মহসীন হাবিব
পূর্ব ইউরোপের মাটিতে সাড়ে তিন বছর ধরে এক ভয়ানক যুদ্ধ চলছে, যার তাপ এসে দক্ষিণ গোলার্ধেও লাগছে। আমরা পশ্চিমের প্রভাবিত গণমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পারি, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে এ যুদ্ধ বাঁধিয়েছে। সুতরাং এ যুদ্ধের দায় রাশিয়া তথা পুতিনের।
তাই কি? ধরা যাক একটি বৃদ্ধ সিংহ কিছুটা অসুস্থ অবস্থায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। কয়েকটি হায়েনা গিয়ে ঘিরে ধরল। অনেক সময় সিংহকে অসুস্থ মনে করে হায়েনা তাই করে। তখন যদি সিংহ উঠে হায়েনাগুলোকে ধাওয়া করে এবং দু-একটি দুর্বল হায়েনা থাবার নাগালে পড়ে মৃত্যুবরণ করে, আপনি বলবেন, এ ঘটনার জন্য সিংহ এককভাবে দায়ী।
এক্সাক্টলি তাই ঘটছে ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে। বরং ঘটনাবলির দিকে গভীরভাবে নজর দিলে পরিষ্কার হয়ে উঠবে, পুতিন তথা রাশিয়া অনেক বেশি ধৈর্য্য ধরেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর প্রায় ৩০ বছর ধরে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, অন্যায় আচরণ এবং রাশিয়ান ফেডারেশনকে অস্তিত্বহীন করার ধুরন্ধর প্রচেষ্টা পুতিনকে শেষ পর্যন্ত ঠেলে দিয়েছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে। সঠিক কথাই বলেছেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফ্রি স্যাকস। তিনি বলেছেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নেয় রাশিয়ার সঙ্গে সহ অবস্থান নয়, বরং রাশিয়াকে পরাস্থ করার।’ তার কথা কতটা খাঁটি তা একটু পেছনে ফিরলেই পরিস্কার দেখা যায়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে যায় ১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর। কিন্তু ভাঙনের শব্দ শোনা যাচ্ছিল বছর কয়েক আগে থেকেই। বিশেষ করে মিখাইল গর্ভাচেভের গ্লাসনস্ত বা খোলা দুয়ার এবং পেরেস্ত্রইকা বা পুনর্গঠন সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকে। যা শুরু হয় ১৯৮৭ সালে। পূর্ব জার্মানি, পোল্যান্ডসহ পূর্ব-ইউরোপের দেশগুলো একে একে রাশিয়ার অবিভাবকত্ব ছেড়ে, সমাজতন্ত্র থেকে বের হয়ে যেতে থাকে। তখনই বোঝা যায় রাশিয়া নিজেও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে বের হতে প্রস্তত হচ্ছে।
অন্যদিকে ১৯৯১ সালের ৮ ডিসেম্বর বেলোভেজা অ্যাকোর্ড, যাকে মিনস্ক অ্যাকোর্ড বলা হয়, তা স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বেলারুশ ও ইউক্রেন বের হয়ে যায়। এই চুক্তি ছিল কমনওয়েলথ অব ইনডিপেন্ডেন্ট স্টেটস গঠনের পদক্ষেপ। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে তার অর্থনীতি কী হবে, সামরিক শক্তির কী হবে সেসব নিয়ে আগেই আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেটস জেমস বেকার সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্ভাচভের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট বা আমি কেউই চলমান শান্তি প্রক্রিয়া থেকে কোনো সুবিধা আদায় করতে চাই না। পুর্বদিকে ন্যাটো এক ইঞ্চি পরিমাণ জায়গায় প্রবেশ করবে না। আমেরিকা এটা বোঝে যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইউরোপের জন্য এটা কত গুরুত্বপূর্ণ।’ জবাবে গর্বাচেভ তখনকার পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট ভিটোল্ড জারুলেস্কির বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনা উপস্থিতি ইউরোপে স্থিতিশীলতা আনতে সহায়তা করবে।’
