
শাহাবুদ্দিন শুভ

ভারতের মেঘালয়ের হৃদয়, সোহরা বা চেরাপুঞ্জি—যেখানে মেঘ নেমে আসে ছুঁয়ে দিতে, বৃষ্টি কথা বলে, আর পাহাড় গায় গানের সুর। এখানেই লুকিয়ে আছে ভারতের অন্যতম সুন্দর জলপ্রপাত নোহসিংথিয়াং ফলস, যা সবার কাছে পরিচিত সেভেন সিস্টার্স ফলস নামে। একদিন আমি আর আমার দুই প্রিয় বন্ধু ঠিক করলাম—শিলং শহর থেকে বেরিয়ে একটু অন্যরকম একদিন কাটাব, এই রূপকথার পাহাড়ি পথে। ফলাফল—একটি দিন, যা আজও স্মৃতির পাতায় সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

যাত্রার শুরু
২৪ ডিসেম্বর ২০২২, ভোরের আলোয় সিলেট শহর তখনো ঘুমিয়ে। সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিল আমাদের রোমাঞ্চকর যাত্রা। মূলত ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের শিলং যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হঠাৎ ভিসাজনিত সমস্যায় তারা আটকে যান। আমি যেহেতু আগের দিন ঢাকা থেকে সিলেটে পৌঁছে গিয়েছিলাম, তাই বন্ধু সৈয়দ রাসেল ও ইকবাল মুন্সি সিদ্ধান্ত নিলেন—আমরা তিনজনই যাচ্ছি মেঘালয়।
সকালেই সীমান্তে পৌঁছে দেখি, ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তারা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। কারণ, আগের দিনই জানানো হয়েছিল—সিলেট থেকে ২০ জনেরও বেশি সাংবাদিক যাচ্ছেন ভারতের ‘প্রকৃতির স্বর্গরাজ্য’ মেঘালয়ে। আমাদের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া মাত্রই আমরা পাড়ি দিলাম সেই কুয়াশায় মোড়া সীমান্তের ওপারে।
দুই পাশের ইমিগ্রেশন শেষ করে আমরা একটি প্রাইভেট গাড়িতে যাত্রা শুরু করলাম। রাস্তার দুই পাশে পাহাড়, ঝরনা আর মেঘের সারি। বিকেলের মধ্যে পৌঁছে গেলাম মেঘালয়ের রাজধানী ‘শিলং’–এর পুলিশ বাজারে, যেখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা আগে থেকেই করা ছিল। শহরজুড়ে বড়দিনের সাজসজ্জা—আলো, সংগীত আর হাসিমুখে ভরে ছিল পুরো পরিবেশ।

সোহরার পথে
২৫ ডিসেম্বর সকাল। শিলং তখনো হালকা কুয়াশায় মোড়া। হাতে গরম কফি, ব্যাগে ক্যামেরা, আর তিনজন সাংবাদিকের মুখে উৎসাহের ঝিলিক। আমরা ট্যাক্সি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম সোহরার (চেরাপুঞ্জি) পথে।
প্রায় দুই ঘণ্টার এই পথের প্রতিটি বাঁকেই যেন নতুন কোনো ছবির জন্ম হচ্ছিল। সবুজ পাহাড়, গভীর উপত্যকা, আর কখনো কখনো মেঘ এসে ছুঁয়ে যাচ্ছিল গাড়ির জানালা। পথের মাঝে থেমে স্থানীয় বিক্রেতার কাছ থেকে তাজা আনারস ও কলা কিনলাম—তার মিষ্টতা আজও মুখে লেগে আছে!
আমাদের গাড়িচালক, যিনি একইসঙ্গে ছিলেন এক দারুণ গল্পকথক, পথে পথে গাড়ি থামিয়ে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন আশপাশের দর্শনীয় স্থানগুলোর সঙ্গে। তার বর্ণনা শুনতে শুনতে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের স্বপ্নের ঠিকানায়—নোহসিংথিয়াং ফলস, অর্থাৎ বিখ্যাত সেভেন সিস্টার্স ফলস।

