প্রবীর বিকাশ সরকার, জাপান
জাপানের শ্রেষ্ঠ শিল্পরসজ্ঞ, অসামান্য মনস্বী, শিল্পকলার বিচক্ষণ ইতিহাসবিদ শিল্পাচার্য ওকাকুরা তেনশিন বিংশ শতাব্দির একজন বিশ্ববিশ্রুত ব্যক্তিত্ব। এশিয়া মহাদেশে শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ‘প্রাচ্যভাতৃবাদ’ তথা ‘এশিয়ানিজম’, যাকে জাপানি ভাষায় বলা হয় ‘দাইআজিয়াসুগি’ তার পথিকৃৎ প্রবক্তা ছিলেন তিনি। ওকাকুরাই প্রথম এই মতবাদের বার্তা নিয়ে ভারতবর্ষে গমন করেন ১৯০২ সালে। ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী কলকাতায় স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
যাওয়ার আগে জাপানে অবস্থানরতা স্বামীজির আমেরিকান শিষ্যা মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডের মাধ্যমে ওকাকুরা স্বামীজিকে পত্র লেখেন। আমেরিকার শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্বধর্ম সম্মেলনের মতো একটি প্রাচ্যধর্ম সম্মেলন জাপানে আয়োজনকল্পে স্বামীজিকে পত্রমারফত আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে এই আমন্ত্রণ স্বামীজি রক্ষা করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। কাজেই ওকাকুরার সঙ্গে স্বামীজির যোগাযোগ হয়েছিল। ফলে স্বামীজি তাঁকে বেলুড়মঠে আন্তরিকভাবে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। এই সাক্ষাতকালে স্বামীজি আনন্দের আতিশয্যে ‘হারানো ভাইকে ফিরে পেলাম’ বলে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন।
প্রাচ্যের দুই মহান চিন্তক ভ্রাতার এই সাক্ষাৎ কালজয়ী হয়ে আছে। স্বামীজির মাধ্যমে প্রাচ্যভাতৃবাদের বার্তাবাহী ওকাকুরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ শুধু সাক্ষাতই ছিল না, জাপান ও ভারতের মধ্যে মৈত্রীবন্ধনের সুবর্ণ সূচনা ছিল। যা পরবর্তীকালে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, ভাবের আদান-প্রদান ও ঘটনার মধ্য দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী হয়েছিল। উদীয়মান শক্তি জাপান এবং স্বাধীনতাকামী মুক্তিপাগল বাংলা অঞ্চলের মধ্যে অভূতপূর্ব শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক ভাববিনিময়ের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যা চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। আজ শতবর্ষ পেরিয়ে এই সম্পর্ক অব্যাহত রয়েছে।
মনীষী ওকাকুরা দুবার ভারতবর্ষ ভ্রমণ করে ভারতকে আবিষ্কার করেছিলেন একবার ১৯০২ সালে এবং আরেকবার ১৯১২ সালে। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৬ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে পাঁচবার জাপান ভ্রমণ করে জাপানকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। দুজন-দুজনের চিন্তাদ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, ওকাকুরা ১৯১৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হন দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫০ বছর বয়সে। তাঁর মৃত্যুর পরপরই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এশিয়ায় প্রথম নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। ওকাকুরা জীবিত থাকলে কী যে খুশি হতেন তা কল্পনাও করা যায় না! ওকুকারার মহাপ্রয়াণের পর ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার বন্ধু ওকাকুরার দেশ জাপান ভ্রমণে আসেন। তখন জাপানে তাঁর জনপ্রিয়তা পর্বতসমান নোবেল পুরস্কারের বদৌলতে।
প্রথম ভ্রমণের সময় জাপানের একাধিক বিখ্যাত স্থানে তিনি যান এবং বক্তৃতা করেন। বহু জাপানি তাঁর ভক্ত হয়ে ওঠেন। তাঁর দীর্ঘ চুল-দাড়ি-গোঁফের কারণে তাঁকে প্রাচীন ভারতের ঋষিদের মতো দেখায় বলে জাপানিরা তাঁকে ‘শিসেই’ বা ‘ঋষিকবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। যেখানেই গিয়েছেন তিনি বিপুল অভ্যর্থনা ও সংবর্ধনা লাভ করেছিলেন। কবি তাতে এতই অভিভূত হয়েছিলেন যে, ৩ আষাঢ়, ১৩২৩ সাল তথা ১৯১৬ সালের ১৭ জুন শনিবার, নগেন্দ্রনাথ দত্তকে একটি চিঠিতে লিখেছেন, ‘জাপানে এসে এক কাজ হয়েছে...এত অজস্র আদর অভ্যর্থনা আমার জীবনে আর কোথাও পাইনি।’
