
মঞ্জুর চৌধুরী

আমার আজকের গল্পটা আমাদের সিলেটের। অতি ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর জীবনে ঘটা। সে নাম প্রকাশ করতে চায় না বলেই তার আসল নাম বলছি না। ধরা যাক, তার নাম আসিফ।
আসিফ তখন কলেজে পড়ে। সিলেটে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। এসএসসি পাস করার পর বাবা–মা তাকে ঢাকায় একটি কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। আমরা পড়ে রইলাম সিলেট এমসি কলেজে। পুরানো বন্ধুরা একসঙ্গে কলেজে যাই, ক্লাস করি কম, আড্ডা দিই বেশি। ‘বড় হয়ে গেছি’ ভাব নিয়ে শহরময় ঘুরে বেড়াই।
অন্যদিকে আসিফ বেচারা দূরের ঢাকা শহরে নতুন বন্ধু বানাতে ব্যস্ত। নতুন শহর, নতুন মানুষ, নতুন পরিবেশ আর এইচএসসির বিশাল সিলেবাসের চাপ। আমরাতো ওকে মিস করতামই, আসিফ আমাদের আরও বেশি মিস করত।
আসিফ ধনী পরিবারের সন্তান। বাবার নানান ব্যবসা আছে। সিলেট শহরে বাবার বিশাল দোতলা বাড়ি। সেখানে সামনে পেছনে দুই দিকেই চমৎকার বাগান। বাগানে সাদা খরগোশ খেলে বেড়ায়। কোনো এককালে নাকি হরিণও ছিল। ঘরের ভেতরে সিঁড়ি। সিনেমার শুটিং করার মতোন চমৎকার লোকেশন। ওই বাড়িতে গেলেই আমার মনে হতো আসিফের ধনী বাবা স্যুট–টাই পরে পাইপ হাতে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে গরিব কোনো নায়ককে বলবেন, ‘বল, কত টাকা পেলে তুমি আমার মেয়ের জীবন থেকে সরে যাবে?’ নায়ক তখন পাল্টা হুমকি দেবে, ‘চৌধুরী সাহেব! টাকা দিয়ে সব কেনা গেলেও, ভালোবাসা কেনা যায় না!’ তিনি কলিজা কাঁপানো হুংকার দেবেন, ‘খামোশ!’
আসিফের কোনো বোন নেই! ওপর নিচে ওঠানামা ছাড়া সিঁড়িটা আমার আর কোনো কাজে লাগল না। আফসোস!
তা কলেজ ফার্স্টইয়ারে শীতের ছুটিতে আসিফ সিলেট ফিরছিল। আংকেল কখনই বাংলাদেশের বাস, ট্রেন ইত্যাদির ওপর ভরসা রাখতে পারতেন না। তার কেবলই মনে হতো ওরা রাস্তায় নামেই অ্যাক্সিডেন্ট করার জন্য। অবিশ্বাস্য মনে হলেও ঘটনা সত্য যে, আসিফ জীবনেও বাংলাদেশে ট্রেনে চড়েনি। হয় প্রাইভেট গাড়ি, না হয় প্লেনে যাতায়াত করত। অথচ আমার শৈশবের সেরা স্মৃতির অন্যতম ছিল ট্রেন যাত্রার মুহূর্তগুলো। আমাদের তিন ভাইবোনের মধ্যে কাড়াকাড়ি হতো কে জানালার পাশের সিটে বসবে তা নিয়ে। জানালা দিয়ে মুগ্ধ নয়নে আমরা দেখতাম কৃষকের গরু দিয়ে ফসলের মাঠে হাল টানা। ছোট ছোট ডোবা বা পুকুরে মহিষের পালের নাক ভাসিয়ে রেখে পানিতে ডুবে থাকা। গ্রামীণ গৃহবধূর কর্মব্যস্ত দিন। রেললাইনের পাশে টেলিগ্রাফের তারের ওপর কোনো স্বাধীন পাখির গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে থাকা। গ্রাম্য শিশু-কিশোরদের দৌড়ে এসে জলাশয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া দেখতে দেখতে ভাবতাম জীবনের সব সুখতো ওরাই ভোগ করছে!
শ্রীমঙ্গলের জঙ্গল বা চা বাগানের মধ্য দিয়ে যখন শীষ বাজিয়ে দুলদুলতে ছুটে যেত আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেন, মনে হতো যেন কোনো হরিৎসাগরে আমরা ডুব সাঁতারে নেমেছি! চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী পাহাড়ের বুকে লেখা ‘উন্নত মম শির’ আজও শরীরের রক্ত দোলায়। আর ট্রেনের জানালা গলে দৃশ্যমান দূরের সমুদ্রের বুকে ভাসমান একাকী নিঃসঙ্গ বিষণ্ণ জাহাজ! ট্রেন যাত্রা না হলে এসব দেখার উপায় ছিল?
অবশ্য আংকেলকে একতরফা দোষ দেওয়া যায় না। তখন সড়ক ও নৌ দুর্ঘটনায় প্রচুর মানুষের মৃত্যুর খবরও প্রতিদিন আসত। তা ছাড়া, আংকেলের কলেজ জীবনের অতি প্রিয় বন্ধু রোড অ্যাকসিডেন্টেই মারা গেছেন। তাই আসিফের জন্য তিনি ঢাকায় একটি প্রাইভেট গাড়িরও ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। টয়োটা প্রাডো। বিশাল আকৃতির এসইউভি। রাক্ষসের মতোন তেল খায়। কলেজ ছাত্রের জন্য এত বিলাসী গাড়ির প্রয়োজন নেই। তবু আংকেলের বিশ্বাস প্রাডোর সঙ্গে অন্য গাড়ি যদি মুখোমুখি সংঘর্ষও করে, তাহলেও এই গাড়ি টিকে থাকবে।
আংকেল নিজের জন্যও তেমনই ভারী আরেকটি গাড়ি ব্যবহার করতেন। ওনার সামর্থ্যে থাকলে তারা গোটা পরিবার মিলিটারি ট্যাংকে যাতায়াত করতেন।
টয়োটা প্রাডোতে চেপে আসিফ সিলেটের উদ্দেশে রওনা দেয়। দুপুরের খাবার খেয়ে রওনা দিলেও সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী ইত্যাদি এলাকায় প্রচন্ড জ্যামে আটকে গিয়ে ঢাকা থেকে বেরোতে বেরোতেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। তবে ঢাকা শহর থেকে বেরোনোর পরেই আর জ্যাম ছিল না। গাড়ি নির্দিষ্ট গতিসীমা বজায় রেখে এগোচ্ছিল। বাইরে অন্ধকার, মাঝে মাঝে হাইওয়ের পাশের দোকান, দালান বা দূরের বাড়িঘরগুলোর টিমটিমে বাতি চোখে পড়ছে। শীতের আকাশ। অর্ধেক পূর্ণিমা। মেঘ ও কুয়াশা সেই আলোতেও ভাগ বসিয়েছে। জানালা দিয়ে বাংলা মায়ের রূপ দর্শনের কোনো উপায় নেই।
সিলেটের দিকে গাড়ি যত এগোচ্ছে, রাস্তায় ট্রাফিক ততই কমছে। মাঝে মাঝে উল্কার বেগে কিছু যাত্রীবোঝাই দূরপাল্লার বাসগুলো ছুটে যাচ্ছে। চালকের চালানোর ভঙ্গিতেই বাংলাদেশের এত এত সড়ক দুর্ঘটনার কারণ সুস্পষ্ট হয়।
আসিফ চালকের পাশের সিটে বসে ছিল। চালকের নাম মিল্টন (এটিও ছদ্মনাম)। ওদের বেশ পুরানো ড্রাইভার। আসিফের জন্মের আগে, এই মিল্টন ভাই–ই গাড়ি চালিয়ে আন্টিকে ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। খুবই সাবধানী চালক। আংকেলের বিশেষ ভরসার লোক। তিনি চোখ কান সব খুলেই গাড়ি চালান।
সেদিন গাড়ির ক্যাসেট প্লেয়ারে উঁচু ভলিউমে ক্যাসেট বাজছে। ইংলিশ ব্যান্ডের গান। কোন ব্যান্ড, কোন অ্যালবাম সেসব আসিফ বলেছিল। কিন্তু আর এখন কিছুই মনে নেই। তবে এটা মনে আছে, গাড়ি চলতে চলতে আসিফের তন্দ্রামতো পেয়েছিল। দুই চোখ খুলে রাখতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। যদিও এ সময়ে ঘুমানোর অভ্যাস ওর ছিল না। তখন বয়সে সে তরুণ, গভীর রাত জেগে আড্ডা দেওয়া ছিল স্বভাব। সন্ধ্যা হতেই ঘুম ব্যাপারটা স্বাভাবিক ছিল না। বহু কষ্টেও সে চোখের পাতা মেলে রাখতে পারছিল না। স্পিকারে গানের ভলিউম বাড়িয়ে দিল। বিদেশি মেটাল গায়ক সুরের তালে চিৎকার চেঁচামেচি করেই যাচ্ছে, কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। একটা পর্যায়ে আসিফ ঘুমে তলিয়ে গেল। গাড়ি চালাচ্ছেন মিল্টন ভাই। তিনি না ঘুমালেই হলো।
আসিফ কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল খেয়াল নেই। ঘুম ভেঙে দেখে সে গাড়িতেই বসা, মিল্টন ভাইও পাশে বসে আছেন, কিন্তু গাড়ি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির চারপাশে সাদা ধোঁয়ার ঘন পর্দা। সামনে পিছনে কোথাও কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
আসিফ বেশ হকচকিয়ে গেল।
‘কী হয়েছে মিল্টন ভাই?’
