
হিমু আকরাম

নদীর পাড়ে বটগাছ। পাতার ফাঁক ফোকর দিয়ে পৌষের রোদ নেমেছে মাটিতে। অল্প কিছু পাকা বটফল এখনো রয়ে গেছে। সেই ফল খেতে ঝগড়ায় লিপ্ত হরিয়াল আর কাঠশালিকের দল। দূর থেকে বেলবাটির টুং টাং শব্দ ভেসে আসে। ডাক পিয়ন বেনু সওদাগর সাইকেল চালিয়ে হারিয়ে যায় বটতলার বাঁকে।
তার কাঁধে চিঠির ঝোলা। মনের মধ্যে নানান কথা—‘৩০ বছর ধরে চিঠি বিলি করলাম। কত মুখ, কত কান্না, কত আশা। কিন্তু... আমার নিজের কথাগুলো কখনো কেউ পড়েনি। অন্যের খবর, আশা, অভিমান, প্রেম... সবই ছিল অন্যের। আমার কিছু ছিল না। আগামী পরশু চাকরিতে শেষ দিন... আর আমার নিজের শুরু।’
অফিস ঘরের পুরনো জানালার খড়খড়ি তুলতেই আলো এসে পড়ে বেনুর মুখে। ৬২ বছরের শুকনো মুখ।
কাঁচা পাকা চুল। চোখে ক্লান্তির ছাপ।
আলমারির পেছন থেকে একটি পুরনো, ধুলো জমা বাক্স টেনে বের করে বেনু। বাক্স খুলতেই ভেসে ওঠে কিছু চিঠি। পোস্ট কার্ড। যেগুলো বিলি হয়নি কখনো। অনেক পুরোনো। একটার সাল ১৯৯৭।
চায়ের দোকানে তখন আলোচনা বেনুর রিটায়ারমেন্ট নিয়ে। রইস উদ্দিন হাসতে হাসতে বলেন, “ভালো সময়েই অবসর নিছেন জেঠা! এখন আর চিঠির দরকার নেই, সবাই হোয়াটসঅ্যাপে প্রেম করে!”
তবারক লাঠি বিস্কুট চুবিয়ে খেতে খেতে হেসে ওঠে।
তবে বেনু সওদাগর এখনো মনে রাখেন কার বাড়িতে কয়টা কুকুর আছে!
বেনু ঘোলা চোখে তবারকের দিকে তাকায়। চশমার কাচে ধুলো জমেছে অনেক। মানুষের মতো চশমাও কি বুড়ো হয়? বেনু বিড়বিড় করে বলে,"চিঠির কালি শুকিয়ে গেলেও, মানুষের অপেক্ষা শুকোয় না...!"
তবারক হাসে। বুঝে অথবা না বুঝে।
বেনু চুপচাপ চা খায়। রইসের রেডিওতে আব্দুল আলিমের গান বাজে।
“পিঞ্জিরার পাখির মতো
আমি তারে উইরা যাইয়া দেখি
কোথায় গো আমার কালো পাখি।।
শিকল কাটিয়া গিয়াছে উড়িয়া
গিয়াছে কোন অজানা দেশে
আমারে ভুলিয়া কার প্রেমে মজিয়া
কেবল আমারে বানাইলো চির দুখী।।”
অফিস ঘরের পুরনো জানালার খড়খড়ির সামনে দাড়িয়ে বেনু। তার হাতে এক মায়ের চিঠি। যে চিঠি কখনো বিলি হয়নি। ২৫ বছর আগে লেখা,"মেয়ে যদি কষ্ট দেয়, সেই কষ্ট কি ঠিক কাগজে লেখা যায়?
তুই চলে যাওয়ার পর প্রতিদিন তোর মুখটাই খুঁজি। ক্ষমা করে দিলাম। দেখতে আসবি মাকে...!"
