ইজাজ আহসান
কিছু বাংলা–হিন্দি ছবির একটা গল্প এরকম থাকে, এলাকার প্রতাপশালী ব্যক্তির বখে যাওয়া একমাত্র ছেলে তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এলাকায় নানান অপকর্ম করে বেড়ায়। কিন্তু কেউ টু শব্দটা পর্যন্ত করতে পারে না। করলেই তার ওপর অত্যাচারের খড়গ্ নেমে আসে। এক পর্যায়ে নায়িকাকে উত্ত্যক্ত করতে গিয়ে বেধে যায় গন্ডগোল। তারপর নায়কের সঙ্গে বেদম মারপিট, থানা–পুলিশ সব হয়। গল্পটা পুরোটা বলার দরকার নেই। শেষ অংশটা অনেকেই অনায়াসে বলে দিতে পারবেন।
যে কারণে এই গল্পের অবতারণা, সেটা হলো ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড নিয়ে। একটা দেশ কী পরিমাণ বেপরোয়া হতে পারে, তা ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড না দেখলে কেউ কল্পনা করতে পারবেন না। দেশটির এই বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের প্রধান মদদদাতা আমেরিকা। তাদের ছত্রছায়ায় ইসরায়েল কল্পনাতীত বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
তবে বর্তমান অবস্থা জানার আগে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসটা একটু বলে নিলে বুঝতে সুবিধা হবে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের মধ্যে দিয়ে ফিলিস্তিন নামের ভূখণ্ডটি ব্রিটেনের করতলগত হয় ১৯১৭ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আরব মুসলিম ও কিছু ইহুদি জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। সমস্যা শুরু হয়, বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার স্বীকৃতির মধ্যে দিয়ে।
বেলফোর ঘোষণা ছিল ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক জারি করা একটি বিবৃতি, যাতে ফিলিস্তিনে ‘ইহুদি জনগণের জন্য একটি জাতীয় আবাস’ প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করা হয়। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর এক চিঠিতে ব্যারন রথচাইল্ডকে এই ঘোষণাটি প্রদান করেন। যা জায়নিস্ট ফেডারেশন অব গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড আয়ারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছিল। এই ঘোষণাটি মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ খুলে দেয় এবং ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য অনেক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশরা ওই ভূখণ্ড থেকে চলে এলে ইহুদিরা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূখণ্ড রাতারাতি স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। দেশের নাম দেওয়া ইসরায়েল।
অন্যদিকে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর আমেরিকা আরব দেশগুলোকে অনেকটা অনুগতর মতো করে ফেলে। ইসরায়েল যা ইচ্ছা তাই করে আর আরব দেশগুলো নীরব থাকে। কারণ যদি না থাকে, তাহলে যেকোনো সময় সেসব দেশের শাসকদের গদিচ্যুত হতে হবে।
সৌদি আরবের সাবেক শাসক ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের ঘটনা আমরা অনেকে জানি। তিনি ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি খুন হয়েছিলেন তাঁরই ভাতিজা ফয়সাল বিন মুসাইদ নামে রাজ পরিবারের এক সদস্যের হাতে।
সৌদি আরবের সাবেক শাসক ফয়সাল ক্ষমতায় থাকাকালে ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর দুবার বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। প্রথমটি ১৯৬৭ সালে, দ্বিতীয়টি ১৯৭৩ সালে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ফয়সালের তেমন ভূমিকা ছিল না। তবে ১৯৭৩ সালে আরব ইসরায়েল যুদ্ধ চলাকালে তাঁর নেতৃত্বে তেল উৎপাদনকারী আরব দেশগুলো একযোগে জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে ৭০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছিল। ইসরায়েলকে সহযোগিতা করায় তারা যুক্তরাষ্ট্র ও নেদারল্যান্ডসে তেল সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেয়। বিশ্বজুড়ে এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। যদিও আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে তা শেষ পর্যন্ত বড় নিয়ামক হয়ে উঠতে পারেনি। এরই ফলশ্রুতিতে তাঁর এই পরিণতি ঘটে বলে অনেকের ধারণা।