মিল্টন ভাই সিলেটি ভাষায় যা বললেন, তার শুদ্ধ বাংলা হচ্ছে ‘কুয়াশা পড়েছে। তাই গাড়ি থামিয়ে বসে আছি।’
আসলেই প্রচন্ড কুয়াশা পড়েছে। এত ঘন কুয়াশা আসিফ জীবনেও দেখেনি। এক হাত সামনের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না।
সময় কাটতে লাগল, তবু কুয়াশার ঘনত্ব কমে না। আশ্চর্য! এমনটা কখনো হয়? এমন আর কতক্ষণ বসে থাকতে হবে? কিন্তু কিছুই করার নেই। সামনে চালাতে গেলেই অ্যাকসিডেন্ট হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা।
আসিফ হাত ঘড়ি দেখল। অবাক কান্ড! ব্যাটারি ডেড! সময়ের কাঁটা থমকে আছে। গাড়ির ঘড়িও থমকে আছে। তখনকার দিনে মোবাইল ফোন ছিল বিলাসী ব্যাপার। কেবল ধনী বাবা মায়ের হাতে থাকত। কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের হাতে থাকারতো প্রশ্নই ওঠে না।
একটু পরপর গাড়ি, বাস ও ট্রাকের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওগুলোর কেউই থেমে নেই। কুয়াশার চাদর ভেদ করে ওরা সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।
ওদের উদ্দেশে মিল্টন ভাই বললেন, ‘ওরা যে মরে, এমনি এমনি মরে না।’
কতক্ষণ পর ঠিক মনে নেই, তবে কুয়াশা খানিকটা পাতলা হলো। মিল্টন ভাই ‘বিসমিল্লাহে মাজরেহা ওয়ামুরসাহা ইন্না রাব্বি লাগাফুরুর রাহিম’ বলে আবারও ইঞ্জিন স্টার্ট করলেন। নূহ নবী (আ.) তার বিখ্যাত নৌকায় উঠে এই দোয়া করেছিলেন। মহাপ্লাবনের হাত থেকে আল্লাহ সেই নৌকাকে রক্ষা করেছিলেন। মুসলিমরা যেকোনো যানে উঠলেই তাই এই দোয়া পাঠ করেন। ‘আল্লাহর নামে এটি চলবে এবং আল্লাহর নামে এটি থামবে। আমার প্রতিপালক অবশ্যই ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’
গাড়ি ধীরে সুস্থে এগুতে লাগল। তবে মিল্টন ভাইকে দেখে বোঝা যাচ্ছে, তিনি চালিয়ে স্বস্তি পাচ্ছেন না।
এই সময়ে আসিফের প্রচন্ড ক্ষুধা পেল। অবিশ্বাস্য রকমের ক্ষুধা। যেন বহুদিনের অভুক্ত সে, পেটে যা যাবে, মুহূর্তেই হজম হয়ে যাবে। লোহা লক্করও হজম করার ক্ষমতা এখন ওর পাকস্থলীর আছে।
সে পেট খামচে ধরে বলল, ‘মিল্টন ভাই, কোথাও কোন রেস্টুরেন্ট পেলে থামেনতো। কিছু খেতে হবে।’
মিল্টন ভাই জানেন আসিফ যেকোনো রেস্টুরেন্টে খায় না। ধনীর ঘরের সন্তান, যেখানে সেখানে খেয়ে অভ্যাস নেই। রাস্তার খাবার খেলে শেষে পেট নেমে যেতে পারে। আংকেলও এ কারণে বকাঝকা করবেন।
কিন্তু আসিফ বলে উঠল, ‘যেকোনো রেস্টুরেন্ট হলেই চলবে। ভাত, বিরিয়ানি, পাউরুটি হলেও কিছু যায় আসে না। ছাপড়া দোকান পেলেও গাড়ি সাইড করবেন।’
মিল্টন ভাই সামনে গাড়ি চালাতে চালাতে রাস্তার সাইডের দিকেও সতর্ক নজর রাখলেন। অদ্ভুত ব্যাপার! এতদূর এগিয়েছেন, অথচ কুয়াশা কাটছেই না। কখনইতো এমন ঘটে না। কুয়াশা যতই ঘন হোক, সামান্য একটা জায়গাজুড়েই তা নামে। অথচ আজকেরটা মনে হচ্ছে যেন গোটা দেশজুড়েই নেমেছে।
হঠাৎ তার কাছে মনে হলো হয়তো কুয়াশা আসলে তাদের সঙ্গেই চলছে। অদ্ভুত ও আজগুবি শোনায় বলেই তিনি ধারণাটাকে তেমন পাত্তা দিলেন না।
আসিফের কাছে দৃশ্যটা অনেকটা প্লেনে চেপে মেঘের মধ্য দিয়ে যাওয়ার মতোন লাগছে। বিদেশে যাওয়ার সময়ে প্লেন একটা পর্যায়ে মেঘের স্তরের মধ্য দিয়ে যায়। তখন প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে এমনই মনে হয়।
অনেকখানি পথ চলার পর মিল্টন ভাই গাড়ি সাইড করলেন। রাস্তার ধারে একটি ঘরে বেশ আলো দেখা যাচ্ছে। দোকানের মতোন মনে হচ্ছে। হয়তোবা কোনো খাবার পাওয়া যাবে!
গাড়ি থেকে নেমে তারা অতি সাবধানে আলো লক্ষ্য করে এগোলো। ভাগ্য ভালো, এটি একটি রেস্টুরেন্ট! চেয়ার-টেবিল পাতা। রেজিস্টারে লোক বসা। মাথা নিচু করে কিছু পড়ছে। তাদের দেখে বেশ অবাক দৃষ্টিতে তাকাল।
লোকটাকে দেখে আসিফও বেশ অবাক হলো। তুষার সাদা পোশাকে রূপবান এক যুবক। শক্তপোক্ত শরীর ও চেহারা। বসে আছে, তবু বোঝা যায় বেশ লম্বা শারীরিক গঠন। দাড়ি গোঁফ কামানো। সুন্দর করে আঁচড়ানো চুল। চোখটা সুন্দর। চোখের মণি ধূসর। তখনকার দিনে ভারতীয় সিনেমায় হৃত্বিক রোশন সুপারস্টার ছিল। লোকটার চোখ হৃত্বিকের মতোই দেখতে। চকচক করছে।
‘খাবার আছে ভাই?’ আসিফ প্রশ্ন করল।
লোকটা ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ে।
‘যা আছে জলদি আনেন।’
লোকটা জিজ্ঞেস করে, ‘কী খাইবেন?’
‘ভাত, মাছ, মাংস যেটা জলদি দিতে পারবেন, সেটাই আনেন।’ আসিফের পেট কয়েকটা মোচড় দিয়ে দিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে কিছু পেটে না গেলে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে। কবি সুকান্ত কেন চাঁদকে রুটির মতোন চিবিয়ে খেতে চেয়েছিলেন সেটা সে এখন ভালোই টের পাচ্ছে।
‘আপনারা বসেন। আনতেছি।’
ছেলেটার উচ্চারণে সিলেটি বা পরিচিত কোন আঞ্চলিক টান নেই। আবার ঠিক শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণও সে করছে না। কোন অঞ্চলের ভাষা আসিফ ঠিক বুঝতে পারল না।
ওরা দোকানের ভেতরে ঢুকে গেল। ভেতরটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। তবে গ্রাম্য হোটেল রেস্টুরেন্ট যেমন হয়, এটি ঠিক তেমন নয়। আসলে, এটি ঠিক পরিচিত শহুরে রেস্তোরাঁগুলোর মতোনও নয়। তীব্র আলোর বন্যায় ঘর ডুবে আছে। টিউবলাইটের সাদা আলো। কয়টা বাতি জ্বালিয়েছে? চোখ মেলে রাখতে বেগ পেতে হয়। আর দেয়ালটাও ধবধবে সাদা। এতটাই সাদা যে মনে হচ্ছে দেয়াল থেকেই যেন আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে। তাতে একটিও ক্যালেন্ডার, ছবির ফ্রেম, দেয়াল ঘড়ি, কোরআন-হাদিসের বাণী কিছুই ঝুলছে না। একটা গ্রামীণ রেস্টুরেন্টে দেয়াল এত ধবধবে সাদা কীভাবে রাখতে পারে? আজকেই কি রং করিয়েছে? প্লাস্টিক পেইন্ট?
দেয়াল ও ছাদ যেমন সাদা, মেঝে তেমনই কুচকুচে কালো। এতটাই যে মনে হয় সেখানে আলো পড়ে প্রতিফলিত হয় না, হারিয়ে যায়। বিজ্ঞান বইয়ে পড়া ব্ল্যাকহোলের মতোন অবস্থা। আলো শুষে নিচ্ছে। ঝাঁ চকচকে পরিষ্কার। একবিন্দু ময়লা সেখানে নেই। হয়তো কিছুক্ষণ আগেই ধোয়ামোছা করা হয়েছে। এমন মেঝেতে জুতা পায়ে হাঁটলে নিজেকে অপরাধী মনে হয়।
ওরা খালি দেখে একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। চেয়ার টেনে বসতে গিয়ে দেখে এটি প্লাস্টিকের নয়, আবার লোহা বা কাঠেরও নয়। কোন ম্যাটেরিয়ালে তৈরি সেটা আসিফ বা মিল্টন ভাই কেউই বুঝতে পারল না। ওজনে হালকা তবে বেশ মজবুত ও টেকসই চেয়ার টেবিল।
আশেপাশের টেবিলের লোকজনও কেমন অদ্ভুত। এক দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছে না। আসিফের সেদিকে খেয়াল নেই। সে ক্ষুধা সহ্য করতে পারছে না। কথায় আছে না, প্রচন্ড ক্ষিধায় চোখে অন্ধকার দেখা? ওর হয়েছে সেই দশা। ওর মাথায় এখন গরম ভাতের থালা, মুরগির মাংসের ঝোল আর একবাটি গরুর মাংস ছাড়া কিছুই নেই।
মিল্টন ভাই কেমন ভীত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক দেখছেন। বিড়বিড় করছেন। কী পড়ছেন? সূরা? কোন দোয়া? আসিফের সেটা জানার ইচ্ছা হলো না।
এক বেয়ারা পানির জগ গ্লাস এনে বলল, ‘একটু বসেন। খাবার আসতেছে।’
সে মনে হয় রেজিস্টারে বসা লোকটার ছোট ভাই। এর চোখও ধূসর। চেহারায়ও বেশ মিল আছে।
আসিফ বলল, ‘ভাই, একটু তাড়াতাড়ি আনো। ক্ষুধায় মরে যাচ্ছি!’
সে চলে যেতেই মিল্টন ভাই ফিসফিস করে আসিফকে বললেন, ‘ভাই, চল, আমরা অন্য কোথাও গিয়া খাই।’
আসিফ বেশ অবাক হলো। মানে কী এই কথাটার? এখানে কি সমস্যা?
মিল্টন ভাই যেন ওর মনের কথাই ধরতে পেরেছে। তিনি গলা আরও নিচু করে বললেন, ‘চল, অন্য কোথাও যাই। এখনই।’
এই বাক্যে অনুরোধ ছিল না, বরং আদেশ ছিল। সঙ্গে তাড়াও। আসিফ মিল্টন ভাইকে জন্ম থেকেই চেনে। ফালতু কারণে এমন কথা বলার লোক তিনি না। নিশ্চই কিছু একটা ঘটেছে। ওনার ওপর ভরসা করা যায়।
যদিও ক্ষুধার যন্ত্রণায় তার অবস্থা মরি মরি, তবুও সে উঠে দাঁড়াল।
তখনই রেজিস্টারের লোকটা একদম ওর সামনে উপস্থিত হলো। ঘটনা এতটাই আকস্মিক ছিল যে, আসিফ রীতিমতোন চমকে উঠল। কারণ রেজিস্টার থেকে তাকে হেঁটে আসতে সে দেখেনি। যেন হাওয়া থেকে ওর সামনে প্রকট হয়েছে।
‘ঘটনা কী ছোটভাই? কই যান? এখানে খাবেন না?’