বেনু সওদাগর চিঠির ব্যাগ কাধে নিয়ে সাইকেল চালিয়ে যায়। তার চোখে-মুখে অনুতাপ। বেনুর কানে ভাসছে চিঠির কথাগুলো। ঘর পালানো মেয়েকে উদ্দেশ করে মায়ের কথাগুলো।
পুরনো এক বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বেনু। ঘুলঘুলিতে ঝগড়া করে ধূসর চড়ুই। বাতাসে ভেসে বেড়ায় শিমুলের তুলো। বেনু দরজায় কড়া নাড়ে। দরজা খোলে এক বৃদ্ধা নারী। সেই মেয়ে এখন বৃদ্ধা হয়েছে। বেনু চিঠি দিয়ে চুপচাপ চলে যায়। বৃদ্ধা নারী চিঠি খুলে পড়ার পর কাঁদে,"মা... তুমি লিখেছিলা? এত বছর কেন আসেনি এই চিঠি। কেন লুকিয়ে রেখেছিল...!"
দুই.
লাইব্রেরিতে বসে বৃদ্ধ আতাউর চিঠি লেখে। মাথার ওপর কান্নার মতো শব্দ তুলে ঘুরতে থাকে সিলিং ফ্যান,
"শেষবার তোর মুখ আমি দেখেছিলাম নদীর ধারে, যেদিন তুই আমার বই ছিঁড়ে ছুড়ে ফেলেছিলি।
তুই রাগ করেছিলি, আর আমি অভিমান!"
সিলিং ফ্যানটা ঘুরতেই থাকে। দূরের রাস্তায় হেঁটে যায় হাওয়াই মিঠাইওয়ালা। তার হাতে ঘন্টা বাজে টুং টুং টুং।
বেনু নদীর পাড়ে বসে থাকে। একটা পানকৌড়ি টুপ করে ডুবে যায় কালো জলে। বেনুর হাতে আতাউরের চিঠি। তার কানে বাজে আতাউরের কথাগুলো,"সেদিন রাতেই আমি তোকে মাফ করে দিয়েছিলাম।
তোকে আবার ডাকার সাহস হয়নি, শুধু একবার চেয়েছিলাম তোকে পাশে বসাতে, নীরবে। কোনো অভিযোগ ছাড়াই!"
জলের গভীর থেকে পানকৌড়িটা ওঠে। খালি ঠোঁটেই উড়ে যায় বহুদূর।
আতাউরের পুরনো বাড়ি। বেনু দাঁড়ানো দরজার সামনে। দরজায় তালা। চারপাশে স্তব্ধতা। তখন এক বৃদ্ধ এসে দাঁড়ায়,"তিন মাস হয়ে গেল। আতাউর আর নেই বাবা…। ক্যানসার। চলে গেল একা একা…!"
দূরে কোথাও একটা কাঠ ঠোকরা ঠক ঠক শব্দে কাঠ কাটে। বেনু সওদাগরের কাঁপা হাত চিঠিতে থমকে থাকে। মুখ পাথরের মতো স্থির। সে ধীরে ধীরে খালি বারান্দায় গিয়ে বসে। অযত্নে পড়ে আছে পুরনো কেরাম বোর্ড। ধুলোমাখা। এক কোণে রোদ পড়ে আছে নিঃশব্দে। বেনু চিঠিতে চোখ বুলায়। এই প্রথম শেষ লাইনগুলো পড়ে, "যদি পারিস, মৃত্যুর আগেই চলে আয়। তোর মুখ দেখে গেলে, মনে হবে জীবনের সবকিছু বৃথা যায়নি।
পুনশ্চ: এই চিঠির কাগজে হয়তো তোর স্পর্শ পড়বে না কখনও...
রাগ যে অনেকটা শীতের কুয়াশার মতো,দূরত্ব ঢাকা দেয়, ছোঁয়ার আগেই মিলিয়ে যায়। তবু কিছু শব্দ রেখে গেলাম বাতাসে ভাসিয়ে—যদি কোনো একলা বিকেলে তুই হঠাৎ কান পেতে শুনিস আমার নীরবতা!"
বেনুর চোখ জলে ভরে। একা একাই কথা বলে মৃত বন্ধুর সাথে, "তুই মাফ করেছিলি…কিন্তু আমি করিনি,বন্ধু। তোকে না বলেই আমি অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম। আর আজ এলাম…যখন তুই আর ডাকতে পারিস না।"
খামওয়ালাদের কান্না বলে কিছু নাই জেনেও চোখ মোছে বেনু। উঠে দাঁড়ায় কেরাম বোর্ডের কাছে। ওপরে একটি সাদা গুটি রাখে, যেন অনেক অনুচ্চারিত কথা রেখে গেল বন্ধুর জন্য,"আজ খেলি না বন্ধু…হেরে গেছি আগেই!"