কিন্তু ঘটল তার উল্টো। ১৯৯৯ সালে প্রথমেই পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও চেক রিপাবলিক ন্যাটোতে যোগদান করে, বলা যায় করানো হয়। বরিস ইয়েলৎসিন, ভ্লাদিমির পুতিন ও মস্কোর নীতি নির্ধারকেরা ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। তারা এই সিদ্ধান্তকে প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন বলে আপত্তি জানান। তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজরসহ অন্য ন্যাটো নেতারা মৌখিক প্রতিশ্রুত দেন, ন্যাটো আর পূর্ব দিকে সম্প্রসারিত হবে না। কিন্তু তারা কোনো চুক্তিতে এলেন না। এরপর আবার ২০০৪ সালে একসঙ্গে বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া ও স্লোভেনিয়া; ২০০৯ সালে আলবেনিয়া ও ক্রোয়েশিয়া, ২০১৭ সালে মন্টেনিগ্রো, ২০২০ সালে উত্তর মেসিডোনিয়া, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ২০২৩ সালে ফিনল্যান্ড এবং ২০২৪ সালে সুইডেন ন্যাটোতে যোগ দেয়! ন্যাটো এগ্রিমেন্টে বারবার বিভিন্নভাবে বলা আছে, ন্যাটোর কোনো রাষ্ট্র অন্য কোনো রাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হলে পুরো ন্যাটো সামরিকভাবে সহায়তা করবে। লক্ষনীয় এই ন্যাটো রাশিয়াকে এমনকি ছোট ছোট দেশ দিয়ে ঘিরে ফেলেছে।
১৯৯৯ সালেই পুতিন ব্যাপারটি বুঝতে পারেন এবং তৎকালীন ন্যাটো প্রধান জর্জ রবার্টসনকে বলেন, ‘আমরা ন্যাটোতে কবে যোগ দিচ্ছি?’ রবার্টসন উত্তর দেন, ‘আমরা কাউকে দাওয়াত করি না, আমাদের কাছে আবেদন করতে হয় এবং অপেক্ষা করতে হয়।’ উত্তরে পুতিন বলেন, ‘ওই ছোট ছোট দেশের পেছনে লাইনে দাঁড়িয়ে ন্যাটোতে যোগদানের কোনো মানে হয় না।’
উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার কাজিমের্স ব্রিজিনিস্কি একটি ফরাসি ম্যাগাজিনকে সাক্ষাৎকার দিয়ে স্বীকার করেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ফেলতে এসব ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ট্র্যাপ।
ন্যাটো শুধু রাশিয়াকে ঘিরেই শান্ত হয়নি। ১৯৯৯ সালে চেচেন যুদ্ধ শুরু হয়, পুতিন দেখতে পান চেচেন যোদ্ধাদের পেছনে ন্যাটোর হাত। চেচেন গেরিলা নেতা ও স্বঘোষিত চেচেন রিপাবলিক অব ইচকেরিয়ার পররাস্ট্রমন্ত্রী ইলিয়াস আখমাদভের সঙ্গে গোপনে একের পর এক সাক্ষাৎ করেন পশ্চিম ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা। পরবর্তীতে জন ম্যাককেইন স্বীকার করেছেন, তার সঙ্গে আখমাদভের তিনবার দেখা হয়েছে। এই আকমাদভকে পরে যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়।
পুতিন বুঝতে পারেন, রাশিয়াকে দুর্বল ও অস্থিতিশীল করতে পশ্চিমারা ঘরে ঢুকে গেছে। তখনো পুতিন ধৈর্য্য ধরেছেন এবং বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সহযোগিতা করতে চেয়েছেন। যেমন, ২০০১ সালে আফগানিস্তান আক্রমণের আগে জর্জ বুশ জুনিয়র পুতিনের সহায়তা চান। কারণ তাজিকিস্তান, তুর্কেমিনিস্তান এবং উজবেকিস্তানের সহায়তা ছাড়া আফগানিস্তান দখল করা কঠিন। আর এই তিনটি দেশই পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। আফগানিস্তানে টেররিস্টদের দমনে পুতিন শুধু সহায়তাই করেননি, তার সামরিক কর্মকর্তাদের আদেশ দেন, ন্যাটোকে আফগান যুদ্ধের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে।