প্রকৃতির অপার মহিমা
প্রথম দর্শনেই আমরা নিঃশব্দ। যেন কথা হারিয়ে গেল মুহূর্তেই। পাহাড়ের বুক চিরে ৭টি ধারায় নিচে নেমে আসছে জলরাশি—দূর থেকে মনে হচ্ছিল, ৭ বোন হাত ধরে নেচে চলেছে বৃষ্টির সুরে। প্রায় ৩০০ মিটার উঁচু থেকে নেমে আসা সেই জলধারা সাদা ফেনায় ভরে নিচের বনে হারিয়ে যাচ্ছে—এক অলৌকিক দৃশ্য!
বর্ষাকালে (জুন থেকে সেপ্টেম্বর) এই জলপ্রপাত তার পূর্ণ রূপে ফেটে পড়ে। জলরাশির গর্জনে যেন পাহাড় কেঁপে ওঠে, আর সেই কম্পন মনে জাগায় এক গভীর প্রশান্তি। সূর্য যখন পশ্চিমে ঢলে পড়ে, তখন ঝরনার ওপর সোনালি আলো পড়ে পাহাড়টাকে রাঙিয়ে দেয় কমলা ও সোনার আভায়।
সেই মুহূর্তে আমরা তিনজনই স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম—মনে হচ্ছিল, সময় থেমে গেছে। আর ঠিক তখনই চোখের সামনে দেখা গেল এক বিস্ময়—আমাদের অনেক নিচ দিয়ে মেঘের সাদা শুভ্র দল উড়ে যাচ্ছে, যেন আমরা দাঁড়িয়ে আছি মেঘের ওপরেই! চোখ বন্ধ করলে মনে হচ্ছিল, আমরা উড়ে চলেছি কোনো স্বপ্নের রাজ্যে। এই অনুভূতিটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না—এটা কেবল অনুভবের জগতে সম্ভব।

নামের পেছনের গল্প
গাইড আমাদের নিয়ে গেলেন ঝরনার ধারে, মৃদু হাসি দিয়ে বললেন—“এই যে ৭টি ধারা একসঙ্গে নেমে আসছে পাহাড়ের বুক বেয়ে, এগুলোই উত্তর-পূর্ব ভারতের ৭ বোন রাজ্যের প্রতীক।” আমরা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম—প্রকৃতি যেন নিজেই এঁকে রেখেছে ঐক্যের এক প্রতীকচিহ্ন। সেই ৭ রাজ্য—অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরা—যাদের ভৌগোলিক অবস্থান আলাদা হলেও সংস্কৃতির শিকড় ও ঐতিহ্যের বন্ধন একই সুতায় গাঁথা।
গাইডের কণ্ঠে আমরা যেন শুনতে পেলাম সেই অঞ্চলের ইতিহাসের দীর্ঘ কাহিনি—সংগ্রাম, সহাবস্থান, ঐক্য আর বৈচিত্র্যের গল্প। এই ৭ ধারা তাই কেবল জল নয়, বরং ৭টি প্রাণ, ৭টি ভাষা, ৭টি সংস্কৃতি, আর ৭টি স্বপ্নের প্রতীক।
মেঘালয়ের মানুষ তাই ভালোবেসে একে ডাকে ‘সেভেন সিস্টার্স ফলস’—কারণ এটি শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, বরং উত্তর-পূর্ব ভারতের আত্মার এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। ঝরনার গর্জনের মধ্যে আমরা তিনজন যেন শুনতে পেলাম সেই ৭ রাজ্যের কণ্ঠস্বর, যারা ভিন্ন অথচ এক—যেন ৭ সুর মিলে তৈরি করেছে ভারতের উত্তর-পূর্বের এক চিরন্তন সিম্ফনি।
পাহাড়ের বিকেল
সন্ধ্যা নামছিল ধীরে ধীরে। আমরা তিনজন পাহাড়ের ধারে বসে গরম চায়ে চুমুক দিচ্ছিলাম। নিচে জলপ্রপাতের অনবরত শব্দ, ওপরে মেঘের ভেলা, সামনে ডুবন্ত সূর্যের কমলা আলো—একটা শান্ত, প্রশান্ত অনুভূতি ভর করেছিল মনে।
তখন মনে হচ্ছিল, প্রকৃতির সামনে মানুষ কত ছোট, অথচ কত আশীর্বাদপুষ্ট যে এমন সৌন্দর্য তার চোখে ধরা পড়ে।