বাস্তবিকই তাই। কোবে, ওসাকা, টোকিও, য়োকোহামা মহানগরী; নাগানো প্রদেশের কারুইজাওয়া শহর এবং ইবারাকি প্রদেশের ইজুরা নামক স্থানে কবিগুরু অসামান্যরূপে সংবর্ধিত ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। এসব স্থানগুলোর মধ্যে ‘ইজুরা’ ছিল ভিন্নরকম। কারণ, ইজুরায় তিনি গিয়েছিলেন প্রয়াত বন্ধু ওকাকুরার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন এবং বিধবা পত্নী ওকাকুরা মোতোকোসহ ওকাকুরার বংশধর ও আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। ওকাকুরা রবীন্দ্রনাথের হৃদয়কে জয় করেছিলেন ভারতে অবস্থানকালেই। ওকাকুরার কল্যাণেই তিনি প্রাচ্যসংস্কৃতি, প্রাচ্যাদর্শ ও জাপানকে গভীরভাবে চিন্তা করার সুযোগ পেয়েছিলেন।
ভারতে অবস্থানকালে ওকাকুরা তাঁর জীবনের প্রথম গ্রন্থ `The Ideals of the East’ রচনা করেন, যা ১৯০৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের প্রথম বাক্যটিই হচ্ছে: `Asia is One’, অর্থাৎ `এশিয়া একটিই’। এই আপ্তবাক্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথও সংহতি প্রকাশ করেছিলেন।
এশিয়ায় যে শান্তি, মৈত্রী ও সহ-অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি ওকাকুরা সেটা শতবর্ষ আগেই অনুধাবন করেছিলেন চীন ও ভারত ভ্রমণের মধ্য দিয়ে। যা তখনো স্বামী বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের ধারণার মধ্যেই ছিল না বলে প্রতীয়মান হয়। ওকাকুরার দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘The Awakening of Japan’ ১৯০৪ সালে আমেরিকার নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটিও প্রমাণ করে, জাপান ও ভারতের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আদর্শ কতখানি সমৃদ্ধ এবং পাশ্চাত্যের জন্য শিক্ষণীয়। এ ছাড়া, ১৯০৬ সালে তাঁর তৃতীয় গ্রন্থ ‘The Book of Tea’ নজিরবিহীন এক অসাধারণ গ্রন্থ। এতে রয়েছে চীনের প্রাচীন প্রকৃতিগত আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির প্রভাবে জাপান তথা প্রাচ্যের শান্তিবাদী চিন্তা-চেতনার শিক্ষণীয় নান্দনিক বহিঃপ্রকাশ, ভাতৃবন্ধন, মৈত্রীবন্ধনের অনন্য পন্থার বহুমুখী দিক। শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্যশক্তির বিরুদ্ধে একটি সবুজ প্রতিবাদ।
‘দ্য বুক অব টি’ গ্রন্থটি জাহাজে পড়তে পড়তে রবীন্দ্রনাথ জাপানে আগমন করেন। ওকাকুরার ৩টি গ্রন্থই রবীন্দ্রনাথকে তাঁর মনন ও তাঁর জন্মভূমি জাপানকে অনুধাবন করতে সহায়ক হয়েছিল। কবিগুরু জাপানে বক্তৃতাকালে ওকাকুরার মেধা ও চিন্তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বলাই বাহুল্য, ওকাকুরার প্রভাবে জাপান রবীন্দ্রনাথকে আমূল পাল্টে দিয়েছিল বললে অত্যুক্তি হয় না। তাঁর রচিত ‘জাপান যাত্রী’ ক্ষুদ্র গ্রন্থটি তার উজ্জ্বল প্রমাণ হলেও, বলা যায় এই গ্রন্থটি তাঁর জাপান দর্শনের খণ্ডিত বিবরণমাত্র। অনেক কিছুই রবীন্দ্রনাথ লিখে যাননি তাঁর জীবদ্দশায় জাপান সম্পর্কে। অনেক জাপানি ব্যক্তিত্বের নামও তিনি স্মরণ করেননি, যাঁদের দ্বারা তিনি নানাভাবে উপকৃত হয়েছিলেন, তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে যাঁরা অকুণ্ঠচিত্তে সাড়া দিয়েছিলেন।
কিন্তু ওকাকুরাকে তিনি আমৃত্যু ভুলতে পারেননি তা আর না বললেও চলে। জীবদ্দশায় যতজন জাপানি নাগরিকের সঙ্গে তাঁর দেখা-সাক্ষাৎ ঘটেছে জাপানে-ভারতে-চীনে-আমেরিকায় প্রায় সকলেই ছিলেন ওকাকুরার প্রত্যক্ষ ছাত্র, না হয় তাঁর ভাবশিষ্য। এখনো ওকাকুরার প্রভাব জাপানি মননে প্রবলভাবে উপস্থিত।
