বিপ্লব শাহনেওয়াজ
মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি ধর্মপ্রাণ হয়ে উঠতে পারেন আবার একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। এটি একটি সংবেদনশীল প্রশ্ন, তাই না…?
রাজবাড়ীর ঘটনাটি অত্যন্ত অমানবিক এবং আদিমতার লক্ষণ। সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সর্বোচ্চ মাত্রা অতিক্রম করলে এসব ঘটনা ঘটতে থাকে। এটাকে শুধু বিচ্ছিন্ন ঘটনা, রাজনৈতিক বা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরবর্তী ঘটনা বললে মূল সমস্যার কারণ থেকে দৃষ্টি ঘোরানো হবে। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর, একটা মানসিক চাপ তৈরি হয়েছিল আমার মনে, তার জন্য একটু লিখতে চেষ্টা করছি।
ঈশ্বর-কমপ্লেক্স, এর অর্থ কী এবং মানুষ কেন এটি পায়?
ঈশ্বর-কমপ্লেক্স হলো এমন একটি ধরন, যেখানে একজন ব্যক্তি বিশ্বাস করেন যে তার অসীম ক্ষমতা, দক্ষতা, নির্ভুলতা, প্রভাব রয়েছে এবং সে অন্যদের থেকে শ্রেষ্ঠ। এটি প্রায়শই নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার বা ম্যানিয়ার সাথে সম্পর্কিত আচরণের সঙ্গে যুক্ত।
‘ঈশ্বর-কমপ্লেক্স’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন সর্বপ্রথম সাইকোঅ্যানালিস্ট আর্নেস্ট জোন্স, তার Essays in Applied Psychoanalysis গ্রন্থে।
কেন কারও ঈশ্বর-কমপ্লেক্স হয়?
এর বিকাশের পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। যেমন আত্মসম্মানের স্বল্পতা, অসহায়ত্বের অনুভূতি বা অমীমাংসিত শৈশবকালের সমস্যা। কখনো কখনো অতিরিক্ত প্রশ্রয় বা অযৌক্তিক প্রশংসা প্রদানকারী অভিভাবকেরাও এই ধরনের প্রবণতা তৈরি করতে পারেন।
যদি কেউ দাবি করে যে, সে-ই ঈশ্বর, তবে তা মানসিক রোগের লক্ষণ হতে পারে—যেমন বিভ্রমজনিত ব্যাধি (Delusional Disorder), বাইপোলার ডিজঅর্ডার অথবা নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার। বিশেষত যখন এর সঙ্গে বিভ্রম, পারিপার্শ্বিকতার বা নিজের ওপর বিরক্তি বা অতিরিক্ত আত্মমগ্নতা জড়িত থাকে। এসব অবস্থায় ব্যক্তি নিজেকে অসীম ক্ষমতার অধিকারী বা ঈশ্বরতুল্য ভাবতে পারেন। নিজেকে মনে করতে পারেন ঈমাম মেহেদী কিংবা মসীহ্ (Messiah)।
মসীহ্ একটি আব্রাহামিক শব্দ। যার অর্থ 'অভিষিক্ত ব্যক্তি' বা 'মুক্তিদাতা'। এটি হিব্রু মশীহ থেকে এসেছে, যা সাধারণত একজন ত্রাণকর্তাকে বোঝায়। ইহুদি ধর্মে, মসীহ বলতে একজন ত্রাণকর্তার কথা বলা হয় যিনি ঈশ্বরের দ্বারা নির্বাচিত এবং যাকে পবিত্র তেল দিয়ে অভিষিক্ত করা হয়েছে। খ্রিস্টধর্মে, এই উপাধি যিশু খ্রীষ্টকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। ইসলামে বা কোরানে ঈসা (আ.)-কে মসীহ উপাধিতে ভূষিত করা হয়, যিনি ‘কুল্লাহ’ বা আল্লাহর বাণী প্রচার করতে পৃথিবীর শেষ সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।
অনেক সাধারণ মানুষও নিজের মধ্যে ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত সেই ‘অভিষিক্ত ব্যক্তি' বা 'মুক্তিদাতা' খুঁজে পান। এই অনুভূতি যতটুকু না ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে তার চেয়ে মানসিক রোগের লক্ষণ থেকে শুরু।
বিভ্রমজনিত ব্যাধি (Delusional Disorder)
ডিলিউশন (Delusion) হলো একটি মানসিক অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি এমন কিছু বিশ্বাস করেন যা বাস্তব নয়। কিন্তু তিনি তা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন এবং যুক্তি বা প্রমাণ দিয়েও এই বিশ্বাস পরিবর্তন করা যায় না। এই বিশ্বাসগুলো সাধারণত সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে অস্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয়। ডিলিউশন -বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। একজন সুস্থ মানুষের কাছে এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক মনে হতে পারে।বিভ্রমজনিত ব্যাধির কেন্দ্রীয় উপসর্গ হলো এমন বাস্তবতাবর্জিত এবং সামঞ্জস্যহীন বিভ্রম। নিজেকে ঈশ্বর মনে করা এর একটি আদর্শ উদাহরণ।
বাইপোলার ডিজঅর্ডার
এমন কিছু মানুষ আছেন যারা এক সময় মানসিকভাবে ভীষণ উৎফুল্ল থাকেন আবার কয়েক দিন পরেই হতাশায় ডুবে যান। দুটি অনুভূতির তীব্রতাই অনেক বেশি পরিমাণে থাকে। একটি পর্ব ম্যানিয়া এবং অন্যটি ডিপ্রেশন। এই ডিজঅর্ডারের ম্যানিয়া পর্বে আক্রান্তরা মহৎ চিন্তা ও বিশ্বাস করতে পারেন—যেমন তারা ঈশ্বরতুল্য ক্ষমতা রাখেন বা তারা ঈশ্বর নির্বাচিত।
নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার
এতে আত্মম্ভরিতা ও শ্রেষ্ঠত্ববোধ থাকে, যা ‘বিশেষ’ বা এমনকি ‘ঈশ্বরসদৃশ’ হওয়ার বিশ্বাসে রূপ নিতে পারে।
আমাদের চারপাশের যে সমাজ; তা উন্নত কিংবা অনুন্নত হোক; বিশ্বের যেকোনো প্রান্তেই হোক না কেন, সেই সমাজে সব শ্রেণির মানুষের মধ্যেই মানসিক স্বাস্থ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিটি মানুষ তার জীবনের কোনো এক পর্বে মানসিক অসুস্থতায় ভুগতে পারে—তা স্বল্প বা চরম মাত্রায় হোক।
মানসিক রোগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ এবং সেই লক্ষ্যে অবকাঠামো গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ।
সঠিক রোগ নির্ণয় কেবল বৈধ চিকিৎসক বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞই করতে পারেন। এর জন্য সঠিক চিকিৎসা জ্ঞানে দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন। প্রয়োজন চারপাশে সহনশীল মানুষের সাহায্য, সহমর্মিতা ও সহানুভূতি। কারও মধ্যে এ ধরনের লক্ষণ থাকলে, সঠিক মূল্যায়ন ও চিকিৎসার জন্য পেশাদার সাহায্য নেওয়া জরুরি।
ধর্ম ও মানসিক স্বাস্থ্য
১৯৮০ সালে ধর্মমনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক উভে উইকস্ট্রোম প্রকাশ করেছিলেন একটি গবেষণা: ‘মনোরোগ ও মনোচিকিৎসায় ধর্মের ভূমিকা—সহায়ক নাকি বোঝা?’
তিনি দেখান যে, ধর্ম ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট কখনো জীবনের কঠিন পরিস্থিতি সামলাতে সাহায্য করতে পারে, আবার কখনো এটি হতাশাজনক চিন্তা, হাইপোম্যানিক পর্ব বা সাইকোটিক অভিজ্ঞতা বাড়িয়ে তুলতে পারে। ধর্ম কখনো কখনো সহিংসতা বা আত্মবিধ্বংসী আচরণের ট্রিগারও হতে পারে।
ধর্ম ও ধর্মীয় জীবন একটি অবিচ্ছেদ্য বিষয়। এক অতিপ্রাকৃত ও অতীন্দ্রিয় বাস্তবতায় ‘বিশ্বাস’–কে কেবল সংজ্ঞা হিসেবে প্রকাশ করা যথেষ্ট নয়। ধর্ম একটি অভিজ্ঞতা। একটি অতীন্দ্রিয় অনুভূতির অভিজ্ঞতা। এটি তাই অতি সংবেদনশীল ঐ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে। অতি সংবেদনশীল সত্তায় আঘাত অনুভব করা তাই অনেকটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সংবেদনশীলতা ও সহনশীলতার সংঘাত তাই অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন এক বাস্তবতা। এখানে ঈশ্বরের ধারণা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, সামাজিক প্রেক্ষাপট, সহনশীল বা অতি সংবেদনশীল পরিবেশ, ক্যারিশম্যাটিক বা গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব সবই ভূমিকা রাখে।
একটা জীব হিসেবে মানুষ অন্য জীবের তুলনায় দৈনন্দিন জৈবিক জীবনযাপন এবং বংশবিস্তার ছাড়াও বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে অনন্য। চিন্তা, বিশ্লেষণ, আত্মউপলব্ধি এবং অস্তিত্বের অনুসন্ধান মানুষের চিন্তাজগতকে সমৃদ্ধ করে। ‘আমি কে? কোত্থেকে আমার উৎপত্তি?’ এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে প্রতিটি মানুষের যে মানসিক অবস্থা বা চিন্তার ধাপ তা পর্যায়ক্রমে অনেক পথ অতিক্রম করে। তারই এক পর্যায়ে দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব। প্রতিটি সমাজ এবং সভ্যতার বিকাশের মধ্যে ভাষা বা সংস্কৃতির ভিন্নতা শুধু নয় বরং ভিন্ন ভিন্ন নিজস্ব ঈশ্বরের উপস্থিতি ছিল। সর্বজনীন একেশ্বরের দর্শন বা ধর্মীয় বিশ্বাসের ইতিহাস মাত্র ৪–৫ হাজার বছরের।
রাজনীতিও মানুষের মজ্জাগত—শুধু রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় তা। কখনো তা পারিবারিক, সামাজিক বা ছোট পরিসরে এমনকি দাম্পত্য জীবনের ক্ষেত্রেও সমানভাবে তা প্রযোজ্য।
মনোরোগবিদ্যা ধর্মকে কীভাবে বোঝে বা বোঝার চেষ্টা করে? এবং ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা মনোরোগবিদ্যা ও মানসিক অসুস্থতাকে কীভাবে বোঝার চেষ্টা করেন? এ ক্ষেত্রেও শিক্ষা, সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বিশেষ বড় ভূমিকা রাখে।
