

শাহাবুদ্দিন শুভ

ইউরোপের অনেক কিছুই বিস্ময়ে ভরিয়ে দেয়। কিন্তু ফ্রান্সের রাস্তায় বই রেখে যাওয়ার এই অভ্যাস আমার মনে অন্যরকম আলো জ্বালায়। নেই কোনো তালা, নেই ফেরত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা—আছে কেবল বিশ্বাস। মনে হয় যেন অদৃশ্য কোনো সেতু গড়ে উঠেছে মানুষ আর জ্ঞানের ভাণ্ডারের মাঝে। এই দৃশ্য দেখে বারবার মনে হয়েছে—যদি এমন সহজলভ্য পাঠাভ্যাস আমাদের দেশেও থাকত!
আমার শৈশবও বইয়ের গন্ধে ভরা ছিল, যদিও সেখানে ছিল না এমন স্বাধীনতা। গ্রাম্যজীবনে পত্রিকার আভাস পেতাম নুরুজ চাচার বাড়িতে। বিকেল গড়িয়ে তবে পৌঁছাত সেই খবরের কাগজ। তবুও আমার চোখ ছুটত শব্দের জগতে। ক্লাস ফোরে থাকতেই প্রতিদিন বিকেলের নেশা হয়ে উঠল পত্রিকা পড়া। পরের বছর, ক্লাস ফাইভে উঠেই, সেই নেশা আরও গভীর হলো।
বাজারের লুৎফর চাচার দোকান ছিল যেন আমার ছোট্ট পাঠাগার। সেখানে রাখা থাকত নানা গ্রাম থেকে আসা পত্রিকা। আমি বসে যেতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা, যেন সময় থমকে গেছে কেবল আমার জন্য। পরে গোপলার বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরোনো ভবনে প্রতিষ্ঠিত হলো।
গোপলা বাজার গণকেন্দ্র পাঠাগার
আমি তখন এর প্রথম দিকের সদস্যদের একজন। এক সপ্তাহের জন্য বই হাতে পেতাম, আর সেই বই আমার পৃথিবী হয়ে উঠত। এত পড়ে ফেলতাম যে, পাঠকের তালিকায় আমার নাম উঠে আসত সবার ওপরে। বাবার চোখে এটি ছিল বেহুদা আসক্তি—কিন্তু আমার কাছে এটি ছিল এক অন্তহীন অভিযাত্রা।

কলেজে গিয়ে বইয়ের টান আরও বাড়ল। সুজন লাইব্রেরি থেকে টাকা দিয়ে বই ভাড়া নিতাম। শর্ত ছিল—একটি দাগও যেন না পড়ে। সেই যত্নে পড়তে পড়তে বই আমার কাছে হয়ে উঠল সাথী, পথপ্রদর্শক, শিক্ষক। কবিতা লেখা শুরু করলাম, ১৯৯৭ সালেই বাংলাদেশ বেতার সিলেটে প্রচার হলো আমার প্রথম কবিতা। ভাবলে অবাক লাগে—সবই বই পড়ার অভ্যাসের ফল।
এখন ফ্রান্সে এসে দেখি, বই এখানে জীবনেরই অংশ। মেট্রোতে কিংবা দূরপাল্লার ট্রেনে মানুষজনের হাতে বই—অসংখ্য গল্প, জ্ঞানের খণ্ড, বা কোনো দার্শনিক চিন্তার ভ্রমণসঙ্গী। কোলাহলময় পরিবেশে তারা ডুবে থাকে অন্য জগতে। শিশুরা শিখে যায়, শিক্ষা মানে কেবল পাঠ্যবই নয়। রাস্তার পাশে রাখা বই, লাইব্রেরির সহজ প্রবেশাধিকার, কিংবা স্কুলে পাঠচর্চার সংস্কৃতি—সব মিলিয়ে সমাজে জ্ঞানের প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করে।
আমাদের দেশে এখনো সেই স্বপ্ন দূরবর্তী। তবু আমি বিশ্বাস করি—স্কুল, কলেজ কিংবা বাজারকেন্দ্রিক ছোট ছোট পাঠাগার গড়ে তুলতে পারলে আমরাও পরিবর্তনের পথ ধরতে পারব। কল্পনা করি, হয়তো কোনো একদিন বাংলাদেশের কোনো শিশু রাস্তায় দাঁড়িয়ে হঠাৎই একটি বই হাতে তুলে নেবে—কোনো প্রশ্ন ছাড়াই, কেবল পাঠের টানে।
এই স্বপ্ন পূরণ হবে কি না জানি না। তবে আমি জানি, স্বপ্ন না দেখলে কোনো বড় পরিবর্তন আসে না। বড় কিছুর শুরু সবসময়ই হয়—একটি স্বপ্ন দিয়ে।
*শাহাবুদ্দিন শুভ: ফ্রান্সপ্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক। ইমেইল: <[email protected]>