তিন.
জলপাই গাছের নিচে আলপনা এঁকেছে বিকেলের মরা রোদ। সেখানেই শিউলির ঘর। সেই ঘরে থাকতে চেয়েছিল মুকিত নামের বোকা ছেলেটি। এখন সেখানে থাকে শিউলি আর তার পুরনো সেলাই মেশিন। সেলাই মেশিনের শব্দ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কাজ করে শিউলি। তার সামনে এসে দাঁড়ায় বেনু। হাতে হলুদ খাম। বাড়িয়ে দিয়ে বলে, মুকিতের চিঠি। ১১ বছর আগের লেখা।
শিউলির ঠোট কাঁপে। চিঠি পেয়ে মেয়েটি স্তব্ধ। তার চোখ জলে ভরে যায়।
মেঠো পথ ধরে সাইকেল চালিয়ে যায় বেনু। তার কানে বাজে আত্মহত্যা করার আগে মুকিতের লেখা শেষ চিঠির কথাগুলো, "তুমি বলেছিলে, আমার জন্য তুমি জীবন দেবেও না, নেবেও না। আমি রাখলাম কথা। শুধু চলে যাচ্ছি, চিরতরে...ভালো থেকো, শিউলি।"
বটগাছের নিচ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে যায় বেনু। তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে সেই দৃশ্য, যেখানে গামছা দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলছিল মুকিতের দেহ। পা দুটো তখনও দুলছিল। যেমন দোল খায় সোনালু ফুল, জ্যৈষ্ঠের গোপন দুপুরে!
শিউলি চোখ ভেজায়। চিঠিটা নাকের কাছে এনে ঘ্রান নেয়, “ও মরে যায়নি… মরেছিল এই চিঠিটা। সময়মতো এলে…হয়তো বাঁচত ও।”
চার.
বেনুর ঘর। কাঠের টেবিলের ওপর ফ্রেমে বাঁধা মানুর ছবি। কলেজ ড্রেসে হাসিমুখে মানু। বেনুর হাতে একটা হলুদ খাম। সে খামের দিকে তাকিয়ে থাকে।
"এ চিঠি আমি কাকে দেব? আমার নিজের ছেলেকে? সে তো গেছে... চলে গেছে রাগ নিয়ে,অভিমান নিয়ে। আমি তো কখনও বলিনি তাকে... আমি ভালোবাসি তোকে। বিয়ে আমি করেছিলাম, তবে সংসারী হবার জন্য নয়। সমাজে একজন ধর্ষিতা নারীকে সন্মান দিতে।"
চিঠিতে হয়তো সেই কথাটুকুই লেখা ছিল। টেবিলে হলুদ চিঠির খামটা রাখে বেনু। খামের ওপরে স্পষ্ট পোস্ট অফিসের সিল দেওয়া তারিখ। ডাক টিকিট। চিঠিটা সে লিখেছিল ৯ বছর আগে। কিন্তু ছেলেকে কখনো পোস্ট করা হয়নি সেই চিঠি।
ডাক পিয়ন বেনু সওদাগর এবার সিদ্ধান্ত নেয় চাকরির শেষ দিনে শেষ চিঠিটা নিজের হাতেই বিলি করবে তার একমাত্র পুত্র মানু সওদাগরের হাতে। বেনু মোটা ফ্রেমের চশমাটা পরে। জানালার বাইরে ঝুলে থাকে আতাফল গাছের ডাল। অন্ধকারে মিটিমিটি জ্বলে কিছু জোনাকি। দূর থেকে ভেসে আসে শিয়ালের ডাক, বেনুর কাছে কান্না বলে মনে হয়।
ট্রেনটা ছুটে চলে পাহাড়ের গা ঘেসে। বেনু জানালার ধারে বসা। একে একে পেছনে চলে যায় চা বাগান, সাঁওতালের দল, লাল ইটের ব্রিজ। পেছনে চলে যায় ডাক পিয়ন বেনু সওদাগরের স্মৃতিও।
