পারভেজ রাকসান্দ কামাল, মেলবোর্ন
ভ্রমণকাহিনি
‘Cruisers are not Losers’
অস্ট্রেলিয়ায় সবচেয়ে লম্বা ছুটি থাকে ক্রিসমাস ও ইংরেজি নববর্ষের সময়টাতে। এই সময়টাতে কখনো কখনো আমরা বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশ বা অন্তত পক্ষে অস্ট্রেলিয়ার ভেতরেই বেশ বড়সড় ঘোরাঘুরি করে থাকি। এই ঘোরাঘুরিতে আমরা সাধারণত সড়কপথ, রেলপথ বা আকাশপথ ব্যবহার করে থাকি। এবারের ছুটিতে আমার মনে হলো জলপথে ভ্রমণ করলে কেমন হয়। অস্ট্রেলিয়ার চারপাশে তো খালি সমূদ্র আর সমূদ্র। সেই সমূদ্র পথই হোক না হয় আমাদের এবারের পথ হারানোর পথ। বিষয়টি আমার মাথায় এসেছিল জুলাই ২০২৪ এর দিকে। তখনই আমরা যোগাযোগ করি একটি ট্যুর কোম্পানির সঙ্গে। ট্যুর কোম্পানি আমাদের জানায়, ‘তোমরা ভালো সময়েই এসেছ। আমরা ক্রুজ ট্যুরের বুকিং নিচ্ছি।’ কোনো আগুপিছু আর ভাবিনি। প্রাথমিক বুকিং করে ফেলি। এরপরে অক্টোবর ২০২৪ মাসে দিলাম ফাইনাল বুকিং। ব্যাস, হয়ে গেল।
অক্টোবরের পর থেকে শুরু হলো আমাদের তোড়জোড়। আমার স্ত্রী শিলা ও আমি খুবই একসাইটেড এই ট্যুর নিয়ে। এই সময়ের মধ্যে শিলা কিছু শপিং করে ফেলেছে। আমার কেমন যেন থ্রিল ফিল হচ্ছে। জীবনে কোনো দিন সমূদ্র যাত্রা করিনি। শুনেছি সমূদ্রের ঢেউয়ের দুলুনিতে সি-সিকনেস হয় অনেকের। অনেক কে নাকি হেলিকপ্টারে ফেরত নিয়ে আসা হয়। কী যে হবে আমাদের!
তবে আমার মনে একটি ভরসা ছিল যে, আমি বাংলাদেশে ঢাকা থেকে আমার বাড়ি চুয়াডাঙ্গা যাবার সময় ফেরি পার হয়েছি শত শত বার। সুতরাং সমূদ্রের ওইটুকু দুলুনিতে কিছু হবে না। শিলাকে কথাটা বলতে ও হেসে বলল, ‘নদীতে ফেরি পারাপার আর সমূদ্র যাত্রা এক হলো? ভালোই বলেছ। তোমাকে দিয়েই হবে।’ ওর কথা শুনে আমার একটু ভয় ভয় করছিল। মনে হচ্ছিল ভূমিতে অবস্থান করেও আমি মাঝেমধ্যে দুলে দুলে উঠছি আর আমার বমি বমি ভাব হচ্ছে। আমি এ সব কিছু শিলার কাছে কায়দা করে চেপে গেলাম। তা না হলে ও আরও হাসাহাসি করত।
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
এইভাবে তালেগোলে ও দুলে দুলে কয়েক মাস পার হয়ে গেল। আজ আমরা যাচ্ছি সমূদ্র ভ্রমণে। একটা উবার ডেকে চেপে বসেছি। আজকের এক্সাইটমেন্ট চরমে আমাদের। উবার কিছুক্ষণ চলার পর আমার মনে হলো যে আমরা সি-পোর্টের দিকে না গিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছি। মেলবোর্নে আছি প্রায় ৮ বছর হলো। মেলবোর্নের অনেক রাস্তায় আমি চিনি। উবার ড্রাইভারকে বলতেই তিনি জিভ কেঁটে স্যরি বলে গাড়ি ঘুরিয়ে ফেললেন। এদিকে আমাদের বোর্ডিংয়ের সময় দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছে। যা হোক, আল্লাহর অশেষ কৃপায় আর ভুলভ্রান্তি না করে ড্রাইভার সাহেব আমাদের সি-পোর্টে পৌঁছিয়ে দিলেন। রাস্তা থেকেই জাহাজখানা চোখে পড়ল। কী বিশাল জাহাজরে বাবা! দানবের মতো লাগছে একদম।
আল্লাহর নাম নিয়ে সমস্ত চেকপোষ্ট পার করে উঠে পড়েলাম জাহাজে। জাহাজে ঢুকে দেখি আমরা একটি ৪/৫ তারকা হোটেলের বলরুমে চলে এসেছি। চোখ ধাঁধানো করে সাজানো। চোখে তখন টাইটানিকের সেই রিসেপশন এরিয়ার রূপ ভাসছে। রিসেপশনিস্টরা আমাদের অভ্যর্থনা করে কেবিন দেখিয়ে দিল। কেবিনের কাছে আসতেই কেবিন স্টুয়ার্ট আমাদের স্বাগত জানাল। তাঁর নাম সোমাং। তিনি বললেন, ‘এই কয়েক দিন আমিই তোমাদের দেখভাল করব। তোমাদের কোনো কিছুর দরকার হলে আমাকে বলবে।’ কেবিনে ঢুকেই আমার মজা লাগতে শুরু করেছে। কী সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো!
