logo
প্রবাসের খবর

গুপ্তহত্যার শঙ্কায় উত্তরসূরি ঠিক করেছেন খামেনি

নিউইয়র্ক টাইমস১২ দিন আগে
Copied!
গুপ্তহত্যার শঙ্কায় উত্তরসূরি ঠিক করেছেন খামেনি
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। ফাইল ছবি: রয়টার্স

ইসরায়েলের হামলার পর নিরাপত্তার স্বার্থে নিজ বাসভবন ছেড়ে বাংকারে আশ্রয় নিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। তিনি সরাসরি যোগাযোগ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। যোগাযোগের জন্য মোবাইল বা কোনো প্রযুক্তির ব্যবহার করছেন না। কেবল একান্ত বিশ্বস্ত দূতের মাধ্যমে সেনা কর্মকর্তা ও অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইরানের তিনজন কর্মকর্তা নিউইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছেন, দেশের শীর্ষ নেতাদের কেউ নিহত হলে যেন শৃঙ্খলা ধরে রাখা যায়, সে জন্য খামেনি বিকল্প নেতৃত্বের একটি তালিকা তৈরি করেছেন। তবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো নিজে নিহত হলে যাতে দ্রুত তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচন করা যায়, এ জন্য তিনি তিনজন জ্যেষ্ঠ নেতার নাম অনুমোদন দিয়েছেন।

৮৬ বছর বয়সী খামেনির আশঙ্কা, ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে হত্যা করতে পারে। তাই সর্বোচ্চ নেতৃত্ব বাছাইয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘মজলিশে খোবরেগান-ই-রাহবারি’ বা নেতৃত্ব নির্ধারণে বিশেষজ্ঞদের পরিষদকে তিনি আগেভাগেই বলে দিয়েছেন, যেন তাঁর দেওয়া নামের মধ্য থেকেই দ্রুত নতুন সর্বোচ্চ নেতা বেছে নেওয়া হয়।

ইসরায়েলের চলমান হামলাকে ১৯৮০-৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় সামরিক আগ্রাসন বলে মনে করে তেহরান। ১৩ জুন ভোররাত থেকে শুরু হওয়া হামলায় এরই মধ্যে রাজধানী তেহরানে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা ওই ৮ বছরের যুদ্ধেও হয়নি।

তবে হামলার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠেছে ইরান। এখন তারা প্রতিদিনই পাল্টা হামলা চালাচ্ছে। ইসরায়েলের সামরিক স্থাপনা, হাইফার তেল শোধনাগারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় আঘাত হেনেছে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন।

সংঘাতের এই পর্যায়ে ইরানের রাজনৈতিক নেতৃত্বে এখনো দৃশ্যমান কোনো মতবিরোধ নেই। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া এখনো কার্যকর রয়েছে। দেশটির আইনসভা, বিচারব্যবস্থা, নির্বাহী বিভাগ এবং সামরিক বাহিনীর সর্বময় ক্ষমতা খামেনির হাতে।

আলী খামেনি একই সঙ্গে শিয়াদের শীর্ষ ধর্মীয় অভিভাবক বা ‘ভালিয়ে ফকিহ’। তাঁর ছেলে মোজতবা খামেনিও ধর্মীয় নেতা। কিন্তু তাঁর নাম উত্তরসূরি তালিকায় নেই। খামেনির পর দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি সর্বোচ্চ নেতা হতে পারেন বলে ধারণা করা হতো। কিন্তু ২০২৪ সালে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় তিনি নিহত হন।

ইরানের হামলা শুরুর পর খামেনি দুবার ভিডিও বার্তা দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘ইরানের মানুষ চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ রুখে দাঁড়াবে। আমরা আত্মসমর্পণ করব না।’

সাধারণ সময়ে খামেনি তেহরানের ‘বাইত রাহবারি’ নামের বিশেষ নিরাপত্তাবেষ্টিত স্থানে থাকেন। এটা দেশটির সর্বোচ্চ নেতার দাপ্তরিক ও বাসভবনের নাম। বিশেষ উপলক্ষ ছাড়া তিনি এখান থেকে বের হন না। সামরিক বা রাজনৈতিক নেতারা প্রতি সপ্তাহে সেখানে গিয়ে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেন। জনগণের উদ্দেশে দেওয়া তাঁর ভাষণও সেখান থেকে প্রচার করা হয়।

