ইজাজ আহসান
জুলাই বিপ্লবের পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে। হাওয়া বইতে শুরু করা মানে বাংলাদেশের মানুষের মনে একটা আশার আলো দেখা দেয়, এবার হয়তো ভালো কিছু হবে।
আশা করাটাই স্বাভাবিক। এত সংগ্রাম, এত আত্মত্যাগ, দিনমজুর থেকে ছোট্ট শিশু সবাই কেউ বাদ যায়নি। সবার ভূমিকা থাকলেও সম্মুখ সারিতে ছাত্রদের ভূমিকা ছিল মুখ্য। বন্দুকের নলের সামনে বুক পেতে না দিলে ওই সরকারের পতন এত সহজ ছিল না বা হতো না।
সেই অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ছাত্রদের উপদেষ্টা পরিষদে স্থান দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড জনমনে বেশ হতাশা সৃষ্টি করেছে। এই সবের সত্যাসত্য জানা বা প্রমাণ করা কঠিন। তাদের মধ্যে থেকে আবার উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বেরিয়ে এসে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। তবে ছাত্র রাজনীতি দেশের চলমান রাজনীতির ধারায় একটা বড় আঘাত হেনেছে আর সেটা হলো কল্যাণমুখী রাজনীতি।
বাংলাদেশের চিরন্তন রাজনৈতিক ধারাটা ছিল সন্ত্রাস, পেশি শক্তি আর অবৈধ অর্থের দৌরাত্মের ওপর নির্ভরশীল। মোটা অঙ্কের অবৈধ টাকা দিয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নমিনেশন কেনা। যারা টাকা দিয়ে নমিনেশন কিনতেন তাদের কোনো রাজনৈতিক দর্শন ছিল না। অবৈধভাবে অর্জিত টাকা তারা বিনিয়োগ করতেন রাজনীতির পদ পদবি কেনায়। আবার সেই পদে যেতে পারলে তা দিয়ে নিজের অপকর্ম ঢাকার পাশাপাশি ব্যাবসায়িক সুবিধা আদায় করে নিতেন। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ভূমি দখল, মাদকব্যবসা, অবৈধভাবে বিদেশে টাকা পাচার থেকে নিয়ে এমন কোনো কাজ নেই, যেখানে এই রাজনীতিবিদদের পদচারণা ছিল না। কোনো কোনো এলাকায় এই সব জনদরদী নেতারা সন্ত্রাসের গড ফাদার হিসাবে পরিচিত ছিলেন। খুন খারাবি রাহাজানির জন্য তারা একটি চক্র গড়ে তুলতেন। এসব কাজে তারা প্রশাসনের সহযোগিতাও পেয়ে যেতেন খুব সহজে।
অবস্থাটা ছিল এরকমই। মানুষ এই কারণে ভোটের রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল। আর হবেই বা না কেন, ভোট দিয়ে একগাদা এ ধরনের ব্যক্তিদের নির্বাচিত করার চেয়ে ভোট না দেওয়াই ভালো। তাই আগের নির্বাচনগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই নগণ্য। এমনকি একপর্যায়ে ভোট দেওয়া আর না দেওয়া একই কথা হয়ে দাঁড়ায়। ২০২৪ সালের নির্বাচনে তার প্রমাণ দেখা যায়, ভোটার উপস্থিতির হার ছিল সবনিম্ন।
প্রায় ৫৩ বছর ধরে চলা এই ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সহসা একটা পরিবর্তনের ঢেউ এসে লেগেছে। আর এটা এসেছে ছাত্র রাজনীতির অঙ্গনে। ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে। এই দুই নির্বাচন ছাত্র রাজনীতির লেজুড়বৃত্তির প্রথাগত নির্বাচন ব্যবস্থায় আঘাত হেনেছে। কীভাবে তা সবার জানা।
এই নির্বাচনের বেশ কিছুদিন আগে ঈদুল আজহার সময় এক ছাত্র সংগঠন ঈদ উৎসব পালনের আয়োজন করে এবং হলগুলোর ছাত্র শিক্ষক কর্মচারীদের খাওয়া–দাওয়ার ব্যবস্থা করে। অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্যও পৃথক আয়োজন ছিল।