ইউরোপের অনেক কিছুই বিস্ময়ে ভরিয়ে দেয়। কিন্তু ফ্রান্সের রাস্তায় বই রেখে যাওয়ার এই অভ্যাস আমার মনে অন্যরকম আলো জ্বালায়। নেই কোনো তালা, নেই ফেরত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা—আছে কেবল বিশ্বাস। মনে হয় যেন অদৃশ্য কোনো সেতু গড়ে উঠেছে মানুষ আর জ্ঞানের ভাণ্ডারের মাঝে। এই দৃশ্য দেখে বারবার মনে হয়েছে—যদি এমন সহজলভ্য পাঠাভ্যাস আমাদের দেশেও থাকত!
আমার শৈশবও বইয়ের গন্ধে ভরা ছিল, যদিও সেখানে ছিল না এমন স্বাধীনতা। গ্রাম্যজীবনে পত্রিকার আভাস পেতাম নুরুজ চাচার বাড়িতে। বিকেল গড়িয়ে তবে পৌঁছাত সেই খবরের কাগজ। তবুও আমার চোখ ছুটত শব্দের জগতে। ক্লাস ফোরে থাকতেই প্রতিদিন বিকেলের নেশা হয়ে উঠল পত্রিকা পড়া। পরের বছর, ক্লাস ফাইভে উঠেই, সেই নেশা আরও গভীর হলো।
বাজারের লুৎফর চাচার দোকান ছিল যেন আমার ছোট্ট পাঠাগার। সেখানে রাখা থাকত নানা গ্রাম থেকে আসা পত্রিকা। আমি বসে যেতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা, যেন সময় থমকে গেছে কেবল আমার জন্য। পরে গোপলার বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরোনো ভবনে প্রতিষ্ঠিত হলো।
গোপলা বাজার গণকেন্দ্র পাঠাগার
আমি তখন এর প্রথম দিকের সদস্যদের একজন। এক সপ্তাহের জন্য বই হাতে পেতাম, আর সেই বই আমার পৃথিবী হয়ে উঠত। এত পড়ে ফেলতাম যে, পাঠকের তালিকায় আমার নাম উঠে আসত সবার ওপরে। বাবার চোখে এটি ছিল বেহুদা আসক্তি—কিন্তু আমার কাছে এটি ছিল এক অন্তহীন অভিযাত্রা।

কলেজে গিয়ে বইয়ের টান আরও বাড়ল। সুজন লাইব্রেরি থেকে টাকা দিয়ে বই ভাড়া নিতাম। শর্ত ছিল—একটি দাগও যেন না পড়ে। সেই যত্নে পড়তে পড়তে বই আমার কাছে হয়ে উঠল সাথী, পথপ্রদর্শক, শিক্ষক। কবিতা লেখা শুরু করলাম, ১৯৯৭ সালেই বাংলাদেশ বেতার সিলেটে প্রচার হলো আমার প্রথম কবিতা। ভাবলে অবাক লাগে—সবই বই পড়ার অভ্যাসের ফল।
এখন ফ্রান্সে এসে দেখি, বই এখানে জীবনেরই অংশ। মেট্রোতে কিংবা দূরপাল্লার ট্রেনে মানুষজনের হাতে বই—অসংখ্য গল্প, জ্ঞানের খণ্ড, বা কোনো দার্শনিক চিন্তার ভ্রমণসঙ্গী। কোলাহলময় পরিবেশে তারা ডুবে থাকে অন্য জগতে। শিশুরা শিখে যায়, শিক্ষা মানে কেবল পাঠ্যবই নয়। রাস্তার পাশে রাখা বই, লাইব্রেরির সহজ প্রবেশাধিকার, কিংবা স্কুলে পাঠচর্চার সংস্কৃতি—সব মিলিয়ে সমাজে জ্ঞানের প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করে।
আমাদের দেশে এখনো সেই স্বপ্ন দূরবর্তী। তবু আমি বিশ্বাস করি—স্কুল, কলেজ কিংবা বাজারকেন্দ্রিক ছোট ছোট পাঠাগার গড়ে তুলতে পারলে আমরাও পরিবর্তনের পথ ধরতে পারব। কল্পনা করি, হয়তো কোনো একদিন বাংলাদেশের কোনো শিশু রাস্তায় দাঁড়িয়ে হঠাৎই একটি বই হাতে তুলে নেবে—কোনো প্রশ্ন ছাড়াই, কেবল পাঠের টানে।
এই স্বপ্ন পূরণ হবে কি না জানি না। তবে আমি জানি, স্বপ্ন না দেখলে কোনো বড় পরিবর্তন আসে না। বড় কিছুর শুরু সবসময়ই হয়—একটি স্বপ্ন দিয়ে।
*শাহাবুদ্দিন শুভ: ফ্রান্সপ্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক। ইমেইল: <[email protected]>
গামা আব্দুল কাদির সুদীর্ঘ প্রবাস জীবনে বাংলাদেশ অ্যাসেসিয়েশনের পাচঁবার সভাপতি এবং তিনবার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি এখনো এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদ, অস্ট্রেলিয়া এবং আওয়ামী লীগের অস্ট্রেলিয়া শাখারও প্রধান উপদেষ্টা।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতাদের একমাত্র যোগ্যতা—অসততা ও মিথ্যাচার। আর কর্মীদের যোগ্যতা—তোষামোদ। এক কঠিন সত্য হলো—এই দেশে কোনো নেতা কখনোই অযোগ্য হয় না, দুর্নীতি যতই করুক।
সমস্যা সম্পদ নয়—সমস্যা চরিত্রের, মানসিকতার, আর সৎ মানুষের কণ্ঠরোধের। রাজনৈতিক নেতাদের ওলি-আউলিয়া ভাবার সুযোগ নেই। সভ্য দেশে একটি গুরুতর অপরাধই তাদের রাজনৈতিক জীবনের ইতি টানে। আমাদের দেশে এটিই সবচেয়ে বড় ঘাটতি।
আজও বহু দেশে স্বৈরাচারী শাসন টিকে আছে; পরিবারতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র আরও গাঢ় হয়েছে। শাসন আর শোষণ যেন একই স্রোতে মিশে গেছে। বক্তব্যের স্বাধীনতা প্রতিনিয়ত আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে, ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার পরিণত হয়েছে নিছক প্রহসনে।