ওকাকুরা যে কতখানি প্রভাবশালী ও নমস্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুবার সশরীর জাপানে উপস্থিত হয়ে সেটা অনুভব করে আন্দোলিত হয়েছিলেন। প্রথমবার ১৯১৬ সালে, দ্বিতীয়বার ১৯২৯ সালে এবং ইবারাকি প্রদেশেরই ‘ইজুরা’ ও ‘মিতো’ নামক স্থানে (মিতোর ঘটনা অন্যসময় বলা যাবে)। নাগানো প্রদেশের কারুইজাওয়া শহর থেকে ট্রেনে চড়ে কবিগুরুর প্রথমবারের ইজুরা ভ্রমণ থেকে জানা যায় যে, বন্ধু ওকাকুরার সমাধি পরিদর্শনকল্পে ২২ আগস্ট থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত চার দিন কিতাইবারাকি শহরে অবস্থান করেন। ওকাকুরার শোকাহত পরিবার ও ইজুরার মধ্যবর্তী সেকিমোতো রেলস্টেশনে (বর্তমানে ওওৎসুমিনাতো স্টেশন) আগত স্থানীয়দের দ্বারা অভূতপূর্ব উষ্ণ আতিথেয়তা ও অভ্যর্থনা লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর দলবলকে নিয়ে দশের বেশি ‘জিন্রিকিশা’ বা ‘হাতেটানা রিকশা’ ইজুরার দিকে যাত্রা করে মিছিলের মতো। দৈনিক পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রচুর ছবি ছাপা হওয়ার কারণে রবীন্দ্রনাথকে চিনতে কারও কষ্ট হয়নি। ব্যাপক সাড়া পড়ে যায় ইজুরা শহরে।
চার দিন অবস্থানকালে কবিগুরু ওকাকুরার বাড়িতে যান, তাঁর পরিবারের সঙ্গে মিলিত হন। কবিগুরু বন্ধু ওকাকুরার স্মৃতিচারণ করেন। বাড়ির বাগানে পরিবার–পরিজনসহ একাধিক আলোকচিত্র ধারণে অংশ নেন। ওকাকুরার সহধর্মিণী মোতোকো কবিগুরুকে জাপানি ঐতিহ্যবাহী ইউকাতা (গ্রীষ্মকালের হালকা পোশাক) এবং হাওরি (ইউকাতার ওপর হালকা পরিধান) উপহার দেন। হাওরি পরিধানে ওকাকুরা পরিবারের নিজস্ব পরিচিতিচিহ্ন ক্রেস্ট সংযুক্ত ছিল। সেটা পরেই তিনি প্রয়াত বন্ধু ওকাকুরার সমাধিতে ফুলসমেত শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ওকাকুরা কর্তৃক প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে নির্মিত হয়েছিল ৬ কোণবিশিষ্ট নান্দনিক বিশ্রামস্থল ‘রোকুকাকুদোও’ তাতে তিনি অবসর যাপন করতেন। সেই কুঠুরি তথা বিশ্রামস্থলে রবীন্দ্রনাথ প্রতিদিনই ধ্যান করেন এবং স্মরণ করে প্রয়াত সুহৃদ ওকাকুরাকে।
কুঠুরিতে বসে থাকলে বাইরের সামুদ্রিক উত্তাল ঢেউ ও বাউড়ি বাতাসের শব্দ অদ্ভুত এক আরাম ও প্রশান্তি এনে দেয় মনে। রবীন্দ্রনাথেরও তাই হয়েছিল বলাই বাহুল্য। তা ছাড়া, সমুদ্রের নীল জলে আকাশের ডুবে যাওয়া সৌন্দর্য অন্যলোকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, আনমনা করে ফেলে। রবীন্দ্রনাথের এই দৃশ্য যে ভালো লেগেছিল তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। জীবদ্দশায় ওকাকুরাকে যে মাঝি নৌকোতে করে সমুদ্রবিহার বা ছিপ দিয়ে মাছ ধরার জন্য নিয়ে যেতেন সেই বৃদ্ধমাঝির সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে।
ওকাকুরার বাড়িতে প্রয়াত বন্ধু স্মরণে কবিগুরু কাগজের ওপর সংস্কৃত অক্ষরে “ঔম” শব্দটি লিখে বন্ধুপত্নী মোতোকোকে উপহার প্রদান করেন। পরবর্তীকালে ওকাকুরার পৌত্র ওকাকুরা কোওশিরোওর উদ্যোগে সেটা স্থানীয় চোওশোওজি বৌদ্ধমন্দিরে সংরক্ষিত করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি হিসেবে প্রতিটি জিনিসই কী যে যত্নসহকারে সংরক্ষিত আছে জাপানের বিভিন্ন স্থানে তা বাঙালিরা কল্পনাও করতে পারবেন না! ইজুরা তথা ইবারাকি প্রদেশেও তার ব্যতিক্রম দেখা যায় না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইজুরা ভ্রমণ করবেন বলে তাঁকে সঙ্গ প্রদান করেন গুরুদেবের বন্ধুবর চিত্রশিল্পী য়োকোয়ামা তাইকান, চিত্রশিল্পী কানজান শিমোমুরা, চিত্রশিল্পী হাশিমোতো গাহোও, চিত্রশিল্পী কিমুরা বুজান প্রমুখ। তারা শিল্পাচার্য ওকাকুরার প্রধান ছাত্র এবং জাপানের সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিল্পী। রবীন্দ্রনাথ যাতে নির্ভুলভাবে পৌঁছুতে পারেন ইজুরাতে তার জন্য শিল্পী তাইকান একটি পথনির্দেশক মানচিত্র এঁকেছিলেন। এটা সুদীর্ঘ বছর রবীন্দ্রনাথের তখনকার ভ্রমণসঙ্গী চিত্রশিল্পী মুকুলচন্দ্র দের কাছে ছিল। সেটি ১৯৯৮ সালে সংগ্রহ করে এনে ইবারাকি তেনশিন স্মারক শিল্পকলা জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে। কবিগুরুর ইজুরা ভ্রমণের সময় দোভাষী ও তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে ছিলেন ওকাকুরার অনুজ ওকাকুরা য়োশিসাবুরোও। তিনিও ওকাকুরার মতো খুব ভালো ইংরেজি জানতেন এবং ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ওকাকুরা তাকাকোর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ওকাকুরার বাড়িতে রন্ধনকৃত হাঁসের মাংশ সানন্দে উপভোগ করেছিলেন। কবিগুরু সকালের জলখাবার হিসেবে পছন্দ করতেন পাউরুটি। সেটা ইজুরার মতো আধাশহর-আধাগ্রাম স্থানে পাওয়া যেত না বিধায় টোকিওর ব্যয়বহুল শহর গিনজা থেকে ক্রয় করা হতো, আর সেটা ভোরবেলা ট্রেনে আসত। এই ট্রেনটি দ্রুতগামী ট্রেন বলে সাধারণ স্টেশনে থামত না, চলন্ত অবস্থায় ড্রাইভারের ছুঁড়ে দেওয়া পাউরুটি স্টেশন মাস্টার গ্রহণ করতেন।
চিত্রশিল্পী হাশিমোতো গাহোওর কনিষ্ঠপুত্র হাশিমোতো হাজিমের (?) স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, কৈশোরে তিনি ইজুরায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওকাকুরার বাড়িতে একটি ছোট্ট পদ্মফোটা পুকুর রবীন্দ্রনাথ খুবই পছন্দ করেছিলেন। যেহেতু ভারতেও পদ্মফুল ফোটে তাই মনে মনে একটা আত্মীয়তাও অনুভব করেছিলেন তিনি। আগস্ট মাস বলে তখন পদ্ম ফুটেছিল। সেই পদ্মের গোলাপি আভার সৌন্দর্য কবিকে মুগ্ধ করেছিল। হাজিমে একপাতা সোনালি রঙের কাগজ এগিয়ে কিছু লিখতে অনুরোধ করলে কবিগুরু ছোট্ট একটি কবিতা ইংরেজিতে লিখে প্রদান করেন। কবিতাটি নিম্নরূপ:
‘The lotus of our clime
blooms here in the alien
water with the same sweetness,
under another name.’
২০০৯ সালে এই লেখকের সৌভাগ্য হয়েছিল ইবারাকি প্রদেশের সুবিখ্যাত ৎসুকুবা শহরে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে অংশগ্রহণ করার। আয়োজন করেছিলেন স্থানীয় অধিবাসী কতিপয় রবীন্দ্রভক্ত। তখন ইজুরা ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল। পরিদর্শন করেছিলাম প্রাচ্যভাতৃবাদের প্রবক্তা রবীন্দ্র-অনুরাগী ওকাকুরা তেনশিনের বাড়িটি, যা এখন ওকাকুরা স্মারক জাদুঘরের অধীনে ওকাকুরা তীর্থস্থান। সেখানে দেখা হয়েছিল লালরঙা ‘রোকুকাকুদোও’ কুঠুরিটিও। এই কুঠুরিতে বসে কবিগুরু একদা ধ্যানে মগ্ন ছিলেন ভাবতেই বুকের ভেতরটা অদ্ভুত এক ভালোলাগায় নেচে উঠল! দেখতে পেলাম ওকাকুরার বাড়ির প্রাঙ্গণে একটি পাথুরে স্তম্ভ, তার শরীরে খোদিত আছে ওকাকুরার মুখাবয়ব এবং জাপানি ভাষায় ‘আজিয়া ওয়া হিতোৎসু নারি’ বা ‘Asia is One’ আপ্তবাক্যটি।
ইবারাকি তেনশিন স্মারক শিল্পকলা জাদুঘরে রয়েছে ওকাকুরার অনেক স্মারক বস্তু। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় কবি ও সমাজসেবী প্রিয়ম্বদা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ওকাকুরার পত্রবিনিময়ের অনেকগুলো ইংরেজি প্রেমপত্র এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অনেক দলিলপত্র। প্রাচ্যভাতৃবাদের উদ্গাতা ওকাকুরা তেনশিন শেষজীবন ইজুরাতেই কাটিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণের কারণে ইজুরা আজ রবীন্দ্রস্মৃতিতীর্থ হিসেবেও জাপানিদের কাছে সুপরিচিত।
লেখক: শিশুসাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক
জাপানের শ্রেষ্ঠ শিল্পরসজ্ঞ, অসামান্য মনস্বী, শিল্পকলার বিচক্ষণ ইতিহাসবিদ শিল্পাচার্য ওকাকুরা তেনশিন বিংশ শতাব্দির একজন বিশ্ববিশ্রুত ব্যক্তিত্ব। এশিয়া মহাদেশে শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ‘প্রাচ্যভাতৃবাদ’ তথা ‘এশিয়ানিজম’, যাকে জাপানি ভাষায় বলা হয় ‘দাইআজিয়াসুগি’ তার পথিকৃৎ প্রবক্তা ছিলেন তিনি। ওকাকুরাই প্রথম এই মতবাদের বার্তা নিয়ে ভারতবর্ষে গমন করেন ১৯০২ সালে। ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী কলকাতায় স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
