
শাহাবুদ্দিন শুভ

ফ্রান্সে আমি যে শহরে এখন বসবাস করছি, সেই শহরের নাম ল্য ক্রুসো (Le Creusot)। শহরটি আকারে খুব বড় নয়। ফ্রান্সের মানচিত্রে এটি একটি শান্ত, নিরিবিলি ও মূলত শিল্পনগরী হিসেবেই পরিচিত। চারপাশে কারখানার ইতিহাস, শ্রমিক সংস্কৃতি আর শিল্পায়নের ছাপ স্পষ্ট। বাইরে থেকে দেখলে মনে হতে পারে, এখানে হয়তো সাংস্কৃতিক আয়োজন সীমিত। কিন্তু এই শহরের বুকেই যে একটি আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটির নাম ল’আর্ক—সীন ন্যাশনাল ল্য ক্রুসো (L’arc – Scène Nationale Le Creusot)। সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠানটি আমার ঘুরে দেখার সুযোগ হয়। আমার কাছে এটা শুধু একটি স্থাপনা দেখা নয়, বরং আধুনিক শিল্প–সংস্কৃতির দর্শন, পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করার এক গভীর অভিজ্ঞতা।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতিকর্মের সূত্রে আমি বহু থিয়েটার হল, মিলনায়তন ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ঘুরে দেখেছি। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে জেলা শহর পর্যন্ত, মঞ্চ দেখেছি, আয়োজন দেখেছি, শিল্পীদের কাজ দেখেছি। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আজকের এই লেখা।

পরিকল্পনার সংস্কৃতি, সময়ানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার পাঠ
আমাদের এই ভিজিটটি প্রায় চার সপ্তাহ আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। ফ্রান্সে এসে একটি বিষয় আমি বারবার লক্ষ্য করেছি, এখানে হঠাৎ করে কিছু হয় না। কোনো অনুষ্ঠান, বৈঠক, সাক্ষাৎ বা সাংস্কৃতিক আয়োজন, সবকিছুই এক থেকে দুই মাস আগেই পরিকল্পিত ও শিডিউল করা থাকে।
বিশেষ করে সরকারি ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই নিয়ম আরও কঠোরভাবে মানা হয়। এমনকি মেয়রের সঙ্গে আমার একটি সাক্ষাতও প্রায় দুই মাস আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। এই পরিকল্পনার সংস্কৃতি এখানকার সমাজব্যবস্থার একটি শক্ত ভিত।
নির্ধারিত দিন সকাল ৯টার আগেই আমাদের দলের সবাই একে একে উপস্থিত হন। আগের দিন এখানে মেয়রের একটি বড় অনুষ্ঠান ছিল। ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাত করে বাসায় ফিরেছিলেন। তারপরও নির্ধারিত সময় অনুযায়ী সবাই ঠিক সময়ে হাজির। কারণ সময়ানুবর্তিতা এখানে ব্যক্তিগত গুণ নয়, সামাজিক দায়িত্ব।
প্রথমে আমাদের ল’আর্ক সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু তথ্যসমৃদ্ধ পরিচিতি দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস, কার্যক্রম, দর্শন ও লক্ষ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়। এরপর শুরু হয় মূল ভ্রমণ।