পরবর্তীতে প্রত্যেক হলে বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা করা, সিট সমস্যার সমাধান, হলের খাবারের মান উন্নত এবং লেখাপড়ার ব্যাপারে ছাত্রদের দেখভাল করা। এমনকি সেদিন দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয় পরিচ্ছন্নতা অভিযানের আয়োজন করা হয়েছে সিটি কর্পোরেশনের সাহায্যে।
ফলাফল এসেছে নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী। বিপুল ভোটে সেই সংগঠন জয়লাভ করেছে। কোনো ছাত্র সংগঠন যে সাধারণ ছাত্রদের কল্যাণে আসতে পারে, এই ধারণাই ছাত্রদের মাথা থেকে মুছে গিয়েছিল।
ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহ করতে আসা এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে এক ছাত্রী উত্তর দিয়েছিল ডাক্সুকে সে খাবার দোকান বলে জানত, এটা যে ছাত্রদের সংগঠন তা তার জানা ছিল না। হাস্যকর হলেও সেটাই স্বাভাবিক।
এর চেয়েও আরও ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আছে ছাত্র সংগঠন নিয়ে। গণরুম, গেস্ট রুম, সেই সঙ্গে জোর করে মিছিলে নিয়ে যাওয়া, মারধর করা ইত্যাদি। এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে যখন কল্যাণমুখী রাজনীতিতে পরিবর্তিত হতে থাকে তখন অন্য ছাত্র সংগঠনদেরও ইচ্ছা থাকুক আর নাই থাকুক সেই পথেই হাঁটতে হবে।
এর আগে ছাত্র রাজনীতি ছিল স্ব স্ব রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডকেন্দ্রিক। সেখান থেকে মনোনয়ন দেওয়া হতো দলীয় প্রধানের ইচ্ছায়। যে সরকার যখন ক্ষমতায় থাকবে তার ছাত্র সংগঠন তখন রাজত্ব করবে, এটাই ছিল তাদের মূলমন্ত্র। সাধারণ ছাত্রদের চাওয়া–পাওয়া এ ক্ষেত্রে থাকত উপেক্ষিত, অবহেলিত। সেই নিয়োগপ্রাপ্ত ছাত্র নেতাদের মূল দায়িত্ব থাকত বিরোধী দলের আন্দোলন–সংগ্রাম দমনে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কাজ করা। এর বিনিময়ে তারা লাভ করত সংশ্লিষ্ট এলাকার চাঁদাবাজির একচ্ছত্র আধিপত্য।
ছাত্রনেতা হওয়ার অর্থ ছিল মুহূর্তেই দামি গাড়ি–বাড়ি আর মোটা অঙ্কের ব্যাংক ব্যালেন্সের মালিক বনে যাওয়া। ছাত্রনেতা হওয়ার প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বী অনেককে তাই স্বর্গবাসী হতে হয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এবারে যে পরিবর্তন এসেছে তা অনেকটা বৈপ্লবিক বললে বোধ হয় ভুল হবে না। ডাকসু ও জাকসু শিক্ষার্থীরা তাদের প্রকৃত প্রতিনিধি নির্বাচনে সার্থক হয়েছে। তার ফলাফল শুধু ছাত্রছাত্রীরা নয় দেশবাসীও দেখছে।
সামনে বহুপ্রতীক্ষিত জাতীয় নির্বাচন। ইতিমধ্যে ভোটাররা বুঝতে পেরেছেন কোন ধরনের প্রার্থী তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা দিতে পারবে। এর আগের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা ছিলেন তাদের দল কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত জায়গীরদার। তাদের অধীনে এলাকার সাধারণ মানুষের জানমাল, সহায়সম্বল ছিল হুমকির মুখে। কিন্তু ছাত্র নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা তাদের সে ধারণা পালটে দিয়েছে। নেতৃত্বের দক্ষতা ছাত্রছাত্রীদের প্রতি দায়বদ্ধতা, সততা নিষ্ঠা ও মমত্ববোধ ভিন্ন ধারার এক রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার জন্ম দিয়েছে।
