
রহমান মৃধা

বাংলাদেশের পরিবার ও সমাজজীবনে দীর্ঘদিনের একটি অমীমাংসিত সংকট হলো সম্পত্তি বণ্টন ও উত্তরাধিকার। বাবা–মা জীবদ্দশায় খুব কমই সন্তানের মধ্যে সুষ্ঠু ও ন্যায়সংগতভাবে সম্পদ ভাগ করে দেন। দায়িত্বগুলো রেখে যান মৃত্যুর পরের জন্য। আর তখনই শুরু হয় বিরোধ, মামলা-মোকদ্দমা, রাগ–অভিমান, সম্পর্কচ্ছেদ—যা অনেক পরিবারের আজীবনের শান্তি নষ্ট করে দেয়।
একটি পরিবার সারাজীবন একসঙ্গে থাকার পরও, একটি ভুল সিদ্ধান্ত অতীতকে মুছে দিয়ে ঘৃণা ও দূরত্বের সম্পর্ক তৈরি করে। আশ্চর্যের বিষয়, এই সংকট দেশের সমাজে প্রচণ্ডভাবে বিদ্যমান হলেও এ নিয়ে কোনো বাস্তবিক আলোচনা নেই। পরিবারে কলহ, জমি নিয়ে মারামারি, পুলিশ–কাচারি, সালিশ—এসব প্রতিনিয়ত ঘটে, কিন্তু আমরা তা প্রকাশ্যে বলতে সংকোচ বোধ করি।
তবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে সমালোচনা করতে আমাদের কোনো দ্বিধা নেই।
যেমন পরিবার, তেমনই নেতৃত্ব—এ কথাটি আজ আরও সত্য। পরিবারের অগোছালো ও অসুস্থ সংস্কৃতি অবশেষে রাষ্ট্রীয় আচরণেই প্রতিফলিত হয়। সেই জায়গা থেকেই শুরু হয় রাজনীতির আরেক অন্ধকার অধ্যায়।
বাংলাদেশের রাজনীতি: অসুস্থ নেতৃত্ব ও বিকৃত কর্মীবাহিনী
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নিজে হাঁটতে পারেন না, চলাফেরায় অন্যের সাহায্য লাগে। বয়স ও অসুস্থতার কারণে তাকে হাসপাতালেই বেশি সময় কাটাতে হয়। মানসিক সক্ষমতাও আগের মতো নেই। তবু তিনি আগামী জাতীয় নির্বাচনে ৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তার শাসনামলে বাংলাদেশ টানা পাঁচবার বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হয়েছিল।
জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদও দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। তার পায়ে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা নেই, তবু দলীয় ক্ষমতা দখল নিয়ে কীভাবে সংঘাতে জড়িয়েছিলেন—সবাই জানে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেন মোহাম্মদ এরশাদও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দলের নেতৃত্ব ছাড়তে চাননি এবং দুর্নীতির দায়ে তিনি বহু বছর কারাগারে ছিলেন।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বয়সও অনেক। ক্ষমতা হারানোর পর তিনি এখন ভারতে অবস্থান করছেন। ভারতে যাওয়ার আগে সহিংসতা, অগ্নিসন্ত্রাস, হতাহতের মতো ঘটনা ঘটেছে। তবু তিনি আবার ক্ষমতায় ফিরতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন। তার একদল সমর্থক মনে করে—তিনি দেশে ফিরে এলে যা-ই ঘটুক, তিনি আবার ক্ষমতায় বসবেন।
বাংলাদেশে সমস্যা হলো—এদের কাউকেই ক্ষমতা থেকে সরানো যায় না; টেনে নামাতে হয়।
তাদের পেছনে আছে লাখ লাখ অন্ধভক্ত, যাদের ‘কর্মী’ বলা হলেও তারা মূলত বেকার, সংঘর্ষপ্রিয় ও সুবিধাবাদী। তাদের দায়িত্ব হলো বিরোধী পক্ষের সঙ্গে মারামারি করা, আর দল ক্ষমতায় এলে চাঁদাবাজি, মাস্তানি ও দাপট দেখানো। বড় একটি অংশ কম শিক্ষিত, অসংবেদনশীল এবং টোকাই মানসিকতার।
দল ক্ষমতায় এলে তারা হয়ে যায় সমাজের কর্তাব্যক্তি। কারও সঙ্গে সামান্য মতবিরোধ হলেই তাদের আসল চরিত্র প্রকাশ পায়।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতাদের একমাত্র যোগ্যতা—অসততা ও মিথ্যাচার। আর কর্মীদের যোগ্যতা—তোষামোদ। এক কঠিন সত্য হলো—এই দেশে কোনো নেতা কখনোই অযোগ্য হয় না, দুর্নীতি যতই করুক। যতদিন পর্যন্ত এই দেশের অন্ধভক্ত, মূর্খ, লোভী, অসৎ, ধান্দাবাজ টোকাই রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে—ততদিন এই দেশ কখনো আলোর মুখ দেখবে না।