লোকটার কণ্ঠস্বর ফ্যাসফ্যাসে। যেন গলায় ঠান্ডা লেগেছে।
আসিফ কিছু বলার আগেই মিল্টন ভাই বললেন, ‘একটা জরুরি কাজ আছে, আমাদের এখনই যেতে হবে।’
লোকটা মিল্টন ভাইয়ের দিকে ফিরে বললেন, ‘খাবারের চেয়ে জরুরি কাজ আর কী থাকতে পারে? বসেন, খেয়ে যান। কাজ আপনাদের জন্য অপেক্ষা করবে।’
কণ্ঠে কেমন ঔদ্ধত্য়পনা। ওরা যেহেতু চাইছে, তাই খেয়ে যেতেই হবে। এ ছাড়া, আর কোনো অপশন নেই।
মিল্টন ভাইও অটল।
‘না, আমাদের এখুনি যেতে হবে।’
রেস্টুরেন্টে উপস্থিত অন্য কাস্টমারেরা এইবার সমবেত স্বরে বলে উঠল, ‘না, বসেন। খেয়ে যান। একটু পরে যাবেন।’
এবার আসিফ ঘাবড়ে গেল। সবাই কোরাসে এক বাক্য কীভাবে বলল? যেন রিহার্সেল করে তৈরি হয়েছে। একটা বাক্যও এদিক সেদিক হয়নি। এমনটাতো স্বাভাবিক না।

মিল্টন ভাই সামনের দিকে এগোতে গেলে একজন তার সামনে এসে দাঁড়াল। বেশ লম্বা লোকটা। আসিফ লক্ষ্য করল রেস্টুরেন্টের অন্য কাস্টমারেরাও উঠে দাঁড়িয়েছে। সবাই একই সমান লম্বা। সবার পোশাকই এক, দুধ সাদা। যেন কোনো প্রতিষ্ঠানের ইউনিফর্ম, নতুন প্যাকেট খুলে পরে এখানে খেতে এসেছে। আর আশ্চর্যজনক ব্যাপার, সবার চোখই ধূসর!
মিল্টন ভাই আসিফের হাত ধরে এক হ্যাচকা টান দিয়ে বললেন, ‘দৌড়াও, গাড়ির দিকে দৌড়াও! জান লাগায়ে দৌড় দাও!’
আসিফ নির্দেশ শোনামাত্রই দৌড় শুরু করল। দৌড়ালেন মিল্টন ভাইও। রেস্টুরেন্টের কেউ অবশ্য ওদের পিছু ধাওয়া করল না। বাইরে বেরিয়েই গাড়ির দরজা খুলে ওরা ভেতরে ঢুকে পড়ল। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে হেডলাইট জ্বালাতেই দেখে সামনে কোনো রেস্টুরেন্ট, বাড়িঘর, দালান কিছুই নেই। এই কিছুক্ষণ আগেই যা ছিল, যেখানে ওরা বসে ছিল, যেখান থেকে ওরা ছুটে এসেছে, এখন সব গায়েব! তার জায়গায় সব ঘুটঘুটে অন্ধকার। তবে ওদের গাড়ির আলোয় বহু জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। অন্ধকার রাতে রাস্তার কুকুরের চোখে গাড়ির বাতি পড়লে যেমনটা জ্বলে, ঠিক তেমন।
মিল্টন ভাই জোরে জেরে আয়াতুল কুরসি পড়তে শুরু করলেন। দৌড়ে এসে তিনি হাঁপাচ্ছেন। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন। আর পা দিয়ে এক্সেলেটরে জোরে চাপ দিতে থাকলেন। ভি সিক্স ইঞ্জিনের দানবীয় গাড়িটা বুনো পশুর মতোন গর্জন তুলে ছুটতে শুরু করল। আসিফ দেখতে চাইল ওদের কেউ পিছু নিয়েছে কি না। মিল্টন ভাই বললেন, ‘পেছনে তাকায়ো না। সামনে তাকাও! আল্লাহর নাম নাও! জোরে জোরে সূরা পড়্।’
আসিফও আয়াতুল কুরসি পড়তে শুরু করে। বেশ জোরেই।
ইঞ্জিন ও টায়ারের গর্জন করতে করতে শীতের কুয়াশামাখা বাতাস কেটে ছুটে চলেছে টয়োটা প্রাডো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা হাইওয়েতে উঠে গেল। তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে মিল্টন ভাই হাইওয়েতে উঠে গেলেন। কুয়াশার পর্দা ততক্ষণে সরে গেছে। আশেপাশে হাইওয়ের পাশের সাধারণ দৃশ্য। দোকান, মানুষ, বাড়িঘর, ধানখেত, গাছপালা। মিল্টন ভাই তবুও জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন আর উল্কার বেগে গাড়ি ছুটাচ্ছেন। সমানে আয়াতুল কুরসি পড়ে যাচ্ছেন।
‘আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লাহু ওয়াল হাইয়ুল কাইয়ুম।.....’
আশ্চর্য, আসিফের পেটে আর সেই দুঃসহ ক্ষুধাবোধ নেই। ভয়ের কারণেই কি সেটা মরে গেছে?
‘ওরা কারা ছিল?’
আসিফের প্রশ্নে মিল্টন ভাই বললেন, ‘এখন কথা বইলো না। আল্লাহর নাম নাও। পরে বলতেছি।’
সিলেটে বাড়িতে এসে মিল্টন ভাই শান্ত হলেন। যেন ঘাম দিয়ে তার জ্বর ছাড়ল।
তিনি বলেছিলেন, বাড়ির কাউকে এই ঘটনা না বলতে। আসিফ তাই বলেনি। আন্টি এইসবে খুব বিশ্বাস করেন এবং প্রচণ্ড ভয় পান। তিনি জানতে পারলে হয়তো ওর ঢাকায় পড়াশোনাই বন্ধ করে দেবেন। সাথে আট দশটা তাবিজও গলায় ঝুলিয়ে দেবেন।
আসিফ রাতে খেয়েদেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু দুঃস্বপ্নের কারণে ঘুম ঠিক মতোন আসেনি। চোখ বন্ধ করলেই সে দেখেছে সাদা পোশাকের লম্বা এক ব্যক্তি চকচকে দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এমন কঠিন দৃষ্টি সে ওর ছোট্ট জীবনে আর কোথাও দেখেনি।
পরের দিন আমাদের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা করল। সন্ধ্যায় চৌহাট্টায় আমাদের চিরচেনা রেস্টুরেন্টে পরোটা দিয়ে শিক কাবাব খেয়ে বরাবরের মতোন আমার বাড়ির ছাদেই বন্ধুদের আড্ডা হলো। বহু দিনের জমানো গল্প। আমাদের ক্লাসে কী হয়, কোন বন্ধু কী কুকাম করেছে থেকে শুরু করে আমার বাড়ির সামনের এক উঁচু শিমুল গাছের ডগায় চিল সংসার পেতেছে, মাথার ওপর জীবনানন্দের সোনালি ডানার চিল ওড়াউড়ি করে—এমন ফালতু বিষয় নিয়েও আলাপ হলো। অথচ আগের রাতেরই এত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটা আসিফ আমাদের জানাল না।
তার পরের দিন সকালে মিল্টন ভাইকে আসিফ জিজ্ঞেস করলে তিনি আসিফকে বললেন, ‘আমরা একটা বিরাট ফান্দে পড়ছিলাম।’
‘মানে?’
‘কুয়াশা শুধু আমাদের জন্যই আছিল, খেয়াল কর নাই, আমাদের আশেপাশের অন্য সব গাড়ি ঠিকই চলতেছিল? ওই কুয়াশায় কি গাড়ি চালানো সম্ভব আছিল?’
আসিফ এবার অবাক হয়ে যায়। ঘটনা সত্যি। ওরা থেমে থাকলেও অন্য গাড়ি ঠিকই চলাচল করছিল। অথচ সেই ঘন কুয়াশায় শক্তিশালী ফগ লাইট জ্বালিয়ে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। এত দীর্ঘক্ষণ এত ঘন কুয়াশাটাও অস্বাভাবিক ছিল।
‘আমরা যখন টেবিলে বসছিলাম, তখন দেখি আমাদের দিকে ওরা সবাই এক দৃষ্টিতে তাকায়ে আছে।’
‘হু, সেটা আমিও খেয়াল করেছি’, আসিফ বলে।
মিল্টন ভাই বলেন, ‘আমি যখন ওদের সামনের পাতের দিকে তাকাই, দেখি সব কাঁচা মাংস রাখা।’
‘মানে?’
‘মানে ওদের সবার পাতে রান্না ছাড়া কাঁচা মাংস রাখা। এমন যেন এই মাত্র জবাই করে পিস পিস করে কেটে ওদের সামনে রাখা হইছে।’
‘বলেন কী!’
‘আর ওরা সেটা কচ কচ কইরা খাইতেছিল! বাঘ সিংহ বা কুত্তা যেভাবে খায়, ঠিক সেইভাবে। হাত না লাগায়ে, ডাইরেক্ট মুখ দিয়ে তুলে চাবাচ্ছিল।’
আসিফ শুনে হা হয়ে গেল।
‘আপনি নিজের চোখে দেখেছেন?’
মিল্টন ভাইয়ের চোখ মুখ ফ্যাকাসে। আতঙ্কে তিনি তখনো জমে যাচ্ছেন। এই লোকটা শুধু শুধু বানিয়ে মিথ্যা কথা বলার লোক না। বললেন, ‘নাইলে তোমারে কী আর এমনি এমনি উঠতে বলছি?’
‘হু।’
‘তারপরে দেখ নাই ওদের সবার চৌখ আছিল বিলাই চোখা?’