যাওয়ার আগে জাপানে অবস্থানরতা স্বামীজির আমেরিকান শিষ্যা মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডের মাধ্যমে ওকাকুরা স্বামীজিকে পত্র লেখেন। আমেরিকার শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্বধর্ম সম্মেলনের মতো একটি প্রাচ্যধর্ম সম্মেলন জাপানে আয়োজনকল্পে স্বামীজিকে পত্রমারফত আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে এই আমন্ত্রণ স্বামীজি রক্ষা করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। কাজেই ওকাকুরার সঙ্গে স্বামীজির যোগাযোগ হয়েছিল। ফলে স্বামীজি তাঁকে বেলুড়মঠে আন্তরিকভাবে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। এই সাক্ষাতকালে স্বামীজি আনন্দের আতিশয্যে ‘হারানো ভাইকে ফিরে পেলাম’ বলে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন।
প্রাচ্যের দুই মহান চিন্তক ভ্রাতার এই সাক্ষাৎ কালজয়ী হয়ে আছে। স্বামীজির মাধ্যমে প্রাচ্যভাতৃবাদের বার্তাবাহী ওকাকুরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ শুধু সাক্ষাতই ছিল না, জাপান ও ভারতের মধ্যে মৈত্রীবন্ধনের সুবর্ণ সূচনা ছিল। যা পরবর্তীকালে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, ভাবের আদান-প্রদান ও ঘটনার মধ্য দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী হয়েছিল। উদীয়মান শক্তি জাপান এবং স্বাধীনতাকামী মুক্তিপাগল বাংলা অঞ্চলের মধ্যে অভূতপূর্ব শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক ভাববিনিময়ের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যা চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। আজ শতবর্ষ পেরিয়ে এই সম্পর্ক অব্যাহত রয়েছে।
মনীষী ওকাকুরা দুবার ভারতবর্ষ ভ্রমণ করে ভারতকে আবিষ্কার করেছিলেন একবার ১৯০২ সালে এবং আরেকবার ১৯১২ সালে। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৬ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে পাঁচবার জাপান ভ্রমণ করে জাপানকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। দুজন-দুজনের চিন্তাদ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, ওকাকুরা ১৯১৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হন দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫০ বছর বয়সে। তাঁর মৃত্যুর পরপরই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এশিয়ায় প্রথম নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। ওকাকুরা জীবিত থাকলে কী যে খুশি হতেন তা কল্পনাও করা যায় না! ওকুকারার মহাপ্রয়াণের পর ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার বন্ধু ওকাকুরার দেশ জাপান ভ্রমণে আসেন। তখন জাপানে তাঁর জনপ্রিয়তা পর্বতসমান নোবেল পুরস্কারের বদৌলতে।
প্রথম ভ্রমণের সময় জাপানের একাধিক বিখ্যাত স্থানে তিনি যান এবং বক্তৃতা করেন। বহু জাপানি তাঁর ভক্ত হয়ে ওঠেন। তাঁর দীর্ঘ চুল-দাড়ি-গোঁফের কারণে তাঁকে প্রাচীন ভারতের ঋষিদের মতো দেখায় বলে জাপানিরা তাঁকে ‘শিসেই’ বা ‘ঋষিকবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। যেখানেই গিয়েছেন তিনি বিপুল অভ্যর্থনা ও সংবর্ধনা লাভ করেছিলেন। কবি তাতে এতই অভিভূত হয়েছিলেন যে, ৩ আষাঢ়, ১৩২৩ সাল তথা ১৯১৬ সালের ১৭ জুন শনিবার, নগেন্দ্রনাথ দত্তকে একটি চিঠিতে লিখেছেন, ‘জাপানে এসে এক কাজ হয়েছে...এত অজস্র আদর অভ্যর্থনা আমার জীবনে আর কোথাও পাইনি।’
বাস্তবিকই তাই। কোবে, ওসাকা, টোকিও, য়োকোহামা মহানগরী; নাগানো প্রদেশের কারুইজাওয়া শহর এবং ইবারাকি প্রদেশের ইজুরা নামক স্থানে কবিগুরু অসামান্যরূপে সংবর্ধিত ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। এসব স্থানগুলোর মধ্যে ‘ইজুরা’ ছিল ভিন্নরকম। কারণ, ইজুরায় তিনি গিয়েছিলেন প্রয়াত বন্ধু ওকাকুরার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন এবং বিধবা পত্নী ওকাকুরা মোতোকোসহ ওকাকুরার বংশধর ও আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। ওকাকুরা রবীন্দ্রনাথের হৃদয়কে জয় করেছিলেন ভারতে অবস্থানকালেই। ওকাকুরার কল্যাণেই তিনি প্রাচ্যসংস্কৃতি, প্রাচ্যাদর্শ ও জাপানকে গভীরভাবে চিন্তা করার সুযোগ পেয়েছিলেন।