কীভাবে যাবেন
শিলং শহর থেকে সোহরা (চেরাপুঞ্জি) যাওয়া যায় খুব সহজে। স্থানীয় ক্যাব, শেয়ারড ট্যাক্সি বা রিজার্ভ গাড়ি পাওয়া যায়। দূরত্ব প্রায় ৬০ কিলোমিটার, সময় লাগে প্রায় ২ ঘণ্টা। সোহরা থেকে ফলস পর্যন্ত প্রায় ২০ মিনিটের রাস্তা।
গুয়াহাটি বিমানবন্দর থেকে শিলং যেতে লাগে প্রায় ৩ ঘণ্টা (১০০ কিমি)। শিলং পৌঁছে সোহরার পথে গাড়ি ভাড়া নিতে পারেন। পুরো ভ্রমণ একদিনেই সম্ভব, তবে রাতে শিলংয়ে থাকলে অভিজ্ঞতাটা আরও উপভোগ্য হয়।
স্থানীয় গাইডের সাহায্য নিন: স্থানীয় ভাষা (খাসি) বোঝা ও পথের ইতিহাস জানতে একজন গাইড নেওয়া ভালো। অনেক গাইড ইংরেজিতেও পারদর্শী এবং তারা আপনাকে সেরা ভিউপয়েন্টগুলোতে নিয়ে যাবেন।

কখন যাবেন
সেভেন সিস্টার্স ফলস ভ্রমণের সেরা সময় জুন থেকে সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ বর্ষাকাল। তখন জলপ্রপাত থাকে তার পূর্ণ রূপে, আর আকাশে ভাসে রংধনু। তবে যারা রৌদ্রোজ্জ্বল দৃশ্য পছন্দ করেন, তাদের জন্য অক্টোবর থেকে মার্চ সময়টাও উপযুক্ত—তখন আকাশ থাকে পরিষ্কার এবং পাহাড়ের দৃশ্য আরও মনোরম।
কিছু দরকারি টিপস
রেইনকোট ও ছাতা সঙ্গে রাখুন—সোহরাতে হঠাৎ বৃষ্টি নামা খুব সাধারণ ব্যাপার।
ভেজা পাথরে সাবধানে হাঁটুন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বললে তাদের সংস্কৃতি ও গল্প জানা যায়।
সূর্যাস্তের মুহূর্তটি কখনো মিস করবেন না—এটাই ভ্রমণের সবচেয়ে জাদুকরী সময়।
শেষবিন্দু
ফিরতি পথে আমরা তিন বন্ধু গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম পাহাড়ের দিকে। আকাশে তখন মেঘের ভেলা, সূর্য ধীরে ধীরে ডুবছে। মনে হচ্ছিল, এই দিনটি যেন আমাদের বন্ধুত্বের গল্পের এক চিরস্থায়ী অধ্যায় হয়ে থাকবে।
সেভেন সিস্টার্স ফলস কেবল একটি জলপ্রপাত নয়—এটি এক অভিজ্ঞতা, যেখানে মানুষ, প্রকৃতি ও সম্পর্ক একসূত্রে গাঁথা।
যারা এখনো এই রূপকথার পাহাড়ে যাননি, একবার অন্তত যান—হয়তো সেখানেই খুঁজে পাবেন নিজের হারিয়ে যাওয়া শান্তিটা।
*লেখক ফ্রান্সপ্রবাসী ও প্রধান সম্পাদক, সিলেটপিডিয়া

ভারতের মেঘালয়ের হৃদয়, সোহরা বা চেরাপুঞ্জি—যেখানে মেঘ নেমে আসে ছুঁয়ে দিতে, বৃষ্টি কথা বলে, আর পাহাড় গায় গানের সুর। এখানেই লুকিয়ে আছে ভারতের অন্যতম সুন্দর জলপ্রপাত নোহসিংথিয়াং ফলস, যা সবার কাছে পরিচিত সেভেন সিস্টার্স ফলস নামে। একদিন আমি আর আমার দুই প্রিয় বন্ধু ঠিক করলাম—শিলং শহর থেকে বেরিয়ে একটু অন্যরকম একদিন কাটাব, এই রূপকথার পাহাড়ি পথে। ফলাফল—একটি দিন, যা আজও স্মৃতির পাতায় সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

