
শাহাবুদ্দিন শুভ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) একসময় নতুন আশার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। দীর্ঘদিনের দ্বিদলীয় রাজনীতির ক্লান্তি, আন্দোলনের ব্যর্থতা ও নেতৃত্ব সংকটের মধ্যে অনেক মানুষ এনসিপিকে ঘিরে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। বিশেষ করে ২০২৪ সালের আন্দোলনের পর নাহিদ ইসলামদের নেতৃত্বে যে নতুন রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে, তা বহু মানুষের মনে এই বিশ্বাস জন্ম দিয়েছিল, এবার হয়তো সত্যিই একটি বিকল্প রাজনীতির সূচনা হচ্ছে।
কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সেই আশার জায়গায় এখন প্রশ্ন, সংশয় ও হতাশা জমতে শুরু করেছে। প্রশ্নটা আজ আর ছোট নয়, এনসিপি কি ধীরে ধীরে অপ্রসঙ্গিক হয়ে পড়ছে, নাকি মানুষের মন থেকেই বিলীন হওয়ার পথে হাঁটছে?
সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “জামায়াত ও সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আমাদের কোনো আদর্শিক ঐক্য হয়নি, এটি কেবল একটি নির্বাচনী সমঝোতা।” এই বক্তব্যই এনসিপির রাজনীতির সবচেয়ে বড় আত্মবিরোধিতাকে উন্মোচিত করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যার সঙ্গে আদর্শিক মিল নেই, যার অতীত ও রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে সমাজে গভীর বিতর্ক ও আপত্তি রয়েছে, তার সঙ্গে কেবল নির্বাচনী সুবিধার জন্য জোটে যাওয়ার নৈতিক ও রাজনৈতিক যুক্তি কোথায়?
রাজনীতি শুধু আসন ভাগাভাগির অঙ্ক নয়। রাজনীতি আদর্শ, বিশ্বাস এবং জনগণের আস্থার বিষয়। এনসিপি যে জায়গা থেকে উঠে এসেছে, সেখানে তাদের মূল শক্তি ছিল অপরাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান, পুরনো শক্তির বাইরে একটি স্বতন্ত্র বিকল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ এবং নৈতিক উচ্চতার দাবি। কিন্তু জামায়াতের মতো একটি দলের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা সেই নৈতিক উচ্চতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশে এমন বিপুলসংখ্যক মানুষ আছেন, যারা আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির রাজনীতি পছন্দ করেন না, আবার একইসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিকেও সমর্থন করেন না। এই জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ এনসিপির দিকে ঝুঁকেছিল ঠিক এই কারণেই যে, তারা মনে করেছিল এনসিপি হবে পুরনো রাজনীতির বাইরে একটি নাগরিক, প্রগতিশীল ও নীতিনির্ভর শক্তি। জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার ঘোষণার মাধ্যমে এনসিপি কার্যত সেই জনগোষ্ঠীর আস্থার জায়গাতেই আঘাত করেছে।
সবচেয়ে বড় বৈপরীত্য হলো—২০২৪ সালের যে আন্দোলনের মাধ্যমে এনসিপির উত্থান, সেটি কোনো ধর্মভিত্তিক বা আদর্শগত জোটের ফসল ছিল না। সেটি ছিল ছাত্র, তরুণ, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। ১৭ বছর ধরে বহু রাজনৈতিক দল ও জোট যা করতে পারেনি, তা এই নতুন নেতৃত্ব করতে পেরেছিল। ফলে মানুষের প্রত্যাশাও ছিল ভিন্ন। তারা ভেবেছিল এনসিপি আপসের রাজনীতি নয়, বরং বিকল্প রাজনীতির প্রতীক হবে।
কিন্তু আজ যখন বলা হচ্ছে, “এটি আদর্শিক নয়, কেবল নির্বাচনী সমঝোতা”— তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যদি আদর্শ বিসর্জন দিতে হয়, তাহলে এনসিপি আর অন্যদের থেকে আলাদা থাকল কোথায়? এতে করে এনসিপি শুধু নিজের সঙ্গে নিজেই প্রতারণা করছে না, বরং সেই সব মানুষকেও বিভ্রান্ত করছে যারা তাদের ওপর ভর করে নতুন রাজনীতির স্বপ্ন দেখেছিল।

এই সংকটকে আরও গভীর করেছে দলটির ভেতরের ভাঙন। তাসনিম জারা ও তাজনূভা জাবীনের পদত্যাগ এনসিপির জন্য নিছক সাংগঠনিক ঘটনা নয়; এটি একটি শক্ত রাজনৈতিক বার্তা। বিশেষ করে তাসনিম জারার পদত্যাগ নিয়ে আলোচনা বেশি হওয়ার কারণ, তিনি ছিলেন এনসিপির সবচেয়ে দৃশ্যমান ও গ্রহণযোগ্য মুখগুলোর একজন। দল গঠনের পর থেকে গণমাধ্যম, আলোচনা সভা ও নাগরিক পরিসরে এনসিপির পরিচিতি তৈরিতে তাঁকে সচেতনভাবেই সামনে রাখা হয়েছিল।