‘সেটাতো দেখেছিই।’
‘হ, লাইট পড়তেই চকচক কইরা উঠল। মাইনষের চোখ এমনে জ্বলে না। আর ওদের খাড়ানো অবস্থায় খেয়াল করছ? কেউই কিন্তু মাটির ওপরে খাড়ানো আছিল না। বাতাসে ভাসতেছিল। আমি কইতেছি, ওরা মানুষ আছিল না।’ তারপরে মিল্টন ভাই গলার স্বর পুরোপুরি পাল্টে বললেন, ‘উনারা আছিলেন।’
‘উনারা বলতে কারা?’ আসিফ ধরতে পারছিল না।
‘উনাদের নাম নিতে নাই।’ মিল্টন ভাই জবাব দেন।
‘জিন?’ আসিফের প্রশ্ন।
মিল্টন ভাই সঙ্গে সঙ্গে নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে বললেন, ‘আহা! তোমারে নাম নিতে না নিষেধ করছি! তুমি নাও কেন? জিন, কিন্তু উনাদের মধ্যেও রকমফের আছে। উনাদের জগতেও অনেক জাতের প্রাণি আর জানোয়ার আছে।’
আসিফ মাথা চুলকাল। জিন–ভূতের ব্যাপারে ওর জ্ঞান কম।
‘আমরা যখন গাড়ি ছুটায় আইতেছিলাম, তখন ওরা সবাই আমাদের গাড়ির ঠিক পিছেই খাড়ায়া ছিল। আমি আয়নায় দেখছি। এই কারণে তোমারে পিছে তাকাইতে না করছি। হয়তো তাকাইলে আমরা গাড়ি কইরা পলায়ে আসতে পারতাম না।’
‘বলেন কী! আসিফ পুরাই হতভম্ভ!
মিল্টন ভাই বললেন, ‘আল্লাহ বিরাট বিপদ থেইকা আমাদের উদ্ধার করছেন। জীবন নিয়া আইতে পারছি, এই কারণেই উনার দরবারে কোটি কোটি শুকরিয়া।’
আসিফের মুখ থেকে যখন আমি গল্পটা শুনলাম, আমিও তখন ওকে বললাম, ‘বলিস কী! কীভাবে সম্ভব?’
তারপরে বললাম, ‘রেস্টুরেন্টটা কোথায় বলতে পারিস?’
আসিফ বলল, ‘সিলেট-ঢাকা হাইওয়েতে। হবিগঞ্জ পেরিয়ে সিলেটের দিকে। একজ্যাক্ট লোকেশন ধরতে পারিনি। তবে এরপরে আর কখনই রাতে ওই রুট ধরে যাত্রা করিনি।’
‘বলিস কী! তোরা আর পরে খোঁজার চেষ্টা করিসনি?’
আসিফ বলে উঠল, ‘আমার কি তোর মতোন মাথা খারাপ পেয়েছিস? কুমিরের মুখ থেকে একবার অলৌকিক উপায়ে বেঁচে ফিরেছি। তাই বলে ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে আবার ওর মুখে যাব?’
‘কিন্তু রহস্যের মুখোমুখি না দাঁড়ালে সেটা ভেদ করবি কীভাবে? নিশ্চই ঘটনার লৌকিক কোনো ব্যাখ্যা আছে।’
‘তোর লৌকিক ব্যাখ্যার .....।’
আসিফ একটা গালি দিল। গালিটা সে ঢাকায় গিয়ে নতুন বন্ধু বান্ধবের কাছে শিখেছে। ব্যাড ইনফ্লুয়েন্স!
এই পর্যন্ত ছিল আসিফের গল্প। এখন আমি বলি হঠাৎ এই পুরানো গল্প বলার কারণটা কী।

আসিফের মুখে ঘটনাটা শুনেছিলাম প্রায় ১৭-১৮ বছর আগে। মস্তিষ্কের অসংখ্য ফোল্ডারের কোনো এক ফাইলে সেটা সযত্নে তুলে রাখা আছে। প্রয়োজন পড়ে না, তাই আর সেটাকে তুলে এনে ঘাটাঘাটি করি না। ধুলা জমে, জমুক। আমি ব্যস্ত নতুন নতুন স্মৃতি সংগ্রহে।
গত বছর এক জরুরি কাজে অস্টিন গিয়েছি। ডালাস থেকে তিন সাড়ে তিন ঘন্টা ড্রাইভিং দূরত্বের পথ। দিনের বেলা গিয়েছি, সন্ধ্যায় কাজ শেষ, ভাবলাম রাতে সেখানে না থেকে বরং বাড়িতেই ফিরে আসি।
রওনা দিয়েছি। পথে কোনো এক কারণে প্রচন্ড ট্রাফিক জ্যাম ছিল। বিরক্তিকর জ্যাম। রাশ আওয়ার (অফিস ছুটি), অ্যাকসিডেন্ট, কনস্ট্রাকশন ইত্যাদি সব একসঙ্গে। গাড়ি নড়েই না এমন অবস্থা। ঘন্টাখানেক পরে ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে, ইন্টারস্টেট হাইওয়ে ছেড়ে ভিন্ন পথে ডালাসের দিকে রওনা হলাম।
শীতের রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার। গ্রামের মধ্য দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে যাচ্ছি। দৃষ্টি রাস্তার দিকে স্থির। এ দেশে সমস্যা হচ্ছে হঠাৎই রাস্তায় বণ্য হরিণ বা ফার্ম থেকে বেরিয়ে আসা গরু–ছাগল রাস্তায় উঠে আসে। তখন বড়সড় অ্যাকসিডেন্ট হয়।
জিপিএস দেখাচ্ছে বাড়ি পৌঁছাতে তখনো দুই ঘন্টা বাকি। ডালাসের কাছাকাছি গিয়ে গাড়ির ব্যাটারি চার্জ করতে হবে। পুরো দিনের ক্লান্তিতে ইচ্ছে করছে এখুনি গিয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়ি। রাতে রওনা দেওয়াটা ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে কি না যখন ভাবছি তখন হঠাৎই ঘন কুয়াশায় আমার পৃথিবী ঢেকে গেল। কুয়াশার ঘনত্ব এতটাই যে আমি পথের ধারে গাড়ি পার্ক করতে বাধ্য হলাম। ফোনের নেটওয়ার্ক নেই। কোন গহীন গ্রামের ভেতর দিয়ে জিপিএস নিয়ে যাচ্ছে আল্লাহ মালুম! বিরক্তিতে মেজাজ অত্যন্ত খারাপ। ঠিক তখন তীব্র ক্ষুধায় আমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেল। প্রচণ্ড ক্ষুধা। রমজান মাসে আমি সেহরি না খেয়েই গোটা মাস রোজা রাখি। ২৪ ঘন্টা না খেয়ে থাকার অভ্যাস আমার খুব আছে। কিন্তু তখনো এমন ক্ষুধাবোধ হয় না। ইচ্ছা করছে এখনই গাড়ি থেকে বেরিয়ে সামনে যা পাব, তাই খেয়ে ফেলি।
আমি ভাবলাম যা আছে কপালে, ধীরে ধীরে গাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া যাক। পথের ধারে কোনো একটি গ্যাস স্টেশন নিশ্চই পাওয়া যাবে। সেখানে নেমে কিছু একটা খেয়ে নেওয়া যাবে।
জিপিএসে সার্চ দিই আশেপাশে খাবারের দোকান কোথায় আছে। দেখায় দেড় মাইল দূরেই একটি আছে। আমি সেই অনুযায়ী গাড়ি নিয়ে এগোতে থাকি।
টেসলা গাড়ির সুবিধা হচ্ছে এর মনিটরে রাস্তার লেন, সামনের গাড়ি, মানুষ ইত্যাদি সব দেখা যায়। অটোড্রাইভ মুডে দিয়ে দিলে গাড়ি বেশ নিরাপদেই সামনের দিকে এগোয়। আমি দেখলাম এই ঘন কুয়াশায় আমি খালি চোখে সামনের কিছু না দেখতে পারলেও আমার গাড়ি তার বিশেষ ক্যামেরা ও সেন্সরে ঠিকই পথ দেখছে। আমি মনিটরের দিকে তাকিয়ে অতি ধীরে অটোপাইলটে দিয়ে গাড়ি চালানো শুরু করলাম। মজাও পেলাম। কেমন একটা ভিডিও গেম ভিডিও গেম অনুভূতি।
হঠাৎ দেখি কুয়াশা পাতলা হয়েছে এবং আমার ডানদিকেই একটি দোকান। রেস্টুরেন্ট নাকি গ্যাস স্টেশন সেটা স্পষ্ট বোঝা না গেলেও এটা বোঝা যাচ্ছে যে, সেখানে খাবারের ব্যবস্থা আছে। দরজা খোলা, ভেতরে আলো ঝলমল করছে।
খানিকটা অবাক হলাম, কারণ আমার জিপিএস বা গাড়ির মনিটরে এই দোকানের কোনো অস্তিত্ব দেখাচ্ছে না। মনিটর দেখাচ্ছে পাশের মাঠ ফাঁকা। আমি গাড়ি সাইড করতে যাব, ঠিক তখনই মস্তিষ্কের সেই পুরানো ফোল্ডার থেকে আসিফের গল্পের ফাইল উঠে এলো। তখন প্রচণ্ড ভয় পেলাম। কুয়াশা, ক্ষুধা, হাইওয়ের পাশের রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি সবতো মিলে যাচ্ছে। ভয়ে আমার লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল। জিন ভূতের পাল্লায় পড়িনিতো?
কিসের ক্ষুধা, কিসের খাওয়া, আমি এক্সেলেটরে চাপ দিলাম। গাড়ি আবার রাস্তায় উঠে গেল। কিছুক্ষণ এগিয়ে যেতেই কুয়াশাও গায়েব! রাস্তা ফকফকা। মাথার ওপরে টেক্সাসের গ্রামীণ বিশাল চাঁদ। আমি গাড়ির গতি বাড়ালাম। পুলিশ ধরলে ধরুক। আমাকে পালাতে হবে।
আমি জানি না, সেদিন আসলেই আমিও কি আসিফের মতোই কোন অদ্ভুতুড়ে রেস্টুরেন্টের ফাঁদে পড়তে চলেছিলাম কি না। অথবা ওটা হয়তো ছিল আমার মনের অহেতুক ভয়। হয়তো নামলে দেখা যেত লোকাল কোন রেস্টুরেন্ট ছিল, যারা বিশ্বের সেরা বার্গার পরিবেশন করে।
কে জানে কী ছিল! আমার রহস্যভেদের ইচ্ছাও হয়নি। ভূতে বিশ্বাস না করলেও ভূতের সাক্ষাতে আমার ভীষণ ভয়।
*মঞ্জুর চৌধুরী, ডালাস, টোক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র

আমার আজকের গল্পটা আমাদের সিলেটের। অতি ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর জীবনে ঘটা। সে নাম প্রকাশ করতে চায় না বলেই তার আসল নাম বলছি না। ধরা যাক, তার নাম আসিফ।
আসিফ তখন কলেজে পড়ে। সিলেটে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। এসএসসি পাস করার পর বাবা–মা তাকে ঢাকায় একটি কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। আমরা পড়ে রইলাম সিলেট এমসি কলেজে। পুরানো বন্ধুরা একসঙ্গে কলেজে যাই, ক্লাস করি কম, আড্ডা দিই বেশি। ‘বড় হয়ে গেছি’ ভাব নিয়ে শহরময় ঘুরে বেড়াই।
অন্যদিকে আসিফ বেচারা দূরের ঢাকা শহরে নতুন বন্ধু বানাতে ব্যস্ত। নতুন শহর, নতুন মানুষ, নতুন পরিবেশ আর এইচএসসির বিশাল সিলেবাসের চাপ। আমরাতো ওকে মিস করতামই, আসিফ আমাদের আরও বেশি মিস করত।
আসিফ ধনী পরিবারের সন্তান। বাবার নানান ব্যবসা আছে। সিলেট শহরে বাবার বিশাল দোতলা বাড়ি। সেখানে সামনে পেছনে দুই দিকেই চমৎকার বাগান। বাগানে সাদা খরগোশ খেলে বেড়ায়। কোনো এককালে নাকি হরিণও ছিল। ঘরের ভেতরে সিঁড়ি। সিনেমার শুটিং করার মতোন চমৎকার লোকেশন। ওই বাড়িতে গেলেই আমার মনে হতো আসিফের ধনী বাবা স্যুট–টাই পরে পাইপ হাতে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে গরিব কোনো নায়ককে বলবেন, ‘বল, কত টাকা পেলে তুমি আমার মেয়ের জীবন থেকে সরে যাবে?’ নায়ক তখন পাল্টা হুমকি দেবে, ‘চৌধুরী সাহেব! টাকা দিয়ে সব কেনা গেলেও, ভালোবাসা কেনা যায় না!’ তিনি কলিজা কাঁপানো হুংকার দেবেন, ‘খামোশ!’