কুসংস্কার ও কুপ্রবৃত্তি দূর করার নীতিগত ও ব্যবহারিক উপায়
কুসংস্কার শুধু ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয় নয়; এটি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ধর্ম, গণমাধ্যম এবং রাজনীতির সমন্বিত প্রভাব। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতায় দেখা যায়—একযোগে উদ্যোগ নিলে কুসংস্কার দ্রুত হ্রাস পায়।
১. শিক্ষা সংস্কার
*প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে সমালোচনামূলক চিন্তা ও মিডিয়া সাক্ষরতা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
*কারণ বিশ্লেষণ, প্রমাণ যাচাই ও যুক্তিচর্চা শিক্ষার্থীর ভিত মজবুত করে।
*শিক্ষক প্রশিক্ষণ বাড়ানো জরুরি।
২. স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি
*গ্রাম–শহরের দুর্বল জনগোষ্ঠীর কাছে সঠিক স্বাস্থ্যতথ্য পৌঁছাতে হবে।
*স্বাস্থ্যকর্মী, এনজিও ও স্থানীয় সংগঠনকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
৩. ধর্মীয় ও স্থানীয় নেতাদের সম্পৃক্ততা
*ধর্মীয় নেতাদের বৈজ্ঞানিক তথ্য ও মানবিক মূল্যবোধের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
*আন্তধর্মীয় সংলাপের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা জরুরি।
৪. গণমাধ্যম ও বিনোদনমাধ্যমে দায়িত্বশীলতা
*তথ্যভিত্তিক নাটক, ডকুমেন্টারি ও অনুষ্ঠান কুসংস্কার কমাতে কার্যকর।
*ফ্যাক্ট চেকিং ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. এনজিও ও সিভিল সোসাইটির ভূমিকা
*মাইক্রো উদ্যোগ ও কমিউনিটি প্রকল্প কুসংস্কার ভাঙতে কার্যকর।
*সফল পাইলট প্রকল্প দ্রুত বিস্তৃত করতে হবে।
৬. আইনগত সুরক্ষা ও বিচার
*কুসংস্কারজনিত ক্ষতিকর কাজের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার জরুরি।
*পুনর্বাসন ও সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে।
৭. গবেষণা ও মূল্যায়ন
*কোন নীতি কার্যকর হচ্ছে তা নিয়মিত মূল্যায়ন ও গবেষণার মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে।
আলফ্রেড নোবেল: ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধের উদাহরণ
আলফ্রেড নোবেল তার সম্পদের বৃহৎ অংশ মানবকল্যাণে উৎসর্গ করেছিলেন। তার ইচ্ছাপত্রে তিনি নির্দেশ দেন—এই সম্পদ বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তিতে বৈশ্বিক উন্নতির জন্য ব্যবহার করা হবে।
নোবেল পুরস্কার আজ বিশ্বমানবতার উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রেখে চলেছে। এটি প্রমাণ করে—নৈতিক সিদ্ধান্ত একটি জাতিকে বদলে দিতে পারে।
সুইডেনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি: গ্রহণযোগ্যতার শিক্ষা
সুইডেনে দেখা যায়—অনেক প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক জীবন শেষে সাধারণ চাকরিতে ফিরে যান।
ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি জনগণের আস্থা বাড়ায়।
অনেকে জনগণের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন—“আমি ৪ বা ৮ বছরে কিছু করতে পারিনি, ভবিষ্যতেও পারব না।”
বাংলাদেশে পরিস্থিতি উল্টো—নেতারা নিজেদের সর্বকালের ‘গ্রিন এভার’ মনে করেন।
যদি বাংলাদেশের নেতারাও ভুল স্বীকার ও ক্ষমতা হস্তান্তরের সংস্কৃতি গ্রহণ করেন—সহিংসতা কমবে, জবাবদিহিতা বাড়বে।
তিন বছরের রোডম্যাপ
প্রথম ৬ মাস
*জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন
*দুই জেলায় পাঠ্যক্রম পাইলট প্রকল্প
*গ্রামীণ স্বাস্থ্য সচেতনতা অভিযানের সূচনা
৬–১৮ মাস
*পাইলট মূল্যায়ন ও সম্প্রসারণ
*গণমাধ্যমে তথ্যভিত্তিক প্রচারাভিযান
*ধর্মীয় নেতাদের প্রশিক্ষণ