সুইডেন পৃথিবীর অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, যেখানে ধর্মকে ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে দেখা হয়। ধর্মকে অবমাননা বা ধর্মহীনতা বা ধর্মকে অসম্মান কিংবা ঘৃণা কিছু না করে না। ডাইভারসিটি বা মানুষের মধ্যে ধার্মিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং ভাষাগত বৈচিত্র্যকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে মানবাধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতার চর্চাকারী দেশ হিসেবে ধর্মকে ব্যক্তিগত অনুভূতি ও বিশ্বাস হিসেবে বিবেচনা করে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করা হয়। ধর্ম সম্পর্কে ব্যক্তির এই অনুভূতির সঙ্গে রাষ্ট্রের একটা স্পষ্ট সীমারেখা রক্ষা করাই ধর্মনিরপেক্ষতা। এমন একটি দেশ যেখানে সমস্ত জনসংখ্যা এক কোটিরও কম; কিন্তু পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষের সম্মানজনক সহাবস্থান; শতাধিক ভাষায় যেখানে কথা বলা হয়। যেখানে স্কুলে স্কুলে অভিবাসী বাবা-মায়ের সন্তানদের তাদের নিজস্ব ভাষা শেখানো হয়।
এমন একটি দেশে মনোরোগবিদ, মনোবিজ্ঞানী, সমাজকর্মী, নার্স ও সাইকিয়াট্রিক স্টাফরা ধর্মকে প্রায়শই সংবেদনশীল ও কঠিন একটি বিষয় মনে করেন।
আমার বিশ্বাস সবার মাঝে এ নিয়ে অযথা শঙ্কা থাকে। কিন্তু রোগী যদি ধর্মীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে ভোগেন, আর কর্মীরা যদি তা এড়িয়ে যান, তাহলে পরিস্থিতি রোগীর কাছে আরও ভীতিকর হয়ে উঠতে পারে।
ধর্ম সহায়কও হতে পারে
মনোরোগে ধর্ম প্রায়শই সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। আধুনিক সাইকোথেরাপির ধরণ যেমন Acceptance and Commitment Therapy (ACT) ও Mindfulness প্রায়শই বৌদ্ধ চিন্তাধারার দিকে ইঙ্গিত করে। ধর্মতত্ত্ববিদদের গবেষণা অনুযায়ী একই ধরনের জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম ও ইহুদি ধর্মেও বিদ্যমান। হিন্দু ও আরও অনেক ধর্মেও তার অস্তিত্ব রয়েছে।
ধর্ম অনেকের কাছে হতে পারে পরিচয়ের ও আত্মপরিচয়ের উৎস। ধর্মীয় গ্রন্থ মানুষকে কঠিন সময়ে মানসিকভাবে শক্তি যোগাতে পারে। ড্যানিশ লেখক ক্যারেন ব্লিক্সেন লিখেছিলেন: ‘সব কষ্টই বহন করা যায় যদি তা কোনো গল্পে স্থান পায়, অথবা যদি তুমি সে বিষয়ে একটি গল্প বলো।’ প্রতিটি ধর্মই এমন গল্প সরবরাহ করে।
মনোরোগবিদ্যায়ও মিথ আছে। এটাও মনে রাখা দরকার যে আধুনিক মনোরোগবিদ্যায়ও ‘বিশ্বাস বনাম জ্ঞান’–এর দ্বন্দ্ব ছিল এবং এখানে ধ্বংসাত্মক মিথও বিদ্যমান।
একজন রোগী, যিনি আজ olanzapin নামক ঔষুধের কারণে ভালো আছেন। অথচ কীভাবে এইতো নব্বইয়ের দশকে এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তাকে বলেছিলেন যে তার সাইকোসিস আসলে মায়ের প্রতি দমিত ক্রোধের ফল। রোগী তখন বাবা-মায়ের সহায়তার অত্যন্ত প্রয়োজন বোধ করছিলেন। আর এ মন্তব্য তার কষ্টকে আরও গভীর করে তুলেছিল। এ গল্প বেশি দিন আগের নয়। মাত্র কয়েক দশকের। গত এক দশকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি মস্তিষ্কের গঠন ও কর্মক্ষমতা সম্পর্কে গভীর ধারণা অর্জন করেছে। সেই সঙ্গে তৈরি হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি এবং আধুনিক সব ঔষুধ। গত দশকের ট্যাবু আজকে ভিন্ন বাস্তবতায় পরিণত এবং মানুষ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তা মোকাবিলা করছে। মানসিক অসুস্থতার সঙ্গে যুক্ত ধর্মীয় প্রশ্ন বা অভিজ্ঞতা অন্য কোনো প্রশ্নের চেয়ে বেশি দুর্বল বা গুরুত্বহীন নয়।
যেমন ধর্ম কখনো মিথ ব্যবহার করে মানুষকে দমন করে, তেমনি মনোরোগবিদ্যাতেও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিহীন মিথ ক্ষতিকর হতে পারে। তেমনটাই ঘটেছে আমাদের অদূর অতীতে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—ধর্মীয় অভিজ্ঞতাটি সহায়ক না বোঝা? এখানেই আমরা সবাই সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারি।
একজন ব্যক্তির মানসিক অসুস্থতা উপলব্ধি করতে সক্ষম না হয়ে সেই রোগীর প্রতি সম্মিলিত মানসিক চাপ সৃষ্টি কখনোই সভ্যতার স্বাভাবিক বিকাশ নয়। ওই অসুস্থ ব্যক্তির কোনো কর্মকাণ্ড বা আচরণ এক রোগীরই আচরণ বা রোগীর রোগের লক্ষণ। রোগের উপসর্গ যেমন শরীরের ক্ষতি করে তেমনি তার প্রভাব পরিবারে পড়তে পারে। তেমনি সমাজ বা ধর্মীয় অনুভূতিতেও আঘাত হানতে পারে। এ সম্পর্কে আমাদের সবার মধ্যে সচেতনতা, সহনশীলতা, সহানুভূতি এবং সহমর্মিতার চর্চা করা প্রয়োজন।