রাশিয়ার পাশের জর্জিয়ায় কী হয়েছিল? আমরা সবাই জানি, ২০০৮ সালে দুর্বল জর্জিয়ায় সবল রাশিয়া হামলা করেছে। কিন্তু পেছনের চিত্র ছিল অন্যরকম। ২০০৩ সালের নির্বাচনের আগে চার হাজার এনজিও সক্রিয় হয়ে ওঠে প্রেসিডেন্ট এডোয়ার্ড শেভার্দনাৎজেকে ক্ষমতাচ্যুত করতে। ওই নির্বাচন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করেছিল বিদেশি এনজিওগুলো। তারপরও ভোটে শেভার্দনাৎজে জয়লাভ করেন। বিরোধী নেতা মিখাইল শাখাসভিলি সে নির্বাচন না মেনে আন্দোলনে নামেন। পার্লামেন্টের সেশন শুরু হলে শাখাসভিলি বিপ্লবীদের নিয়ে ঢুকে পড়েন সেখানে, যাদের হাতে ছিল গোলাপ ফুল। অনেকগুলো ঘটনার পর শান্তির প্রত্যাশায় রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইগোর ইভানভকে পাঠায় মস্কো। শেভার্দনাৎজে পদত্যাগ করেন। শাখাসভিলি প্রেসিডেন্ট হন।
সম্পূর্ণ পশ্চিমা মানসিকতার শাখাসভিলি কিন্তু ইউক্রেনেরও নেতা। তাকে ২০১৫ সালে ওডেসার গভর্ণর নিয়োগ করেন ইউক্রেনের আরেক রাশিয়া বিরোধী প্রেসিডেন্ট পেরোশেঙ্কো। ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তাকে ‘দ্য এক্সিকিউটিভ কমিটি অব দ্য ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর রিফর্মস অব ইউক্রেন’–এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন। এই শাখাসভিলি প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ২০০৮ সালে সমস্ত জর্জিয়ায়, বিশেষ করে রাশিয়ার সীমান্তে শতশত পশ্চিমা গোয়েন্দা আবাস গড়ে তুলতে থাকে। যেখানে রুশভাষীদের বসবাস এবং ওটেশিয়া ও আবখাজিয়া অঞ্চলে ১৫০০ রাশিয়ান বা রুশভাষীকে শাখাসভিলির সরকার হত্যা করে। তখন রাশিয়া তথা পুতিন আর ধৈর্য্য ধরতে পারেনি।
ঠিক তেমনি ইউক্রেন প্রশ্নেও ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারেনি। কারণ ইউক্রেনের ঘটনাবলি সব ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট লিওনিদ কুচমা তার উত্তরাধিকারী হিসেবে ২০০৪ সালে ইউক্রেনে নির্বাচনে ভিক্টর ইউনোকোভিচকে মনোনিত করেন। ইউনোকোভিচ জন্মগ্রহণ করেন দোনেৎস্ক অঞ্চলে এবং তিনি একজন রাশিয়া পন্থী। অন্যদিকে ভিক্টর ইউশেঙ্কো ইউরোপপন্থী এবং পশ্চিম ইউরোপের সহায়তাপুষ্ট। সেই নির্বাচন ছিল রীতিমতো প্রক্সি-ওয়ারের মত। উত্তর-পূর্ব ইউক্রেনের কৃষক এবং রুশ ভাষীরা সমর্থন করেন ইউনোকোভিচকে, আর দক্ষিন-পশ্চিম ইউক্রেনের লোকেরা ইউশেঙ্কোকে। উল্লেখ্য, ইউক্রেন এবং জর্জিয়া উভয় দেশেই পট পরিবর্তনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছিল ইউএস এইড এবং জর্জ সোরোসের এনজিও ওপেস সোসাইটি ফাউন্ডেশন।