১৮–৩৬ মাস
*শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও পাঠ্যপুস্তক সংস্কার
*প্রয়োজনীয় আইনগত সংস্কার
*জাতীয় পর্যায়ে গবেষণা ও মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠান গঠন
উপসংহার
কুসংস্কার দূর করা কোনো একক প্রচেষ্টায় সম্ভব নয়। এটি শিক্ষা, সংস্কৃতি, গণমাধ্যম, ধর্মীয় নেতৃত্ব, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং নাগরিক দায়িত্বের সমন্বিত ফল।
একজন আলফ্রেড নোবেল দেখিয়েছেন—একজন মানুষও সমাজ বদলে দিতে পারে।
সুইডেন দেখিয়েছে—স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও সীমাবদ্ধতা স্বীকারের সংস্কৃতি কীভাবে রাষ্ট্রকে শক্ত করে।
বাংলাদেশ যদি শিক্ষা, গণমাধ্যম, নেতৃত্ব এবং জনগণের বিবেক জাগ্রত করতে পারে—তবে কুসংস্কার ও অজ্ঞতার জায়গা দখল করবে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও নৈতিকতা।
এটা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। শুরু করতে হবে এখনই।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
*লেখক গবেষক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। ইমেইল: [email protected]

বাংলাদেশের পরিবার ও সমাজজীবনে দীর্ঘদিনের একটি অমীমাংসিত সংকট হলো সম্পত্তি বণ্টন ও উত্তরাধিকার। বাবা–মা জীবদ্দশায় খুব কমই সন্তানের মধ্যে সুষ্ঠু ও ন্যায়সংগতভাবে সম্পদ ভাগ করে দেন। দায়িত্বগুলো রেখে যান মৃত্যুর পরের জন্য। আর তখনই শুরু হয় বিরোধ, মামলা-মোকদ্দমা, রাগ–অভিমান, সম্পর্কচ্ছেদ—যা অনেক পরিবারের আজীবনের শান্তি নষ্ট করে দেয়।
একটি পরিবার সারাজীবন একসঙ্গে থাকার পরও, একটি ভুল সিদ্ধান্ত অতীতকে মুছে দিয়ে ঘৃণা ও দূরত্বের সম্পর্ক তৈরি করে। আশ্চর্যের বিষয়, এই সংকট দেশের সমাজে প্রচণ্ডভাবে বিদ্যমান হলেও এ নিয়ে কোনো বাস্তবিক আলোচনা নেই। পরিবারে কলহ, জমি নিয়ে মারামারি, পুলিশ–কাচারি, সালিশ—এসব প্রতিনিয়ত ঘটে, কিন্তু আমরা তা প্রকাশ্যে বলতে সংকোচ বোধ করি।
তবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে সমালোচনা করতে আমাদের কোনো দ্বিধা নেই।
যেমন পরিবার, তেমনই নেতৃত্ব—এ কথাটি আজ আরও সত্য। পরিবারের অগোছালো ও অসুস্থ সংস্কৃতি অবশেষে রাষ্ট্রীয় আচরণেই প্রতিফলিত হয়। সেই জায়গা থেকেই শুরু হয় রাজনীতির আরেক অন্ধকার অধ্যায়।
বাংলাদেশের রাজনীতি: অসুস্থ নেতৃত্ব ও বিকৃত কর্মীবাহিনী
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নিজে হাঁটতে পারেন না, চলাফেরায় অন্যের সাহায্য লাগে। বয়স ও অসুস্থতার কারণে তাকে হাসপাতালেই বেশি সময় কাটাতে হয়। মানসিক সক্ষমতাও আগের মতো নেই। তবু তিনি আগামী জাতীয় নির্বাচনে ৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তার শাসনামলে বাংলাদেশ টানা পাঁচবার বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হয়েছিল।
জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদও দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। তার পায়ে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা নেই, তবু দলীয় ক্ষমতা দখল নিয়ে কীভাবে সংঘাতে জড়িয়েছিলেন—সবাই জানে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেন মোহাম্মদ এরশাদও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দলের নেতৃত্ব ছাড়তে চাননি এবং দুর্নীতির দায়ে তিনি বহু বছর কারাগারে ছিলেন।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বয়সও অনেক। ক্ষমতা হারানোর পর তিনি এখন ভারতে অবস্থান করছেন। ভারতে যাওয়ার আগে সহিংসতা, অগ্নিসন্ত্রাস, হতাহতের মতো ঘটনা ঘটেছে। তবু তিনি আবার ক্ষমতায় ফিরতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন। তার একদল সমর্থক মনে করে—তিনি দেশে ফিরে এলে যা-ই ঘটুক, তিনি আবার ক্ষমতায় বসবেন।