গ্র্যান্ড থিয়েটার আধুনিকতা ও কারিগরি নিখুঁততার অসাধারণ উদাহরণ
পুরো ভ্রমণটি পরিচালনা করেন আশু শারাজেদ। তিনি ‘রিলাসিওঁ আভেক লে প্যাবলিক’ বিভাগের দায়িত্বে আছেন। আমরা পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি জানালেন, আজ আমাদের পুরো ভবনটি ঘুরিয়ে দেখানো হবে, যেখানে রয়েছে দুটি থিয়েটার হল ও একটি প্রদর্শনী গ্যালারি।
প্রথমেই আমরা প্রবেশ করি প্রায় এক হাজার আসনবিশিষ্ট গ্র্যান্ড থিয়েটারে। হলটিতে ঢোকার মুহূর্তেই আমার চোখ আটকে যায়। বিশাল হলেও কোথাও ভারী লাগেনি। বরং পুরো জায়গাটি আধুনিক, পরিমিত ও দৃষ্টিনন্দন।
প্রথমে আমাদের বোঝানো হয় হলটির আলোক নিক্ষেপণ ব্যবস্থা। কোথায় কোন ধরনের আলো ব্যবহার করা হয়, কোন আলো দৃশ্য তৈরি করে, কোনটি আবহ গড়ে তোলে—সবকিছুই অত্যন্ত পরিকল্পিত। এরপর ব্যাখ্যা করা হয় সাউন্ড সিস্টেম, মঞ্চের কাঠামো ও কারিগরি ব্যবস্থাপনা।
এরপর আমরা একটি সরু সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাই হলের একেবারে ওপরের অংশে, যেখানে রয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। কাচের ভেতর থেকে পুরো হলটি দেখা যায়। আলো, শব্দ ও মঞ্চ—সবকিছু এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়। কাচের আড়াল থেকে বিশাল হলটি অপূর্ব দেখাচ্ছিল।
এরপর আমাদের নেওয়া হয় মঞ্চের পেছনের দিকে। সেখানে রয়েছে অত্যাধুনিক ইন্টেরিয়রে সাজানো তিনটি আলাদা কক্ষ। নাটক বা পারফরম্যান্সের আগে শিল্পীরা এখানে বিশ্রাম নেন, পোশাক পরিবর্তন করেন। আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে, এই কক্ষগুলোর ভেতরেই শাওয়ার ও ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনা রয়েছে। সবকিছুই আধুনিক, স্বয়ংক্রিয় ও শিল্পীবান্ধব।
আসনগুলোর ঢাল, মঞ্চের গভীরতা, শব্দের প্রতিফলন—সবকিছু এমনভাবে নকশা করা যে, দর্শক হলের যেখানেই বসুন না কেন, পারফরম্যান্স উপভোগে কোনো বাধা থাকে না।
বাংলাদেশে বহু থিয়েটার হলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু এত নিখুঁত পরিকল্পনা, প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা ও আরামদায়ক পরিবেশ আগে কখনো চোখে পড়েনি। সত্যি বলতে, আমি অভিভূত হয়েছিলাম।

পেতি থিয়েটার ছোট পরিসরে বড় অনুভব
গ্র্যান্ড থিয়েটার দেখার পর আমরা যাই পেতি থিয়েটারে। এখানে আসন সংখ্যা ২১৫ থেকে ২৩২টি। এই হলটি আকারে ছোট হলেও অনুভূতিতে বিশাল।
ভেতরে ঢুকেই এক ধরনের অন্তরঙ্গ পরিবেশ তৈরি হয়। এটি এমনভাবে নকশা করা যে, দর্শক ও শিল্পীর মধ্যে দূরত্ব কমে আসে। আলো-ছায়ার ব্যবহার অত্যন্ত সূক্ষ্ম। দেয়ালের অ্যাকুস্টিক ডিজাইন এমনভাবে তৈরি, যাতে কণ্ঠস্বর ও সংগীত প্রাকৃতিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, অতিরিক্ত যন্ত্রনির্ভরতা ছাড়াই। আসনগুলো আরামদায়ক। দীর্ঘ সময় বসেও ক্লান্তি আসে না। প্রতিটি আসন থেকেই মঞ্চের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ বজায় থাকে।
ছোট নাটক, একক অভিনয়, পরীক্ষামূলক থিয়েটার, কবিতা পাঠ, আলোচনা সভা কিংবা সৃজনশীল কর্মশালার জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি আদর্শ সাংস্কৃতিক পরিসর।

