ইজাজ আহসান
একটা দেশের অর্থনীতিতে আর্থিক খাতের ভূমিকা কী, তা মনে হয় বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। আর্থিক খাতের প্রধান অঙ্গগুলো হলো—ব্যাংক, ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও শেয়ার বাজার।
বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থার ইতিহাস একটু জেনে নেওয়া দরকার। ১৯৭১ সালের আগে এখানকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা ছিল পাকিস্তানি আর বিদেশিদের নিয়ন্ত্রণে। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানি মালিকানায় থাকা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পরিণত করা হয়। এ ছাড়া, আরও ৩টি বিশেষায়িত ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের দ্রুত উন্নয়নের লক্ষ্যে।
সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর অব্যবস্থাপনা ও এই খাতে প্রতিযোগিতার অভাব বিবেচনায় আশির দশকে ব্যক্তি মালিকানায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়া শুরু হয়। আশা করা হয়েছিল, আর্থিক খাতে সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সুদিন ফিরে আসবে। কিছু ব্যাংক যেমন ইসলামি ব্যাংকসহ আরও দু–একটা ব্যাংক ভালো ফলাফল দেখালেও ব্যাংকিং খাতের অবস্থা সরকারি খাতসহ দিনে দিনে খারাপ হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো গঠনমূলক পদক্ষেপ তো ছিলই না, উপরন্তু একেক সরকার আসার পর নতুন করে ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার হিড়িক পরে যায়। সরকার তার তাঁবেদার বাহিনীকে খুশি করতে শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স দিয়ে থাকে। ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে।
বাংলাদেশের বিকাশমান অর্থনীতিতে ব্যাংকের সংখ্যা যদি কিছু বেশি হতো তাহলে এত অসুবিধা হতো না। দক্ষ ব্যবস্থাপনা আর বিপণন কৌশল থাকলে যেকোনো ব্যাংক ভালো ফলাফল নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স পাওয়া এই সমস্ত ব্যাংক রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ব্যাংকগুলো থেকে আমানতকৃত টাকা লুট করে নিয়ে যায় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা একশ্রেণির ব্যবসায়ী। এই লুটের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে, সেই ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে পড়ে। এই তালিকায় শুধু ব্যাংকই না যোগ হয় লিজিং কোম্পানিগুলোও বিপুল পরিমাণ অনাদায়ি ঋণের দায়ে তারা দেউলিয়া হয়ে পড়েছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর উদ্যোগী হয় এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনার জন্য। কিন্তু ততদিনে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। ব্যাংক আর ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দফারফা হয়ে গিয়েছিল। ব্যাংক লুটকারী ব্যবসায়ীরা লুটের টাকা নিয়ে দেশান্তরী হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র—এই সব দেশে তারা সম্পদ গড়ে তুলেছে। এই সমস্ত ব্যবসায়ীরা আর ব্যাঙ্ক লূটকারীরা নাকি মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইসহ আশেপাশের দেশ ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে।
একটা বিষয় স্পষ্ট যে, অসাধু সরকারি কর্মকর্তা আর অসৎ রাজনৈতিক নেতৃতের সহায়তা ছাড়া দেশের সম্পদ এভাবে লূটপাট করা সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষ যদি সামান্য টাকার ঋণ পেতে চায় তবে তাকে বহু কাঠখড় পুড়াতে হয়, বহু দলিলপত্র দেখাতে হয়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ একেকটা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কীভাবে এত সহজে তুলে নিয়ে গেল।
অন্য দিকে দেখা গিয়েছে ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণকারীরা অনেক কম মাত্রায় ঋণ খেলাপি হয়। সব ব্যবসায় কিছু না কিছু ঝুঁকি থাকে। কিন্তু এই মাত্রায় ঝুঁকি কখোনই হতে পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এগুলো পরিকল্পিত। দুর্ঘটনাবশতঃ তারা ঋণখেলাপি হয়নি। তাহলে কীভাবে এগুলো হলো?