ভারতে অবস্থানকালে ওকাকুরা তাঁর জীবনের প্রথম গ্রন্থ `The Ideals of the East’ রচনা করেন, যা ১৯০৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের প্রথম বাক্যটিই হচ্ছে: `Asia is One’, অর্থাৎ `এশিয়া একটিই’। এই আপ্তবাক্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথও সংহতি প্রকাশ করেছিলেন।
এশিয়ায় যে শান্তি, মৈত্রী ও সহ-অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি ওকাকুরা সেটা শতবর্ষ আগেই অনুধাবন করেছিলেন চীন ও ভারত ভ্রমণের মধ্য দিয়ে। যা তখনো স্বামী বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের ধারণার মধ্যেই ছিল না বলে প্রতীয়মান হয়। ওকাকুরার দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘The Awakening of Japan’ ১৯০৪ সালে আমেরিকার নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটিও প্রমাণ করে, জাপান ও ভারতের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আদর্শ কতখানি সমৃদ্ধ এবং পাশ্চাত্যের জন্য শিক্ষণীয়। এ ছাড়া, ১৯০৬ সালে তাঁর তৃতীয় গ্রন্থ ‘The Book of Tea’ নজিরবিহীন এক অসাধারণ গ্রন্থ। এতে রয়েছে চীনের প্রাচীন প্রকৃতিগত আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির প্রভাবে জাপান তথা প্রাচ্যের শান্তিবাদী চিন্তা-চেতনার শিক্ষণীয় নান্দনিক বহিঃপ্রকাশ, ভাতৃবন্ধন, মৈত্রীবন্ধনের অনন্য পন্থার বহুমুখী দিক। শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্যশক্তির বিরুদ্ধে একটি সবুজ প্রতিবাদ।
‘দ্য বুক অব টি’ গ্রন্থটি জাহাজে পড়তে পড়তে রবীন্দ্রনাথ জাপানে আগমন করেন। ওকাকুরার ৩টি গ্রন্থই রবীন্দ্রনাথকে তাঁর মনন ও তাঁর জন্মভূমি জাপানকে অনুধাবন করতে সহায়ক হয়েছিল। কবিগুরু জাপানে বক্তৃতাকালে ওকাকুরার মেধা ও চিন্তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বলাই বাহুল্য, ওকাকুরার প্রভাবে জাপান রবীন্দ্রনাথকে আমূল পাল্টে দিয়েছিল বললে অত্যুক্তি হয় না। তাঁর রচিত ‘জাপান যাত্রী’ ক্ষুদ্র গ্রন্থটি তার উজ্জ্বল প্রমাণ হলেও, বলা যায় এই গ্রন্থটি তাঁর জাপান দর্শনের খণ্ডিত বিবরণমাত্র। অনেক কিছুই রবীন্দ্রনাথ লিখে যাননি তাঁর জীবদ্দশায় জাপান সম্পর্কে। অনেক জাপানি ব্যক্তিত্বের নামও তিনি স্মরণ করেননি, যাঁদের দ্বারা তিনি নানাভাবে উপকৃত হয়েছিলেন, তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে যাঁরা অকুণ্ঠচিত্তে সাড়া দিয়েছিলেন।
কিন্তু ওকাকুরাকে তিনি আমৃত্যু ভুলতে পারেননি তা আর না বললেও চলে। জীবদ্দশায় যতজন জাপানি নাগরিকের সঙ্গে তাঁর দেখা-সাক্ষাৎ ঘটেছে জাপানে-ভারতে-চীনে-আমেরিকায় প্রায় সকলেই ছিলেন ওকাকুরার প্রত্যক্ষ ছাত্র, না হয় তাঁর ভাবশিষ্য। এখনো ওকাকুরার প্রভাব জাপানি মননে প্রবলভাবে উপস্থিত।
ওকাকুরা যে কতখানি প্রভাবশালী ও নমস্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুবার সশরীর জাপানে উপস্থিত হয়ে সেটা অনুভব করে আন্দোলিত হয়েছিলেন। প্রথমবার ১৯১৬ সালে, দ্বিতীয়বার ১৯২৯ সালে এবং ইবারাকি প্রদেশেরই ‘ইজুরা’ ও ‘মিতো’ নামক স্থানে (মিতোর ঘটনা অন্যসময় বলা যাবে)। নাগানো প্রদেশের কারুইজাওয়া শহর থেকে ট্রেনে চড়ে কবিগুরুর প্রথমবারের ইজুরা ভ্রমণ থেকে জানা যায় যে, বন্ধু ওকাকুরার সমাধি পরিদর্শনকল্পে ২২ আগস্ট থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত চার দিন কিতাইবারাকি শহরে অবস্থান করেন। ওকাকুরার শোকাহত পরিবার ও ইজুরার মধ্যবর্তী সেকিমোতো রেলস্টেশনে (বর্তমানে ওওৎসুমিনাতো স্টেশন) আগত স্থানীয়দের দ্বারা অভূতপূর্ব উষ্ণ আতিথেয়তা ও অভ্যর্থনা লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর দলবলকে নিয়ে দশের বেশি ‘জিন্রিকিশা’ বা ‘হাতেটানা রিকশা’ ইজুরার দিকে যাত্রা করে মিছিলের মতো। দৈনিক পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রচুর ছবি ছাপা হওয়ার কারণে রবীন্দ্রনাথকে চিনতে কারও কষ্ট হয়নি। ব্যাপক সাড়া পড়ে যায় ইজুরা শহরে।