প্রদর্শনী হল: শিল্পের প্রতি শ্রদ্ধা ও সৃজনশীলতার বিস্তার
প্রায় ৩০০ বর্গমিটারজুড়ে বিস্তৃত প্রদর্শনী হলটি ল’আর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি কেবল শিল্পকর্ম ঝুলিয়ে রাখার জায়গা নয়, বরং শিল্পী ও দর্শকের মধ্যে নীরব সংলাপের একটি পরিসর।
আলোকব্যবস্থা অত্যন্ত পেশাদার। প্রতিটি শিল্পকর্মের জন্যখ আলাদা আলো পরিকল্পনা করা হয়েছে, যাতে রং, গঠন ও ভাব পুরোপুরি ফুটে ওঠে।
এই কক্ষটির বিন্যাস খুবই নমনীয়। প্রয়োজনে দেয়াল সরিয়ে বা স্থান পুনর্বিন্যাস করে বিভিন্ন ধরনের প্রদর্শনী আয়োজন করা যায়।
চিত্রকলা, ভাস্কর্য, আলোকচিত্র, ইনস্টলেশন কিংবা মাল্টিমিডিয়া—সব ধরনের শিল্প এখানে সমান গুরুত্ব পায়।
এখানকার সমকালীন শিল্পীদের কাজ দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়—ল্য ক্রুসো শুধু শিল্পের শহর নয়, বরং শিল্পভাবনার শহর।

মানুষই একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রাণ
এই পুরো অভিজ্ঞতাকে আরও ব্যক্তিগত ও স্মরণীয় করে তুলেছেন আশু শারাজেদ। তার ব্যাখ্যা, ধৈর্য ও আন্তরিকতা বুঝিয়ে দেয়, একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সৌন্দর্য শুধু স্থাপত্যে নয়, মানুষের মননেও লুকিয়ে থাকে।
এ ছাড়া. মারি আনিক ও লরার অংশগ্রহণ ভ্রমণটিকে আরও তথ্যসমৃদ্ধ ও উষ্ণ করে তুলেছে।

আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি: শিল্প, শহর ও মানুষের নীরব সংলাপ
ল’আর্কের এই ভ্রমণ আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে, একটি হল শুধু শিল্প দেখানোর জায়গা নয়। এটি একটি শহরের রুচি, মনন ও আধুনিকতার প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশে আমার জীবনে বহু সাংস্কৃতিক পরিসর দেখার সুযোগ হয়েছে। সেসব অভিজ্ঞতা আমাকে সমৃদ্ধও করেছে। কিন্তু এখানে এসে উপলব্ধি করলাম, আধুনিকতা কেবল প্রযুক্তির নাম নয়; আধুনিকতা হলো পরিকল্পনার শুদ্ধতা ও শিল্পের প্রতি সম্মান।
মনে হয়েছে. যদি এমন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আমাদের দেশেও আরও থাকত, তবে নতুন প্রজন্ম শিল্পকে শুধু বিনোদন হিসেবে নয়, জীবনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করত। ল’আর্ক আমার কাছে তাই শুধু একটি স্থাপনা নয়। এটি এক জীবন্ত উদাহরণ, যেখানে শিল্প কথা বলে, মানুষ শোনে, আর একটি শহর নিজের পরিচয় নির্মাণ করে নীরবে, সৌন্দর্যের ভেতর দিয়ে।
*লেখক সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইমেইল: [email protected]