৯ বছর আগের বেনুর ঘর। কাঠের টেবিলের ওপর ফ্রেমে বাধা মানুর ছবি। টেবিলে মিটমিট করে জ্বলে হারিকেন। বেনু ছেলের কাছে চিঠি লেখে।
"মানু,আমি জানি, আমি কখনও তোকে ‘ভালোবাসি’ বলিনি।
আমি জানি, মা-কে হারানোর পর তুই আমায় দোষ দিয়েছিলি। মানতে পারিসনি মায়ের জায়গায় অন্য একজনকে। জানিস, সেই অন্য একজনও তোর মায়ের মতো হারিয়ে গেছে। তুই জানিস না কতকিছু! না জেনেই আর কোনোদিন বাবার কাছে ফিরে আসিসনি। আমি তোর খেলার মাঠে গিয়েছিলাম চুপিচুপি…। আমি তোকে দেখতে গিয়েছিলাম মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায়…আমি তোকে ভালোবাসি, রে। তুই হয়তো শুনতে পাবি না, তবুও বলছি—তুই আমার ছেলে, আমি তোকে ভালোবাসি।"
ছেলের বাসার দরজায় গিয়ে দাঁড়ায় ডাকপিয়ন বেনু। দরজা খোলে মানু। এখন ৩৮ বছরের ডাক্তার। দুজনই দীর্ঘ সময় চুপ। বেনু শুধু খামটা এগিয়ে দিয়ে বলে, “এটা…পৌঁছে দিতে পারিনি সময়মতো।”
ছেলের হাতে হলুদ খামটা দিয়ে চলে যায় বেনু। মানু চিঠির খামটার দিকে তাকায়। পোস্ট অফিসের সিল আর তারিখটা নয় বছর আগের। ধীরে ধীরে চিঠিটা পড়ে মানু। কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। চোখে জল জমে।
ডাক পিয়ন বেনু তখন কুঁজো হয়ে হাঁটে। সরকারি কোয়াটারের বাঁকা গলিতে মিলে যাচ্ছিল সে। মানু দৌড়ে রাস্তায় নামে। চিৎকার করে বাবাকে ডাকে, "বাবা!"
বেনুর পা থেমে যায়। পেছনে তাকালে ঘোলা চোখে মানুকে দেখে। দূরে দাঁড়ানো। কাছে আসে মানু। বাবার বুকের কাছে দাঁড়ায়, গলা কাঁপে—"তুমি তো কোনোদিন বলোনি...বাবা…!"
বেনু মাথা নিচু করে। দূরে কোথাও ট্রেনের হুইসেল বাজে, "আমি চিঠি বিলি করতাম। কিন্তু নিজের কথাগুলো কখনো পৌঁছে দিতে পারিনি...।"
মানু এগিয়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। দুজনের চোখেই জল। দূর থেকে গানের কথা ভেসে আসে। গাইছে অন্ধ কোনো ভিখারী, "যদিগো পাইতাম হৃদয়ে বসাইতাম, শুনিতাম মধুরও বুলি... "
গোধূলির আলোয় গ্রাম ডুবে যায় বিষণ্ণতায়। দারুচিনি গাছের পাতা ওড়ে বাতাসে। হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে দূরের পাহাড়ে নদীতে! এক কুঁজো বৃদ্ধ ডাকপিয়ন হাঁটতে থাকে ধীর পায়ে।
সব চিঠি সময়মতো পৌঁছে না।
তবুও একদিন পৌঁছালে তার ওজন থাকে। চিঠির ওজন…
অনুভবের ওজন…
সম্পর্কের ওজন।
*লেখক যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী

নদীর পাড়ে বটগাছ। পাতার ফাঁক ফোকর দিয়ে পৌষের রোদ নেমেছে মাটিতে। অল্প কিছু পাকা বটফল এখনো রয়ে গেছে। সেই ফল খেতে ঝগড়ায় লিপ্ত হরিয়াল আর কাঠশালিকের দল। দূর থেকে বেলবাটির টুং টাং শব্দ ভেসে আসে। ডাক পিয়ন বেনু সওদাগর সাইকেল চালিয়ে হারিয়ে যায় বটতলার বাঁকে।
