logo
মতামত

মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় বাংলাদেশ–ভারত সুসম্পর্ক

ইজাজ আহসান২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
Copied!
মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় বাংলাদেশ–ভারত সুসম্পর্ক

বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ–ভারত একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। এক সময় এই দুই দেশ একটাই দেশ ছিল। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশের জন্ম হয়। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে আবার বাংলাদেশের জন্ম হয়। বাংলাদেশের জন্মে ভারতের একটা প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। সেই কারণে স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের গভীর সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্পর্ক বললে একটু ভুল হবে, আরও খোলাসা করে বললে, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু সেটা ভেস্তে যায় পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে। কিন্তু ভারত তখন প্রকাশ্যে তেমন বৈরিতা প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকে। এভাবেই খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলতে থাকে এই সম্পর্ক। আশির দশকে দক্ষিণ এশিয়ার ৭টি দেশ নিয়ে সার্ক গঠিত হয়। প্রাথমিক অবস্থায় সার্কভুক্ত দেশগুলোর সম্পর্ককে বহুমাত্রিক করার প্রচেষ্টা চলে। ক্রীড়া, সংস্কৃতি, বাণিজ্য,বিজ্ঞান, গবেষণা, যোগাযোগ ব্যবস্থা—এই সমস্ত ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হয়। প্রাথমিক অবস্থায় বেশ কিছুটা সাফল্য আসে।

কিন্তু কালের প্রবাহে দেশগুলোতে নেতৃত্বের পরিবর্তন ঘটে। সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে থাকে সার্কের কর্মকাণ্ড। বিশেষ করে ভারত–পাকিস্তান সম্পর্ক এখানে বড় একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষত ভারতের অভ্যন্তরে ঘটা বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে পাকিস্তানের যোগসাজশ আছে বলে ভারত জোরালো দাবি তোলে। এই সব দাবির সত্য মিথ্যা বা অকাট্য প্রমাণ নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু ভারত তার জায়গায় ছিল অটল। এভাবে চলতে চলতে এক পর্যায়ে সার্ক মৃতপ্রায় একটা সংস্থায় পরিণত হয়ে পড়ে। বর্তমানে এর কোনো কার্যক্রম নেই বললেই চলে। ভারতের অসহযোগিতাই মূলত এর কারণ। ভারত চেয়েছিল এবং এখনো চায় এই অঞ্চলে যেন সে তার কর্তৃত্ব স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

আঞ্চলিক সহযোগিতা এই অঞ্চলের সব মানুষের ভাগ্যের দুয়ার খুলে দিতে পারত। যেমন পেরেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। দক্ষিণ এশিয়ার বিশাল বাজার, জনশক্তি ও প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার এই অঞ্চলের দেশগুলোকে অর্থনৈতিক উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে পারে। ভারতই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে পারত। তার বিশাল আয়তন, জনশক্তি এবং অন্য সব দেশ মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত হওয়ায় প্রতিটি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য যোগাযোগ অনেক বেশি সুবিধাজনক ছিল। কিন্তু এই অঞ্চলের কারও সঙ্গে এখন আর ভারতের সুসম্পর্ক নেই। তার পররাষ্ট্র নীতিটা অনেকটা এমন যে, নিজের ভালো হোক বা না হোক অন্যের যেন ভালো কিছু না হয়। সেটা যদি তার জন্য ক্ষতি বয়ে আনে তবে তাতেও রাজি। কথায় আছে না, নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ।

এই প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ল। দেবদূত এসে একজনকে বললেন, তোমার সব ইচ্ছা পূরণ করে দেওয়া হবে, তবে একটা শর্ত আছে। তোমার যা হবে তোমার প্রতিবেশীর তার দ্বিগুণ হবে, ভালো মন্দ উভয়ই। লোকটি রাজি হলো। তারপর থেকে তার একটা গাড়ি হলে প্রতিবেশীর দুইটা, তার একটা বাড়ি হলে প্রতিবেশীর দুইটা। এভাবে কত সহ্য করা যায়। এক পর্যায়ে ওই লোক একদিন দেবদূতকে ডেকে বলল, তুমি আমার একটা চোখ উপড়ে ফেল। তার মানে তার প্রতিবেশীর দুই চোখই উপড়ে ফেলা হবে।