আর তা যদি না হয়, এই মানসিক রোগ বিপর্যয়কর পর্যায় অতিক্রম করে আরও ভয়াবহ হবে চরমতম বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সে ক্ষেত্রে তা ব্যক্তিতে সীমাবদ্ধ না থেকে সামগ্রিকতায় রূপান্তরিত হতে পারে।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ ঘাট আমার স্মৃতিতে ঢাকা-খুলনা যাওয়ার সময় বালি ঘেরা পদ্মা পাড়। ছোট লঞ্চে করে উত্তাল পদ্মা নদী পারাপার। সঙ্গে ফেরি ঘাটের ইলিশ-পাঙাশ। ফেরিওয়ালার সে বৈচিত্র্যময় ছন্দ। ভিক্ষার জন্য হাহাকার করা মানুষের ভিড়। খুলনার বাস গোয়ালন্দে নামিয়ে দিত। বাস পরিবর্তন করতে হতো পদ্মার ওপারে লঞ্চে গিয়ে। এই লঞ্চই ছিল সেই দুপাশে যোগাযোগের মাধ্যম। সেই নষ্টালজিক ছোটবেলা সময়ের স্রোতে ভেসে গেছে বহু দূরে। সেই দারিদ্র্য এখন অতীত। কিন্তু সেই গোয়ালন্দে আজ মানবিক দৈন্যতার ছাপ। অতিপ্রাচীন আদিমতা যেন শরীরে ছড়িয়ে পড়া ক্যানসার রোগীর উপসর্গ হয়ে সবার কাছে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। আরও ভয়ঙ্কর কিছু অপেক্ষা করছে। সামাজিক অবক্ষয় আর মানসিক অসুস্থতা ব্যক্তির গন্ডি ছাড়িয়ে সমাজ রাষ্ট্রের বৃহত্তর মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
মৃত ব্যক্তির লাশ দুই সপ্তাহ পর কবর খুঁড়ে তুলে প্রানহীন, ব্যথার অনুভূতিহীন দেহটাকে জুতার আঘাতে আঘাতে কী অর্জন করা যায়? নিজের এবং সমষ্টিগত ঘৃণা, ক্ষোভ, বিদ্বেষ, প্রতিহিংসার প্রকাশ করা যায় চরম আদিমতায়। চরম পাশবিকতায়। নিজের সেই প্রতিহিংসার ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তেই শত মানুষের মধ্যে। নিমিষেই মানুষগুলো অমানবিক অনুভূতিহীন পাশবিক হয়ে ওঠে। স্কুলের বুলিং থেকে যার সূত্রপাত তা যেন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে আর মব-জাষ্টিসে পরিণত হয়েছে। লাশ উত্তোলন করে, সেই অর্ধগলিত দেহ জুতোর আঘাতে আঘাতে (মৃতদেহ আহতও করা যায় না) …কোন শব্দ ব্যবহার করব? তারপর পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার আছে। বাঁচার। কথা বলার। নাগরিক অধিকার পাবার। মৃত্যুর পরেও সম্মান পাবার নূন্যতম মানবিক অধিকারটুকু কি একটি মৃতদেহ পাবার অধিকার রাখে না! আমরা কি এমন একটি ভিত্তির ওপর রেখে যাচ্ছি আমাদের দেশটিকে। লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত একটি স্বাধীন দেশ-অনেক আবেগ আর ভালোবাসা জড়িয়ে রয়েছে সেই দারিদ্র্যে জর্জরিত স্বদেশ মাতার কাছে। অজানা এক কুয়াশায় সব অন্ধকার হয়ে আসছে।
এ সমস্যা শুধু রাজনৈতিক নয়। শুধু সামাজিক নয়। বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। অনেক গভীরের ক্ষত। শত শত বছরের পুরনো ক্ষত। আজ সময় এসেছে সমাজবিজ্ঞানী দ্বারা, মনোবিজ্ঞানী দ্বারা পর্যালোচনার।
মনে রাখতে হবে আমরা শুধু তাই নিমিত্তবাদের Homo Sapiens নই। অতিপ্রাকৃত বাস্তবতা থাকুক বা না থাকুক, আমরা Homo Religiosus ও—ধর্মীয় অর্থ-সন্ধানী মানুষ, এবং সেই সঙ্গে Homo Narrans—গল্প বলার মাধ্যমে অর্থ খোঁজার মানুষ। নিজের মতো করেই গল্প তৈরি করার মানুষ।
এই সুপার আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগে আমরা হোমো টেকনোলজিকাসও বটে-তবুও আমরা হোমো রিলিজিয়াস (Homo Religiosus)। সংবেদনশীলতা ও সহনশীলতার সংঘাত তাই অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন এক বাস্তবতা।
*বিপ্লব শাহনেওয়াজ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও বিভাগীয় প্রধান, জরুরি বিভাগ, উপসলা ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল, উপসলা, সুইডেন।
মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি ধর্মপ্রাণ হয়ে উঠতে পারেন আবার একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। এটি একটি সংবেদনশীল প্রশ্ন, তাই না…?
রাজবাড়ীর ঘটনাটি অত্যন্ত অমানবিক এবং আদিমতার লক্ষণ। সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সর্বোচ্চ মাত্রা অতিক্রম করলে এসব ঘটনা ঘটতে থাকে। এটাকে শুধু বিচ্ছিন্ন ঘটনা, রাজনৈতিক বা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরবর্তী ঘটনা বললে মূল সমস্যার কারণ থেকে দৃষ্টি ঘোরানো হবে। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর, একটা মানসিক চাপ তৈরি হয়েছিল আমার মনে, তার জন্য একটু লিখতে চেষ্টা করছি।
ঈশ্বর-কমপ্লেক্স, এর অর্থ কী এবং মানুষ কেন এটি পায়?