আসিফের কোনো বোন নেই! ওপর নিচে ওঠানামা ছাড়া সিঁড়িটা আমার আর কোনো কাজে লাগল না। আফসোস!
তা কলেজ ফার্স্টইয়ারে শীতের ছুটিতে আসিফ সিলেট ফিরছিল। আংকেল কখনই বাংলাদেশের বাস, ট্রেন ইত্যাদির ওপর ভরসা রাখতে পারতেন না। তার কেবলই মনে হতো ওরা রাস্তায় নামেই অ্যাক্সিডেন্ট করার জন্য। অবিশ্বাস্য মনে হলেও ঘটনা সত্য যে, আসিফ জীবনেও বাংলাদেশে ট্রেনে চড়েনি। হয় প্রাইভেট গাড়ি, না হয় প্লেনে যাতায়াত করত। অথচ আমার শৈশবের সেরা স্মৃতির অন্যতম ছিল ট্রেন যাত্রার মুহূর্তগুলো। আমাদের তিন ভাইবোনের মধ্যে কাড়াকাড়ি হতো কে জানালার পাশের সিটে বসবে তা নিয়ে। জানালা দিয়ে মুগ্ধ নয়নে আমরা দেখতাম কৃষকের গরু দিয়ে ফসলের মাঠে হাল টানা। ছোট ছোট ডোবা বা পুকুরে মহিষের পালের নাক ভাসিয়ে রেখে পানিতে ডুবে থাকা। গ্রামীণ গৃহবধূর কর্মব্যস্ত দিন। রেললাইনের পাশে টেলিগ্রাফের তারের ওপর কোনো স্বাধীন পাখির গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে থাকা। গ্রাম্য শিশু-কিশোরদের দৌড়ে এসে জলাশয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া দেখতে দেখতে ভাবতাম জীবনের সব সুখতো ওরাই ভোগ করছে!
শ্রীমঙ্গলের জঙ্গল বা চা বাগানের মধ্য দিয়ে যখন শীষ বাজিয়ে দুলদুলতে ছুটে যেত আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেন, মনে হতো যেন কোনো হরিৎসাগরে আমরা ডুব সাঁতারে নেমেছি! চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী পাহাড়ের বুকে লেখা ‘উন্নত মম শির’ আজও শরীরের রক্ত দোলায়। আর ট্রেনের জানালা গলে দৃশ্যমান দূরের সমুদ্রের বুকে ভাসমান একাকী নিঃসঙ্গ বিষণ্ণ জাহাজ! ট্রেন যাত্রা না হলে এসব দেখার উপায় ছিল?
অবশ্য আংকেলকে একতরফা দোষ দেওয়া যায় না। তখন সড়ক ও নৌ দুর্ঘটনায় প্রচুর মানুষের মৃত্যুর খবরও প্রতিদিন আসত। তা ছাড়া, আংকেলের কলেজ জীবনের অতি প্রিয় বন্ধু রোড অ্যাকসিডেন্টেই মারা গেছেন। তাই আসিফের জন্য তিনি ঢাকায় একটি প্রাইভেট গাড়িরও ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। টয়োটা প্রাডো। বিশাল আকৃতির এসইউভি। রাক্ষসের মতোন তেল খায়। কলেজ ছাত্রের জন্য এত বিলাসী গাড়ির প্রয়োজন নেই। তবু আংকেলের বিশ্বাস প্রাডোর সঙ্গে অন্য গাড়ি যদি মুখোমুখি সংঘর্ষও করে, তাহলেও এই গাড়ি টিকে থাকবে।
আংকেল নিজের জন্যও তেমনই ভারী আরেকটি গাড়ি ব্যবহার করতেন। ওনার সামর্থ্যে থাকলে তারা গোটা পরিবার মিলিটারি ট্যাংকে যাতায়াত করতেন।
টয়োটা প্রাডোতে চেপে আসিফ সিলেটের উদ্দেশে রওনা দেয়। দুপুরের খাবার খেয়ে রওনা দিলেও সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী ইত্যাদি এলাকায় প্রচন্ড জ্যামে আটকে গিয়ে ঢাকা থেকে বেরোতে বেরোতেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। তবে ঢাকা শহর থেকে বেরোনোর পরেই আর জ্যাম ছিল না। গাড়ি নির্দিষ্ট গতিসীমা বজায় রেখে এগোচ্ছিল। বাইরে অন্ধকার, মাঝে মাঝে হাইওয়ের পাশের দোকান, দালান বা দূরের বাড়িঘরগুলোর টিমটিমে বাতি চোখে পড়ছে। শীতের আকাশ। অর্ধেক পূর্ণিমা। মেঘ ও কুয়াশা সেই আলোতেও ভাগ বসিয়েছে। জানালা দিয়ে বাংলা মায়ের রূপ দর্শনের কোনো উপায় নেই।
সিলেটের দিকে গাড়ি যত এগোচ্ছে, রাস্তায় ট্রাফিক ততই কমছে। মাঝে মাঝে উল্কার বেগে কিছু যাত্রীবোঝাই দূরপাল্লার বাসগুলো ছুটে যাচ্ছে। চালকের চালানোর ভঙ্গিতেই বাংলাদেশের এত এত সড়ক দুর্ঘটনার কারণ সুস্পষ্ট হয়।
আসিফ চালকের পাশের সিটে বসে ছিল। চালকের নাম মিল্টন (এটিও ছদ্মনাম)। ওদের বেশ পুরানো ড্রাইভার। আসিফের জন্মের আগে, এই মিল্টন ভাই–ই গাড়ি চালিয়ে আন্টিকে ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। খুবই সাবধানী চালক। আংকেলের বিশেষ ভরসার লোক। তিনি চোখ কান সব খুলেই গাড়ি চালান।
সেদিন গাড়ির ক্যাসেট প্লেয়ারে উঁচু ভলিউমে ক্যাসেট বাজছে। ইংলিশ ব্যান্ডের গান। কোন ব্যান্ড, কোন অ্যালবাম সেসব আসিফ বলেছিল। কিন্তু আর এখন কিছুই মনে নেই। তবে এটা মনে আছে, গাড়ি চলতে চলতে আসিফের তন্দ্রামতো পেয়েছিল। দুই চোখ খুলে রাখতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। যদিও এ সময়ে ঘুমানোর অভ্যাস ওর ছিল না। তখন বয়সে সে তরুণ, গভীর রাত জেগে আড্ডা দেওয়া ছিল স্বভাব। সন্ধ্যা হতেই ঘুম ব্যাপারটা স্বাভাবিক ছিল না। বহু কষ্টেও সে চোখের পাতা মেলে রাখতে পারছিল না। স্পিকারে গানের ভলিউম বাড়িয়ে দিল। বিদেশি মেটাল গায়ক সুরের তালে চিৎকার চেঁচামেচি করেই যাচ্ছে, কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। একটা পর্যায়ে আসিফ ঘুমে তলিয়ে গেল। গাড়ি চালাচ্ছেন মিল্টন ভাই। তিনি না ঘুমালেই হলো।
আসিফ কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল খেয়াল নেই। ঘুম ভেঙে দেখে সে গাড়িতেই বসা, মিল্টন ভাইও পাশে বসে আছেন, কিন্তু গাড়ি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির চারপাশে সাদা ধোঁয়ার ঘন পর্দা। সামনে পিছনে কোথাও কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
আসিফ বেশ হকচকিয়ে গেল।
‘কী হয়েছে মিল্টন ভাই?’