ভিক্টর ইউশেঙ্কো ক্ষমতায় এসেই বুঝতে পারেন, বিশাল রাশিয়ার সঙ্গে ব্যালান্স করাটা জরুরি। এই ব্যালান্স করতে গিয়ে তাকে ক্ষমতা হারাতে হয়। ২০১০ সালে রাশিয়াপন্থী ইউনোকোভিচ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু ২০১৪ সালে মাইদান বিপ্লবের মাধ্যমে তাকে বিতাড়িত করা হয়। সে বিপ্লবের পেছনে ছিল ন্যাটোর বড় দেশগুলো বলে মস্কোর অভিযোগ। এরপর থেকেই একের পর এক রাশিয়া বিরোধী এবং পশ্চিমের প্রতি ভক্ত প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় আসতে থাকেন। তাদের সময়ে পূর্ব ইউক্রেনের রুশভাষীদের ওপর এমনকি গণহত্যাও চালানো হয়। সেই সঙ্গে ন্যাটোতে যোগদানের সম্ভাবনা প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে ওঠে। ফলে আরও একবার ধৈর্য্য হারান পুতিন। সর্বশেষ যা পরিস্থিতি তাতে জার্মান দার্শনিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের ১৯১৮ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘দ্য ডিক্লাইন অব দ্য ওয়েস্ট’ একটি উক্তি মনে করিয়ে দিচ্ছে। তিনি লিখেছেন, ‘পশ্চিমের দেশগুলো অনিবার্যভাবে অধপতনের দিকে যাবে এবং সেটা থামাতে তারা শক্তিপ্রয়োগের চেষ্টা করবে। পশ্চিম সভ্য হয়েছে, তবে কোনো নৈতিক শক্তি ছাড়াই।’
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
*লেখক: সাংবাদিক
পূর্ব ইউরোপের মাটিতে সাড়ে তিন বছর ধরে এক ভয়ানক যুদ্ধ চলছে, যার তাপ এসে দক্ষিণ গোলার্ধেও লাগছে। আমরা পশ্চিমের প্রভাবিত গণমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পারি, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে এ যুদ্ধ বাঁধিয়েছে। সুতরাং এ যুদ্ধের দায় রাশিয়া তথা পুতিনের।
তাই কি? ধরা যাক একটি বৃদ্ধ সিংহ কিছুটা অসুস্থ অবস্থায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। কয়েকটি হায়েনা গিয়ে ঘিরে ধরল। অনেক সময় সিংহকে অসুস্থ মনে করে হায়েনা তাই করে। তখন যদি সিংহ উঠে হায়েনাগুলোকে ধাওয়া করে এবং দু-একটি দুর্বল হায়েনা থাবার নাগালে পড়ে মৃত্যুবরণ করে, আপনি বলবেন, এ ঘটনার জন্য সিংহ এককভাবে দায়ী।
এক্সাক্টলি তাই ঘটছে ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে। বরং ঘটনাবলির দিকে গভীরভাবে নজর দিলে পরিষ্কার হয়ে উঠবে, পুতিন তথা রাশিয়া অনেক বেশি ধৈর্য্য ধরেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর প্রায় ৩০ বছর ধরে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, অন্যায় আচরণ এবং রাশিয়ান ফেডারেশনকে অস্তিত্বহীন করার ধুরন্ধর প্রচেষ্টা পুতিনকে শেষ পর্যন্ত ঠেলে দিয়েছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে। সঠিক কথাই বলেছেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফ্রি স্যাকস। তিনি বলেছেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নেয় রাশিয়ার সঙ্গে সহ অবস্থান নয়, বরং রাশিয়াকে পরাস্থ করার।’ তার কথা কতটা খাঁটি তা একটু পেছনে ফিরলেই পরিস্কার দেখা যায়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে যায় ১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর। কিন্তু ভাঙনের শব্দ শোনা যাচ্ছিল বছর কয়েক আগে থেকেই। বিশেষ করে মিখাইল গর্ভাচেভের গ্লাসনস্ত বা খোলা দুয়ার এবং পেরেস্ত্রইকা বা পুনর্গঠন সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকে। যা শুরু হয় ১৯৮৭ সালে। পূর্ব জার্মানি, পোল্যান্ডসহ পূর্ব-ইউরোপের দেশগুলো একে একে রাশিয়ার অবিভাবকত্ব ছেড়ে, সমাজতন্ত্র থেকে বের হয়ে যেতে থাকে। তখনই বোঝা যায় রাশিয়া নিজেও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে বের হতে প্রস্তত হচ্ছে।