এটা বাংলাদেশের রাজনীতির সনাতনী ধারাকে একেবারে হুমকির মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশের আপামর জনগণ তাদের নেতা, নেতৃত্ব আর রাজনীতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। আশা করা যায়, এবারের নির্বাচন হবে নিরপেক্ষ অবাধ ও শান্তিপূর্ণ। সেখানে জনগণ ভোট দিতে ভুল করবে না।
ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের পর অনেক সুশীল আর রাজনৈতিক নেতা এটার কোনো প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়বে না বলে মতামত দেন। এক হিসেবে তা ঠিক আছে। কারণ এগুলো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন। তবে তাদের বক্তব্য ঠিক আছে না বলে আগের হিসেবে ঠিক ছিল বললে বোধহয় ভুল হবে। যুগের পর যুগ ধরে এই মানুষগুলো প্রতারিত হয়ে এসেছে। কিন্তু আর কত। এখন এই ছাত্র সংসদ নির্বাচন তাদের চোখ খুলে দিয়েছে।
এখন যেসব রাজনৈতিক দল তাদের অতীত কর্মকাণ্ড বজায় রেখে রাজনীতি করতে চাইবে তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ পেশি শক্তি, গুন্ডাতন্ত্র, অবৈধ টাকায় ভোট কেনা, ভোট কেন্দ্র দখল করা আর সম্ভব হবে না। এখন যে রাজনৈতিক দল কল্যাণমুখী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কর্মসূচি নিয়ে আসতে পারবে ভোটের রাজনীতিতে তারাই অগ্রগামী হবে।
কিন্তু এখনো বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা, দলীয় শৃঙ্খলা কল্যাণমুখী কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসা এসবের কোনো বালাই নেই। রাজনৈতিক দলগুলো যদি যোগ্য, সৎ নেতৃত্বের হাতে দলের দায়িত্ব তুলে দিতে না পারে তবে তাদের ভরাডুবি অবশ্যম্ভাবী। তবে হঠাৎ করে এতসব কিছু বদলে ফেলা দলগুলোর পক্ষে মোটেও সম্ভব নয়। এ জন্য দীর্ঘসময়ের পরিকল্পনা, কর্মকাণ্ড ও নেতৃত্ব প্রয়োজন।
যারা বছরের পর বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে এইসব চর্চা করে আসছে তাদের পক্ষেই এটা সম্ভব। নির্বাচনের আগে দিয়ে বেশ কিছু মুখরোচক উন্নয়ন পরিকল্পনা ঘোষণা দিয়ে ভোট পেয়ে যাওয়া, এবার আর সম্ভব বলে মনে হয় না। তবে এই নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে দুর্নীতি ও দারিদ্র্য দূর হবে। মেধাবী সৎ আর যোগ্য নেতৃত্ব, সে যে দলেরই হোক আগামীর বাংলাদেশকে নিয়ে যাবে নতুন উচ্চতায়, জনগণের আশা এটাই। এবার আর নেতৃত্ব বেছে নিতে বাংলাদেশ ভুল করবে না।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
লেখক বিভাগীয় প্রধান (বাবসায় শিক্ষা), বাংলাদেশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মাস্কাট, ওমান। ইমেইলঃ [email protected]
জুলাই বিপ্লবের পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে। হাওয়া বইতে শুরু করা মানে বাংলাদেশের মানুষের মনে একটা আশার আলো দেখা দেয়, এবার হয়তো ভালো কিছু হবে।
আশা করাটাই স্বাভাবিক। এত সংগ্রাম, এত আত্মত্যাগ, দিনমজুর থেকে ছোট্ট শিশু সবাই কেউ বাদ যায়নি। সবার ভূমিকা থাকলেও সম্মুখ সারিতে ছাত্রদের ভূমিকা ছিল মুখ্য। বন্দুকের নলের সামনে বুক পেতে না দিলে ওই সরকারের পতন এত সহজ ছিল না বা হতো না।