যাহোক, ফিলিস্তিন ভূখন্ডে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই চলছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। এখন এমন হয়েছে যে প্রায় প্রতিদিনের আন্তর্জাতিক খবরের একটা অংশজুড়ে থাকে ইসরায়েলি নৃশংসতা। সব থেকে দুঃখজনক হলো, ইসরায়েলের প্রতি আরব রাস্টগুলোর সমর্থন। এটা ইসরায়েলকে অনেক বেশি দুর্দমনীয় আর বেপরোয়া করে তুলেছে। সেই বিষয়টা নিয়েই মূলত এই লেখা।
এই কিছুদিন আগে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মধ্যপ্রাচ্য সফর করলেন। তার রাজসিক সেই সফরের আতিথেয়তা বিশ্ববাসীকে হতবাক করেছে। বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন কাতারের আমির আস্ত একটা বোয়িং ৭৪৭-৪০০ উপহার হিসেবে দিয়ে। প্রেসিডেন্টের বিমানটা পুরাতন হয়ে গিয়েছে, তার কষ্ট হয় এই ভেবে তিনি দিয়েছেন। কিন্তু গাজার লাখ লাখ অসহায় নরনারী ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত। তাতে তার কোনো কষ্ট হয় না। এই উপহারের যোগ্য প্রতিদান পাওয়ার আশা ছিল কাতারের। সেই কাতারেই হলো ইসরায়েলি বোমা হামলা। লক্ষবস্তু শান্তি চুক্তিতে আসা হামাস নেতারা। ভাগ্যের জেরে হামাস নেতারা এই হামলা থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু আরব নেতাদের আর বুঝতে বাকি থাকার কথা নয় যে, যাকে ভালোবেসে বন্ধু ভেবে নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সে বন্ধুত্বের মূল্য কীভাবে দিতে পারে। আমেরিকা অবশ্য বলেছে তারা নাকি কিছুই জানে না।
এদিকে এই ঘটনায় সূত্র ধরে পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে একটা বড় মাপের প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই দুই দেশের কোনো এবটি দেশকে কেউ আক্রমণ করলে তা আরেক দেশকে আক্রমণ করার শামিল হবে। এখন এটা দুই দেশকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কতটা সুরক্ষা দেবে তা ভাববার বিষয়। তবে মুসলিম দেশগুলোর একটা সামরিক জোট এখন সময়ের দাবি। শুধু দুই দেশ নয় সব মুসলিম দেশ, তা না হলে অন্তত তুরস্ক, ইরান ও পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে নিয়ে এই জোট গঠন করা উচিত। এটা মুসলিম ন্যাটো হিসেবে আবির্ভূত হবে।
দুঃখের বিষয় মুসলিম উম্মার সবচেয়ে বড়ো প্রতিষ্ঠান ওআইসি কার্যত নিষ্ক্রিয়। ১৯৬৯ সালে গঠিত হওয়া এই প্রতিষ্ঠান বিবৃতি দেওয়া প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এখন সময় এসেছে একটা শক্তিশালী সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট গঠনের। মুসলিম বিশ্বের একটা শক্ত অর্থনৈতিক জোটও গড়ে তোলা দরকার। আমেরিকা তার মুদ্রা ডলার দিয়ে তেলের দাম পরিশোধের চুক্তি করে উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে, বিনিময়ে এই দেশগুলোর নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এই জালে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, আটকা পড়ে আছে সারা বিশ্ব। সবার অর্থনীতি এই ডলার নির্ভর হয়ে গিয়েছে। আমেরিকা যখন যাকে যেভাবে ইচ্ছা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। কখন নিজে একা আবার কখন জাতিসংঘকে ব্যবহার করে।
এই লেখা যখন লিখছি, তখন জাতিসংঘের ছত্রছায়ায় ইরানের ওপর স্ন্যাপবাক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। সেই নিষেধাজ্ঞা মূলত ইসরায়েলের ওপর দেওয়া উচিত ছিল। মুসলিম বিশ্বে যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মতো শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোট থাকত, তবে তাদের ওপর পাল্টা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যেত। মুসলিম বিশ্বের সব থেকে বড় অর্থনৈতিক অস্ত্র হচ্ছে তেল। যদি এটা স্বল্প সময়ের জন্য তেল নিষেধাজ্ঞা ব্যবহার করা হয় তবে বিশ্ব অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়বে নিশ্চিতভাবে। কোনো সামরিক পদক্ষেপের দরকার হবে না, রাশিয়ার তেল ছিল বলেই আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা তেমন কার্যকরি হয়নি।
