সমাজ স্বপ্ন দেখতে ভুলে যায়, সেখানে স্থবিরতা আসে অবধারিতভাবে।

বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম যদি শেখার অভ্যাস ও স্বপ্ন দেখার সাহস বজায় রাখে, তাহলে ভবিষ্যতে আমরা জ্ঞান, দক্ষতা ও মানবিকতায় সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে বিশ্বে আলোকিত হব।মানুষের জীবনের সার্থকতা শুধু বেঁচে থাকায় নয়—বরং শেখার মাধ্যমে নিজেকে ও সমাজকে উন্নত করার মধ্যে।স্বপ্ন মানুষকে চালিত করে, শেখা তাকে যোগ্য করে তোলে।

এই দুই শক্তি একত্রিত হলে মানুষ হয়ে ওঠে অদম্য, অনন্য ও অনুপ্রেরণার প্রতীক। আজীবন শেখা মানে আত্মউন্নয়নের অঙ্গীকার, আর স্বপ্ন দেখা মানে নিজের সীমা অতিক্রমের সাহস।এই দুটি গুণই মানুষকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়—যেখানে সাফল্য কেবল ব্যক্তিগত নয়, সামাজিকও হয়ে ওঠে।

শেষকথা

যে শেখা বন্ধ করে, সে থেমে যায়।

যে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে, সে মরে যায়।

তাই শেখা ও স্বপ্নের আলোয় জীবনকে জ্বালিয়ে রাখুন—দেখবেন, একদিন আপনি নিজেই হয়ে উঠবে অন্যদের শেখা ও স্বপ্ন দেখার প্রেরণা।


*লেখক সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বেসরকারি ব্যাংকিং আর্থিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ, কলামিস্ট ও কবি

আরও পড়ুন

আত্মীয়তা রক্তে নয়, আত্মায়—সম্পর্কের প্রকৃত মানে

আত্মীয়তা রক্তে নয়, আত্মায়—সম্পর্কের প্রকৃত মানে

আত্মার আত্মীয়তা জোর করে হয় না। এটি সময়, অভিজ্ঞতা ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। কখনো কোনো কথায়, কখনো এক মুহূর্তের সহানুভূতিতে—মন থেকে মন যুক্ত হয়।

১৪ ঘণ্টা আগে

প্রবাসীদের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা

প্রবাসীদের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা

জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র চার মাস বাকি আছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে সবকিছু সম্পন্ন করা নির্বাচন কমিশনের জন্য কঠিন একটা কাজ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। পাশাপাশি এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক ভুলভ্রান্তিও হতে পারে। কিন্তু তাই বলে, এটার অজুহাতে প্রবাসীদের ভোটাধিকারে বঞ্চিত করা কি সংগত হবে?

১৫ ঘণ্টা আগে

ভোট বিদেশে, দায় দেশে: প্রবাসীদের ভোট ও গণতন্ত্রের পরীক্ষা

ভোট বিদেশে, দায় দেশে: প্রবাসীদের ভোট ও গণতন্ত্রের পরীক্ষা

বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতা বলে, অনেক দেশে প্রবাসী নাগরিকেরা দূতাবাসে গিয়ে আগেভাগে ভোট দেন বা ডাক-ভোটের ব্যবস্থা ব্যবহার করেন। তাতে ভোটারদের আইনগত অধিকার রক্ষা পায়, কিন্তু অংশগ্রহণের হার সাধারণত স্থায়ী বসবাসকারী ভোটারদের তুলনায় কম থাকে।

৩ দিন আগে

আজীবন শেখা ও স্বপ্ন দেখার শক্তি: মানুষকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়

আজীবন শেখা ও স্বপ্ন দেখার শক্তি: মানুষকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়

শেখা মানে শুধু বই পড়া বা ক্লাসে পাঠ শোনা নয়; বরং জীবনকে বোঝা, অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং নিজেকে প্রতিনিয়ত নবায়ন করা। প্রকৃতি, সমাজ, মানুষ—সবাই আমাদের শিক্ষক।

৩ দিন আগে