তাসনিম জারা কোনো পেশাদার রাজনীতিবিদ ছিলেন না। বিদেশে একটি নিরাপদ ও প্রতিষ্ঠিত ক্যারিয়ার থাকা সত্ত্বেও তিনি দেশের টানে ফিরে এসেছিলেন। মহামারি-পরবর্তী সময়ে জনস্বাস্থ্য, নাগরিক সচেতনতা ও রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতা নিয়ে তার সক্রিয় ভূমিকা তাকে একটি নির্দলীয়, বিশ্বাসযোগ্য কণ্ঠে পরিণত করেছিল। এনসিপি সেই বিশ্বাসযোগ্যতাকেই রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করেছিল। ফলে তার পদত্যাগ কেবল ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়, এটি এনসিপির আদর্শিক সংকটের প্রতীক।
এ প্রেক্ষাপটে নাহিদ ইসলামের মন্তব্য, “কেউ দলে থাকবে কি না, সেটা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত”—নেতৃত্বের জায়গা থেকে দায়িত্ব এড়ানোর ভাষা বলেই মনে হয়। কারণ প্রশ্নটি ব্যক্তির নয়; প্রশ্নটি দলের সিদ্ধান্ত এমন কেন হলো, যার ফলে দলের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মুখগুলো সরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
২৮ ডিসেম্বর বাংলামোটরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নাহিদ ইসলাম বলেছেন, নির্বাহী পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে জামায়াতসহ আট দলের সঙ্গে সমঝোতার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা সবসময় নৈতিক বৈধতা নিশ্চিত করে না। ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্তই শেষ পর্যন্ত দলের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে।
তাসনিম জারা ও তাজনূভা জাবীনের পদত্যাগ, সঙ্গে আরও কয়েকজন নেতার প্রকাশ্য আপত্তি স্পষ্ট করে দেয়—এনসিপির ভেতরে আদর্শ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিয়ে গভীর ফাটল তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে নারী ও নাগরিক নেতৃত্বের এমন প্রস্থান এনসিপির জন্য বড় এক নেতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দেবে। তরুণ ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির আস্থা আরও দুর্বল হবে, আর ‘নতুন রাজনীতি’র যে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল, তা অনেকের চোখে ভেঙে পড়বে।
আজ এনসিপির সংকট শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক নয়; এটি অস্তিত্বের সংকট। মানুষ একসময় এনসিপিকে ঘিরে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল। এখন প্রশ্ন একটাই—এনসিপি কি সেই জনগণের প্রত্যাশার পথে আবার ফিরতে পারবে, নাকি অপ্রসঙ্গিক হয়ে থেকে ধীরে ধীরে মানুষের মন থেকেই বিলীন হয়ে যাবে?
এই প্রশ্নের উত্তর দেবে এনসিপির পরবর্তী সিদ্ধান্ত, আত্মসমালোচনার ক্ষমতা এবং আদর্শের প্রশ্নে তারা কতটা দৃঢ় থাকতে পারে—সেটিই।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
*লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) একসময় নতুন আশার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। দীর্ঘদিনের দ্বিদলীয় রাজনীতির ক্লান্তি, আন্দোলনের ব্যর্থতা ও নেতৃত্ব সংকটের মধ্যে অনেক মানুষ এনসিপিকে ঘিরে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। বিশেষ করে ২০২৪ সালের আন্দোলনের পর নাহিদ ইসলামদের নেতৃত্বে যে নতুন রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে, তা বহু মানুষের মনে এই বিশ্বাস জন্ম দিয়েছিল, এবার হয়তো সত্যিই একটি বিকল্প রাজনীতির সূচনা হচ্ছে।
কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সেই আশার জায়গায় এখন প্রশ্ন, সংশয় ও হতাশা জমতে শুরু করেছে। প্রশ্নটা আজ আর ছোট নয়, এনসিপি কি ধীরে ধীরে অপ্রসঙ্গিক হয়ে পড়ছে, নাকি মানুষের মন থেকেই বিলীন হওয়ার পথে হাঁটছে?
সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “জামায়াত ও সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আমাদের কোনো আদর্শিক ঐক্য হয়নি, এটি কেবল একটি নির্বাচনী সমঝোতা।” এই বক্তব্যই এনসিপির রাজনীতির সবচেয়ে বড় আত্মবিরোধিতাকে উন্মোচিত করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যার সঙ্গে আদর্শিক মিল নেই, যার অতীত ও রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে সমাজে গভীর বিতর্ক ও আপত্তি রয়েছে, তার সঙ্গে কেবল নির্বাচনী সুবিধার জন্য জোটে যাওয়ার নৈতিক ও রাজনৈতিক যুক্তি কোথায়?
রাজনীতি শুধু আসন ভাগাভাগির অঙ্ক নয়। রাজনীতি আদর্শ, বিশ্বাস এবং জনগণের আস্থার বিষয়। এনসিপি যে জায়গা থেকে উঠে এসেছে, সেখানে তাদের মূল শক্তি ছিল অপরাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান, পুরনো শক্তির বাইরে একটি স্বতন্ত্র বিকল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ এবং নৈতিক উচ্চতার দাবি। কিন্তু জামায়াতের মতো একটি দলের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা সেই নৈতিক উচ্চতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশে এমন বিপুলসংখ্যক মানুষ আছেন, যারা আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির রাজনীতি পছন্দ করেন না, আবার একইসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিকেও সমর্থন করেন না। এই জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ এনসিপির দিকে ঝুঁকেছিল ঠিক এই কারণেই যে, তারা মনে করেছিল এনসিপি হবে পুরনো রাজনীতির বাইরে একটি নাগরিক, প্রগতিশীল ও নীতিনির্ভর শক্তি। জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার ঘোষণার মাধ্যমে এনসিপি কার্যত সেই জনগোষ্ঠীর আস্থার জায়গাতেই আঘাত করেছে।
সবচেয়ে বড় বৈপরীত্য হলো—২০২৪ সালের যে আন্দোলনের মাধ্যমে এনসিপির উত্থান, সেটি কোনো ধর্মভিত্তিক বা আদর্শগত জোটের ফসল ছিল না। সেটি ছিল ছাত্র, তরুণ, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। ১৭ বছর ধরে বহু রাজনৈতিক দল ও জোট যা করতে পারেনি, তা এই নতুন নেতৃত্ব করতে পেরেছিল। ফলে মানুষের প্রত্যাশাও ছিল ভিন্ন। তারা ভেবেছিল এনসিপি আপসের রাজনীতি নয়, বরং বিকল্প রাজনীতির প্রতীক হবে।
কিন্তু আজ যখন বলা হচ্ছে, “এটি আদর্শিক নয়, কেবল নির্বাচনী সমঝোতা”— তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যদি আদর্শ বিসর্জন দিতে হয়, তাহলে এনসিপি আর অন্যদের থেকে আলাদা থাকল কোথায়? এতে করে এনসিপি শুধু নিজের সঙ্গে নিজেই প্রতারণা করছে না, বরং সেই সব মানুষকেও বিভ্রান্ত করছে যারা তাদের ওপর ভর করে নতুন রাজনীতির স্বপ্ন দেখেছিল।

এই সংকটকে আরও গভীর করেছে দলটির ভেতরের ভাঙন। তাসনিম জারা ও তাজনূভা জাবীনের পদত্যাগ এনসিপির জন্য নিছক সাংগঠনিক ঘটনা নয়; এটি একটি শক্ত রাজনৈতিক বার্তা। বিশেষ করে তাসনিম জারার পদত্যাগ নিয়ে আলোচনা বেশি হওয়ার কারণ, তিনি ছিলেন এনসিপির সবচেয়ে দৃশ্যমান ও গ্রহণযোগ্য মুখগুলোর একজন। দল গঠনের পর থেকে গণমাধ্যম, আলোচনা সভা ও নাগরিক পরিসরে এনসিপির পরিচিতি তৈরিতে তাঁকে সচেতনভাবেই সামনে রাখা হয়েছিল।
তাসনিম জারা কোনো পেশাদার রাজনীতিবিদ ছিলেন না। বিদেশে একটি নিরাপদ ও প্রতিষ্ঠিত ক্যারিয়ার থাকা সত্ত্বেও তিনি দেশের টানে ফিরে এসেছিলেন। মহামারি-পরবর্তী সময়ে জনস্বাস্থ্য, নাগরিক সচেতনতা ও রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতা নিয়ে তার সক্রিয় ভূমিকা তাকে একটি নির্দলীয়, বিশ্বাসযোগ্য কণ্ঠে পরিণত করেছিল। এনসিপি সেই বিশ্বাসযোগ্যতাকেই রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করেছিল। ফলে তার পদত্যাগ কেবল ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়, এটি এনসিপির আদর্শিক সংকটের প্রতীক।