এ ছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো ডলারের বিপরীতে ইসলামি মুদ্রা চালু করতে পারে, যেটা অন্য যেকোনো দেশের পক্ষে খুবই কঠিন। যেমন চীন ও রাশিয়া তাদের মুদ্রাকে ডলারের বিপরীতে দাঁড় করাতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছে না। ইসলামি মুদ্রা তাহলে কীভাবে পারবে তা বিস্তর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রয়োজন যেটা এখানে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে এটা যে পারা যাবে এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
তবে যেটার অভাব সেটা হলো একতা আর সংহতি। সেটাই হলো ইহুদিচক্রের মূল অস্ত্র। ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতিতে মুসলিম বিশ্বকে তছনছ করে ফেলছে। এক মুসলিম দেশকে যখন আক্রমণ করছে অন্য সবাই তখন নীরব থাকছে। এরই ধারাবাহিকতায় ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, ইরান ও ফিলিস্তিন আক্রান্ত হয়েছে। সারা মুসলিম বিশ্ব চেয়ে দেখেছে। কেউ কেউ আবার ঘাঁটি ব্যবহার করতে দিয়েছে কিন্তু দেখা যাবে কাতারের মতো কাল সে নিজেই আক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। তাই সময় এসেছে ভেবে দেখার। কেবলমাত্র একটা শক্তিশালী সামরিক ও অর্থনৈতিক জোটই পারবে ইহুদিচক্রের হাত থেকে মুসলিমদের রক্ষা করতে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
*লেখক বিভাগীয় প্রধান ব্যবসায় শিক্ষা, বাংলাদেশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মাস্কাট, ওমান
কিছু বাংলা–হিন্দি ছবির একটা গল্প এরকম থাকে, এলাকার প্রতাপশালী ব্যক্তির বখে যাওয়া একমাত্র ছেলে তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এলাকায় নানান অপকর্ম করে বেড়ায়। কিন্তু কেউ টু শব্দটা পর্যন্ত করতে পারে না। করলেই তার ওপর অত্যাচারের খড়গ্ নেমে আসে। এক পর্যায়ে নায়িকাকে উত্ত্যক্ত করতে গিয়ে বেধে যায় গন্ডগোল। তারপর নায়কের সঙ্গে বেদম মারপিট, থানা–পুলিশ সব হয়। গল্পটা পুরোটা বলার দরকার নেই। শেষ অংশটা অনেকেই অনায়াসে বলে দিতে পারবেন।
যে কারণে এই গল্পের অবতারণা, সেটা হলো ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড নিয়ে। একটা দেশ কী পরিমাণ বেপরোয়া হতে পারে, তা ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড না দেখলে কেউ কল্পনা করতে পারবেন না। দেশটির এই বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের প্রধান মদদদাতা আমেরিকা। তাদের ছত্রছায়ায় ইসরায়েল কল্পনাতীত বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
তবে বর্তমান অবস্থা জানার আগে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসটা একটু বলে নিলে বুঝতে সুবিধা হবে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের মধ্যে দিয়ে ফিলিস্তিন নামের ভূখণ্ডটি ব্রিটেনের করতলগত হয় ১৯১৭ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আরব মুসলিম ও কিছু ইহুদি জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। সমস্যা শুরু হয়, বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার স্বীকৃতির মধ্যে দিয়ে।
বেলফোর ঘোষণা ছিল ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক জারি করা একটি বিবৃতি, যাতে ফিলিস্তিনে ‘ইহুদি জনগণের জন্য একটি জাতীয় আবাস’ প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করা হয়। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর এক চিঠিতে ব্যারন রথচাইল্ডকে এই ঘোষণাটি প্রদান করেন। যা জায়নিস্ট ফেডারেশন অব গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড আয়ারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছিল। এই ঘোষণাটি মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ খুলে দেয় এবং ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য অনেক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশরা ওই ভূখণ্ড থেকে চলে এলে ইহুদিরা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূখণ্ড রাতারাতি স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। দেশের নাম দেওয়া ইসরায়েল।