যাত্রার শুরু
২৪ ডিসেম্বর ২০২২, ভোরের আলোয় সিলেট শহর তখনো ঘুমিয়ে। সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিল আমাদের রোমাঞ্চকর যাত্রা। মূলত ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের শিলং যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হঠাৎ ভিসাজনিত সমস্যায় তারা আটকে যান। আমি যেহেতু আগের দিন ঢাকা থেকে সিলেটে পৌঁছে গিয়েছিলাম, তাই বন্ধু সৈয়দ রাসেল ও ইকবাল মুন্সি সিদ্ধান্ত নিলেন—আমরা তিনজনই যাচ্ছি মেঘালয়।
সকালেই সীমান্তে পৌঁছে দেখি, ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তারা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। কারণ, আগের দিনই জানানো হয়েছিল—সিলেট থেকে ২০ জনেরও বেশি সাংবাদিক যাচ্ছেন ভারতের ‘প্রকৃতির স্বর্গরাজ্য’ মেঘালয়ে। আমাদের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া মাত্রই আমরা পাড়ি দিলাম সেই কুয়াশায় মোড়া সীমান্তের ওপারে।
দুই পাশের ইমিগ্রেশন শেষ করে আমরা একটি প্রাইভেট গাড়িতে যাত্রা শুরু করলাম। রাস্তার দুই পাশে পাহাড়, ঝরনা আর মেঘের সারি। বিকেলের মধ্যে পৌঁছে গেলাম মেঘালয়ের রাজধানী ‘শিলং’–এর পুলিশ বাজারে, যেখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা আগে থেকেই করা ছিল। শহরজুড়ে বড়দিনের সাজসজ্জা—আলো, সংগীত আর হাসিমুখে ভরে ছিল পুরো পরিবেশ।

সোহরার পথে
২৫ ডিসেম্বর সকাল। শিলং তখনো হালকা কুয়াশায় মোড়া। হাতে গরম কফি, ব্যাগে ক্যামেরা, আর তিনজন সাংবাদিকের মুখে উৎসাহের ঝিলিক। আমরা ট্যাক্সি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম সোহরার (চেরাপুঞ্জি) পথে।
প্রায় দুই ঘণ্টার এই পথের প্রতিটি বাঁকেই যেন নতুন কোনো ছবির জন্ম হচ্ছিল। সবুজ পাহাড়, গভীর উপত্যকা, আর কখনো কখনো মেঘ এসে ছুঁয়ে যাচ্ছিল গাড়ির জানালা। পথের মাঝে থেমে স্থানীয় বিক্রেতার কাছ থেকে তাজা আনারস ও কলা কিনলাম—তার মিষ্টতা আজও মুখে লেগে আছে!
আমাদের গাড়িচালক, যিনি একইসঙ্গে ছিলেন এক দারুণ গল্পকথক, পথে পথে গাড়ি থামিয়ে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন আশপাশের দর্শনীয় স্থানগুলোর সঙ্গে। তার বর্ণনা শুনতে শুনতে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের স্বপ্নের ঠিকানায়—নোহসিংথিয়াং ফলস, অর্থাৎ বিখ্যাত সেভেন সিস্টার্স ফলস।

প্রকৃতির অপার মহিমা
প্রথম দর্শনেই আমরা নিঃশব্দ। যেন কথা হারিয়ে গেল মুহূর্তেই। পাহাড়ের বুক চিরে ৭টি ধারায় নিচে নেমে আসছে জলরাশি—দূর থেকে মনে হচ্ছিল, ৭ বোন হাত ধরে নেচে চলেছে বৃষ্টির সুরে। প্রায় ৩০০ মিটার উঁচু থেকে নেমে আসা সেই জলধারা সাদা ফেনায় ভরে নিচের বনে হারিয়ে যাচ্ছে—এক অলৌকিক দৃশ্য!
বর্ষাকালে (জুন থেকে সেপ্টেম্বর) এই জলপ্রপাত তার পূর্ণ রূপে ফেটে পড়ে। জলরাশির গর্জনে যেন পাহাড় কেঁপে ওঠে, আর সেই কম্পন মনে জাগায় এক গভীর প্রশান্তি। সূর্য যখন পশ্চিমে ঢলে পড়ে, তখন ঝরনার ওপর সোনালি আলো পড়ে পাহাড়টাকে রাঙিয়ে দেয় কমলা ও সোনার আভায়।
সেই মুহূর্তে আমরা তিনজনই স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম—মনে হচ্ছিল, সময় থেমে গেছে। আর ঠিক তখনই চোখের সামনে দেখা গেল এক বিস্ময়—আমাদের অনেক নিচ দিয়ে মেঘের সাদা শুভ্র দল উড়ে যাচ্ছে, যেন আমরা দাঁড়িয়ে আছি মেঘের ওপরেই! চোখ বন্ধ করলে মনে হচ্ছিল, আমরা উড়ে চলেছি কোনো স্বপ্নের রাজ্যে। এই অনুভূতিটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না—এটা কেবল অনুভবের জগতে সম্ভব।