তার কাঁধে চিঠির ঝোলা। মনের মধ্যে নানান কথা—‘৩০ বছর ধরে চিঠি বিলি করলাম। কত মুখ, কত কান্না, কত আশা। কিন্তু... আমার নিজের কথাগুলো কখনো কেউ পড়েনি। অন্যের খবর, আশা, অভিমান, প্রেম... সবই ছিল অন্যের। আমার কিছু ছিল না। আগামী পরশু চাকরিতে শেষ দিন... আর আমার নিজের শুরু।’
অফিস ঘরের পুরনো জানালার খড়খড়ি তুলতেই আলো এসে পড়ে বেনুর মুখে। ৬২ বছরের শুকনো মুখ।
কাঁচা পাকা চুল। চোখে ক্লান্তির ছাপ।
আলমারির পেছন থেকে একটি পুরনো, ধুলো জমা বাক্স টেনে বের করে বেনু। বাক্স খুলতেই ভেসে ওঠে কিছু চিঠি। পোস্ট কার্ড। যেগুলো বিলি হয়নি কখনো। অনেক পুরোনো। একটার সাল ১৯৯৭।
চায়ের দোকানে তখন আলোচনা বেনুর রিটায়ারমেন্ট নিয়ে। রইস উদ্দিন হাসতে হাসতে বলেন, “ভালো সময়েই অবসর নিছেন জেঠা! এখন আর চিঠির দরকার নেই, সবাই হোয়াটসঅ্যাপে প্রেম করে!”
তবারক লাঠি বিস্কুট চুবিয়ে খেতে খেতে হেসে ওঠে।
তবে বেনু সওদাগর এখনো মনে রাখেন কার বাড়িতে কয়টা কুকুর আছে!
বেনু ঘোলা চোখে তবারকের দিকে তাকায়। চশমার কাচে ধুলো জমেছে অনেক। মানুষের মতো চশমাও কি বুড়ো হয়? বেনু বিড়বিড় করে বলে,"চিঠির কালি শুকিয়ে গেলেও, মানুষের অপেক্ষা শুকোয় না...!"
তবারক হাসে। বুঝে অথবা না বুঝে।
বেনু চুপচাপ চা খায়। রইসের রেডিওতে আব্দুল আলিমের গান বাজে।
“পিঞ্জিরার পাখির মতো
আমি তারে উইরা যাইয়া দেখি
কোথায় গো আমার কালো পাখি।।
শিকল কাটিয়া গিয়াছে উড়িয়া
গিয়াছে কোন অজানা দেশে
আমারে ভুলিয়া কার প্রেমে মজিয়া
কেবল আমারে বানাইলো চির দুখী।।”
অফিস ঘরের পুরনো জানালার খড়খড়ির সামনে দাড়িয়ে বেনু। তার হাতে এক মায়ের চিঠি। যে চিঠি কখনো বিলি হয়নি। ২৫ বছর আগে লেখা,"মেয়ে যদি কষ্ট দেয়, সেই কষ্ট কি ঠিক কাগজে লেখা যায়?
তুই চলে যাওয়ার পর প্রতিদিন তোর মুখটাই খুঁজি। ক্ষমা করে দিলাম। দেখতে আসবি মাকে...!"
বেনু সওদাগর চিঠির ব্যাগ কাধে নিয়ে সাইকেল চালিয়ে যায়। তার চোখে-মুখে অনুতাপ। বেনুর কানে ভাসছে চিঠির কথাগুলো। ঘর পালানো মেয়েকে উদ্দেশ করে মায়ের কথাগুলো।
পুরনো এক বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বেনু। ঘুলঘুলিতে ঝগড়া করে ধূসর চড়ুই। বাতাসে ভেসে বেড়ায় শিমুলের তুলো। বেনু দরজায় কড়া নাড়ে। দরজা খোলে এক বৃদ্ধা নারী। সেই মেয়ে এখন বৃদ্ধা হয়েছে। বেনু চিঠি দিয়ে চুপচাপ চলে যায়। বৃদ্ধা নারী চিঠি খুলে পড়ার পর কাঁদে,"মা... তুমি লিখেছিলা? এত বছর কেন আসেনি এই চিঠি। কেন লুকিয়ে রেখেছিল...!"
দুই.