অন্যদিকে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর আমেরিকা আরব দেশগুলোকে অনেকটা অনুগতর মতো করে ফেলে। ইসরায়েল যা ইচ্ছা তাই করে আর আরব দেশগুলো নীরব থাকে। কারণ যদি না থাকে, তাহলে যেকোনো সময় সেসব দেশের শাসকদের গদিচ্যুত হতে হবে।
সৌদি আরবের সাবেক শাসক ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের ঘটনা আমরা অনেকে জানি। তিনি ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি খুন হয়েছিলেন তাঁরই ভাতিজা ফয়সাল বিন মুসাইদ নামে রাজ পরিবারের এক সদস্যের হাতে।
সৌদি আরবের সাবেক শাসক ফয়সাল ক্ষমতায় থাকাকালে ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর দুবার বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। প্রথমটি ১৯৬৭ সালে, দ্বিতীয়টি ১৯৭৩ সালে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ফয়সালের তেমন ভূমিকা ছিল না। তবে ১৯৭৩ সালে আরব ইসরায়েল যুদ্ধ চলাকালে তাঁর নেতৃত্বে তেল উৎপাদনকারী আরব দেশগুলো একযোগে জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে ৭০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছিল। ইসরায়েলকে সহযোগিতা করায় তারা যুক্তরাষ্ট্র ও নেদারল্যান্ডসে তেল সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেয়। বিশ্বজুড়ে এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। যদিও আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে তা শেষ পর্যন্ত বড় নিয়ামক হয়ে উঠতে পারেনি। এরই ফলশ্রুতিতে তাঁর এই পরিণতি ঘটে বলে অনেকের ধারণা।
যাহোক, ফিলিস্তিন ভূখন্ডে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই চলছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। এখন এমন হয়েছে যে প্রায় প্রতিদিনের আন্তর্জাতিক খবরের একটা অংশজুড়ে থাকে ইসরায়েলি নৃশংসতা। সব থেকে দুঃখজনক হলো, ইসরায়েলের প্রতি আরব রাস্টগুলোর সমর্থন। এটা ইসরায়েলকে অনেক বেশি দুর্দমনীয় আর বেপরোয়া করে তুলেছে। সেই বিষয়টা নিয়েই মূলত এই লেখা।
এই কিছুদিন আগে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মধ্যপ্রাচ্য সফর করলেন। তার রাজসিক সেই সফরের আতিথেয়তা বিশ্ববাসীকে হতবাক করেছে। বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন কাতারের আমির আস্ত একটা বোয়িং ৭৪৭-৪০০ উপহার হিসেবে দিয়ে। প্রেসিডেন্টের বিমানটা পুরাতন হয়ে গিয়েছে, তার কষ্ট হয় এই ভেবে তিনি দিয়েছেন। কিন্তু গাজার লাখ লাখ অসহায় নরনারী ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত। তাতে তার কোনো কষ্ট হয় না। এই উপহারের যোগ্য প্রতিদান পাওয়ার আশা ছিল কাতারের। সেই কাতারেই হলো ইসরায়েলি বোমা হামলা। লক্ষবস্তু শান্তি চুক্তিতে আসা হামাস নেতারা। ভাগ্যের জেরে হামাস নেতারা এই হামলা থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু আরব নেতাদের আর বুঝতে বাকি থাকার কথা নয় যে, যাকে ভালোবেসে বন্ধু ভেবে নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সে বন্ধুত্বের মূল্য কীভাবে দিতে পারে। আমেরিকা অবশ্য বলেছে তারা নাকি কিছুই জানে না।
এদিকে এই ঘটনায় সূত্র ধরে পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে একটা বড় মাপের প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই দুই দেশের কোনো এবটি দেশকে কেউ আক্রমণ করলে তা আরেক দেশকে আক্রমণ করার শামিল হবে। এখন এটা দুই দেশকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কতটা সুরক্ষা দেবে তা ভাববার বিষয়। তবে মুসলিম দেশগুলোর একটা সামরিক জোট এখন সময়ের দাবি। শুধু দুই দেশ নয় সব মুসলিম দেশ, তা না হলে অন্তত তুরস্ক, ইরান ও পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে নিয়ে এই জোট গঠন করা উচিত। এটা মুসলিম ন্যাটো হিসেবে আবির্ভূত হবে।