নামের পেছনের গল্প
গাইড আমাদের নিয়ে গেলেন ঝরনার ধারে, মৃদু হাসি দিয়ে বললেন—“এই যে ৭টি ধারা একসঙ্গে নেমে আসছে পাহাড়ের বুক বেয়ে, এগুলোই উত্তর-পূর্ব ভারতের ৭ বোন রাজ্যের প্রতীক।” আমরা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম—প্রকৃতি যেন নিজেই এঁকে রেখেছে ঐক্যের এক প্রতীকচিহ্ন। সেই ৭ রাজ্য—অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরা—যাদের ভৌগোলিক অবস্থান আলাদা হলেও সংস্কৃতির শিকড় ও ঐতিহ্যের বন্ধন একই সুতায় গাঁথা।
গাইডের কণ্ঠে আমরা যেন শুনতে পেলাম সেই অঞ্চলের ইতিহাসের দীর্ঘ কাহিনি—সংগ্রাম, সহাবস্থান, ঐক্য আর বৈচিত্র্যের গল্প। এই ৭ ধারা তাই কেবল জল নয়, বরং ৭টি প্রাণ, ৭টি ভাষা, ৭টি সংস্কৃতি, আর ৭টি স্বপ্নের প্রতীক।
মেঘালয়ের মানুষ তাই ভালোবেসে একে ডাকে ‘সেভেন সিস্টার্স ফলস’—কারণ এটি শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, বরং উত্তর-পূর্ব ভারতের আত্মার এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। ঝরনার গর্জনের মধ্যে আমরা তিনজন যেন শুনতে পেলাম সেই ৭ রাজ্যের কণ্ঠস্বর, যারা ভিন্ন অথচ এক—যেন ৭ সুর মিলে তৈরি করেছে ভারতের উত্তর-পূর্বের এক চিরন্তন সিম্ফনি।
পাহাড়ের বিকেল
সন্ধ্যা নামছিল ধীরে ধীরে। আমরা তিনজন পাহাড়ের ধারে বসে গরম চায়ে চুমুক দিচ্ছিলাম। নিচে জলপ্রপাতের অনবরত শব্দ, ওপরে মেঘের ভেলা, সামনে ডুবন্ত সূর্যের কমলা আলো—একটা শান্ত, প্রশান্ত অনুভূতি ভর করেছিল মনে।
তখন মনে হচ্ছিল, প্রকৃতির সামনে মানুষ কত ছোট, অথচ কত আশীর্বাদপুষ্ট যে এমন সৌন্দর্য তার চোখে ধরা পড়ে।

কীভাবে যাবেন
শিলং শহর থেকে সোহরা (চেরাপুঞ্জি) যাওয়া যায় খুব সহজে। স্থানীয় ক্যাব, শেয়ারড ট্যাক্সি বা রিজার্ভ গাড়ি পাওয়া যায়। দূরত্ব প্রায় ৬০ কিলোমিটার, সময় লাগে প্রায় ২ ঘণ্টা। সোহরা থেকে ফলস পর্যন্ত প্রায় ২০ মিনিটের রাস্তা।
গুয়াহাটি বিমানবন্দর থেকে শিলং যেতে লাগে প্রায় ৩ ঘণ্টা (১০০ কিমি)। শিলং পৌঁছে সোহরার পথে গাড়ি ভাড়া নিতে পারেন। পুরো ভ্রমণ একদিনেই সম্ভব, তবে রাতে শিলংয়ে থাকলে অভিজ্ঞতাটা আরও উপভোগ্য হয়।
স্থানীয় গাইডের সাহায্য নিন: স্থানীয় ভাষা (খাসি) বোঝা ও পথের ইতিহাস জানতে একজন গাইড নেওয়া ভালো। অনেক গাইড ইংরেজিতেও পারদর্শী এবং তারা আপনাকে সেরা ভিউপয়েন্টগুলোতে নিয়ে যাবেন।