ঈশ্বর-কমপ্লেক্স হলো এমন একটি ধরন, যেখানে একজন ব্যক্তি বিশ্বাস করেন যে তার অসীম ক্ষমতা, দক্ষতা, নির্ভুলতা, প্রভাব রয়েছে এবং সে অন্যদের থেকে শ্রেষ্ঠ। এটি প্রায়শই নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার বা ম্যানিয়ার সাথে সম্পর্কিত আচরণের সঙ্গে যুক্ত।
‘ঈশ্বর-কমপ্লেক্স’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন সর্বপ্রথম সাইকোঅ্যানালিস্ট আর্নেস্ট জোন্স, তার Essays in Applied Psychoanalysis গ্রন্থে।
কেন কারও ঈশ্বর-কমপ্লেক্স হয়?
এর বিকাশের পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। যেমন আত্মসম্মানের স্বল্পতা, অসহায়ত্বের অনুভূতি বা অমীমাংসিত শৈশবকালের সমস্যা। কখনো কখনো অতিরিক্ত প্রশ্রয় বা অযৌক্তিক প্রশংসা প্রদানকারী অভিভাবকেরাও এই ধরনের প্রবণতা তৈরি করতে পারেন।
যদি কেউ দাবি করে যে, সে-ই ঈশ্বর, তবে তা মানসিক রোগের লক্ষণ হতে পারে—যেমন বিভ্রমজনিত ব্যাধি (Delusional Disorder), বাইপোলার ডিজঅর্ডার অথবা নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার। বিশেষত যখন এর সঙ্গে বিভ্রম, পারিপার্শ্বিকতার বা নিজের ওপর বিরক্তি বা অতিরিক্ত আত্মমগ্নতা জড়িত থাকে। এসব অবস্থায় ব্যক্তি নিজেকে অসীম ক্ষমতার অধিকারী বা ঈশ্বরতুল্য ভাবতে পারেন। নিজেকে মনে করতে পারেন ঈমাম মেহেদী কিংবা মসীহ্ (Messiah)।
মসীহ্ একটি আব্রাহামিক শব্দ। যার অর্থ 'অভিষিক্ত ব্যক্তি' বা 'মুক্তিদাতা'। এটি হিব্রু মশীহ থেকে এসেছে, যা সাধারণত একজন ত্রাণকর্তাকে বোঝায়। ইহুদি ধর্মে, মসীহ বলতে একজন ত্রাণকর্তার কথা বলা হয় যিনি ঈশ্বরের দ্বারা নির্বাচিত এবং যাকে পবিত্র তেল দিয়ে অভিষিক্ত করা হয়েছে। খ্রিস্টধর্মে, এই উপাধি যিশু খ্রীষ্টকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। ইসলামে বা কোরানে ঈসা (আ.)-কে মসীহ উপাধিতে ভূষিত করা হয়, যিনি ‘কুল্লাহ’ বা আল্লাহর বাণী প্রচার করতে পৃথিবীর শেষ সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।
অনেক সাধারণ মানুষও নিজের মধ্যে ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত সেই ‘অভিষিক্ত ব্যক্তি' বা 'মুক্তিদাতা' খুঁজে পান। এই অনুভূতি যতটুকু না ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে তার চেয়ে মানসিক রোগের লক্ষণ থেকে শুরু।
বিভ্রমজনিত ব্যাধি (Delusional Disorder)
ডিলিউশন (Delusion) হলো একটি মানসিক অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি এমন কিছু বিশ্বাস করেন যা বাস্তব নয়। কিন্তু তিনি তা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন এবং যুক্তি বা প্রমাণ দিয়েও এই বিশ্বাস পরিবর্তন করা যায় না। এই বিশ্বাসগুলো সাধারণত সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে অস্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয়। ডিলিউশন -বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। একজন সুস্থ মানুষের কাছে এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক মনে হতে পারে।বিভ্রমজনিত ব্যাধির কেন্দ্রীয় উপসর্গ হলো এমন বাস্তবতাবর্জিত এবং সামঞ্জস্যহীন বিভ্রম। নিজেকে ঈশ্বর মনে করা এর একটি আদর্শ উদাহরণ।
বাইপোলার ডিজঅর্ডার
এমন কিছু মানুষ আছেন যারা এক সময় মানসিকভাবে ভীষণ উৎফুল্ল থাকেন আবার কয়েক দিন পরেই হতাশায় ডুবে যান। দুটি অনুভূতির তীব্রতাই অনেক বেশি পরিমাণে থাকে। একটি পর্ব ম্যানিয়া এবং অন্যটি ডিপ্রেশন। এই ডিজঅর্ডারের ম্যানিয়া পর্বে আক্রান্তরা মহৎ চিন্তা ও বিশ্বাস করতে পারেন—যেমন তারা ঈশ্বরতুল্য ক্ষমতা রাখেন বা তারা ঈশ্বর নির্বাচিত।
নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার
এতে আত্মম্ভরিতা ও শ্রেষ্ঠত্ববোধ থাকে, যা ‘বিশেষ’ বা এমনকি ‘ঈশ্বরসদৃশ’ হওয়ার বিশ্বাসে রূপ নিতে পারে।
আমাদের চারপাশের যে সমাজ; তা উন্নত কিংবা অনুন্নত হোক; বিশ্বের যেকোনো প্রান্তেই হোক না কেন, সেই সমাজে সব শ্রেণির মানুষের মধ্যেই মানসিক স্বাস্থ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিটি মানুষ তার জীবনের কোনো এক পর্বে মানসিক অসুস্থতায় ভুগতে পারে—তা স্বল্প বা চরম মাত্রায় হোক।
মানসিক রোগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ এবং সেই লক্ষ্যে অবকাঠামো গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ।
সঠিক রোগ নির্ণয় কেবল বৈধ চিকিৎসক বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞই করতে পারেন। এর জন্য সঠিক চিকিৎসা জ্ঞানে দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন। প্রয়োজন চারপাশে সহনশীল মানুষের সাহায্য, সহমর্মিতা ও সহানুভূতি। কারও মধ্যে এ ধরনের লক্ষণ থাকলে, সঠিক মূল্যায়ন ও চিকিৎসার জন্য পেশাদার সাহায্য নেওয়া জরুরি।
ধর্ম ও মানসিক স্বাস্থ্য
১৯৮০ সালে ধর্মমনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক উভে উইকস্ট্রোম প্রকাশ করেছিলেন একটি গবেষণা: ‘মনোরোগ ও মনোচিকিৎসায় ধর্মের ভূমিকা—সহায়ক নাকি বোঝা?’