ব্যাপার একটাই তা হলো; এসব ব্যবসায়ী অসাধু সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের গাড়ি–বাড়ি ও বিদেশ ভ্রমণ ইত্যাদি জোগান দেবে আর বিনিময়ে তারা ব্যবসায়ীদের টাকা লুটের ব্যবস্থা করে দেবে। যেমন রোমান সাম্রাজ্যে পোপ রাজাকে আর রাজা পোপকে নিয়োগ দিতেন। এই ব্যবস্থায় একে অপরকে তাদের বিভিন্ন অবৈধ কীর্তি কলাপের নিরাপত্তা দিতেন। সব কিছু অসহায় ধর্মপ্রাণ নাগরিকদের মুখ বুজে সহ্য করতে হতো। এখানেও ব্যাপারটা সেইরকম। একে অপরকে সাহায্য করে দুজনেই ফুলে ফেঁপে ওঠে। আর অসহায় আমানতকারীরা তাদের কষ্টের টাকা ব্যাংক থেকে তুলতে গেলে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। যদিও তারা সাহায্যপ্রার্থী নয়।
আর লিজিং কোম্পানিগুলোর অবস্থাতো আরও খারাপ। আমানতকারীদের টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ। হয়তো বেশ কয়েকটা লিজিং কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করে সেগুলোকে লিকুইডেট করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। হতভাগ্য আমানতকারীরা বেশি লাভের আশায় এই লিজিং কোম্পানিগুলোতে তাদের কষ্টার্জিত টাকা এমনকি অনেকের শেষ সম্বল পর্যন্ত গচ্ছিত রেখেছিল। পিপলস লিজিংয়ের কথা আমরা সবাই জানি। একজন টাকা লুট করে ভারতে পালিয়েছে। তিনি এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এত গেল অসহায় আমানতকারীদের কথা। এই কোম্পানিগুলোর বেশির ভাগ শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি। তার মানে ওই কোম্পানিরগুলোর শেয়ার কিনেছে বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। সাধারণত বিনিয়োগকারীরা অন্য শেয়ারের তুলনায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে বিনিয়োগকে এই ভেবে অগ্রাধিকার দেয় যে, এগুলোতে বিনিয়োগ নিরাপদ। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংকে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো বা (CIB) নামে একটা একটা পৃথক বিভাগ আছে। এই বিভাগের দায়িত্ব মন্দ ঋণ তদারক করা।
এসব স্বত্বেও দিনের পর দিন ধরে এই সব কাণ্ডকারখানা কীভাবে হয়েছে তা অনেক প্রশ্নের দাবি রাখে। এগুলো এক দিনে ভূমিকম্পের মতো করে হয়ে যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়া সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন রয়েছে। তাদের ওপর শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার গুরুদায়িত্ব অর্পিত রয়েছে। তাদেরই বা ভূমিকা কি?
এদিকে অনেক কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকেরা তাদের শেয়ার চড়া দামে বিক্রি করে সরে পড়েছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কাছে যখন প্রকৃত তথ্য আসে তখন সব শেষ। শেয়ার বিক্রি করার মতো অবস্থাও থাকে না।
উত্তরটা এরকম হতে পারে, তারা তো নিজ দায়িত্বে বিনিয়োগ করেছে অথবা দায়দায়িত্ব তাদের। কিন্তু কোম্পনিগুলোর তলে তলে নিয়মনীতি বহির্ভূত কার্যকলাপের ওপর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সামান্য কোনো তথ্য বা নিয়ন্ত্রণ থাকে না। থাকলে তারা সেই সব শেয়ারে বিনিয়োগ বা সেখানে আমানত রাখত না। যখন সেই প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়ে তখন তার তার দায়দায়িত্ব গিয়ে পড়ে অসহায় বিনিয়োগকারী আর আমানতকারীদের ওপর।
এখন এই প্রতিষ্ঠানগুলো একীভূত করা হোক বা লিকুইডেট করা হোক, চরম অনাস্থা বিরাজ করবে আর্থিক খাতে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য সরকার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু যখন তারা জানবে যে আর্থিক খাতের অবস্থা এরকম ভঙ্গুর, তখন তারা এত বোকা গবেট না যে, আরও অনেক নিরাপদ জায়গা ছেড়ে এখানে বিনিয়োগ করতে আসবে। অথচ বিনিয়োগ আর কর্মসংস্থান আমাদের অগ্রাধিকার খাত।
অন্যদিকে শেয়ার বাজার আর ব্যাংকিং বা সর্বোপরি আর্থিক খাতে এই ধরনের অনিশ্চয়তা আর দুর্বৃত্তায়ন অব্যাহত থাকে তবে অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। বিনিয়োগ যদি ঝুঁকিপূর্ণ আর অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তবে কর্মসংস্থান ও সার্বিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হবে।
বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে আর্থিক খাতের সংস্কার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে শিগগিরই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। আশা করা যায় এতে আবার দেশের আর্থিক ব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়াবে। তবে দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে—এক; জনগণের অর্থ লূটকারী ব্যাংক আর লিজিং কোম্পানির মালিকদের শাস্তির আওতায় আনা, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা আর দ্বিতীয়ত; বিনিয়োগকারী আর আমানতকারীদের যথাযথ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা। তাতে করে আবার সবাই আস্থা ফিরে পাবে। আর জনগণের অর্থ লুটকারীরা বুঝতে পারবে এখন আর এসব করে পার পাওয়া যাবে না। আশা করি বাংলাদেশের আর্থিক খাতে আবার সুবাতাস বইবে। সেই শুভক্ষণের প্রতীক্ষায় আছে দেশের আপামর জনগণ।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