লাইব্রেরিতে বসে বৃদ্ধ আতাউর চিঠি লেখে। মাথার ওপর কান্নার মতো শব্দ তুলে ঘুরতে থাকে সিলিং ফ্যান,
"শেষবার তোর মুখ আমি দেখেছিলাম নদীর ধারে, যেদিন তুই আমার বই ছিঁড়ে ছুড়ে ফেলেছিলি।
তুই রাগ করেছিলি, আর আমি অভিমান!"
সিলিং ফ্যানটা ঘুরতেই থাকে। দূরের রাস্তায় হেঁটে যায় হাওয়াই মিঠাইওয়ালা। তার হাতে ঘন্টা বাজে টুং টুং টুং।
বেনু নদীর পাড়ে বসে থাকে। একটা পানকৌড়ি টুপ করে ডুবে যায় কালো জলে। বেনুর হাতে আতাউরের চিঠি। তার কানে বাজে আতাউরের কথাগুলো,"সেদিন রাতেই আমি তোকে মাফ করে দিয়েছিলাম।
তোকে আবার ডাকার সাহস হয়নি, শুধু একবার চেয়েছিলাম তোকে পাশে বসাতে, নীরবে। কোনো অভিযোগ ছাড়াই!"
জলের গভীর থেকে পানকৌড়িটা ওঠে। খালি ঠোঁটেই উড়ে যায় বহুদূর।
আতাউরের পুরনো বাড়ি। বেনু দাঁড়ানো দরজার সামনে। দরজায় তালা। চারপাশে স্তব্ধতা। তখন এক বৃদ্ধ এসে দাঁড়ায়,"তিন মাস হয়ে গেল। আতাউর আর নেই বাবা…। ক্যানসার। চলে গেল একা একা…!"
দূরে কোথাও একটা কাঠ ঠোকরা ঠক ঠক শব্দে কাঠ কাটে। বেনু সওদাগরের কাঁপা হাত চিঠিতে থমকে থাকে। মুখ পাথরের মতো স্থির। সে ধীরে ধীরে খালি বারান্দায় গিয়ে বসে। অযত্নে পড়ে আছে পুরনো কেরাম বোর্ড। ধুলোমাখা। এক কোণে রোদ পড়ে আছে নিঃশব্দে। বেনু চিঠিতে চোখ বুলায়। এই প্রথম শেষ লাইনগুলো পড়ে, "যদি পারিস, মৃত্যুর আগেই চলে আয়। তোর মুখ দেখে গেলে, মনে হবে জীবনের সবকিছু বৃথা যায়নি।
পুনশ্চ: এই চিঠির কাগজে হয়তো তোর স্পর্শ পড়বে না কখনও...
রাগ যে অনেকটা শীতের কুয়াশার মতো,দূরত্ব ঢাকা দেয়, ছোঁয়ার আগেই মিলিয়ে যায়। তবু কিছু শব্দ রেখে গেলাম বাতাসে ভাসিয়ে—যদি কোনো একলা বিকেলে তুই হঠাৎ কান পেতে শুনিস আমার নীরবতা!"
বেনুর চোখ জলে ভরে। একা একাই কথা বলে মৃত বন্ধুর সাথে, "তুই মাফ করেছিলি…কিন্তু আমি করিনি,বন্ধু। তোকে না বলেই আমি অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম। আর আজ এলাম…যখন তুই আর ডাকতে পারিস না।"
খামওয়ালাদের কান্না বলে কিছু নাই জেনেও চোখ মোছে বেনু। উঠে দাঁড়ায় কেরাম বোর্ডের কাছে। ওপরে একটি সাদা গুটি রাখে, যেন অনেক অনুচ্চারিত কথা রেখে গেল বন্ধুর জন্য,"আজ খেলি না বন্ধু…হেরে গেছি আগেই!"
তিন.