মিল্টন ভাই সিলেটি ভাষায় যা বললেন, তার শুদ্ধ বাংলা হচ্ছে ‘কুয়াশা পড়েছে। তাই গাড়ি থামিয়ে বসে আছি।’
আসলেই প্রচন্ড কুয়াশা পড়েছে। এত ঘন কুয়াশা আসিফ জীবনেও দেখেনি। এক হাত সামনের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না।
সময় কাটতে লাগল, তবু কুয়াশার ঘনত্ব কমে না। আশ্চর্য! এমনটা কখনো হয়? এমন আর কতক্ষণ বসে থাকতে হবে? কিন্তু কিছুই করার নেই। সামনে চালাতে গেলেই অ্যাকসিডেন্ট হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা।
আসিফ হাত ঘড়ি দেখল। অবাক কান্ড! ব্যাটারি ডেড! সময়ের কাঁটা থমকে আছে। গাড়ির ঘড়িও থমকে আছে। তখনকার দিনে মোবাইল ফোন ছিল বিলাসী ব্যাপার। কেবল ধনী বাবা মায়ের হাতে থাকত। কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের হাতে থাকারতো প্রশ্নই ওঠে না।
একটু পরপর গাড়ি, বাস ও ট্রাকের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওগুলোর কেউই থেমে নেই। কুয়াশার চাদর ভেদ করে ওরা সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।
ওদের উদ্দেশে মিল্টন ভাই বললেন, ‘ওরা যে মরে, এমনি এমনি মরে না।’
কতক্ষণ পর ঠিক মনে নেই, তবে কুয়াশা খানিকটা পাতলা হলো। মিল্টন ভাই ‘বিসমিল্লাহে মাজরেহা ওয়ামুরসাহা ইন্না রাব্বি লাগাফুরুর রাহিম’ বলে আবারও ইঞ্জিন স্টার্ট করলেন। নূহ নবী (আ.) তার বিখ্যাত নৌকায় উঠে এই দোয়া করেছিলেন। মহাপ্লাবনের হাত থেকে আল্লাহ সেই নৌকাকে রক্ষা করেছিলেন। মুসলিমরা যেকোনো যানে উঠলেই তাই এই দোয়া পাঠ করেন। ‘আল্লাহর নামে এটি চলবে এবং আল্লাহর নামে এটি থামবে। আমার প্রতিপালক অবশ্যই ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’
গাড়ি ধীরে সুস্থে এগুতে লাগল। তবে মিল্টন ভাইকে দেখে বোঝা যাচ্ছে, তিনি চালিয়ে স্বস্তি পাচ্ছেন না।
এই সময়ে আসিফের প্রচন্ড ক্ষুধা পেল। অবিশ্বাস্য রকমের ক্ষুধা। যেন বহুদিনের অভুক্ত সে, পেটে যা যাবে, মুহূর্তেই হজম হয়ে যাবে। লোহা লক্করও হজম করার ক্ষমতা এখন ওর পাকস্থলীর আছে।
সে পেট খামচে ধরে বলল, ‘মিল্টন ভাই, কোথাও কোন রেস্টুরেন্ট পেলে থামেনতো। কিছু খেতে হবে।’
মিল্টন ভাই জানেন আসিফ যেকোনো রেস্টুরেন্টে খায় না। ধনীর ঘরের সন্তান, যেখানে সেখানে খেয়ে অভ্যাস নেই। রাস্তার খাবার খেলে শেষে পেট নেমে যেতে পারে। আংকেলও এ কারণে বকাঝকা করবেন।
কিন্তু আসিফ বলে উঠল, ‘যেকোনো রেস্টুরেন্ট হলেই চলবে। ভাত, বিরিয়ানি, পাউরুটি হলেও কিছু যায় আসে না। ছাপড়া দোকান পেলেও গাড়ি সাইড করবেন।’
মিল্টন ভাই সামনে গাড়ি চালাতে চালাতে রাস্তার সাইডের দিকেও সতর্ক নজর রাখলেন। অদ্ভুত ব্যাপার! এতদূর এগিয়েছেন, অথচ কুয়াশা কাটছেই না। কখনইতো এমন ঘটে না। কুয়াশা যতই ঘন হোক, সামান্য একটা জায়গাজুড়েই তা নামে। অথচ আজকেরটা মনে হচ্ছে যেন গোটা দেশজুড়েই নেমেছে।
হঠাৎ তার কাছে মনে হলো হয়তো কুয়াশা আসলে তাদের সঙ্গেই চলছে। অদ্ভুত ও আজগুবি শোনায় বলেই তিনি ধারণাটাকে তেমন পাত্তা দিলেন না।
আসিফের কাছে দৃশ্যটা অনেকটা প্লেনে চেপে মেঘের মধ্য দিয়ে যাওয়ার মতোন লাগছে। বিদেশে যাওয়ার সময়ে প্লেন একটা পর্যায়ে মেঘের স্তরের মধ্য দিয়ে যায়। তখন প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে এমনই মনে হয়।
অনেকখানি পথ চলার পর মিল্টন ভাই গাড়ি সাইড করলেন। রাস্তার ধারে একটি ঘরে বেশ আলো দেখা যাচ্ছে। দোকানের মতোন মনে হচ্ছে। হয়তোবা কোনো খাবার পাওয়া যাবে!
গাড়ি থেকে নেমে তারা অতি সাবধানে আলো লক্ষ্য করে এগোলো। ভাগ্য ভালো, এটি একটি রেস্টুরেন্ট! চেয়ার-টেবিল পাতা। রেজিস্টারে লোক বসা। মাথা নিচু করে কিছু পড়ছে। তাদের দেখে বেশ অবাক দৃষ্টিতে তাকাল।
লোকটাকে দেখে আসিফও বেশ অবাক হলো। তুষার সাদা পোশাকে রূপবান এক যুবক। শক্তপোক্ত শরীর ও চেহারা। বসে আছে, তবু বোঝা যায় বেশ লম্বা শারীরিক গঠন। দাড়ি গোঁফ কামানো। সুন্দর করে আঁচড়ানো চুল। চোখটা সুন্দর। চোখের মণি ধূসর। তখনকার দিনে ভারতীয় সিনেমায় হৃত্বিক রোশন সুপারস্টার ছিল। লোকটার চোখ হৃত্বিকের মতোই দেখতে। চকচক করছে।
‘খাবার আছে ভাই?’ আসিফ প্রশ্ন করল।
লোকটা ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ে।
‘যা আছে জলদি আনেন।’
লোকটা জিজ্ঞেস করে, ‘কী খাইবেন?’
‘ভাত, মাছ, মাংস যেটা জলদি দিতে পারবেন, সেটাই আনেন।’ আসিফের পেট কয়েকটা মোচড় দিয়ে দিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে কিছু পেটে না গেলে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে। কবি সুকান্ত কেন চাঁদকে রুটির মতোন চিবিয়ে খেতে চেয়েছিলেন সেটা সে এখন ভালোই টের পাচ্ছে।
‘আপনারা বসেন। আনতেছি।’
ছেলেটার উচ্চারণে সিলেটি বা পরিচিত কোন আঞ্চলিক টান নেই। আবার ঠিক শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণও সে করছে না। কোন অঞ্চলের ভাষা আসিফ ঠিক বুঝতে পারল না।
ওরা দোকানের ভেতরে ঢুকে গেল। ভেতরটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। তবে গ্রাম্য হোটেল রেস্টুরেন্ট যেমন হয়, এটি ঠিক তেমন নয়। আসলে, এটি ঠিক পরিচিত শহুরে রেস্তোরাঁগুলোর মতোনও নয়। তীব্র আলোর বন্যায় ঘর ডুবে আছে। টিউবলাইটের সাদা আলো। কয়টা বাতি জ্বালিয়েছে? চোখ মেলে রাখতে বেগ পেতে হয়। আর দেয়ালটাও ধবধবে সাদা। এতটাই সাদা যে মনে হচ্ছে দেয়াল থেকেই যেন আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে। তাতে একটিও ক্যালেন্ডার, ছবির ফ্রেম, দেয়াল ঘড়ি, কোরআন-হাদিসের বাণী কিছুই ঝুলছে না। একটা গ্রামীণ রেস্টুরেন্টে দেয়াল এত ধবধবে সাদা কীভাবে রাখতে পারে? আজকেই কি রং করিয়েছে? প্লাস্টিক পেইন্ট?
দেয়াল ও ছাদ যেমন সাদা, মেঝে তেমনই কুচকুচে কালো। এতটাই যে মনে হয় সেখানে আলো পড়ে প্রতিফলিত হয় না, হারিয়ে যায়। বিজ্ঞান বইয়ে পড়া ব্ল্যাকহোলের মতোন অবস্থা। আলো শুষে নিচ্ছে। ঝাঁ চকচকে পরিষ্কার। একবিন্দু ময়লা সেখানে নেই। হয়তো কিছুক্ষণ আগেই ধোয়ামোছা করা হয়েছে। এমন মেঝেতে জুতা পায়ে হাঁটলে নিজেকে অপরাধী মনে হয়।
ওরা খালি দেখে একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। চেয়ার টেনে বসতে গিয়ে দেখে এটি প্লাস্টিকের নয়, আবার লোহা বা কাঠেরও নয়। কোন ম্যাটেরিয়ালে তৈরি সেটা আসিফ বা মিল্টন ভাই কেউই বুঝতে পারল না। ওজনে হালকা তবে বেশ মজবুত ও টেকসই চেয়ার টেবিল।
আশেপাশের টেবিলের লোকজনও কেমন অদ্ভুত। এক দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছে না। আসিফের সেদিকে খেয়াল নেই। সে ক্ষুধা সহ্য করতে পারছে না। কথায় আছে না, প্রচন্ড ক্ষিধায় চোখে অন্ধকার দেখা? ওর হয়েছে সেই দশা। ওর মাথায় এখন গরম ভাতের থালা, মুরগির মাংসের ঝোল আর একবাটি গরুর মাংস ছাড়া কিছুই নেই।
মিল্টন ভাই কেমন ভীত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক দেখছেন। বিড়বিড় করছেন। কী পড়ছেন? সূরা? কোন দোয়া? আসিফের সেটা জানার ইচ্ছা হলো না।
এক বেয়ারা পানির জগ গ্লাস এনে বলল, ‘একটু বসেন। খাবার আসতেছে।’
সে মনে হয় রেজিস্টারে বসা লোকটার ছোট ভাই। এর চোখও ধূসর। চেহারায়ও বেশ মিল আছে।
আসিফ বলল, ‘ভাই, একটু তাড়াতাড়ি আনো। ক্ষুধায় মরে যাচ্ছি!’
সে চলে যেতেই মিল্টন ভাই ফিসফিস করে আসিফকে বললেন, ‘ভাই, চল, আমরা অন্য কোথাও গিয়া খাই।’
আসিফ বেশ অবাক হলো। মানে কী এই কথাটার? এখানে কি সমস্যা?
মিল্টন ভাই যেন ওর মনের কথাই ধরতে পেরেছে। তিনি গলা আরও নিচু করে বললেন, ‘চল, অন্য কোথাও যাই। এখনই।’
এই বাক্যে অনুরোধ ছিল না, বরং আদেশ ছিল। সঙ্গে তাড়াও। আসিফ মিল্টন ভাইকে জন্ম থেকেই চেনে। ফালতু কারণে এমন কথা বলার লোক তিনি না। নিশ্চই কিছু একটা ঘটেছে। ওনার ওপর ভরসা করা যায়।
যদিও ক্ষুধার যন্ত্রণায় তার অবস্থা মরি মরি, তবুও সে উঠে দাঁড়াল।
তখনই রেজিস্টারের লোকটা একদম ওর সামনে উপস্থিত হলো। ঘটনা এতটাই আকস্মিক ছিল যে, আসিফ রীতিমতোন চমকে উঠল। কারণ রেজিস্টার থেকে তাকে হেঁটে আসতে সে দেখেনি। যেন হাওয়া থেকে ওর সামনে প্রকট হয়েছে।
‘ঘটনা কী ছোটভাই? কই যান? এখানে খাবেন না?’