চার দিন অবস্থানকালে কবিগুরু ওকাকুরার বাড়িতে যান, তাঁর পরিবারের সঙ্গে মিলিত হন। কবিগুরু বন্ধু ওকাকুরার স্মৃতিচারণ করেন। বাড়ির বাগানে পরিবার–পরিজনসহ একাধিক আলোকচিত্র ধারণে অংশ নেন। ওকাকুরার সহধর্মিণী মোতোকো কবিগুরুকে জাপানি ঐতিহ্যবাহী ইউকাতা (গ্রীষ্মকালের হালকা পোশাক) এবং হাওরি (ইউকাতার ওপর হালকা পরিধান) উপহার দেন। হাওরি পরিধানে ওকাকুরা পরিবারের নিজস্ব পরিচিতিচিহ্ন ক্রেস্ট সংযুক্ত ছিল। সেটা পরেই তিনি প্রয়াত বন্ধু ওকাকুরার সমাধিতে ফুলসমেত শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ওকাকুরা কর্তৃক প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে নির্মিত হয়েছিল ৬ কোণবিশিষ্ট নান্দনিক বিশ্রামস্থল ‘রোকুকাকুদোও’ তাতে তিনি অবসর যাপন করতেন। সেই কুঠুরি তথা বিশ্রামস্থলে রবীন্দ্রনাথ প্রতিদিনই ধ্যান করেন এবং স্মরণ করে প্রয়াত সুহৃদ ওকাকুরাকে।
কুঠুরিতে বসে থাকলে বাইরের সামুদ্রিক উত্তাল ঢেউ ও বাউড়ি বাতাসের শব্দ অদ্ভুত এক আরাম ও প্রশান্তি এনে দেয় মনে। রবীন্দ্রনাথেরও তাই হয়েছিল বলাই বাহুল্য। তা ছাড়া, সমুদ্রের নীল জলে আকাশের ডুবে যাওয়া সৌন্দর্য অন্যলোকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, আনমনা করে ফেলে। রবীন্দ্রনাথের এই দৃশ্য যে ভালো লেগেছিল তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। জীবদ্দশায় ওকাকুরাকে যে মাঝি নৌকোতে করে সমুদ্রবিহার বা ছিপ দিয়ে মাছ ধরার জন্য নিয়ে যেতেন সেই বৃদ্ধমাঝির সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে।
ওকাকুরার বাড়িতে প্রয়াত বন্ধু স্মরণে কবিগুরু কাগজের ওপর সংস্কৃত অক্ষরে “ঔম” শব্দটি লিখে বন্ধুপত্নী মোতোকোকে উপহার প্রদান করেন। পরবর্তীকালে ওকাকুরার পৌত্র ওকাকুরা কোওশিরোওর উদ্যোগে সেটা স্থানীয় চোওশোওজি বৌদ্ধমন্দিরে সংরক্ষিত করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি হিসেবে প্রতিটি জিনিসই কী যে যত্নসহকারে সংরক্ষিত আছে জাপানের বিভিন্ন স্থানে তা বাঙালিরা কল্পনাও করতে পারবেন না! ইজুরা তথা ইবারাকি প্রদেশেও তার ব্যতিক্রম দেখা যায় না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইজুরা ভ্রমণ করবেন বলে তাঁকে সঙ্গ প্রদান করেন গুরুদেবের বন্ধুবর চিত্রশিল্পী য়োকোয়ামা তাইকান, চিত্রশিল্পী কানজান শিমোমুরা, চিত্রশিল্পী হাশিমোতো গাহোও, চিত্রশিল্পী কিমুরা বুজান প্রমুখ। তারা শিল্পাচার্য ওকাকুরার প্রধান ছাত্র এবং জাপানের সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিল্পী। রবীন্দ্রনাথ যাতে নির্ভুলভাবে পৌঁছুতে পারেন ইজুরাতে তার জন্য শিল্পী তাইকান একটি পথনির্দেশক মানচিত্র এঁকেছিলেন। এটা সুদীর্ঘ বছর রবীন্দ্রনাথের তখনকার ভ্রমণসঙ্গী চিত্রশিল্পী মুকুলচন্দ্র দের কাছে ছিল। সেটি ১৯৯৮ সালে সংগ্রহ করে এনে ইবারাকি তেনশিন স্মারক শিল্পকলা জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে। কবিগুরুর ইজুরা ভ্রমণের সময় দোভাষী ও তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে ছিলেন ওকাকুরার অনুজ ওকাকুরা য়োশিসাবুরোও। তিনিও ওকাকুরার মতো খুব ভালো ইংরেজি জানতেন এবং ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ওকাকুরা তাকাকোর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ওকাকুরার বাড়িতে রন্ধনকৃত হাঁসের মাংশ সানন্দে উপভোগ করেছিলেন। কবিগুরু সকালের জলখাবার হিসেবে পছন্দ করতেন পাউরুটি। সেটা ইজুরার মতো আধাশহর-আধাগ্রাম স্থানে পাওয়া যেত না বিধায় টোকিওর ব্যয়বহুল শহর গিনজা থেকে ক্রয় করা হতো, আর সেটা ভোরবেলা ট্রেনে আসত। এই ট্রেনটি দ্রুতগামী ট্রেন বলে সাধারণ স্টেশনে থামত না, চলন্ত অবস্থায় ড্রাইভারের ছুঁড়ে দেওয়া পাউরুটি স্টেশন মাস্টার গ্রহণ করতেন।