ইরানি কর্মকর্তাদের মতে, যুদ্ধ চলছে দুটি ফ্রন্টে। একটি ফ্রন্ট আকাশপথ। ইসরায়েল ইরানের সেনাঘাঁটি, পরমাণু স্থাপনা, জ্বালানি বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন স্থানে আঘাত হানছে। এসব কিছুর অধিকাংশই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়। এখন পর্যন্ত একাধিক শীর্ষ সেনা কমান্ডার হারিয়েছে ইরান।

দ্বিতীয় ফ্রন্ট আরও জটিল, যা ইরানের অভ্যন্তরে। বিশাল ভূখণ্ডের দেশটিতে ছড়িয়ে থাকা ইসরায়েলি গুপ্তচর ও দোসররা ড্রোনের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সামরিক স্থাপনায় হামলা চালাচ্ছে। শীর্ষ নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা মহলে এই অনুপ্রবেশের শঙ্কা এতটাই বেড়েছে যে খোদ আয়াতুল্লাহ খামেনিও উদ্বিগ্ন।

ইরানি পার্লামেন্টের স্পিকার গালিবাফের উপদেষ্টা মাহদি মোহাম্মাদি এক অডিও বার্তায় বলেছেন, ‘আমাদের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা ব্যবস্থায় বড় ধরনের ফাঁক ছিল, এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এক ঘণ্টার মধ্যে আমাদের শীর্ষ কমান্ডাররা নিহত হয়েছেন।’

মাহদি আরও বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো ইসরায়েলি হামলার আগে তারা দীর্ঘদিন ধরে যে প্রস্তুতি নিয়েছে, সে খবর আমরা পাইনি।’

কর্মকর্তারা বলছেন, ইরানি নেতৃত্বের প্রধান উদ্বেগ ৩টি: খামেনিকে গুপ্তভাবে হত্যা করতে চাওয়া, যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি যুদ্ধে যোগ দেওয়া এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র, তেল ও গ্যাস শোধনাগার ও বাঁধ ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে হামলা।

গুপ্তচর ও হত্যাচেষ্টার শঙ্কা এতটাই তীব্র যে ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয় সব কর্মকর্তাকে মোবাইলসহ বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করতে বলেছেন। দুজন ইরানি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সামরিক কমান্ডারদের বাংকারে অবস্থান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সন্দেহজনক ব্যক্তি ও যানবাহনের গতিবিধি জানাতে এবং সংবেদনশীল এলাকায় ছবি বা ভিডিও না করতে প্রতিদিনই সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে।

ইরানের সঙ্গে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ইন্টারনেট ব্যবস্থা মাঝেমধ্যে বন্ধ হয়ে যায়, আন্তর্জাতিক ফোনকল বন্ধ। শত্রুদের ঠেকাতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়।

প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের জনসংযোগ পরিচালক আলী আহমাদিনিয়া বলেন, ‘ইন্টারনেট এখন বেসামরিক ব্যক্তিদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে বলে মনে করছে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী। তাই বন্ধ রাখা হয়েছে।’

গত শুক্রবার ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল ঘোষণা দিয়েছে, যারা শত্রুর হয়ে কাজ করছেন, তারা যেন রোববারের (আজকের মধ্যে) মধ্যে আত্মসমর্পণ করেন এবং অস্ত্র জমা দিয়ে ‘জনগণের কাতারে ফিরে আসেন’। না মানলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।

ইসরায়েল তেহরানের বিভিন্ন জনবহুল এলাকা থেকে লোকজনকে সরে যেতে বারবার নির্দেশ দিয়েছে। অনেক মানুষ এরই মধ্যে শহর ছেড়েছেন। রাজধানীর যেসব সড়কে সাধারণ সময়ে যানজট লেগে থাকত, তা এখন প্রায় ফাঁকা। তেহরানে থাকা বাসিন্দারা জানিয়েছেন, শহরের প্রতিটি মহাসড়ক ও উপসড়কে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে।