লোকটার কণ্ঠস্বর ফ্যাসফ্যাসে। যেন গলায় ঠান্ডা লেগেছে।
আসিফ কিছু বলার আগেই মিল্টন ভাই বললেন, ‘একটা জরুরি কাজ আছে, আমাদের এখনই যেতে হবে।’
লোকটা মিল্টন ভাইয়ের দিকে ফিরে বললেন, ‘খাবারের চেয়ে জরুরি কাজ আর কী থাকতে পারে? বসেন, খেয়ে যান। কাজ আপনাদের জন্য অপেক্ষা করবে।’
কণ্ঠে কেমন ঔদ্ধত্য়পনা। ওরা যেহেতু চাইছে, তাই খেয়ে যেতেই হবে। এ ছাড়া, আর কোনো অপশন নেই।
মিল্টন ভাইও অটল।
‘না, আমাদের এখুনি যেতে হবে।’
রেস্টুরেন্টে উপস্থিত অন্য কাস্টমারেরা এইবার সমবেত স্বরে বলে উঠল, ‘না, বসেন। খেয়ে যান। একটু পরে যাবেন।’
এবার আসিফ ঘাবড়ে গেল। সবাই কোরাসে এক বাক্য কীভাবে বলল? যেন রিহার্সেল করে তৈরি হয়েছে। একটা বাক্যও এদিক সেদিক হয়নি। এমনটাতো স্বাভাবিক না।

মিল্টন ভাই সামনের দিকে এগোতে গেলে একজন তার সামনে এসে দাঁড়াল। বেশ লম্বা লোকটা। আসিফ লক্ষ্য করল রেস্টুরেন্টের অন্য কাস্টমারেরাও উঠে দাঁড়িয়েছে। সবাই একই সমান লম্বা। সবার পোশাকই এক, দুধ সাদা। যেন কোনো প্রতিষ্ঠানের ইউনিফর্ম, নতুন প্যাকেট খুলে পরে এখানে খেতে এসেছে। আর আশ্চর্যজনক ব্যাপার, সবার চোখই ধূসর!
মিল্টন ভাই আসিফের হাত ধরে এক হ্যাচকা টান দিয়ে বললেন, ‘দৌড়াও, গাড়ির দিকে দৌড়াও! জান লাগায়ে দৌড় দাও!’
আসিফ নির্দেশ শোনামাত্রই দৌড় শুরু করল। দৌড়ালেন মিল্টন ভাইও। রেস্টুরেন্টের কেউ অবশ্য ওদের পিছু ধাওয়া করল না। বাইরে বেরিয়েই গাড়ির দরজা খুলে ওরা ভেতরে ঢুকে পড়ল। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে হেডলাইট জ্বালাতেই দেখে সামনে কোনো রেস্টুরেন্ট, বাড়িঘর, দালান কিছুই নেই। এই কিছুক্ষণ আগেই যা ছিল, যেখানে ওরা বসে ছিল, যেখান থেকে ওরা ছুটে এসেছে, এখন সব গায়েব! তার জায়গায় সব ঘুটঘুটে অন্ধকার। তবে ওদের গাড়ির আলোয় বহু জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। অন্ধকার রাতে রাস্তার কুকুরের চোখে গাড়ির বাতি পড়লে যেমনটা জ্বলে, ঠিক তেমন।
মিল্টন ভাই জোরে জেরে আয়াতুল কুরসি পড়তে শুরু করলেন। দৌড়ে এসে তিনি হাঁপাচ্ছেন। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন। আর পা দিয়ে এক্সেলেটরে জোরে চাপ দিতে থাকলেন। ভি সিক্স ইঞ্জিনের দানবীয় গাড়িটা বুনো পশুর মতোন গর্জন তুলে ছুটতে শুরু করল। আসিফ দেখতে চাইল ওদের কেউ পিছু নিয়েছে কি না। মিল্টন ভাই বললেন, ‘পেছনে তাকায়ো না। সামনে তাকাও! আল্লাহর নাম নাও! জোরে জোরে সূরা পড়্।’
আসিফও আয়াতুল কুরসি পড়তে শুরু করে। বেশ জোরেই।
ইঞ্জিন ও টায়ারের গর্জন করতে করতে শীতের কুয়াশামাখা বাতাস কেটে ছুটে চলেছে টয়োটা প্রাডো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা হাইওয়েতে উঠে গেল। তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে মিল্টন ভাই হাইওয়েতে উঠে গেলেন। কুয়াশার পর্দা ততক্ষণে সরে গেছে। আশেপাশে হাইওয়ের পাশের সাধারণ দৃশ্য। দোকান, মানুষ, বাড়িঘর, ধানখেত, গাছপালা। মিল্টন ভাই তবুও জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন আর উল্কার বেগে গাড়ি ছুটাচ্ছেন। সমানে আয়াতুল কুরসি পড়ে যাচ্ছেন।
‘আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লাহু ওয়াল হাইয়ুল কাইয়ুম।.....’
আশ্চর্য, আসিফের পেটে আর সেই দুঃসহ ক্ষুধাবোধ নেই। ভয়ের কারণেই কি সেটা মরে গেছে?
‘ওরা কারা ছিল?’
আসিফের প্রশ্নে মিল্টন ভাই বললেন, ‘এখন কথা বইলো না। আল্লাহর নাম নাও। পরে বলতেছি।’
সিলেটে বাড়িতে এসে মিল্টন ভাই শান্ত হলেন। যেন ঘাম দিয়ে তার জ্বর ছাড়ল।
তিনি বলেছিলেন, বাড়ির কাউকে এই ঘটনা না বলতে। আসিফ তাই বলেনি। আন্টি এইসবে খুব বিশ্বাস করেন এবং প্রচণ্ড ভয় পান। তিনি জানতে পারলে হয়তো ওর ঢাকায় পড়াশোনাই বন্ধ করে দেবেন। সাথে আট দশটা তাবিজও গলায় ঝুলিয়ে দেবেন।
আসিফ রাতে খেয়েদেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু দুঃস্বপ্নের কারণে ঘুম ঠিক মতোন আসেনি। চোখ বন্ধ করলেই সে দেখেছে সাদা পোশাকের লম্বা এক ব্যক্তি চকচকে দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এমন কঠিন দৃষ্টি সে ওর ছোট্ট জীবনে আর কোথাও দেখেনি।
পরের দিন আমাদের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা করল। সন্ধ্যায় চৌহাট্টায় আমাদের চিরচেনা রেস্টুরেন্টে পরোটা দিয়ে শিক কাবাব খেয়ে বরাবরের মতোন আমার বাড়ির ছাদেই বন্ধুদের আড্ডা হলো। বহু দিনের জমানো গল্প। আমাদের ক্লাসে কী হয়, কোন বন্ধু কী কুকাম করেছে থেকে শুরু করে আমার বাড়ির সামনের এক উঁচু শিমুল গাছের ডগায় চিল সংসার পেতেছে, মাথার ওপর জীবনানন্দের সোনালি ডানার চিল ওড়াউড়ি করে—এমন ফালতু বিষয় নিয়েও আলাপ হলো। অথচ আগের রাতেরই এত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটা আসিফ আমাদের জানাল না।
তার পরের দিন সকালে মিল্টন ভাইকে আসিফ জিজ্ঞেস করলে তিনি আসিফকে বললেন, ‘আমরা একটা বিরাট ফান্দে পড়ছিলাম।’
‘মানে?’
‘কুয়াশা শুধু আমাদের জন্যই আছিল, খেয়াল কর নাই, আমাদের আশেপাশের অন্য সব গাড়ি ঠিকই চলতেছিল? ওই কুয়াশায় কি গাড়ি চালানো সম্ভব আছিল?’
আসিফ এবার অবাক হয়ে যায়। ঘটনা সত্যি। ওরা থেমে থাকলেও অন্য গাড়ি ঠিকই চলাচল করছিল। অথচ সেই ঘন কুয়াশায় শক্তিশালী ফগ লাইট জ্বালিয়ে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। এত দীর্ঘক্ষণ এত ঘন কুয়াশাটাও অস্বাভাবিক ছিল।
‘আমরা যখন টেবিলে বসছিলাম, তখন দেখি আমাদের দিকে ওরা সবাই এক দৃষ্টিতে তাকায়ে আছে।’
‘হু, সেটা আমিও খেয়াল করেছি’, আসিফ বলে।
মিল্টন ভাই বলেন, ‘আমি যখন ওদের সামনের পাতের দিকে তাকাই, দেখি সব কাঁচা মাংস রাখা।’
‘মানে?’
‘মানে ওদের সবার পাতে রান্না ছাড়া কাঁচা মাংস রাখা। এমন যেন এই মাত্র জবাই করে পিস পিস করে কেটে ওদের সামনে রাখা হইছে।’
‘বলেন কী!’
‘আর ওরা সেটা কচ কচ কইরা খাইতেছিল! বাঘ সিংহ বা কুত্তা যেভাবে খায়, ঠিক সেইভাবে। হাত না লাগায়ে, ডাইরেক্ট মুখ দিয়ে তুলে চাবাচ্ছিল।’
আসিফ শুনে হা হয়ে গেল।
‘আপনি নিজের চোখে দেখেছেন?’
মিল্টন ভাইয়ের চোখ মুখ ফ্যাকাসে। আতঙ্কে তিনি তখনো জমে যাচ্ছেন। এই লোকটা শুধু শুধু বানিয়ে মিথ্যা কথা বলার লোক না। বললেন, ‘নাইলে তোমারে কী আর এমনি এমনি উঠতে বলছি?’
‘হু।’
‘তারপরে দেখ নাই ওদের সবার চৌখ আছিল বিলাই চোখা?’
‘সেটাতো দেখেছিই।’
‘হ, লাইট পড়তেই চকচক কইরা উঠল। মাইনষের চোখ এমনে জ্বলে না। আর ওদের খাড়ানো অবস্থায় খেয়াল করছ? কেউই কিন্তু মাটির ওপরে খাড়ানো আছিল না। বাতাসে ভাসতেছিল। আমি কইতেছি, ওরা মানুষ আছিল না।’ তারপরে মিল্টন ভাই গলার স্বর পুরোপুরি পাল্টে বললেন, ‘উনারা আছিলেন।’
‘উনারা বলতে কারা?’ আসিফ ধরতে পারছিল না।
‘উনাদের নাম নিতে নাই।’ মিল্টন ভাই জবাব দেন।
‘জিন?’ আসিফের প্রশ্ন।
মিল্টন ভাই সঙ্গে সঙ্গে নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে বললেন, ‘আহা! তোমারে নাম নিতে না নিষেধ করছি! তুমি নাও কেন? জিন, কিন্তু উনাদের মধ্যেও রকমফের আছে। উনাদের জগতেও অনেক জাতের প্রাণি আর জানোয়ার আছে।’
আসিফ মাথা চুলকাল। জিন–ভূতের ব্যাপারে ওর জ্ঞান কম।
‘আমরা যখন গাড়ি ছুটায় আইতেছিলাম, তখন ওরা সবাই আমাদের গাড়ির ঠিক পিছেই খাড়ায়া ছিল। আমি আয়নায় দেখছি। এই কারণে তোমারে পিছে তাকাইতে না করছি। হয়তো তাকাইলে আমরা গাড়ি কইরা পলায়ে আসতে পারতাম না।’
‘বলেন কী! আসিফ পুরাই হতভম্ভ!