জলপাই গাছের নিচে আলপনা এঁকেছে বিকেলের মরা রোদ। সেখানেই শিউলির ঘর। সেই ঘরে থাকতে চেয়েছিল মুকিত নামের বোকা ছেলেটি। এখন সেখানে থাকে শিউলি আর তার পুরনো সেলাই মেশিন। সেলাই মেশিনের শব্দ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কাজ করে শিউলি। তার সামনে এসে দাঁড়ায় বেনু। হাতে হলুদ খাম। বাড়িয়ে দিয়ে বলে, মুকিতের চিঠি। ১১ বছর আগের লেখা।
শিউলির ঠোট কাঁপে। চিঠি পেয়ে মেয়েটি স্তব্ধ। তার চোখ জলে ভরে যায়।
মেঠো পথ ধরে সাইকেল চালিয়ে যায় বেনু। তার কানে বাজে আত্মহত্যা করার আগে মুকিতের লেখা শেষ চিঠির কথাগুলো, "তুমি বলেছিলে, আমার জন্য তুমি জীবন দেবেও না, নেবেও না। আমি রাখলাম কথা। শুধু চলে যাচ্ছি, চিরতরে...ভালো থেকো, শিউলি।"
বটগাছের নিচ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে যায় বেনু। তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে সেই দৃশ্য, যেখানে গামছা দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলছিল মুকিতের দেহ। পা দুটো তখনও দুলছিল। যেমন দোল খায় সোনালু ফুল, জ্যৈষ্ঠের গোপন দুপুরে!
শিউলি চোখ ভেজায়। চিঠিটা নাকের কাছে এনে ঘ্রান নেয়, “ও মরে যায়নি… মরেছিল এই চিঠিটা। সময়মতো এলে…হয়তো বাঁচত ও।”
চার.
বেনুর ঘর। কাঠের টেবিলের ওপর ফ্রেমে বাঁধা মানুর ছবি। কলেজ ড্রেসে হাসিমুখে মানু। বেনুর হাতে একটা হলুদ খাম। সে খামের দিকে তাকিয়ে থাকে।
"এ চিঠি আমি কাকে দেব? আমার নিজের ছেলেকে? সে তো গেছে... চলে গেছে রাগ নিয়ে,অভিমান নিয়ে। আমি তো কখনও বলিনি তাকে... আমি ভালোবাসি তোকে। বিয়ে আমি করেছিলাম, তবে সংসারী হবার জন্য নয়। সমাজে একজন ধর্ষিতা নারীকে সন্মান দিতে।"
চিঠিতে হয়তো সেই কথাটুকুই লেখা ছিল। টেবিলে হলুদ চিঠির খামটা রাখে বেনু। খামের ওপরে স্পষ্ট পোস্ট অফিসের সিল দেওয়া তারিখ। ডাক টিকিট। চিঠিটা সে লিখেছিল ৯ বছর আগে। কিন্তু ছেলেকে কখনো পোস্ট করা হয়নি সেই চিঠি।
ডাক পিয়ন বেনু সওদাগর এবার সিদ্ধান্ত নেয় চাকরির শেষ দিনে শেষ চিঠিটা নিজের হাতেই বিলি করবে তার একমাত্র পুত্র মানু সওদাগরের হাতে। বেনু মোটা ফ্রেমের চশমাটা পরে। জানালার বাইরে ঝুলে থাকে আতাফল গাছের ডাল। অন্ধকারে মিটিমিটি জ্বলে কিছু জোনাকি। দূর থেকে ভেসে আসে শিয়ালের ডাক, বেনুর কাছে কান্না বলে মনে হয়।
ট্রেনটা ছুটে চলে পাহাড়ের গা ঘেসে। বেনু জানালার ধারে বসা। একে একে পেছনে চলে যায় চা বাগান, সাঁওতালের দল, লাল ইটের ব্রিজ। পেছনে চলে যায় ডাক পিয়ন বেনু সওদাগরের স্মৃতিও।
৯ বছর আগের বেনুর ঘর। কাঠের টেবিলের ওপর ফ্রেমে বাধা মানুর ছবি। টেবিলে মিটমিট করে জ্বলে হারিকেন। বেনু ছেলের কাছে চিঠি লেখে।
"মানু,আমি জানি, আমি কখনও তোকে ‘ভালোবাসি’ বলিনি।
আমি জানি, মা-কে হারানোর পর তুই আমায় দোষ দিয়েছিলি। মানতে পারিসনি মায়ের জায়গায় অন্য একজনকে। জানিস, সেই অন্য একজনও তোর মায়ের মতো হারিয়ে গেছে। তুই জানিস না কতকিছু! না জেনেই আর কোনোদিন বাবার কাছে ফিরে আসিসনি। আমি তোর খেলার মাঠে গিয়েছিলাম চুপিচুপি…। আমি তোকে দেখতে গিয়েছিলাম মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায়…আমি তোকে ভালোবাসি, রে। তুই হয়তো শুনতে পাবি না, তবুও বলছি—তুই আমার ছেলে, আমি তোকে ভালোবাসি।"
ছেলের বাসার দরজায় গিয়ে দাঁড়ায় ডাকপিয়ন বেনু। দরজা খোলে মানু। এখন ৩৮ বছরের ডাক্তার। দুজনই দীর্ঘ সময় চুপ। বেনু শুধু খামটা এগিয়ে দিয়ে বলে, “এটা…পৌঁছে দিতে পারিনি সময়মতো।”
ছেলের হাতে হলুদ খামটা দিয়ে চলে যায় বেনু। মানু চিঠির খামটার দিকে তাকায়। পোস্ট অফিসের সিল আর তারিখটা নয় বছর আগের। ধীরে ধীরে চিঠিটা পড়ে মানু। কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। চোখে জল জমে।
ডাক পিয়ন বেনু তখন কুঁজো হয়ে হাঁটে। সরকারি কোয়াটারের বাঁকা গলিতে মিলে যাচ্ছিল সে। মানু দৌড়ে রাস্তায় নামে। চিৎকার করে বাবাকে ডাকে, "বাবা!"