দুঃখের বিষয় মুসলিম উম্মার সবচেয়ে বড়ো প্রতিষ্ঠান ওআইসি কার্যত নিষ্ক্রিয়। ১৯৬৯ সালে গঠিত হওয়া এই প্রতিষ্ঠান বিবৃতি দেওয়া প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এখন সময় এসেছে একটা শক্তিশালী সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট গঠনের। মুসলিম বিশ্বের একটা শক্ত অর্থনৈতিক জোটও গড়ে তোলা দরকার। আমেরিকা তার মুদ্রা ডলার দিয়ে তেলের দাম পরিশোধের চুক্তি করে উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে, বিনিময়ে এই দেশগুলোর নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এই জালে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, আটকা পড়ে আছে সারা বিশ্ব। সবার অর্থনীতি এই ডলার নির্ভর হয়ে গিয়েছে। আমেরিকা যখন যাকে যেভাবে ইচ্ছা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। কখন নিজে একা আবার কখন জাতিসংঘকে ব্যবহার করে।
এই লেখা যখন লিখছি, তখন জাতিসংঘের ছত্রছায়ায় ইরানের ওপর স্ন্যাপবাক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। সেই নিষেধাজ্ঞা মূলত ইসরায়েলের ওপর দেওয়া উচিত ছিল। মুসলিম বিশ্বে যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মতো শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোট থাকত, তবে তাদের ওপর পাল্টা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যেত। মুসলিম বিশ্বের সব থেকে বড় অর্থনৈতিক অস্ত্র হচ্ছে তেল। যদি এটা স্বল্প সময়ের জন্য তেল নিষেধাজ্ঞা ব্যবহার করা হয় তবে বিশ্ব অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়বে নিশ্চিতভাবে। কোনো সামরিক পদক্ষেপের দরকার হবে না, রাশিয়ার তেল ছিল বলেই আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা তেমন কার্যকরি হয়নি।
এ ছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো ডলারের বিপরীতে ইসলামি মুদ্রা চালু করতে পারে, যেটা অন্য যেকোনো দেশের পক্ষে খুবই কঠিন। যেমন চীন ও রাশিয়া তাদের মুদ্রাকে ডলারের বিপরীতে দাঁড় করাতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছে না। ইসলামি মুদ্রা তাহলে কীভাবে পারবে তা বিস্তর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রয়োজন যেটা এখানে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে এটা যে পারা যাবে এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
তবে যেটার অভাব সেটা হলো একতা আর সংহতি। সেটাই হলো ইহুদিচক্রের মূল অস্ত্র। ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতিতে মুসলিম বিশ্বকে তছনছ করে ফেলছে। এক মুসলিম দেশকে যখন আক্রমণ করছে অন্য সবাই তখন নীরব থাকছে। এরই ধারাবাহিকতায় ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, ইরান ও ফিলিস্তিন আক্রান্ত হয়েছে। সারা মুসলিম বিশ্ব চেয়ে দেখেছে। কেউ কেউ আবার ঘাঁটি ব্যবহার করতে দিয়েছে কিন্তু দেখা যাবে কাতারের মতো কাল সে নিজেই আক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। তাই সময় এসেছে ভেবে দেখার। কেবলমাত্র একটা শক্তিশালী সামরিক ও অর্থনৈতিক জোটই পারবে ইহুদিচক্রের হাত থেকে মুসলিমদের রক্ষা করতে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
*লেখক বিভাগীয় প্রধান ব্যবসায় শিক্ষা, বাংলাদেশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মাস্কাট, ওমান
আত্মার আত্মীয়তা জোর করে হয় না। এটি সময়, অভিজ্ঞতা ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। কখনো কোনো কথায়, কখনো এক মুহূর্তের সহানুভূতিতে—মন থেকে মন যুক্ত হয়।
জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র চার মাস বাকি আছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে সবকিছু সম্পন্ন করা নির্বাচন কমিশনের জন্য কঠিন একটা কাজ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। পাশাপাশি এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক ভুলভ্রান্তিও হতে পারে। কিন্তু তাই বলে, এটার অজুহাতে প্রবাসীদের ভোটাধিকারে বঞ্চিত করা কি সংগত হবে?
বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতা বলে, অনেক দেশে প্রবাসী নাগরিকেরা দূতাবাসে গিয়ে আগেভাগে ভোট দেন বা ডাক-ভোটের ব্যবস্থা ব্যবহার করেন। তাতে ভোটারদের আইনগত অধিকার রক্ষা পায়, কিন্তু অংশগ্রহণের হার সাধারণত স্থায়ী বসবাসকারী ভোটারদের তুলনায় কম থাকে।
শেখা মানে শুধু বই পড়া বা ক্লাসে পাঠ শোনা নয়; বরং জীবনকে বোঝা, অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং নিজেকে প্রতিনিয়ত নবায়ন করা। প্রকৃতি, সমাজ, মানুষ—সবাই আমাদের শিক্ষক।