সেই অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ছাত্রদের উপদেষ্টা পরিষদে স্থান দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড জনমনে বেশ হতাশা সৃষ্টি করেছে। এই সবের সত্যাসত্য জানা বা প্রমাণ করা কঠিন। তাদের মধ্যে থেকে আবার উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বেরিয়ে এসে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। তবে ছাত্র রাজনীতি দেশের চলমান রাজনীতির ধারায় একটা বড় আঘাত হেনেছে আর সেটা হলো কল্যাণমুখী রাজনীতি।
বাংলাদেশের চিরন্তন রাজনৈতিক ধারাটা ছিল সন্ত্রাস, পেশি শক্তি আর অবৈধ অর্থের দৌরাত্মের ওপর নির্ভরশীল। মোটা অঙ্কের অবৈধ টাকা দিয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নমিনেশন কেনা। যারা টাকা দিয়ে নমিনেশন কিনতেন তাদের কোনো রাজনৈতিক দর্শন ছিল না। অবৈধভাবে অর্জিত টাকা তারা বিনিয়োগ করতেন রাজনীতির পদ পদবি কেনায়। আবার সেই পদে যেতে পারলে তা দিয়ে নিজের অপকর্ম ঢাকার পাশাপাশি ব্যাবসায়িক সুবিধা আদায় করে নিতেন। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ভূমি দখল, মাদকব্যবসা, অবৈধভাবে বিদেশে টাকা পাচার থেকে নিয়ে এমন কোনো কাজ নেই, যেখানে এই রাজনীতিবিদদের পদচারণা ছিল না। কোনো কোনো এলাকায় এই সব জনদরদী নেতারা সন্ত্রাসের গড ফাদার হিসাবে পরিচিত ছিলেন। খুন খারাবি রাহাজানির জন্য তারা একটি চক্র গড়ে তুলতেন। এসব কাজে তারা প্রশাসনের সহযোগিতাও পেয়ে যেতেন খুব সহজে।
অবস্থাটা ছিল এরকমই। মানুষ এই কারণে ভোটের রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল। আর হবেই বা না কেন, ভোট দিয়ে একগাদা এ ধরনের ব্যক্তিদের নির্বাচিত করার চেয়ে ভোট না দেওয়াই ভালো। তাই আগের নির্বাচনগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই নগণ্য। এমনকি একপর্যায়ে ভোট দেওয়া আর না দেওয়া একই কথা হয়ে দাঁড়ায়। ২০২৪ সালের নির্বাচনে তার প্রমাণ দেখা যায়, ভোটার উপস্থিতির হার ছিল সবনিম্ন।
প্রায় ৫৩ বছর ধরে চলা এই ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সহসা একটা পরিবর্তনের ঢেউ এসে লেগেছে। আর এটা এসেছে ছাত্র রাজনীতির অঙ্গনে। ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে। এই দুই নির্বাচন ছাত্র রাজনীতির লেজুড়বৃত্তির প্রথাগত নির্বাচন ব্যবস্থায় আঘাত হেনেছে। কীভাবে তা সবার জানা।
এই নির্বাচনের বেশ কিছুদিন আগে ঈদুল আজহার সময় এক ছাত্র সংগঠন ঈদ উৎসব পালনের আয়োজন করে এবং হলগুলোর ছাত্র শিক্ষক কর্মচারীদের খাওয়া–দাওয়ার ব্যবস্থা করে। অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্যও পৃথক আয়োজন ছিল।
পরবর্তীতে প্রত্যেক হলে বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা করা, সিট সমস্যার সমাধান, হলের খাবারের মান উন্নত এবং লেখাপড়ার ব্যাপারে ছাত্রদের দেখভাল করা। এমনকি সেদিন দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয় পরিচ্ছন্নতা অভিযানের আয়োজন করা হয়েছে সিটি কর্পোরেশনের সাহায্যে।
ফলাফল এসেছে নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী। বিপুল ভোটে সেই সংগঠন জয়লাভ করেছে। কোনো ছাত্র সংগঠন যে সাধারণ ছাত্রদের কল্যাণে আসতে পারে, এই ধারণাই ছাত্রদের মাথা থেকে মুছে গিয়েছিল।
ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহ করতে আসা এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে এক ছাত্রী উত্তর দিয়েছিল ডাক্সুকে সে খাবার দোকান বলে জানত, এটা যে ছাত্রদের সংগঠন তা তার জানা ছিল না। হাস্যকর হলেও সেটাই স্বাভাবিক।