মিল্টন ভাই বললেন, ‘আল্লাহ বিরাট বিপদ থেইকা আমাদের উদ্ধার করছেন। জীবন নিয়া আইতে পারছি, এই কারণেই উনার দরবারে কোটি কোটি শুকরিয়া।’
আসিফের মুখ থেকে যখন আমি গল্পটা শুনলাম, আমিও তখন ওকে বললাম, ‘বলিস কী! কীভাবে সম্ভব?’
তারপরে বললাম, ‘রেস্টুরেন্টটা কোথায় বলতে পারিস?’
আসিফ বলল, ‘সিলেট-ঢাকা হাইওয়েতে। হবিগঞ্জ পেরিয়ে সিলেটের দিকে। একজ্যাক্ট লোকেশন ধরতে পারিনি। তবে এরপরে আর কখনই রাতে ওই রুট ধরে যাত্রা করিনি।’
‘বলিস কী! তোরা আর পরে খোঁজার চেষ্টা করিসনি?’
আসিফ বলে উঠল, ‘আমার কি তোর মতোন মাথা খারাপ পেয়েছিস? কুমিরের মুখ থেকে একবার অলৌকিক উপায়ে বেঁচে ফিরেছি। তাই বলে ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে আবার ওর মুখে যাব?’
‘কিন্তু রহস্যের মুখোমুখি না দাঁড়ালে সেটা ভেদ করবি কীভাবে? নিশ্চই ঘটনার লৌকিক কোনো ব্যাখ্যা আছে।’
‘তোর লৌকিক ব্যাখ্যার .....।’
আসিফ একটা গালি দিল। গালিটা সে ঢাকায় গিয়ে নতুন বন্ধু বান্ধবের কাছে শিখেছে। ব্যাড ইনফ্লুয়েন্স!
এই পর্যন্ত ছিল আসিফের গল্প। এখন আমি বলি হঠাৎ এই পুরানো গল্প বলার কারণটা কী।

আসিফের মুখে ঘটনাটা শুনেছিলাম প্রায় ১৭-১৮ বছর আগে। মস্তিষ্কের অসংখ্য ফোল্ডারের কোনো এক ফাইলে সেটা সযত্নে তুলে রাখা আছে। প্রয়োজন পড়ে না, তাই আর সেটাকে তুলে এনে ঘাটাঘাটি করি না। ধুলা জমে, জমুক। আমি ব্যস্ত নতুন নতুন স্মৃতি সংগ্রহে।
গত বছর এক জরুরি কাজে অস্টিন গিয়েছি। ডালাস থেকে তিন সাড়ে তিন ঘন্টা ড্রাইভিং দূরত্বের পথ। দিনের বেলা গিয়েছি, সন্ধ্যায় কাজ শেষ, ভাবলাম রাতে সেখানে না থেকে বরং বাড়িতেই ফিরে আসি।
রওনা দিয়েছি। পথে কোনো এক কারণে প্রচন্ড ট্রাফিক জ্যাম ছিল। বিরক্তিকর জ্যাম। রাশ আওয়ার (অফিস ছুটি), অ্যাকসিডেন্ট, কনস্ট্রাকশন ইত্যাদি সব একসঙ্গে। গাড়ি নড়েই না এমন অবস্থা। ঘন্টাখানেক পরে ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে, ইন্টারস্টেট হাইওয়ে ছেড়ে ভিন্ন পথে ডালাসের দিকে রওনা হলাম।
শীতের রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার। গ্রামের মধ্য দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে যাচ্ছি। দৃষ্টি রাস্তার দিকে স্থির। এ দেশে সমস্যা হচ্ছে হঠাৎই রাস্তায় বণ্য হরিণ বা ফার্ম থেকে বেরিয়ে আসা গরু–ছাগল রাস্তায় উঠে আসে। তখন বড়সড় অ্যাকসিডেন্ট হয়।
জিপিএস দেখাচ্ছে বাড়ি পৌঁছাতে তখনো দুই ঘন্টা বাকি। ডালাসের কাছাকাছি গিয়ে গাড়ির ব্যাটারি চার্জ করতে হবে। পুরো দিনের ক্লান্তিতে ইচ্ছে করছে এখুনি গিয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়ি। রাতে রওনা দেওয়াটা ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে কি না যখন ভাবছি তখন হঠাৎই ঘন কুয়াশায় আমার পৃথিবী ঢেকে গেল। কুয়াশার ঘনত্ব এতটাই যে আমি পথের ধারে গাড়ি পার্ক করতে বাধ্য হলাম। ফোনের নেটওয়ার্ক নেই। কোন গহীন গ্রামের ভেতর দিয়ে জিপিএস নিয়ে যাচ্ছে আল্লাহ মালুম! বিরক্তিতে মেজাজ অত্যন্ত খারাপ। ঠিক তখন তীব্র ক্ষুধায় আমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেল। প্রচণ্ড ক্ষুধা। রমজান মাসে আমি সেহরি না খেয়েই গোটা মাস রোজা রাখি। ২৪ ঘন্টা না খেয়ে থাকার অভ্যাস আমার খুব আছে। কিন্তু তখনো এমন ক্ষুধাবোধ হয় না। ইচ্ছা করছে এখনই গাড়ি থেকে বেরিয়ে সামনে যা পাব, তাই খেয়ে ফেলি।
আমি ভাবলাম যা আছে কপালে, ধীরে ধীরে গাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া যাক। পথের ধারে কোনো একটি গ্যাস স্টেশন নিশ্চই পাওয়া যাবে। সেখানে নেমে কিছু একটা খেয়ে নেওয়া যাবে।
জিপিএসে সার্চ দিই আশেপাশে খাবারের দোকান কোথায় আছে। দেখায় দেড় মাইল দূরেই একটি আছে। আমি সেই অনুযায়ী গাড়ি নিয়ে এগোতে থাকি।
টেসলা গাড়ির সুবিধা হচ্ছে এর মনিটরে রাস্তার লেন, সামনের গাড়ি, মানুষ ইত্যাদি সব দেখা যায়। অটোড্রাইভ মুডে দিয়ে দিলে গাড়ি বেশ নিরাপদেই সামনের দিকে এগোয়। আমি দেখলাম এই ঘন কুয়াশায় আমি খালি চোখে সামনের কিছু না দেখতে পারলেও আমার গাড়ি তার বিশেষ ক্যামেরা ও সেন্সরে ঠিকই পথ দেখছে। আমি মনিটরের দিকে তাকিয়ে অতি ধীরে অটোপাইলটে দিয়ে গাড়ি চালানো শুরু করলাম। মজাও পেলাম। কেমন একটা ভিডিও গেম ভিডিও গেম অনুভূতি।
হঠাৎ দেখি কুয়াশা পাতলা হয়েছে এবং আমার ডানদিকেই একটি দোকান। রেস্টুরেন্ট নাকি গ্যাস স্টেশন সেটা স্পষ্ট বোঝা না গেলেও এটা বোঝা যাচ্ছে যে, সেখানে খাবারের ব্যবস্থা আছে। দরজা খোলা, ভেতরে আলো ঝলমল করছে।
খানিকটা অবাক হলাম, কারণ আমার জিপিএস বা গাড়ির মনিটরে এই দোকানের কোনো অস্তিত্ব দেখাচ্ছে না। মনিটর দেখাচ্ছে পাশের মাঠ ফাঁকা। আমি গাড়ি সাইড করতে যাব, ঠিক তখনই মস্তিষ্কের সেই পুরানো ফোল্ডার থেকে আসিফের গল্পের ফাইল উঠে এলো। তখন প্রচণ্ড ভয় পেলাম। কুয়াশা, ক্ষুধা, হাইওয়ের পাশের রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি সবতো মিলে যাচ্ছে। ভয়ে আমার লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল। জিন ভূতের পাল্লায় পড়িনিতো?
কিসের ক্ষুধা, কিসের খাওয়া, আমি এক্সেলেটরে চাপ দিলাম। গাড়ি আবার রাস্তায় উঠে গেল। কিছুক্ষণ এগিয়ে যেতেই কুয়াশাও গায়েব! রাস্তা ফকফকা। মাথার ওপরে টেক্সাসের গ্রামীণ বিশাল চাঁদ। আমি গাড়ির গতি বাড়ালাম। পুলিশ ধরলে ধরুক। আমাকে পালাতে হবে।
আমি জানি না, সেদিন আসলেই আমিও কি আসিফের মতোই কোন অদ্ভুতুড়ে রেস্টুরেন্টের ফাঁদে পড়তে চলেছিলাম কি না। অথবা ওটা হয়তো ছিল আমার মনের অহেতুক ভয়। হয়তো নামলে দেখা যেত লোকাল কোন রেস্টুরেন্ট ছিল, যারা বিশ্বের সেরা বার্গার পরিবেশন করে।
কে জানে কী ছিল! আমার রহস্যভেদের ইচ্ছাও হয়নি। ভূতে বিশ্বাস না করলেও ভূতের সাক্ষাতে আমার ভীষণ ভয়।
*মঞ্জুর চৌধুরী, ডালাস, টোক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র
কিসের ক্ষুধা, কিসের খাওয়া, আমি এক্সেলেটরে চাপ দিলাম। গাড়ি আবার রাস্তায় উঠে গেল। কিছুক্ষণ এগিয়ে যেতেই কুয়াশাও গায়েব! রাস্তা ফকফকা। মাথার ওপরে টেক্সাসের গ্রামীণ বিশাল চাঁদ। আমি গাড়ির গতি বাড়ালাম। পুলিশ ধরলে ধরুক। আমাকে পালাতে হবে।
মীর আনিসুল হাসান ২০১২ সালে স্থায়ীভাবে আবুধাবির বাংলাদেশ স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষের পদে অধিষ্ঠিত হন। এর আগেই আমিরাতের মিনিস্ট্রি অব এডুকেশনের লাইসেন্সও পেয়ে যান তিনি। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অধ্যক্ষের পদে কাজ করে অবসর নিয়ে দেশে চলে এসেছেন তিনি।
দুপুরে ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে বাসায় ফিরছি। দেখি আরেকটা ট্রাক থেকে ওয়াশিং মেশিন নামাচ্ছে। বিরাট গাবদা সাইজ। দুই/তিনতলা সিঁড়ি বেয়ে ওঠাতে হবে। বেচারার গার্লফ্রেন্ড নেই পাশে। এবার দেখি ছেলেলা আমার দিকে তাকায়, ‘হাই’ দেয়।
ষাটের দশক শুধু জেইনের জীবন নয়, বদলে দিল এক পুরো প্রজন্মকে। মানুষ শিখল প্রশ্ন করতে, প্রতিবাদ করতে, আর ভালোবাসতে। সত্যিই, এক নতুন সময়ের জন্ম হয়েছিল।