এটা নিছক একটা গল্প, কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্র নীতি দেখলে এই গল্পটা মনে পড়ে যায়। একটা দেশ নিয়ে এভাবে সোজাসাপটা কথা বলা ঠিক কি না জানি না। তবে জুলাই বিপ্লবের পর ভারতীয় রিপাবলিক টিভিসহ আরও কিছু মিডিয়া আর তাদের সাংবাদিকেরা হাত পা ছুঁড়ে যেভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছে, তা আমাদের অনেকটা বাধ্য করছে এভাবে বলতে।

২০০৯ সালের পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আবার সুদিন ফিরে আসে আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর। তবে সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক তো দূরে থাক, বাংলাদেশ অনেকটা তাদের অলিখিত প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করা শুরু করে। আর ভারতের ভাবটা এমন দাঁড়ায় যে, বাংলাদেশ কোনো স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র নয়, তাদের একটা অধীন একটি দেশ মাত্র। তাদের পরামর্শে পররাষ্ট্র নীতিও নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। পাকিস্তান বা চীনের সঙ্গে সম্পর্ক কী হবে তা নির্ধারিত হতো দিল্লি থেকে। বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ধারা বা সীমানা কত হবে তা একান্তভাবে নির্ধারিত হতো দিল্লি থেকে। তাতে বাংলাদেশের লাভ ক্ষতি যাই হোক, সেটা বিবেচ্য নয়।

ভারত বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা ভোগ করেছে নামমাত্র কর দিয়ে। আরও অসংখ্য সমস্যা ছিল, যেগুলো নিরসনের কোনো উদ্যোগ ভারতের পক্ষ থেকে দেখা যায়নি। বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেগুলো বাধাগ্রস্ত হয়েছে ভারতের অসহযোগিতার কারণে। প্রধান সমস্যা যেমন পানির ন্যায্য হিস্যা, সীমান্তে হত্যা বন্ধ, বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্য রক্ষা—এসবের কোনোটার কোনো সমাধান হয়নি এই দীর্ঘ ১৫ বছরে।

অনেকের আশা ছিল, বাংলাদেশ সরকার যেহেতু তাদের একান্ত অনুগত, তাই চক্ষু লজ্জার জন্য হলেও ভারত কিছু না কিছু করবে। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ১৮ লাখ পর্যটক ভারত ভ্রমণ করত। এর মধ্য একটা বড় সংখ্যা চিকিৎসা সেবার কারণে দেশটিতে যেত। পর্যটন, কেনাকাটা, বা চিকিৎসা সেবা—যে কারণেই হোক, এটা তাদের বিরাট অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দিয়েছে। এ ছাড়া, অনেক ভারতীয় বাংলাদেশে উচ্চপদে কর্মরত আছেন। তারা বিপুল অঙ্কের টাকা দেশে প্রেরণ করছেন।

অন্যদিকে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে রমরমা ব্যবসা করছে। কিন্তু চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশি চ্যানেল ভারতে প্রবেশাধিকার পায়নি। এনিয়ে মাঝে মধ্যে টিভি টকশোতে কিছু আলোচনার সূত্রপাত হতো, কিন্তু তা ওই পর্যন্তই।

তাদের পূজাপার্বণে ইলিশ মাছ দিয়ে রসনা তৃপ্ত করার দায়িত্ব আমাদের, কিন্তু ভারত থেকে গরু আসতে পারবে না। মেনে নিলাম এটা তাদের ধর্মীয় ব্যাপার। কিন্তু যখন দেখি ভারত বিশ্বের অন্যতম গোমাংস রপ্তানিকারক দেশ, তখন হিসাব মেলানো দায় হয়ে পড়ে।

তা ছাড়া, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশিদের ভ্রমণ ভিসা বন্ধ। কেন, কি অপরাধ আমাদের?