ফ্রান্সে আমি যে শহরে এখন বসবাস করছি, সেই শহরের নাম ল্য ক্রুসো (Le Creusot)। শহরটি আকারে খুব বড় নয়। ফ্রান্সের মানচিত্রে এটি একটি শান্ত, নিরিবিলি ও মূলত শিল্পনগরী হিসেবেই পরিচিত। চারপাশে কারখানার ইতিহাস, শ্রমিক সংস্কৃতি আর শিল্পায়নের ছাপ স্পষ্ট। বাইরে থেকে দেখলে মনে হতে পারে, এখানে হয়তো সাংস্কৃতিক আয়োজন সীমিত। কিন্তু এই শহরের বুকেই যে একটি আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটির নাম ল’আর্ক—সীন ন্যাশনাল ল্য ক্রুসো (L’arc – Scène Nationale Le Creusot)। সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠানটি আমার ঘুরে দেখার সুযোগ হয়। আমার কাছে এটা শুধু একটি স্থাপনা দেখা নয়, বরং আধুনিক শিল্প–সংস্কৃতির দর্শন, পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করার এক গভীর অভিজ্ঞতা।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতিকর্মের সূত্রে আমি বহু থিয়েটার হল, মিলনায়তন ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ঘুরে দেখেছি। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে জেলা শহর পর্যন্ত, মঞ্চ দেখেছি, আয়োজন দেখেছি, শিল্পীদের কাজ দেখেছি। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আজকের এই লেখা।

পরিকল্পনার সংস্কৃতি, সময়ানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার পাঠ
আমাদের এই ভিজিটটি প্রায় চার সপ্তাহ আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। ফ্রান্সে এসে একটি বিষয় আমি বারবার লক্ষ্য করেছি, এখানে হঠাৎ করে কিছু হয় না। কোনো অনুষ্ঠান, বৈঠক, সাক্ষাৎ বা সাংস্কৃতিক আয়োজন, সবকিছুই এক থেকে দুই মাস আগেই পরিকল্পিত ও শিডিউল করা থাকে।
বিশেষ করে সরকারি ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই নিয়ম আরও কঠোরভাবে মানা হয়। এমনকি মেয়রের সঙ্গে আমার একটি সাক্ষাতও প্রায় দুই মাস আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। এই পরিকল্পনার সংস্কৃতি এখানকার সমাজব্যবস্থার একটি শক্ত ভিত।
নির্ধারিত দিন সকাল ৯টার আগেই আমাদের দলের সবাই একে একে উপস্থিত হন। আগের দিন এখানে মেয়রের একটি বড় অনুষ্ঠান ছিল। ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাত করে বাসায় ফিরেছিলেন। তারপরও নির্ধারিত সময় অনুযায়ী সবাই ঠিক সময়ে হাজির। কারণ সময়ানুবর্তিতা এখানে ব্যক্তিগত গুণ নয়, সামাজিক দায়িত্ব।
প্রথমে আমাদের ল’আর্ক সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু তথ্যসমৃদ্ধ পরিচিতি দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস, কার্যক্রম, দর্শন ও লক্ষ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়। এরপর শুরু হয় মূল ভ্রমণ।