চিত্রশিল্পী হাশিমোতো গাহোওর কনিষ্ঠপুত্র হাশিমোতো হাজিমের (?) স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, কৈশোরে তিনি ইজুরায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওকাকুরার বাড়িতে একটি ছোট্ট পদ্মফোটা পুকুর রবীন্দ্রনাথ খুবই পছন্দ করেছিলেন। যেহেতু ভারতেও পদ্মফুল ফোটে তাই মনে মনে একটা আত্মীয়তাও অনুভব করেছিলেন তিনি। আগস্ট মাস বলে তখন পদ্ম ফুটেছিল। সেই পদ্মের গোলাপি আভার সৌন্দর্য কবিকে মুগ্ধ করেছিল। হাজিমে একপাতা সোনালি রঙের কাগজ এগিয়ে কিছু লিখতে অনুরোধ করলে কবিগুরু ছোট্ট একটি কবিতা ইংরেজিতে লিখে প্রদান করেন। কবিতাটি নিম্নরূপ:
‘The lotus of our clime
blooms here in the alien
water with the same sweetness,
under another name.’
২০০৯ সালে এই লেখকের সৌভাগ্য হয়েছিল ইবারাকি প্রদেশের সুবিখ্যাত ৎসুকুবা শহরে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে অংশগ্রহণ করার। আয়োজন করেছিলেন স্থানীয় অধিবাসী কতিপয় রবীন্দ্রভক্ত। তখন ইজুরা ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল। পরিদর্শন করেছিলাম প্রাচ্যভাতৃবাদের প্রবক্তা রবীন্দ্র-অনুরাগী ওকাকুরা তেনশিনের বাড়িটি, যা এখন ওকাকুরা স্মারক জাদুঘরের অধীনে ওকাকুরা তীর্থস্থান। সেখানে দেখা হয়েছিল লালরঙা ‘রোকুকাকুদোও’ কুঠুরিটিও। এই কুঠুরিতে বসে কবিগুরু একদা ধ্যানে মগ্ন ছিলেন ভাবতেই বুকের ভেতরটা অদ্ভুত এক ভালোলাগায় নেচে উঠল! দেখতে পেলাম ওকাকুরার বাড়ির প্রাঙ্গণে একটি পাথুরে স্তম্ভ, তার শরীরে খোদিত আছে ওকাকুরার মুখাবয়ব এবং জাপানি ভাষায় ‘আজিয়া ওয়া হিতোৎসু নারি’ বা ‘Asia is One’ আপ্তবাক্যটি।
ইবারাকি তেনশিন স্মারক শিল্পকলা জাদুঘরে রয়েছে ওকাকুরার অনেক স্মারক বস্তু। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় কবি ও সমাজসেবী প্রিয়ম্বদা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ওকাকুরার পত্রবিনিময়ের অনেকগুলো ইংরেজি প্রেমপত্র এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অনেক দলিলপত্র। প্রাচ্যভাতৃবাদের উদ্গাতা ওকাকুরা তেনশিন শেষজীবন ইজুরাতেই কাটিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণের কারণে ইজুরা আজ রবীন্দ্রস্মৃতিতীর্থ হিসেবেও জাপানিদের কাছে সুপরিচিত।
লেখক: শিশুসাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক
মনীষী ওকাকুরা দুবার ভারতবর্ষ ভ্রমণ করে ভারতকে আবিষ্কার করেছিলেন একবার ১৯০২ সালে এবং আরেকবার ১৯১২ সালে। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৬ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে পাঁচবার জাপান ভ্রমণ করে জাপানকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। দুজন-দুজনের চিন্তাদ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছেন।
সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার এক ঝাঁক এনথুসিয়াস্টিক ডাক্তারদের সাথে আমি হোয়াটসঅ্যাপে একটা গ্রুপে জড়িত। সেদিন দেখলাম সোনার বাংলা ফাউন্ডেশন বাপ্পা মজুমদারকে আনছে, ফান্ডরাইজ করবে দেশে গরিব রোগীদের ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়ার জন্য।
১৯৮৩-৮৪ সালে সুগাকো হাশিদার লেখা জাপানি টেলিভিশনের এই ‘ডোরামা’ একযোগে প্রচারিত হয়েছিল বেশ কয়েকটি দেশে। সর্বকালের সর্বাধিক দেখা টিভি শোগুলোর মধ্যে একটি যা জাপানের গন্ডি পেরিয়ে ৬০টি দেশে সম্প্রচারিত হয়েছিল।
অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলথ রাজ্যের রাজধানী সিডনির ইঙ্গেলবার্নে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের মধ্য দিয়ে স্টার পার্টনার্স ইঙ্গেলবার্ন তাদের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন করেছে।