তিনি দেখান যে, ধর্ম ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট কখনো জীবনের কঠিন পরিস্থিতি সামলাতে সাহায্য করতে পারে, আবার কখনো এটি হতাশাজনক চিন্তা, হাইপোম্যানিক পর্ব বা সাইকোটিক অভিজ্ঞতা বাড়িয়ে তুলতে পারে। ধর্ম কখনো কখনো সহিংসতা বা আত্মবিধ্বংসী আচরণের ট্রিগারও হতে পারে।
ধর্ম ও ধর্মীয় জীবন একটি অবিচ্ছেদ্য বিষয়। এক অতিপ্রাকৃত ও অতীন্দ্রিয় বাস্তবতায় ‘বিশ্বাস’–কে কেবল সংজ্ঞা হিসেবে প্রকাশ করা যথেষ্ট নয়। ধর্ম একটি অভিজ্ঞতা। একটি অতীন্দ্রিয় অনুভূতির অভিজ্ঞতা। এটি তাই অতি সংবেদনশীল ঐ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে। অতি সংবেদনশীল সত্তায় আঘাত অনুভব করা তাই অনেকটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সংবেদনশীলতা ও সহনশীলতার সংঘাত তাই অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন এক বাস্তবতা। এখানে ঈশ্বরের ধারণা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, সামাজিক প্রেক্ষাপট, সহনশীল বা অতি সংবেদনশীল পরিবেশ, ক্যারিশম্যাটিক বা গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব সবই ভূমিকা রাখে।
একটা জীব হিসেবে মানুষ অন্য জীবের তুলনায় দৈনন্দিন জৈবিক জীবনযাপন এবং বংশবিস্তার ছাড়াও বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে অনন্য। চিন্তা, বিশ্লেষণ, আত্মউপলব্ধি এবং অস্তিত্বের অনুসন্ধান মানুষের চিন্তাজগতকে সমৃদ্ধ করে। ‘আমি কে? কোত্থেকে আমার উৎপত্তি?’ এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে প্রতিটি মানুষের যে মানসিক অবস্থা বা চিন্তার ধাপ তা পর্যায়ক্রমে অনেক পথ অতিক্রম করে। তারই এক পর্যায়ে দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব। প্রতিটি সমাজ এবং সভ্যতার বিকাশের মধ্যে ভাষা বা সংস্কৃতির ভিন্নতা শুধু নয় বরং ভিন্ন ভিন্ন নিজস্ব ঈশ্বরের উপস্থিতি ছিল। সর্বজনীন একেশ্বরের দর্শন বা ধর্মীয় বিশ্বাসের ইতিহাস মাত্র ৪–৫ হাজার বছরের।
রাজনীতিও মানুষের মজ্জাগত—শুধু রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় তা। কখনো তা পারিবারিক, সামাজিক বা ছোট পরিসরে এমনকি দাম্পত্য জীবনের ক্ষেত্রেও সমানভাবে তা প্রযোজ্য।
মনোরোগবিদ্যা ধর্মকে কীভাবে বোঝে বা বোঝার চেষ্টা করে? এবং ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা মনোরোগবিদ্যা ও মানসিক অসুস্থতাকে কীভাবে বোঝার চেষ্টা করেন? এ ক্ষেত্রেও শিক্ষা, সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বিশেষ বড় ভূমিকা রাখে।
সুইডেন পৃথিবীর অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, যেখানে ধর্মকে ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে দেখা হয়। ধর্মকে অবমাননা বা ধর্মহীনতা বা ধর্মকে অসম্মান কিংবা ঘৃণা কিছু না করে না। ডাইভারসিটি বা মানুষের মধ্যে ধার্মিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং ভাষাগত বৈচিত্র্যকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে মানবাধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতার চর্চাকারী দেশ হিসেবে ধর্মকে ব্যক্তিগত অনুভূতি ও বিশ্বাস হিসেবে বিবেচনা করে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করা হয়। ধর্ম সম্পর্কে ব্যক্তির এই অনুভূতির সঙ্গে রাষ্ট্রের একটা স্পষ্ট সীমারেখা রক্ষা করাই ধর্মনিরপেক্ষতা। এমন একটি দেশ যেখানে সমস্ত জনসংখ্যা এক কোটিরও কম; কিন্তু পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষের সম্মানজনক সহাবস্থান; শতাধিক ভাষায় যেখানে কথা বলা হয়। যেখানে স্কুলে স্কুলে অভিবাসী বাবা-মায়ের সন্তানদের তাদের নিজস্ব ভাষা শেখানো হয়।
এমন একটি দেশে মনোরোগবিদ, মনোবিজ্ঞানী, সমাজকর্মী, নার্স ও সাইকিয়াট্রিক স্টাফরা ধর্মকে প্রায়শই সংবেদনশীল ও কঠিন একটি বিষয় মনে করেন।