অন্যদিকে ১৯৯১ সালের ৮ ডিসেম্বর বেলোভেজা অ্যাকোর্ড, যাকে মিনস্ক অ্যাকোর্ড বলা হয়, তা স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বেলারুশ ও ইউক্রেন বের হয়ে যায়। এই চুক্তি ছিল কমনওয়েলথ অব ইনডিপেন্ডেন্ট স্টেটস গঠনের পদক্ষেপ। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে তার অর্থনীতি কী হবে, সামরিক শক্তির কী হবে সেসব নিয়ে আগেই আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেটস জেমস বেকার সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্ভাচভের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট বা আমি কেউই চলমান শান্তি প্রক্রিয়া থেকে কোনো সুবিধা আদায় করতে চাই না। পুর্বদিকে ন্যাটো এক ইঞ্চি পরিমাণ জায়গায় প্রবেশ করবে না। আমেরিকা এটা বোঝে যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইউরোপের জন্য এটা কত গুরুত্বপূর্ণ।’ জবাবে গর্বাচেভ তখনকার পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট ভিটোল্ড জারুলেস্কির বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনা উপস্থিতি ইউরোপে স্থিতিশীলতা আনতে সহায়তা করবে।’
কিন্তু ঘটল তার উল্টো। ১৯৯৯ সালে প্রথমেই পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও চেক রিপাবলিক ন্যাটোতে যোগদান করে, বলা যায় করানো হয়। বরিস ইয়েলৎসিন, ভ্লাদিমির পুতিন ও মস্কোর নীতি নির্ধারকেরা ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। তারা এই সিদ্ধান্তকে প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন বলে আপত্তি জানান। তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজরসহ অন্য ন্যাটো নেতারা মৌখিক প্রতিশ্রুত দেন, ন্যাটো আর পূর্ব দিকে সম্প্রসারিত হবে না। কিন্তু তারা কোনো চুক্তিতে এলেন না। এরপর আবার ২০০৪ সালে একসঙ্গে বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া ও স্লোভেনিয়া; ২০০৯ সালে আলবেনিয়া ও ক্রোয়েশিয়া, ২০১৭ সালে মন্টেনিগ্রো, ২০২০ সালে উত্তর মেসিডোনিয়া, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ২০২৩ সালে ফিনল্যান্ড এবং ২০২৪ সালে সুইডেন ন্যাটোতে যোগ দেয়! ন্যাটো এগ্রিমেন্টে বারবার বিভিন্নভাবে বলা আছে, ন্যাটোর কোনো রাষ্ট্র অন্য কোনো রাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হলে পুরো ন্যাটো সামরিকভাবে সহায়তা করবে। লক্ষনীয় এই ন্যাটো রাশিয়াকে এমনকি ছোট ছোট দেশ দিয়ে ঘিরে ফেলেছে।
১৯৯৯ সালেই পুতিন ব্যাপারটি বুঝতে পারেন এবং তৎকালীন ন্যাটো প্রধান জর্জ রবার্টসনকে বলেন, ‘আমরা ন্যাটোতে কবে যোগ দিচ্ছি?’ রবার্টসন উত্তর দেন, ‘আমরা কাউকে দাওয়াত করি না, আমাদের কাছে আবেদন করতে হয় এবং অপেক্ষা করতে হয়।’ উত্তরে পুতিন বলেন, ‘ওই ছোট ছোট দেশের পেছনে লাইনে দাঁড়িয়ে ন্যাটোতে যোগদানের কোনো মানে হয় না।’
উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার কাজিমের্স ব্রিজিনিস্কি একটি ফরাসি ম্যাগাজিনকে সাক্ষাৎকার দিয়ে স্বীকার করেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ফেলতে এসব ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ট্র্যাপ।