কখন যাবেন
সেভেন সিস্টার্স ফলস ভ্রমণের সেরা সময় জুন থেকে সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ বর্ষাকাল। তখন জলপ্রপাত থাকে তার পূর্ণ রূপে, আর আকাশে ভাসে রংধনু। তবে যারা রৌদ্রোজ্জ্বল দৃশ্য পছন্দ করেন, তাদের জন্য অক্টোবর থেকে মার্চ সময়টাও উপযুক্ত—তখন আকাশ থাকে পরিষ্কার এবং পাহাড়ের দৃশ্য আরও মনোরম।
কিছু দরকারি টিপস
রেইনকোট ও ছাতা সঙ্গে রাখুন—সোহরাতে হঠাৎ বৃষ্টি নামা খুব সাধারণ ব্যাপার।
ভেজা পাথরে সাবধানে হাঁটুন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বললে তাদের সংস্কৃতি ও গল্প জানা যায়।
সূর্যাস্তের মুহূর্তটি কখনো মিস করবেন না—এটাই ভ্রমণের সবচেয়ে জাদুকরী সময়।
শেষবিন্দু
ফিরতি পথে আমরা তিন বন্ধু গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম পাহাড়ের দিকে। আকাশে তখন মেঘের ভেলা, সূর্য ধীরে ধীরে ডুবছে। মনে হচ্ছিল, এই দিনটি যেন আমাদের বন্ধুত্বের গল্পের এক চিরস্থায়ী অধ্যায় হয়ে থাকবে।
সেভেন সিস্টার্স ফলস কেবল একটি জলপ্রপাত নয়—এটি এক অভিজ্ঞতা, যেখানে মানুষ, প্রকৃতি ও সম্পর্ক একসূত্রে গাঁথা।
যারা এখনো এই রূপকথার পাহাড়ে যাননি, একবার অন্তত যান—হয়তো সেখানেই খুঁজে পাবেন নিজের হারিয়ে যাওয়া শান্তিটা।
*লেখক ফ্রান্সপ্রবাসী ও প্রধান সম্পাদক, সিলেটপিডিয়া
প্রবাসীরা দীর্ঘদিন থেকে জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হতে আইনি বিধানের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। নানা সময়ে তাদের আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। চব্বিশ পরবর্তী নতুন নির্বাচনী প্রেক্ষাপটে এই দাবি বাস্তবায়িত হবে বলে আশা ছিল প্রবাসীদের।
ইতিহাস এখানে মার্বেলের মতো ঠান্ডা,/ তবু তার ভিতরে বেজে ওঠে উষ্ণ নদীর ধ্বনি।/ একজন ভিয়েনীয় কবি জিজ্ঞেস করেন/ “তোমার নদীগুলো কি আজও গান গায়?”/ আমি হেসে বলি—/ “তারা এখনো ভালোবাসে, কিন্তু মুখে কিছু বলে না।”
ড্রোন নিয়মিত উড়িয়ে সড়ক, সেতু, স্কুল, হাসপাতালের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করা যায়। সময়ভিত্তিক ভিডিও ও জিওট্যাগড ছবির মাধ্যমে তদারকি সংস্থাগুলো সহজেই বুঝতে পারে কাজ সঠিক গতিতে এগোচ্ছে কি না।
বর্ষাকালে (জুন থেকে সেপ্টেম্বর) সোহরা জলপ্রপাত তার পূর্ণ রূপে ফেটে পড়ে। জলরাশির গর্জনে যেন পাহাড় কেঁপে ওঠে, আর সেই কম্পন মনে জাগায় এক গভীর প্রশান্তি। সূর্য যখন পশ্চিমে ঢলে পড়ে, তখন ঝরনার ওপর সোনালি আলো পড়ে পাহাড়টাকে রাঙিয়ে দেয় কমলা ও সোনার আভায়।