বাংলাদেশে সমস্যা হলো—এদের কাউকেই ক্ষমতা থেকে সরানো যায় না; টেনে নামাতে হয়।
তাদের পেছনে আছে লাখ লাখ অন্ধভক্ত, যাদের ‘কর্মী’ বলা হলেও তারা মূলত বেকার, সংঘর্ষপ্রিয় ও সুবিধাবাদী। তাদের দায়িত্ব হলো বিরোধী পক্ষের সঙ্গে মারামারি করা, আর দল ক্ষমতায় এলে চাঁদাবাজি, মাস্তানি ও দাপট দেখানো। বড় একটি অংশ কম শিক্ষিত, অসংবেদনশীল এবং টোকাই মানসিকতার।
দল ক্ষমতায় এলে তারা হয়ে যায় সমাজের কর্তাব্যক্তি। কারও সঙ্গে সামান্য মতবিরোধ হলেই তাদের আসল চরিত্র প্রকাশ পায়।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতাদের একমাত্র যোগ্যতা—অসততা ও মিথ্যাচার। আর কর্মীদের যোগ্যতা—তোষামোদ। এক কঠিন সত্য হলো—এই দেশে কোনো নেতা কখনোই অযোগ্য হয় না, দুর্নীতি যতই করুক। যতদিন পর্যন্ত এই দেশের অন্ধভক্ত, মূর্খ, লোভী, অসৎ, ধান্দাবাজ টোকাই রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে—ততদিন এই দেশ কখনো আলোর মুখ দেখবে না।
কুসংস্কার ও কুপ্রবৃত্তি দূর করার নীতিগত ও ব্যবহারিক উপায়
কুসংস্কার শুধু ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয় নয়; এটি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ধর্ম, গণমাধ্যম এবং রাজনীতির সমন্বিত প্রভাব। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতায় দেখা যায়—একযোগে উদ্যোগ নিলে কুসংস্কার দ্রুত হ্রাস পায়।
১. শিক্ষা সংস্কার
*প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে সমালোচনামূলক চিন্তা ও মিডিয়া সাক্ষরতা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
*কারণ বিশ্লেষণ, প্রমাণ যাচাই ও যুক্তিচর্চা শিক্ষার্থীর ভিত মজবুত করে।
*শিক্ষক প্রশিক্ষণ বাড়ানো জরুরি।
২. স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি
*গ্রাম–শহরের দুর্বল জনগোষ্ঠীর কাছে সঠিক স্বাস্থ্যতথ্য পৌঁছাতে হবে।
*স্বাস্থ্যকর্মী, এনজিও ও স্থানীয় সংগঠনকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
৩. ধর্মীয় ও স্থানীয় নেতাদের সম্পৃক্ততা
*ধর্মীয় নেতাদের বৈজ্ঞানিক তথ্য ও মানবিক মূল্যবোধের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
*আন্তধর্মীয় সংলাপের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা জরুরি।
৪. গণমাধ্যম ও বিনোদনমাধ্যমে দায়িত্বশীলতা
*তথ্যভিত্তিক নাটক, ডকুমেন্টারি ও অনুষ্ঠান কুসংস্কার কমাতে কার্যকর।
*ফ্যাক্ট চেকিং ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. এনজিও ও সিভিল সোসাইটির ভূমিকা
*মাইক্রো উদ্যোগ ও কমিউনিটি প্রকল্প কুসংস্কার ভাঙতে কার্যকর।
*সফল পাইলট প্রকল্প দ্রুত বিস্তৃত করতে হবে।
৬. আইনগত সুরক্ষা ও বিচার
*কুসংস্কারজনিত ক্ষতিকর কাজের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার জরুরি।
*পুনর্বাসন ও সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে।
৭. গবেষণা ও মূল্যায়ন
*কোন নীতি কার্যকর হচ্ছে তা নিয়মিত মূল্যায়ন ও গবেষণার মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে।
আলফ্রেড নোবেল: ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধের উদাহরণ
আলফ্রেড নোবেল তার সম্পদের বৃহৎ অংশ মানবকল্যাণে উৎসর্গ করেছিলেন। তার ইচ্ছাপত্রে তিনি নির্দেশ দেন—এই সম্পদ বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তিতে বৈশ্বিক উন্নতির জন্য ব্যবহার করা হবে।