ন্যাটো শুধু রাশিয়াকে ঘিরেই শান্ত হয়নি। ১৯৯৯ সালে চেচেন যুদ্ধ শুরু হয়, পুতিন দেখতে পান চেচেন যোদ্ধাদের পেছনে ন্যাটোর হাত। চেচেন গেরিলা নেতা ও স্বঘোষিত চেচেন রিপাবলিক অব ইচকেরিয়ার পররাস্ট্রমন্ত্রী ইলিয়াস আখমাদভের সঙ্গে গোপনে একের পর এক সাক্ষাৎ করেন পশ্চিম ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা। পরবর্তীতে জন ম্যাককেইন স্বীকার করেছেন, তার সঙ্গে আখমাদভের তিনবার দেখা হয়েছে। এই আকমাদভকে পরে যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়।
পুতিন বুঝতে পারেন, রাশিয়াকে দুর্বল ও অস্থিতিশীল করতে পশ্চিমারা ঘরে ঢুকে গেছে। তখনো পুতিন ধৈর্য্য ধরেছেন এবং বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সহযোগিতা করতে চেয়েছেন। যেমন, ২০০১ সালে আফগানিস্তান আক্রমণের আগে জর্জ বুশ জুনিয়র পুতিনের সহায়তা চান। কারণ তাজিকিস্তান, তুর্কেমিনিস্তান এবং উজবেকিস্তানের সহায়তা ছাড়া আফগানিস্তান দখল করা কঠিন। আর এই তিনটি দেশই পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। আফগানিস্তানে টেররিস্টদের দমনে পুতিন শুধু সহায়তাই করেননি, তার সামরিক কর্মকর্তাদের আদেশ দেন, ন্যাটোকে আফগান যুদ্ধের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে।
রাশিয়ার পাশের জর্জিয়ায় কী হয়েছিল? আমরা সবাই জানি, ২০০৮ সালে দুর্বল জর্জিয়ায় সবল রাশিয়া হামলা করেছে। কিন্তু পেছনের চিত্র ছিল অন্যরকম। ২০০৩ সালের নির্বাচনের আগে চার হাজার এনজিও সক্রিয় হয়ে ওঠে প্রেসিডেন্ট এডোয়ার্ড শেভার্দনাৎজেকে ক্ষমতাচ্যুত করতে। ওই নির্বাচন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করেছিল বিদেশি এনজিওগুলো। তারপরও ভোটে শেভার্দনাৎজে জয়লাভ করেন। বিরোধী নেতা মিখাইল শাখাসভিলি সে নির্বাচন না মেনে আন্দোলনে নামেন। পার্লামেন্টের সেশন শুরু হলে শাখাসভিলি বিপ্লবীদের নিয়ে ঢুকে পড়েন সেখানে, যাদের হাতে ছিল গোলাপ ফুল। অনেকগুলো ঘটনার পর শান্তির প্রত্যাশায় রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইগোর ইভানভকে পাঠায় মস্কো। শেভার্দনাৎজে পদত্যাগ করেন। শাখাসভিলি প্রেসিডেন্ট হন।
সম্পূর্ণ পশ্চিমা মানসিকতার শাখাসভিলি কিন্তু ইউক্রেনেরও নেতা। তাকে ২০১৫ সালে ওডেসার গভর্ণর নিয়োগ করেন ইউক্রেনের আরেক রাশিয়া বিরোধী প্রেসিডেন্ট পেরোশেঙ্কো। ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তাকে ‘দ্য এক্সিকিউটিভ কমিটি অব দ্য ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর রিফর্মস অব ইউক্রেন’–এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন। এই শাখাসভিলি প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ২০০৮ সালে সমস্ত জর্জিয়ায়, বিশেষ করে রাশিয়ার সীমান্তে শতশত পশ্চিমা গোয়েন্দা আবাস গড়ে তুলতে থাকে। যেখানে রুশভাষীদের বসবাস এবং ওটেশিয়া ও আবখাজিয়া অঞ্চলে ১৫০০ রাশিয়ান বা রুশভাষীকে শাখাসভিলির সরকার হত্যা করে। তখন রাশিয়া তথা পুতিন আর ধৈর্য্য ধরতে পারেনি।