আমার বিশ্বাস সবার মাঝে এ নিয়ে অযথা শঙ্কা থাকে। কিন্তু রোগী যদি ধর্মীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে ভোগেন, আর কর্মীরা যদি তা এড়িয়ে যান, তাহলে পরিস্থিতি রোগীর কাছে আরও ভীতিকর হয়ে উঠতে পারে।
ধর্ম সহায়কও হতে পারে
মনোরোগে ধর্ম প্রায়শই সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। আধুনিক সাইকোথেরাপির ধরণ যেমন Acceptance and Commitment Therapy (ACT) ও Mindfulness প্রায়শই বৌদ্ধ চিন্তাধারার দিকে ইঙ্গিত করে। ধর্মতত্ত্ববিদদের গবেষণা অনুযায়ী একই ধরনের জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম ও ইহুদি ধর্মেও বিদ্যমান। হিন্দু ও আরও অনেক ধর্মেও তার অস্তিত্ব রয়েছে।
ধর্ম অনেকের কাছে হতে পারে পরিচয়ের ও আত্মপরিচয়ের উৎস। ধর্মীয় গ্রন্থ মানুষকে কঠিন সময়ে মানসিকভাবে শক্তি যোগাতে পারে। ড্যানিশ লেখক ক্যারেন ব্লিক্সেন লিখেছিলেন: ‘সব কষ্টই বহন করা যায় যদি তা কোনো গল্পে স্থান পায়, অথবা যদি তুমি সে বিষয়ে একটি গল্প বলো।’ প্রতিটি ধর্মই এমন গল্প সরবরাহ করে।
মনোরোগবিদ্যায়ও মিথ আছে। এটাও মনে রাখা দরকার যে আধুনিক মনোরোগবিদ্যায়ও ‘বিশ্বাস বনাম জ্ঞান’–এর দ্বন্দ্ব ছিল এবং এখানে ধ্বংসাত্মক মিথও বিদ্যমান।
একজন রোগী, যিনি আজ olanzapin নামক ঔষুধের কারণে ভালো আছেন। অথচ কীভাবে এইতো নব্বইয়ের দশকে এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তাকে বলেছিলেন যে তার সাইকোসিস আসলে মায়ের প্রতি দমিত ক্রোধের ফল। রোগী তখন বাবা-মায়ের সহায়তার অত্যন্ত প্রয়োজন বোধ করছিলেন। আর এ মন্তব্য তার কষ্টকে আরও গভীর করে তুলেছিল। এ গল্প বেশি দিন আগের নয়। মাত্র কয়েক দশকের। গত এক দশকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি মস্তিষ্কের গঠন ও কর্মক্ষমতা সম্পর্কে গভীর ধারণা অর্জন করেছে। সেই সঙ্গে তৈরি হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি এবং আধুনিক সব ঔষুধ। গত দশকের ট্যাবু আজকে ভিন্ন বাস্তবতায় পরিণত এবং মানুষ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তা মোকাবিলা করছে। মানসিক অসুস্থতার সঙ্গে যুক্ত ধর্মীয় প্রশ্ন বা অভিজ্ঞতা অন্য কোনো প্রশ্নের চেয়ে বেশি দুর্বল বা গুরুত্বহীন নয়।
যেমন ধর্ম কখনো মিথ ব্যবহার করে মানুষকে দমন করে, তেমনি মনোরোগবিদ্যাতেও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিহীন মিথ ক্ষতিকর হতে পারে। তেমনটাই ঘটেছে আমাদের অদূর অতীতে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—ধর্মীয় অভিজ্ঞতাটি সহায়ক না বোঝা? এখানেই আমরা সবাই সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারি।
একজন ব্যক্তির মানসিক অসুস্থতা উপলব্ধি করতে সক্ষম না হয়ে সেই রোগীর প্রতি সম্মিলিত মানসিক চাপ সৃষ্টি কখনোই সভ্যতার স্বাভাবিক বিকাশ নয়। ওই অসুস্থ ব্যক্তির কোনো কর্মকাণ্ড বা আচরণ এক রোগীরই আচরণ বা রোগীর রোগের লক্ষণ। রোগের উপসর্গ যেমন শরীরের ক্ষতি করে তেমনি তার প্রভাব পরিবারে পড়তে পারে। তেমনি সমাজ বা ধর্মীয় অনুভূতিতেও আঘাত হানতে পারে। এ সম্পর্কে আমাদের সবার মধ্যে সচেতনতা, সহনশীলতা, সহানুভূতি এবং সহমর্মিতার চর্চা করা প্রয়োজন।
আর তা যদি না হয়, এই মানসিক রোগ বিপর্যয়কর পর্যায় অতিক্রম করে আরও ভয়াবহ হবে চরমতম বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সে ক্ষেত্রে তা ব্যক্তিতে সীমাবদ্ধ না থেকে সামগ্রিকতায় রূপান্তরিত হতে পারে।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ ঘাট আমার স্মৃতিতে ঢাকা-খুলনা যাওয়ার সময় বালি ঘেরা পদ্মা পাড়। ছোট লঞ্চে করে উত্তাল পদ্মা নদী পারাপার। সঙ্গে ফেরি ঘাটের ইলিশ-পাঙাশ। ফেরিওয়ালার সে বৈচিত্র্যময় ছন্দ। ভিক্ষার জন্য হাহাকার করা মানুষের ভিড়। খুলনার বাস গোয়ালন্দে নামিয়ে দিত। বাস পরিবর্তন করতে হতো পদ্মার ওপারে লঞ্চে গিয়ে। এই লঞ্চই ছিল সেই দুপাশে যোগাযোগের মাধ্যম। সেই নষ্টালজিক ছোটবেলা সময়ের স্রোতে ভেসে গেছে বহু দূরে। সেই দারিদ্র্য এখন অতীত। কিন্তু সেই গোয়ালন্দে আজ মানবিক দৈন্যতার ছাপ। অতিপ্রাচীন আদিমতা যেন শরীরে ছড়িয়ে পড়া ক্যানসার রোগীর উপসর্গ হয়ে সবার কাছে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। আরও ভয়ঙ্কর কিছু অপেক্ষা করছে। সামাজিক অবক্ষয় আর মানসিক অসুস্থতা ব্যক্তির গন্ডি ছাড়িয়ে সমাজ রাষ্ট্রের বৃহত্তর মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