বেনুর পা থেমে যায়। পেছনে তাকালে ঘোলা চোখে মানুকে দেখে। দূরে দাঁড়ানো। কাছে আসে মানু। বাবার বুকের কাছে দাঁড়ায়, গলা কাঁপে—"তুমি তো কোনোদিন বলোনি...বাবা…!"
বেনু মাথা নিচু করে। দূরে কোথাও ট্রেনের হুইসেল বাজে, "আমি চিঠি বিলি করতাম। কিন্তু নিজের কথাগুলো কখনো পৌঁছে দিতে পারিনি...।"
মানু এগিয়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। দুজনের চোখেই জল। দূর থেকে গানের কথা ভেসে আসে। গাইছে অন্ধ কোনো ভিখারী, "যদিগো পাইতাম হৃদয়ে বসাইতাম, শুনিতাম মধুরও বুলি... "
গোধূলির আলোয় গ্রাম ডুবে যায় বিষণ্ণতায়। দারুচিনি গাছের পাতা ওড়ে বাতাসে। হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে দূরের পাহাড়ে নদীতে! এক কুঁজো বৃদ্ধ ডাকপিয়ন হাঁটতে থাকে ধীর পায়ে।
সব চিঠি সময়মতো পৌঁছে না।
তবুও একদিন পৌঁছালে তার ওজন থাকে। চিঠির ওজন…
অনুভবের ওজন…
সম্পর্কের ওজন।
*লেখক যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী
বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও গবেষণায় বিনিয়োগ এখনো সন্তোষজনক নয়। তবে কৃষিক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়। অন্য ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন গবেষণা থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। প্রযুক্তি, চিকিৎসা, সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ, খনিজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থাপনায় এখনো বড় ঘাটতি আছে।
বসার ঘরে ঢুকতেই দেখি, বেগম খালেদা জিয়া বসে আছেন। সাদামাটা কিন্তু দীপ্তিময় পোশাকে। তার ভেতর একটা রাজকীয় নীরবতা, আবার এক মায়ের কোমলতা। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হালকা মাথা নেড়ে বললেন, “এসো, বসো।”
মেঠো পথ ধরে সাইকেল চালিয়ে যায় বেনু। তার কানে বাজে আত্মহত্যা করার আগে মুকিতের লেখা শেষ চিঠির কথাগুলো, "তুমি বলেছিলে, আমার জন্য তুমি জীবন দেবেও না, নেবেও না। আমি রাখলাম কথা। শুধু চলে যাচ্ছি, চিরতরে...ভালো থেকো, শিউলি।"
জবাবদিহিতা ছাড়া কোনো সংস্কার সফল হবে না। যেকোনো অনিয়ম প্রকাশ পেলে দ্রুত তদন্ত, দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি এবং বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এগুলো শুধু আইন প্রয়োগ নয়, বরং এক ধরনের মানসিক বার্তাও তৈরি করে যে অপরাধী রেহাই পায় না। বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে লুটপাটের প্রধান শক্তি ছিল বিচারহীনতা।