এর চেয়েও আরও ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আছে ছাত্র সংগঠন নিয়ে। গণরুম, গেস্ট রুম, সেই সঙ্গে জোর করে মিছিলে নিয়ে যাওয়া, মারধর করা ইত্যাদি। এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে যখন কল্যাণমুখী রাজনীতিতে পরিবর্তিত হতে থাকে তখন অন্য ছাত্র সংগঠনদেরও ইচ্ছা থাকুক আর নাই থাকুক সেই পথেই হাঁটতে হবে।
এর আগে ছাত্র রাজনীতি ছিল স্ব স্ব রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডকেন্দ্রিক। সেখান থেকে মনোনয়ন দেওয়া হতো দলীয় প্রধানের ইচ্ছায়। যে সরকার যখন ক্ষমতায় থাকবে তার ছাত্র সংগঠন তখন রাজত্ব করবে, এটাই ছিল তাদের মূলমন্ত্র। সাধারণ ছাত্রদের চাওয়া–পাওয়া এ ক্ষেত্রে থাকত উপেক্ষিত, অবহেলিত। সেই নিয়োগপ্রাপ্ত ছাত্র নেতাদের মূল দায়িত্ব থাকত বিরোধী দলের আন্দোলন–সংগ্রাম দমনে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কাজ করা। এর বিনিময়ে তারা লাভ করত সংশ্লিষ্ট এলাকার চাঁদাবাজির একচ্ছত্র আধিপত্য।
ছাত্রনেতা হওয়ার অর্থ ছিল মুহূর্তেই দামি গাড়ি–বাড়ি আর মোটা অঙ্কের ব্যাংক ব্যালেন্সের মালিক বনে যাওয়া। ছাত্রনেতা হওয়ার প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বী অনেককে তাই স্বর্গবাসী হতে হয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এবারে যে পরিবর্তন এসেছে তা অনেকটা বৈপ্লবিক বললে বোধ হয় ভুল হবে না। ডাকসু ও জাকসু শিক্ষার্থীরা তাদের প্রকৃত প্রতিনিধি নির্বাচনে সার্থক হয়েছে। তার ফলাফল শুধু ছাত্রছাত্রীরা নয় দেশবাসীও দেখছে।
সামনে বহুপ্রতীক্ষিত জাতীয় নির্বাচন। ইতিমধ্যে ভোটাররা বুঝতে পেরেছেন কোন ধরনের প্রার্থী তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা দিতে পারবে। এর আগের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা ছিলেন তাদের দল কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত জায়গীরদার। তাদের অধীনে এলাকার সাধারণ মানুষের জানমাল, সহায়সম্বল ছিল হুমকির মুখে। কিন্তু ছাত্র নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা তাদের সে ধারণা পালটে দিয়েছে। নেতৃত্বের দক্ষতা ছাত্রছাত্রীদের প্রতি দায়বদ্ধতা, সততা নিষ্ঠা ও মমত্ববোধ ভিন্ন ধারার এক রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার জন্ম দিয়েছে।
এটা বাংলাদেশের রাজনীতির সনাতনী ধারাকে একেবারে হুমকির মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশের আপামর জনগণ তাদের নেতা, নেতৃত্ব আর রাজনীতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। আশা করা যায়, এবারের নির্বাচন হবে নিরপেক্ষ অবাধ ও শান্তিপূর্ণ। সেখানে জনগণ ভোট দিতে ভুল করবে না।
ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের পর অনেক সুশীল আর রাজনৈতিক নেতা এটার কোনো প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়বে না বলে মতামত দেন। এক হিসেবে তা ঠিক আছে। কারণ এগুলো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন। তবে তাদের বক্তব্য ঠিক আছে না বলে আগের হিসেবে ঠিক ছিল বললে বোধহয় ভুল হবে। যুগের পর যুগ ধরে এই মানুষগুলো প্রতারিত হয়ে এসেছে। কিন্তু আর কত। এখন এই ছাত্র সংসদ নির্বাচন তাদের চোখ খুলে দিয়েছে।