*লেখক বিভাগীয় প্রধান (ব্যবসায় শাখা), বাংলাদেশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মাস্কাট, ওমান
একটা দেশের অর্থনীতিতে আর্থিক খাতের ভূমিকা কী, তা মনে হয় বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। আর্থিক খাতের প্রধান অঙ্গগুলো হলো—ব্যাংক, ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও শেয়ার বাজার।
বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থার ইতিহাস একটু জেনে নেওয়া দরকার। ১৯৭১ সালের আগে এখানকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা ছিল পাকিস্তানি আর বিদেশিদের নিয়ন্ত্রণে। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানি মালিকানায় থাকা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পরিণত করা হয়। এ ছাড়া, আরও ৩টি বিশেষায়িত ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের দ্রুত উন্নয়নের লক্ষ্যে।
সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর অব্যবস্থাপনা ও এই খাতে প্রতিযোগিতার অভাব বিবেচনায় আশির দশকে ব্যক্তি মালিকানায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়া শুরু হয়। আশা করা হয়েছিল, আর্থিক খাতে সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সুদিন ফিরে আসবে। কিছু ব্যাংক যেমন ইসলামি ব্যাংকসহ আরও দু–একটা ব্যাংক ভালো ফলাফল দেখালেও ব্যাংকিং খাতের অবস্থা সরকারি খাতসহ দিনে দিনে খারাপ হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো গঠনমূলক পদক্ষেপ তো ছিলই না, উপরন্তু একেক সরকার আসার পর নতুন করে ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার হিড়িক পরে যায়। সরকার তার তাঁবেদার বাহিনীকে খুশি করতে শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স দিয়ে থাকে। ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে।
বাংলাদেশের বিকাশমান অর্থনীতিতে ব্যাংকের সংখ্যা যদি কিছু বেশি হতো তাহলে এত অসুবিধা হতো না। দক্ষ ব্যবস্থাপনা আর বিপণন কৌশল থাকলে যেকোনো ব্যাংক ভালো ফলাফল নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স পাওয়া এই সমস্ত ব্যাংক রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ব্যাংকগুলো থেকে আমানতকৃত টাকা লুট করে নিয়ে যায় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা একশ্রেণির ব্যবসায়ী। এই লুটের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে, সেই ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে পড়ে। এই তালিকায় শুধু ব্যাংকই না যোগ হয় লিজিং কোম্পানিগুলোও বিপুল পরিমাণ অনাদায়ি ঋণের দায়ে তারা দেউলিয়া হয়ে পড়েছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর উদ্যোগী হয় এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনার জন্য। কিন্তু ততদিনে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। ব্যাংক আর ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দফারফা হয়ে গিয়েছিল। ব্যাংক লুটকারী ব্যবসায়ীরা লুটের টাকা নিয়ে দেশান্তরী হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র—এই সব দেশে তারা সম্পদ গড়ে তুলেছে। এই সমস্ত ব্যবসায়ীরা আর ব্যাঙ্ক লূটকারীরা নাকি মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইসহ আশেপাশের দেশ ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে।
একটা বিষয় স্পষ্ট যে, অসাধু সরকারি কর্মকর্তা আর অসৎ রাজনৈতিক নেতৃতের সহায়তা ছাড়া দেশের সম্পদ এভাবে লূটপাট করা সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষ যদি সামান্য টাকার ঋণ পেতে চায় তবে তাকে বহু কাঠখড় পুড়াতে হয়, বহু দলিলপত্র দেখাতে হয়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ একেকটা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কীভাবে এত সহজে তুলে নিয়ে গেল।
অন্য দিকে দেখা গিয়েছে ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণকারীরা অনেক কম মাত্রায় ঋণ খেলাপি হয়। সব ব্যবসায় কিছু না কিছু ঝুঁকি থাকে। কিন্তু এই মাত্রায় ঝুঁকি কখোনই হতে পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এগুলো পরিকল্পিত। দুর্ঘটনাবশতঃ তারা ঋণখেলাপি হয়নি। তাহলে কীভাবে এগুলো হলো?