ঠিক তেমনি ইউক্রেন প্রশ্নেও ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারেনি। কারণ ইউক্রেনের ঘটনাবলি সব ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট লিওনিদ কুচমা তার উত্তরাধিকারী হিসেবে ২০০৪ সালে ইউক্রেনে নির্বাচনে ভিক্টর ইউনোকোভিচকে মনোনিত করেন। ইউনোকোভিচ জন্মগ্রহণ করেন দোনেৎস্ক অঞ্চলে এবং তিনি একজন রাশিয়া পন্থী। অন্যদিকে ভিক্টর ইউশেঙ্কো ইউরোপপন্থী এবং পশ্চিম ইউরোপের সহায়তাপুষ্ট। সেই নির্বাচন ছিল রীতিমতো প্রক্সি-ওয়ারের মত। উত্তর-পূর্ব ইউক্রেনের কৃষক এবং রুশ ভাষীরা সমর্থন করেন ইউনোকোভিচকে, আর দক্ষিন-পশ্চিম ইউক্রেনের লোকেরা ইউশেঙ্কোকে। উল্লেখ্য, ইউক্রেন এবং জর্জিয়া উভয় দেশেই পট পরিবর্তনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছিল ইউএস এইড এবং জর্জ সোরোসের এনজিও ওপেস সোসাইটি ফাউন্ডেশন।
ভিক্টর ইউশেঙ্কো ক্ষমতায় এসেই বুঝতে পারেন, বিশাল রাশিয়ার সঙ্গে ব্যালান্স করাটা জরুরি। এই ব্যালান্স করতে গিয়ে তাকে ক্ষমতা হারাতে হয়। ২০১০ সালে রাশিয়াপন্থী ইউনোকোভিচ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু ২০১৪ সালে মাইদান বিপ্লবের মাধ্যমে তাকে বিতাড়িত করা হয়। সে বিপ্লবের পেছনে ছিল ন্যাটোর বড় দেশগুলো বলে মস্কোর অভিযোগ। এরপর থেকেই একের পর এক রাশিয়া বিরোধী এবং পশ্চিমের প্রতি ভক্ত প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় আসতে থাকেন। তাদের সময়ে পূর্ব ইউক্রেনের রুশভাষীদের ওপর এমনকি গণহত্যাও চালানো হয়। সেই সঙ্গে ন্যাটোতে যোগদানের সম্ভাবনা প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে ওঠে। ফলে আরও একবার ধৈর্য্য হারান পুতিন। সর্বশেষ যা পরিস্থিতি তাতে জার্মান দার্শনিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের ১৯১৮ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘দ্য ডিক্লাইন অব দ্য ওয়েস্ট’ একটি উক্তি মনে করিয়ে দিচ্ছে। তিনি লিখেছেন, ‘পশ্চিমের দেশগুলো অনিবার্যভাবে অধপতনের দিকে যাবে এবং সেটা থামাতে তারা শক্তিপ্রয়োগের চেষ্টা করবে। পশ্চিম সভ্য হয়েছে, তবে কোনো নৈতিক শক্তি ছাড়াই।’
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
*লেখক: সাংবাদিক
পুরাণমতে রাজা সুরথ প্রথম দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন। তিনি বসন্তে এই পূজার আয়োজন করায় একে বাসন্তী পূজা বলা হয়। কিন্তু রাবনের হাত থেকে সীতাকে উদ্ধার করতে লঙ্কা যাত্রার আগে রামচন্দ্র দেবীর পূজার আয়োজন করেন। শরৎকালে এই পূজা হয়। তাই এর নাম শারদীয় উৎসব।
ইউক্রেন যুদ্ধের ঘটনাবলির দিকে গভীরভাবে নজর দিলে পরিষ্কার হয়ে উঠবে, পুতিন তথা রাশিয়া অনেক বেশি ধৈর্য্য ধরেছে।
আঞ্চলিক সহযোগিতা এই অঞ্চলের সব মানুষের ভাগ্যের দুয়ার খুলে দিতে পারত। যেমন পেরেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। দক্ষিণ এশিয়ার বিশাল বাজার, জনশক্তি ও প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার এই অঞ্চলের দেশগুলোকে অর্থনৈতিক উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে পারে।
মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি ধর্মপ্রাণ হয়ে উঠতে পারেন আবার একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। এটি একটি সংবেদনশীল প্রশ্ন, তাই না…?