এখন যেসব রাজনৈতিক দল তাদের অতীত কর্মকাণ্ড বজায় রেখে রাজনীতি করতে চাইবে তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ পেশি শক্তি, গুন্ডাতন্ত্র, অবৈধ টাকায় ভোট কেনা, ভোট কেন্দ্র দখল করা আর সম্ভব হবে না। এখন যে রাজনৈতিক দল কল্যাণমুখী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কর্মসূচি নিয়ে আসতে পারবে ভোটের রাজনীতিতে তারাই অগ্রগামী হবে।
কিন্তু এখনো বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা, দলীয় শৃঙ্খলা কল্যাণমুখী কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসা এসবের কোনো বালাই নেই। রাজনৈতিক দলগুলো যদি যোগ্য, সৎ নেতৃত্বের হাতে দলের দায়িত্ব তুলে দিতে না পারে তবে তাদের ভরাডুবি অবশ্যম্ভাবী। তবে হঠাৎ করে এতসব কিছু বদলে ফেলা দলগুলোর পক্ষে মোটেও সম্ভব নয়। এ জন্য দীর্ঘসময়ের পরিকল্পনা, কর্মকাণ্ড ও নেতৃত্ব প্রয়োজন।
যারা বছরের পর বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে এইসব চর্চা করে আসছে তাদের পক্ষেই এটা সম্ভব। নির্বাচনের আগে দিয়ে বেশ কিছু মুখরোচক উন্নয়ন পরিকল্পনা ঘোষণা দিয়ে ভোট পেয়ে যাওয়া, এবার আর সম্ভব বলে মনে হয় না। তবে এই নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে দুর্নীতি ও দারিদ্র্য দূর হবে। মেধাবী সৎ আর যোগ্য নেতৃত্ব, সে যে দলেরই হোক আগামীর বাংলাদেশকে নিয়ে যাবে নতুন উচ্চতায়, জনগণের আশা এটাই। এবার আর নেতৃত্ব বেছে নিতে বাংলাদেশ ভুল করবে না।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
লেখক বিভাগীয় প্রধান (বাবসায় শিক্ষা), বাংলাদেশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মাস্কাট, ওমান। ইমেইলঃ [email protected]
প্রায় ৫৩ বছর ধরে চলা এই ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সহসা একটা পরিবর্তনের ঢেউ এসে লেগেছে। আর এটা এসেছে ছাত্র রাজনীতির অঙ্গনে। ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে। এই দুই নির্বাচন ছাত্র রাজনীতির লেজুড়বৃত্তির প্রথাগত নির্বাচন ব্যবস্থায় আঘাত হেনেছে। কীভাবে তা সবার জানা।
যারা জনগণের ভোটে সংসদে গেছেন কিংবা রাজনৈতিক কৌশলে ক্ষমতা দখল করেছেন—তাদের প্রতিটি সিদ্ধান্তই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। তবু প্রশ্ন জাগে—তারা কি সত্যিই জানেন সংবিধানের অন্তর্নিহিত দর্শন কী? তারা কি বোঝেন তাদের সাংবিধানিক দায়িত্বের গভীরতা কতটা?
আত্মার আত্মীয়তা জোর করে হয় না। এটি সময়, অভিজ্ঞতা ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। কখনো কোনো কথায়, কখনো এক মুহূর্তের সহানুভূতিতে—মন থেকে মন যুক্ত হয়।
জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র চার মাস বাকি আছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে সবকিছু সম্পন্ন করা নির্বাচন কমিশনের জন্য কঠিন একটা কাজ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। পাশাপাশি এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক ভুলভ্রান্তিও হতে পারে। কিন্তু তাই বলে, এটার অজুহাতে প্রবাসীদের ভোটাধিকারে বঞ্চিত করা কি সংগত হবে?