নোবেল পুরস্কার আজ বিশ্বমানবতার উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রেখে চলেছে। এটি প্রমাণ করে—নৈতিক সিদ্ধান্ত একটি জাতিকে বদলে দিতে পারে।
সুইডেনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি: গ্রহণযোগ্যতার শিক্ষা
সুইডেনে দেখা যায়—অনেক প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক জীবন শেষে সাধারণ চাকরিতে ফিরে যান।
ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি জনগণের আস্থা বাড়ায়।
অনেকে জনগণের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন—“আমি ৪ বা ৮ বছরে কিছু করতে পারিনি, ভবিষ্যতেও পারব না।”
বাংলাদেশে পরিস্থিতি উল্টো—নেতারা নিজেদের সর্বকালের ‘গ্রিন এভার’ মনে করেন।
যদি বাংলাদেশের নেতারাও ভুল স্বীকার ও ক্ষমতা হস্তান্তরের সংস্কৃতি গ্রহণ করেন—সহিংসতা কমবে, জবাবদিহিতা বাড়বে।
তিন বছরের রোডম্যাপ
প্রথম ৬ মাস
*জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন
*দুই জেলায় পাঠ্যক্রম পাইলট প্রকল্প
*গ্রামীণ স্বাস্থ্য সচেতনতা অভিযানের সূচনা
৬–১৮ মাস
*পাইলট মূল্যায়ন ও সম্প্রসারণ
*গণমাধ্যমে তথ্যভিত্তিক প্রচারাভিযান
*ধর্মীয় নেতাদের প্রশিক্ষণ
১৮–৩৬ মাস
*শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও পাঠ্যপুস্তক সংস্কার
*প্রয়োজনীয় আইনগত সংস্কার
*জাতীয় পর্যায়ে গবেষণা ও মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠান গঠন
উপসংহার
কুসংস্কার দূর করা কোনো একক প্রচেষ্টায় সম্ভব নয়। এটি শিক্ষা, সংস্কৃতি, গণমাধ্যম, ধর্মীয় নেতৃত্ব, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং নাগরিক দায়িত্বের সমন্বিত ফল।
একজন আলফ্রেড নোবেল দেখিয়েছেন—একজন মানুষও সমাজ বদলে দিতে পারে।
সুইডেন দেখিয়েছে—স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও সীমাবদ্ধতা স্বীকারের সংস্কৃতি কীভাবে রাষ্ট্রকে শক্ত করে।
বাংলাদেশ যদি শিক্ষা, গণমাধ্যম, নেতৃত্ব এবং জনগণের বিবেক জাগ্রত করতে পারে—তবে কুসংস্কার ও অজ্ঞতার জায়গা দখল করবে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও নৈতিকতা।
এটা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। শুরু করতে হবে এখনই।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
*লেখক গবেষক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। ইমেইল: [email protected]
গামা আব্দুল কাদির সুদীর্ঘ প্রবাস জীবনে বাংলাদেশ অ্যাসেসিয়েশনের পাচঁবার সভাপতি এবং তিনবার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি এখনো এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদ, অস্ট্রেলিয়া এবং আওয়ামী লীগের অস্ট্রেলিয়া শাখারও প্রধান উপদেষ্টা।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতাদের একমাত্র যোগ্যতা—অসততা ও মিথ্যাচার। আর কর্মীদের যোগ্যতা—তোষামোদ। এক কঠিন সত্য হলো—এই দেশে কোনো নেতা কখনোই অযোগ্য হয় না, দুর্নীতি যতই করুক।
সমস্যা সম্পদ নয়—সমস্যা চরিত্রের, মানসিকতার, আর সৎ মানুষের কণ্ঠরোধের। রাজনৈতিক নেতাদের ওলি-আউলিয়া ভাবার সুযোগ নেই। সভ্য দেশে একটি গুরুতর অপরাধই তাদের রাজনৈতিক জীবনের ইতি টানে। আমাদের দেশে এটিই সবচেয়ে বড় ঘাটতি।
আজও বহু দেশে স্বৈরাচারী শাসন টিকে আছে; পরিবারতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র আরও গাঢ় হয়েছে। শাসন আর শোষণ যেন একই স্রোতে মিশে গেছে। বক্তব্যের স্বাধীনতা প্রতিনিয়ত আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে, ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার পরিণত হয়েছে নিছক প্রহসনে।