ব্যাপার একটাই তা হলো; এসব ব্যবসায়ী অসাধু সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের গাড়ি–বাড়ি ও বিদেশ ভ্রমণ ইত্যাদি জোগান দেবে আর বিনিময়ে তারা ব্যবসায়ীদের টাকা লুটের ব্যবস্থা করে দেবে। যেমন রোমান সাম্রাজ্যে পোপ রাজাকে আর রাজা পোপকে নিয়োগ দিতেন। এই ব্যবস্থায় একে অপরকে তাদের বিভিন্ন অবৈধ কীর্তি কলাপের নিরাপত্তা দিতেন। সব কিছু অসহায় ধর্মপ্রাণ নাগরিকদের মুখ বুজে সহ্য করতে হতো। এখানেও ব্যাপারটা সেইরকম। একে অপরকে সাহায্য করে দুজনেই ফুলে ফেঁপে ওঠে। আর অসহায় আমানতকারীরা তাদের কষ্টের টাকা ব্যাংক থেকে তুলতে গেলে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। যদিও তারা সাহায্যপ্রার্থী নয়।
আর লিজিং কোম্পানিগুলোর অবস্থাতো আরও খারাপ। আমানতকারীদের টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ। হয়তো বেশ কয়েকটা লিজিং কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করে সেগুলোকে লিকুইডেট করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। হতভাগ্য আমানতকারীরা বেশি লাভের আশায় এই লিজিং কোম্পানিগুলোতে তাদের কষ্টার্জিত টাকা এমনকি অনেকের শেষ সম্বল পর্যন্ত গচ্ছিত রেখেছিল। পিপলস লিজিংয়ের কথা আমরা সবাই জানি। একজন টাকা লুট করে ভারতে পালিয়েছে। তিনি এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এত গেল অসহায় আমানতকারীদের কথা। এই কোম্পানিগুলোর বেশির ভাগ শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি। তার মানে ওই কোম্পানিরগুলোর শেয়ার কিনেছে বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। সাধারণত বিনিয়োগকারীরা অন্য শেয়ারের তুলনায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে বিনিয়োগকে এই ভেবে অগ্রাধিকার দেয় যে, এগুলোতে বিনিয়োগ নিরাপদ। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংকে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো বা (CIB) নামে একটা একটা পৃথক বিভাগ আছে। এই বিভাগের দায়িত্ব মন্দ ঋণ তদারক করা।
এসব স্বত্বেও দিনের পর দিন ধরে এই সব কাণ্ডকারখানা কীভাবে হয়েছে তা অনেক প্রশ্নের দাবি রাখে। এগুলো এক দিনে ভূমিকম্পের মতো করে হয়ে যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়া সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন রয়েছে। তাদের ওপর শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার গুরুদায়িত্ব অর্পিত রয়েছে। তাদেরই বা ভূমিকা কি?