গ্র্যান্ড থিয়েটার আধুনিকতা ও কারিগরি নিখুঁততার অসাধারণ উদাহরণ
পুরো ভ্রমণটি পরিচালনা করেন আশু শারাজেদ। তিনি ‘রিলাসিওঁ আভেক লে প্যাবলিক’ বিভাগের দায়িত্বে আছেন। আমরা পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি জানালেন, আজ আমাদের পুরো ভবনটি ঘুরিয়ে দেখানো হবে, যেখানে রয়েছে দুটি থিয়েটার হল ও একটি প্রদর্শনী গ্যালারি।
প্রথমেই আমরা প্রবেশ করি প্রায় এক হাজার আসনবিশিষ্ট গ্র্যান্ড থিয়েটারে। হলটিতে ঢোকার মুহূর্তেই আমার চোখ আটকে যায়। বিশাল হলেও কোথাও ভারী লাগেনি। বরং পুরো জায়গাটি আধুনিক, পরিমিত ও দৃষ্টিনন্দন।
প্রথমে আমাদের বোঝানো হয় হলটির আলোক নিক্ষেপণ ব্যবস্থা। কোথায় কোন ধরনের আলো ব্যবহার করা হয়, কোন আলো দৃশ্য তৈরি করে, কোনটি আবহ গড়ে তোলে—সবকিছুই অত্যন্ত পরিকল্পিত। এরপর ব্যাখ্যা করা হয় সাউন্ড সিস্টেম, মঞ্চের কাঠামো ও কারিগরি ব্যবস্থাপনা।
এরপর আমরা একটি সরু সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাই হলের একেবারে ওপরের অংশে, যেখানে রয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। কাচের ভেতর থেকে পুরো হলটি দেখা যায়। আলো, শব্দ ও মঞ্চ—সবকিছু এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়। কাচের আড়াল থেকে বিশাল হলটি অপূর্ব দেখাচ্ছিল।
এরপর আমাদের নেওয়া হয় মঞ্চের পেছনের দিকে। সেখানে রয়েছে অত্যাধুনিক ইন্টেরিয়রে সাজানো তিনটি আলাদা কক্ষ। নাটক বা পারফরম্যান্সের আগে শিল্পীরা এখানে বিশ্রাম নেন, পোশাক পরিবর্তন করেন। আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে, এই কক্ষগুলোর ভেতরেই শাওয়ার ও ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনা রয়েছে। সবকিছুই আধুনিক, স্বয়ংক্রিয় ও শিল্পীবান্ধব।
আসনগুলোর ঢাল, মঞ্চের গভীরতা, শব্দের প্রতিফলন—সবকিছু এমনভাবে নকশা করা যে, দর্শক হলের যেখানেই বসুন না কেন, পারফরম্যান্স উপভোগে কোনো বাধা থাকে না।
বাংলাদেশে বহু থিয়েটার হলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু এত নিখুঁত পরিকল্পনা, প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা ও আরামদায়ক পরিবেশ আগে কখনো চোখে পড়েনি। সত্যি বলতে, আমি অভিভূত হয়েছিলাম।

পেতি থিয়েটার ছোট পরিসরে বড় অনুভব
গ্র্যান্ড থিয়েটার দেখার পর আমরা যাই পেতি থিয়েটারে। এখানে আসন সংখ্যা ২১৫ থেকে ২৩২টি। এই হলটি আকারে ছোট হলেও অনুভূতিতে বিশাল।
ভেতরে ঢুকেই এক ধরনের অন্তরঙ্গ পরিবেশ তৈরি হয়। এটি এমনভাবে নকশা করা যে, দর্শক ও শিল্পীর মধ্যে দূরত্ব কমে আসে। আলো-ছায়ার ব্যবহার অত্যন্ত সূক্ষ্ম। দেয়ালের অ্যাকুস্টিক ডিজাইন এমনভাবে তৈরি, যাতে কণ্ঠস্বর ও সংগীত প্রাকৃতিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, অতিরিক্ত যন্ত্রনির্ভরতা ছাড়াই। আসনগুলো আরামদায়ক। দীর্ঘ সময় বসেও ক্লান্তি আসে না। প্রতিটি আসন থেকেই মঞ্চের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ বজায় থাকে।
ছোট নাটক, একক অভিনয়, পরীক্ষামূলক থিয়েটার, কবিতা পাঠ, আলোচনা সভা কিংবা সৃজনশীল কর্মশালার জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি আদর্শ সাংস্কৃতিক পরিসর।

প্রদর্শনী হল: শিল্পের প্রতি শ্রদ্ধা ও সৃজনশীলতার বিস্তার
প্রায় ৩০০ বর্গমিটারজুড়ে বিস্তৃত প্রদর্শনী হলটি ল’আর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি কেবল শিল্পকর্ম ঝুলিয়ে রাখার জায়গা নয়, বরং শিল্পী ও দর্শকের মধ্যে নীরব সংলাপের একটি পরিসর।
আলোকব্যবস্থা অত্যন্ত পেশাদার। প্রতিটি শিল্পকর্মের জন্যখ আলাদা আলো পরিকল্পনা করা হয়েছে, যাতে রং, গঠন ও ভাব পুরোপুরি ফুটে ওঠে।
এই কক্ষটির বিন্যাস খুবই নমনীয়। প্রয়োজনে দেয়াল সরিয়ে বা স্থান পুনর্বিন্যাস করে বিভিন্ন ধরনের প্রদর্শনী আয়োজন করা যায়।
চিত্রকলা, ভাস্কর্য, আলোকচিত্র, ইনস্টলেশন কিংবা মাল্টিমিডিয়া—সব ধরনের শিল্প এখানে সমান গুরুত্ব পায়।
এখানকার সমকালীন শিল্পীদের কাজ দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়—ল্য ক্রুসো শুধু শিল্পের শহর নয়, বরং শিল্পভাবনার শহর।