ভারত নিজেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ বলে দাবি করে আবার সেই কি না চরম অগণতান্ত্রিক আর মানবাধিকার লঙ্ঘনকারি একটা দলকে সহায়তা দিয়ে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশের আরেকটা অনেক বড় সমস্যা হলো রোহিঙ্গা সমস্যা। এর মুলেও ভারতের হাত আছে বলে মনে করা হয়। এত কিছুর পরে আর একটা প্রতিবেশী দেশের ভালো সম্পর্ক কীভাবে আশা করা যায়।

দুই দেশের সম্পর্ক যদি ভালো হয় তবে উভয় দেশের জনগণই বহু ক্ষেত্রে উপকৃত হবে এতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের মানুষের কিছু অসুবিধা হচ্ছে বিশেষ করে যারা ভারতে চিকিৎসা নিতেন তাদের। অন্যদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতার ব্যবসায়ীদের তো মাথায় হাত। হোটেল, রেস্তোরাঁ, পরিবহণ—সব ক্ষেত্রে হাহাকার। কলকাতায় মূলত বাংলাদেশি পর্যটকেরাই যান। ইউরোপ আমেরিকা থেকে খুব কম পর্যটকই ওখানে আসে। কিন্তু ভারত তো গো ধরে আছে।

তবে এভাবে বেশি দিন চলবে না। বাংলাদেশে একটা গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এলে সেই সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করবে ভারত। তা না হলে চীন–পাকিস্তান সেই সুযোগের সৎব্যবহার করবে। যা ভারত কখনই চাইবে না।

মজার ব্যাপার, ভারতের এই আচরণ তাকে বিশ্ব-দরবারে একঘরে করে দিয়েছে। সব থেকে দুঃখের বিষয় তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমেরিকা তাকে অপমান করে দূরে ঠেলে দিয়েছে। তাই সময় এসেছে তাদের আচরণ পরিবর্তনের। তবে এবার বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চাইলে তা হতে হবে সমতা, পারস্পরিক সম্মান আর মর্যাদার ভিত্তিতে। কবে তা হবে জানা নাই, তাই অপেক্ষা করতে হবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের।


(মতামত লেখকের নিজস্ব)

*ইজাজ আহসান, বিভাগীয় প্রধান (ব্যবসায় শিক্ষা), বাংলাদেশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মাস্কাট, ওমান

আরও দেখুন

অনন‍্য সাধারণ এক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা গামা আব্দুল কাদির

অনন‍্য সাধারণ এক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা গামা আব্দুল কাদির

গামা আব্দুল কাদির সুদীর্ঘ প্রবাস জীবনে বাংলাদেশ অ্যাসেসিয়েশনের পাচঁবার সভাপতি এবং তিনবার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি এখনো এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদ, অস্ট্রেলিয়া এবং আওয়ামী লীগের অস্ট্রেলিয়া শাখারও প্রধান উপদেষ্টা।

৩ দিন আগে

পরিবার থেকে রাজনীতি: বাংলাদেশের সামাজিক ও নৈতিক চিত্র

পরিবার থেকে রাজনীতি: বাংলাদেশের সামাজিক ও নৈতিক চিত্র

বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতাদের একমাত্র যোগ্যতা—অসততা ও মিথ্যাচার। আর কর্মীদের যোগ্যতা—তোষামোদ। এক কঠিন সত্য হলো—এই দেশে কোনো নেতা কখনোই অযোগ্য হয় না, দুর্নীতি যতই করুক।

৩ দিন আগে

সততার দুর্ভিক্ষে চরিত্রের ঐশ্বর্য

সততার দুর্ভিক্ষে চরিত্রের ঐশ্বর্য

সমস্যা সম্পদ নয়—সমস্যা চরিত্রের, মানসিকতার, আর সৎ মানুষের কণ্ঠরোধের। রাজনৈতিক নেতাদের ওলি-আউলিয়া ভাবার সুযোগ নেই। সভ্য দেশে একটি গুরুতর অপরাধই তাদের রাজনৈতিক জীবনের ইতি টানে। আমাদের দেশে এটিই সবচেয়ে বড় ঘাটতি।

৩ দিন আগে

গণতন্ত্রের অপমৃত্যু এবং জনগণের নবজাগরণের অনিবার্য ডাক

গণতন্ত্রের অপমৃত্যু এবং জনগণের নবজাগরণের অনিবার্য ডাক

আজও বহু দেশে স্বৈরাচারী শাসন টিকে আছে; পরিবারতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র আরও গাঢ় হয়েছে। শাসন আর শোষণ যেন একই স্রোতে মিশে গেছে। বক্তব্যের স্বাধীনতা প্রতিনিয়ত আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে, ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার পরিণত হয়েছে নিছক প্রহসনে।

৬ দিন আগে