এদিকে অনেক কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকেরা তাদের শেয়ার চড়া দামে বিক্রি করে সরে পড়েছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কাছে যখন প্রকৃত তথ্য আসে তখন সব শেষ। শেয়ার বিক্রি করার মতো অবস্থাও থাকে না।
উত্তরটা এরকম হতে পারে, তারা তো নিজ দায়িত্বে বিনিয়োগ করেছে অথবা দায়দায়িত্ব তাদের। কিন্তু কোম্পনিগুলোর তলে তলে নিয়মনীতি বহির্ভূত কার্যকলাপের ওপর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সামান্য কোনো তথ্য বা নিয়ন্ত্রণ থাকে না। থাকলে তারা সেই সব শেয়ারে বিনিয়োগ বা সেখানে আমানত রাখত না। যখন সেই প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়ে তখন তার তার দায়দায়িত্ব গিয়ে পড়ে অসহায় বিনিয়োগকারী আর আমানতকারীদের ওপর।
এখন এই প্রতিষ্ঠানগুলো একীভূত করা হোক বা লিকুইডেট করা হোক, চরম অনাস্থা বিরাজ করবে আর্থিক খাতে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য সরকার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু যখন তারা জানবে যে আর্থিক খাতের অবস্থা এরকম ভঙ্গুর, তখন তারা এত বোকা গবেট না যে, আরও অনেক নিরাপদ জায়গা ছেড়ে এখানে বিনিয়োগ করতে আসবে। অথচ বিনিয়োগ আর কর্মসংস্থান আমাদের অগ্রাধিকার খাত।
অন্যদিকে শেয়ার বাজার আর ব্যাংকিং বা সর্বোপরি আর্থিক খাতে এই ধরনের অনিশ্চয়তা আর দুর্বৃত্তায়ন অব্যাহত থাকে তবে অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। বিনিয়োগ যদি ঝুঁকিপূর্ণ আর অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তবে কর্মসংস্থান ও সার্বিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হবে।
বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে আর্থিক খাতের সংস্কার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে শিগগিরই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। আশা করা যায় এতে আবার দেশের আর্থিক ব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়াবে। তবে দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে—এক; জনগণের অর্থ লূটকারী ব্যাংক আর লিজিং কোম্পানির মালিকদের শাস্তির আওতায় আনা, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা আর দ্বিতীয়ত; বিনিয়োগকারী আর আমানতকারীদের যথাযথ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা। তাতে করে আবার সবাই আস্থা ফিরে পাবে। আর জনগণের অর্থ লুটকারীরা বুঝতে পারবে এখন আর এসব করে পার পাওয়া যাবে না। আশা করি বাংলাদেশের আর্থিক খাতে আবার সুবাতাস বইবে। সেই শুভক্ষণের প্রতীক্ষায় আছে দেশের আপামর জনগণ।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
*লেখক বিভাগীয় প্রধান (ব্যবসায় শাখা), বাংলাদেশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মাস্কাট, ওমান
একটা দেশের অর্থনীতিতে আর্থিক খাতের ভূমিকা কী, তা মনে হয় বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। আর্থিক খাতের প্রধান অঙ্গগুলো হলো—ব্যাংক, ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও শেয়ার বাজার।
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এক অদ্ভুত ত্রিভুজ—আওয়ামী লীগ, বিএনপি আর জামায়াত। কখনো সরাসরি, কখনো মুখোমুখি সংঘাত, কখনো আঁতাত—এই ত্রিভুজই ছিল ক্ষমতার মূল অঙ্ক।
শুধু পেশাগত দক্ষতা যথেষ্ট নয়; বিদেশের সংস্কৃতি, ভাষা ও সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি। একটি নতুন দেশে কাজ করতে গেলে কেবল যান্ত্রিক দক্ষতা দিয়ে কাজ চালানো কঠিন হতে পারে। বরং ভাষার দক্ষতা, মানবিক আচরণ ও সামাজিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার ক্ষমতা কর্মীদের জীবনকে ফলপ্রসূ করে তুলতে পারে।
লং টার্ম সম্পর্কের জন্য মোলায়েম কথা খুব উপকারি। ব্যক্তিগত মানুষটি যদি কারণে/অকারণে প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে ওঠে সেই সম্পর্কে আর যাই থাকুক আনুগত্য থাকে না। সম্পর্ক হতে হবে মুক্ত জানালার মতো। যত দূর চোখ যায় শুধু তাকিয়ে থাকা। তাকে ভাবলেই যদি ক্লান্তি আসে সেটা কোনোভাবেই সম্পর্ক হতে পারে না।
শুধু পেশাগত দক্ষতা যথেষ্ট নয়; বিদেশের সংস্কৃতি, ভাষা ও সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি। একটি নতুন দেশে কাজ করতে গেলে কেবল যান্ত্রিক দক্ষতা দিয়ে কাজ চালানো কঠিন হতে পারে। বরং ভাষার দক্ষতা, মানবিক আচরণ ও সামাজিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার ক্ষমতা কর্মীদের জীবনকে ফলপ্রসূ করে তুলতে পারে।
৬ দিন আগে