মানুষই একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রাণ
এই পুরো অভিজ্ঞতাকে আরও ব্যক্তিগত ও স্মরণীয় করে তুলেছেন আশু শারাজেদ। তার ব্যাখ্যা, ধৈর্য ও আন্তরিকতা বুঝিয়ে দেয়, একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সৌন্দর্য শুধু স্থাপত্যে নয়, মানুষের মননেও লুকিয়ে থাকে।
এ ছাড়া. মারি আনিক ও লরার অংশগ্রহণ ভ্রমণটিকে আরও তথ্যসমৃদ্ধ ও উষ্ণ করে তুলেছে।

আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি: শিল্প, শহর ও মানুষের নীরব সংলাপ
ল’আর্কের এই ভ্রমণ আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে, একটি হল শুধু শিল্প দেখানোর জায়গা নয়। এটি একটি শহরের রুচি, মনন ও আধুনিকতার প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশে আমার জীবনে বহু সাংস্কৃতিক পরিসর দেখার সুযোগ হয়েছে। সেসব অভিজ্ঞতা আমাকে সমৃদ্ধও করেছে। কিন্তু এখানে এসে উপলব্ধি করলাম, আধুনিকতা কেবল প্রযুক্তির নাম নয়; আধুনিকতা হলো পরিকল্পনার শুদ্ধতা ও শিল্পের প্রতি সম্মান।
মনে হয়েছে. যদি এমন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আমাদের দেশেও আরও থাকত, তবে নতুন প্রজন্ম শিল্পকে শুধু বিনোদন হিসেবে নয়, জীবনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করত। ল’আর্ক আমার কাছে তাই শুধু একটি স্থাপনা নয়। এটি এক জীবন্ত উদাহরণ, যেখানে শিল্প কথা বলে, মানুষ শোনে, আর একটি শহর নিজের পরিচয় নির্মাণ করে নীরবে, সৌন্দর্যের ভেতর দিয়ে।
*লেখক সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইমেইল: [email protected]
যারা মনে করেন শক্ত হাতে শাসনই স্থিতিশীলতা আনে, তারা ভুলে যান—দমন দিয়ে নীরবতা আনা যায়, কিন্তু আস্থা তৈরি করা যায় না। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে, ভয়ভিত্তিক ও ব্যক্তিনির্ভর শাসনব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদে টেকে না। কারণ সেখানে ভুল সংশোধনের শান্তিপূর্ণ পথ এবং ক্ষমতার ওপর কার্যকর নজরদারি থাকে না।
প্রথমেই আমরা প্রবেশ করি প্রায় এক হাজার আসনবিশিষ্ট গ্র্যান্ড থিয়েটারে। হলটিতে ঢোকার মুহূর্তেই আমার চোখ আটকে যায়। বিশাল হলেও কোথাও ভারী লাগেনি। বরং পুরো জায়গাটি আধুনিক, পরিমিত ও দৃষ্টিনন্দন।
এই সময় বাইরের জীবন কমে আসে, কিন্তু ঘরের ভেতরের জীবন সমৃদ্ধ হয়। মানুষ কম কথা বলে, কিন্তু গভীরভাবে ভাবে। মিডিয়ায় মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা বাড়ে। আলোচনায় আসে শীতকালের বিষণ্নতা, আত্মযত্ন ও সামাজিক সংযোগের গুরুত্ব।
আমরা এখন/ দূরে দাঁড়িয়ে/ হাতে স্লোগান,/ কিন্তু বুকে সাহসের অভাব।