মৃত ব্যক্তির লাশ দুই সপ্তাহ পর কবর খুঁড়ে তুলে প্রানহীন, ব্যথার অনুভূতিহীন দেহটাকে জুতার আঘাতে আঘাতে কী অর্জন করা যায়? নিজের এবং সমষ্টিগত ঘৃণা, ক্ষোভ, বিদ্বেষ, প্রতিহিংসার প্রকাশ করা যায় চরম আদিমতায়। চরম পাশবিকতায়। নিজের সেই প্রতিহিংসার ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তেই শত মানুষের মধ্যে। নিমিষেই মানুষগুলো অমানবিক অনুভূতিহীন পাশবিক হয়ে ওঠে। স্কুলের বুলিং থেকে যার সূত্রপাত তা যেন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে আর মব-জাষ্টিসে পরিণত হয়েছে। লাশ উত্তোলন করে, সেই অর্ধগলিত দেহ জুতোর আঘাতে আঘাতে (মৃতদেহ আহতও করা যায় না) …কোন শব্দ ব্যবহার করব? তারপর পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার আছে। বাঁচার। কথা বলার। নাগরিক অধিকার পাবার। মৃত্যুর পরেও সম্মান পাবার নূন্যতম মানবিক অধিকারটুকু কি একটি মৃতদেহ পাবার অধিকার রাখে না! আমরা কি এমন একটি ভিত্তির ওপর রেখে যাচ্ছি আমাদের দেশটিকে। লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত একটি স্বাধীন দেশ-অনেক আবেগ আর ভালোবাসা জড়িয়ে রয়েছে সেই দারিদ্র্যে জর্জরিত স্বদেশ মাতার কাছে। অজানা এক কুয়াশায় সব অন্ধকার হয়ে আসছে।
এ সমস্যা শুধু রাজনৈতিক নয়। শুধু সামাজিক নয়। বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। অনেক গভীরের ক্ষত। শত শত বছরের পুরনো ক্ষত। আজ সময় এসেছে সমাজবিজ্ঞানী দ্বারা, মনোবিজ্ঞানী দ্বারা পর্যালোচনার।
মনে রাখতে হবে আমরা শুধু তাই নিমিত্তবাদের Homo Sapiens নই। অতিপ্রাকৃত বাস্তবতা থাকুক বা না থাকুক, আমরা Homo Religiosus ও—ধর্মীয় অর্থ-সন্ধানী মানুষ, এবং সেই সঙ্গে Homo Narrans—গল্প বলার মাধ্যমে অর্থ খোঁজার মানুষ। নিজের মতো করেই গল্প তৈরি করার মানুষ।
এই সুপার আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগে আমরা হোমো টেকনোলজিকাসও বটে-তবুও আমরা হোমো রিলিজিয়াস (Homo Religiosus)। সংবেদনশীলতা ও সহনশীলতার সংঘাত তাই অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন এক বাস্তবতা।
*বিপ্লব শাহনেওয়াজ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও বিভাগীয় প্রধান, জরুরি বিভাগ, উপসলা ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল, উপসলা, সুইডেন।
পুরাণমতে রাজা সুরথ প্রথম দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন। তিনি বসন্তে এই পূজার আয়োজন করায় একে বাসন্তী পূজা বলা হয়। কিন্তু রাবনের হাত থেকে সীতাকে উদ্ধার করতে লঙ্কা যাত্রার আগে রামচন্দ্র দেবীর পূজার আয়োজন করেন। শরৎকালে এই পূজা হয়। তাই এর নাম শারদীয় উৎসব।
ইউক্রেন যুদ্ধের ঘটনাবলির দিকে গভীরভাবে নজর দিলে পরিষ্কার হয়ে উঠবে, পুতিন তথা রাশিয়া অনেক বেশি ধৈর্য্য ধরেছে।
আঞ্চলিক সহযোগিতা এই অঞ্চলের সব মানুষের ভাগ্যের দুয়ার খুলে দিতে পারত। যেমন পেরেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। দক্ষিণ এশিয়ার বিশাল বাজার, জনশক্তি ও প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার এই অঞ্চলের দেশগুলোকে অর্থনৈতিক উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে পারে।
মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি ধর্মপ্রাণ হয়ে উঠতে পারেন আবার একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। এটি একটি সংবেদনশীল প্রশ্ন, তাই না…?