সংস্কারপন্থী রাজনীতিক ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী আবতাহি তেহরান থেকে টেলিফোনে বলেন, ইরানিদের প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে, ইসরায়েল তা ভুলভাবে মূল্যায়ন করেছে। তাঁর মতে, যেসব রাজনৈতিক গোষ্ঠী সাধারণত পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে, তারা এখন সর্বোচ্চ নেতার পাশে দাঁড়িয়েছে, তারা দেশের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

হামলার কয়েক ঘণ্টার মাথায় ইংরেজিতে দেওয়া এক ভাষণে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের সরকার পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন। দেশটির সাধারণ মানুষকে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের কঠোর শাসনের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে বলেছিলেন।

কিন্তু ইসরায়েলি হামলা ইরানে নতুন করে জাতীয়তাবাদ উসকে দিয়েছে। এমনকি সরকারের সমালোচকেরা ইসরায়েলি হামলার বিরোধিতা করছেন। দেশটির অধিকারকর্মী, চিকিৎসক, ক্রীড়াবিদ, শিল্পী, তারকাসহ সমাজের নানা পেশার মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একসুরে কথা বলছেন। ইসরায়েলি হামলার সমালোচনা করছেন।

ইরানের জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড় সাঈদ এজাতোল্লাহি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘আমরা পরিবারের মতো। সব সময় একমত হই না ঠিকই, কিন্তু ইরানের মাটি আমাদের চূড়ান্ত সীমা (রেড লাইন)।’

ইরানি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভিডিওতে দেখা গেছে, তেহরান ছেড়ে যাওয়া মানুষের জন্য হোটেল, গেস্টহাউস ও বিয়েবাড়ি খোলা রাখা হয়েছে। বিনা খরচেই তাদের থাকতে দেওয়া হচ্ছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বিনা মূল্যে অনলাইনে সেবা দিচ্ছেন। দোকানে ছাড় চলছে, রুটির দোকানে মানুষ নিজের প্রয়োজনের চেয়ে কম রুটি কিনছেন, যাতে সবাই রুটি পান। স্বেচ্ছাসেবকেরা বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের খোঁজখবর নিচ্ছেন।

কাস্পিয়ান সাগরের পাশে আশ্রয় নেওয়া রেজা (৪২) নামের এক ব্যবসায়ী টেলিফোনে নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘আমরা দারুণ এক সংহতি দেখতে পাচ্ছি। ভয় পাচ্ছি, কিন্তু পাশাপাশি একে অপরকে সাহস ও ভালোবাসা দিচ্ছি।’

শান্তিতে নোবেলজয়ী অধিকারকর্মী নার্গিস মোহাম্মদিকে বারবার কারাবন্দী করা হয়েছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনিও ইসরায়েলি হামলার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন। হামলার বিষয়ে দেশবাসীকে সতর্ক করে তিনি গত সপ্তাহে বিবিসিকে বলেন, ‘যুদ্ধ আর সহিংসতা দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

আরও পড়ুন

৬০ দিনের যুদ্ধবিরতিতে রাজি ইসরায়েল, হামাস না মানলে ফল খারাপ হবে: ট্রাম্প

৬০ দিনের যুদ্ধবিরতিতে রাজি ইসরায়েল, হামাস না মানলে ফল খারাপ হবে: ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি, ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নিতে রাজি হয়েছে ইসরায়েল। পাশাপাশি, হামাস এই চুক্তি না মানলে ফলাফল আরও খারাপ হবে বলেও দাবি করেন ট্রাম্প।

২ দিন আগে

সিরিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ জারি

সিরিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ জারি

সিরিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিতে একটি নির্বাহী আদেশে সই করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রায় ৬ মাস আগে সিরিয়ায় ক্ষমতা থেকে উৎখাত হন দেশটির দীর্ঘদিনের শাসক বাশার আল-আসাদ। তাঁকে উৎখাতে নেতৃত্ব দেন দেশটির বর্তমান শাসক আহমেদ আল–শারা।

২ দিন আগে

ট্রাম্পের নাগরিকত্ব অধ্যাদেশের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের রায়

ট্রাম্পের নাগরিকত্ব অধ্যাদেশের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের রায়

যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে ফেডারেল বিচারকদের ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। এই বিচারকেরা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব সীমিত করার নির্বাহী আদেশ স্থগিত করতে দেশব্যাপী আদেশ জারি করেছিলেন।

৬ দিন আগে