এ প্রেক্ষাপটে নাহিদ ইসলামের মন্তব্য, “কেউ দলে থাকবে কি না, সেটা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত”—নেতৃত্বের জায়গা থেকে দায়িত্ব এড়ানোর ভাষা বলেই মনে হয়। কারণ প্রশ্নটি ব্যক্তির নয়; প্রশ্নটি দলের সিদ্ধান্ত এমন কেন হলো, যার ফলে দলের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মুখগুলো সরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
২৮ ডিসেম্বর বাংলামোটরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নাহিদ ইসলাম বলেছেন, নির্বাহী পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে জামায়াতসহ আট দলের সঙ্গে সমঝোতার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা সবসময় নৈতিক বৈধতা নিশ্চিত করে না। ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্তই শেষ পর্যন্ত দলের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে।
তাসনিম জারা ও তাজনূভা জাবীনের পদত্যাগ, সঙ্গে আরও কয়েকজন নেতার প্রকাশ্য আপত্তি স্পষ্ট করে দেয়—এনসিপির ভেতরে আদর্শ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিয়ে গভীর ফাটল তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে নারী ও নাগরিক নেতৃত্বের এমন প্রস্থান এনসিপির জন্য বড় এক নেতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দেবে। তরুণ ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির আস্থা আরও দুর্বল হবে, আর ‘নতুন রাজনীতি’র যে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল, তা অনেকের চোখে ভেঙে পড়বে।
আজ এনসিপির সংকট শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক নয়; এটি অস্তিত্বের সংকট। মানুষ একসময় এনসিপিকে ঘিরে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল। এখন প্রশ্ন একটাই—এনসিপি কি সেই জনগণের প্রত্যাশার পথে আবার ফিরতে পারবে, নাকি অপ্রসঙ্গিক হয়ে থেকে ধীরে ধীরে মানুষের মন থেকেই বিলীন হয়ে যাবে?
এই প্রশ্নের উত্তর দেবে এনসিপির পরবর্তী সিদ্ধান্ত, আত্মসমালোচনার ক্ষমতা এবং আদর্শের প্রশ্নে তারা কতটা দৃঢ় থাকতে পারে—সেটিই।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
*লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আজ যখন বলা হচ্ছে, “এটি আদর্শিক নয়, কেবল নির্বাচনী সমঝোতা”— তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যদি আদর্শ বিসর্জন দিতে হয়, তাহলে এনসিপি আর অন্যদের থেকে আলাদা থাকল কোথায়?
হাহাকার টইটুম্বুর এই জীবন,/ আমি দুপুরের প্রখর/ সোনালি বিকেল/ আমি সন্ধ্যার তারা/ বিছানার গন্ধ
নেলসন ম্যান্ডেলা দীর্ঘ কারাবাসের পর প্রতিশোধ নয়, সমঝোতার রাজনীতি বেছে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে এগিয়ে নিয়েছিলেন। ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নির্বাসন ও প্রত্যাবর্তন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কাঠামোই বদলে দেয়। প্রত্যাবর্তন কখনো স্থিতি আনে, কখনো নতুন সংকট সৃষ্টি করে।
যারা মনে করেন শক্ত হাতে শাসনই স্থিতিশীলতা আনে, তারা ভুলে যান—দমন দিয়ে নীরবতা আনা যায়, কিন্তু আস্থা তৈরি করা যায় না। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে, ভয়ভিত্তিক ও ব্যক্তিনির্ভর শাসনব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদে টেকে না। কারণ সেখানে ভুল সংশোধনের শান্তিপূর্ণ পথ এবং ক্ষমতার ওপর কার্যকর নজরদারি থাকে না।