আমরা কেবিনে ব্যাগ-স্যুটকেস রেখে জাহাজ ঘুরতে বের হলাম। সোমাং বলল, ‘তোমরা ১৪ তলায় যাও। গিয়ে কিছু খেয়ে নাও। তারপর ১২ ও ১৪ তলার খোলা আকাশের নিচের ডেকে ঘুরতে পার।’
আমরা সেইমতো করলাম। জাহাজের ভেতর ২টি ক্যাপসুল লিফটসহ ৮–১০টা অন্য লিফট রয়েছে। লিফটে উঠতে গিয়ে খেয়াল করলাম যে, লিফটের বাটনে ১২ তলার পর ১৪ তলা লেখা। ১৩ তলা নেই। লিফট ছাড়া সিঁড়ি দিয়ে নেমেও আমি ১৩ তলা খুঁজে না পেয়ে শিলাকে বললাম, ‘ব্যাপার কী? জাহাজে ১৩ তলা নেই। ১২ তলার পর সোজা ১৪ তলা। ১৩ তলা নেই কেন?”
শীলা বলল, ‘১৩ হলো এদের ভাষায় আনলাকি থার্টিন। তাই এই ব্যবস্থা।’
আমি না হেসে পারলাম না। একটু জোরেই হেসে ফেলেছি লিফটের মধ্যে। সবাই আমার দিকে তাঁকিয়ে আছে। হয়তো ভাবছে, ব্যাটা পাগল হয়ে গেল নাকি! শিলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাঁকিয়ে আছে। আমি বললাম, ‘এখানে কাজির গরু গোয়ালে আছে কিন্তু কাগজে নেই অবস্থা।’
শিলা বলল, ‘কী রকম?’
আমি বললাম, ‘সংখ্যাতত্ব অনুযায়ী এই ১৪ তলাটাই হলো আসলে ১৩ তলা। কিন্তু কাগজে কলমে লিখে রেখেছে ১৪ তলা। কুসংষ্কার বিশ্বাস আর কাকে বলে!হা–হা–হা।’ আবার আমি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম।
১৪ তলায় ‘দ্যা প্যান্ট্রি’ নামে একটি বুফে আছে। এর ভেতর আছে ৮/১০টি ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট। এখানে এসে যেকোনো কাউন্টার থেকে যত ইচ্ছা খাবার নিয়ে খাওয়া যায়। শেষে আবার ডেজার্ট হিসেবে রয়েছে বিভিন্ন রকমের পেষ্ট্রি। আর এ সবই আমাদের টিকিটের অর্থের মধ্যেই ধরা রয়েছে। মানে কোনো অর্থ আর দিতে হবে না বুফে খাবারের জন্য। মনে মনে সাধু সাধু বলে উঠলাম। অর্থাৎ কি না তিনবেলা যথেচ্ছ ভূঁড়িভোজন ও বিছানায় শুয়ে ঘুমানো আর কোনো চিন্তা নেই। খাবারদাবার ছাড়াও জাহাজের এ মাথা থেকে ও মাথায় বিভিন্ন কার্যক্রম যেমনঃ স্পা, ক্যাসিনো, খেলাধূলা, কারাওকে, গানবাজনা, কমেডি শো, জিম, সুইমিং, থিয়েটারে সিনেমা দেখা, শপিং মলে ঢুঁ মারা, কফি শপ, আইসক্রিম বার ইত্যাদি সব কিছুতে অংশগ্রহণ করা যাবে। সেই সাথে জাহাজের ক্যাপ্টেন ও তার ক্রুরা আমদেরকে তিনটি আইল্যান্ডে নিয়ে যাবেন ও ঘোরাবেন। এ যেন স্বর্গের ছোট দুনিয়াবি ভার্সন! সেদিনের মতো আমরা জাহাজে একটু ঘোরাঘুরি করে কেবিনে চলে এলাম।
২০ ডিসেম্বর ২০২৪
আজ সকালে একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছি। জানালা দিয়ে বাইরে তাঁকিয়ে একটু ভয় হলো। চারিদিকে শুধুই পানি আর পানি। যতদূর দৃষ্টি যায় কোনো ডাঙ্গা দেখতে পাওয়া যায় না। হালকা হালকা করে জাহাজ দুলছে। কোন এক জায়গায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকলে দুলুনি বোঝা যায়। আমি আপন মনে জানালার সামনে রবিঠাকুর আওড়াচ্ছি,
“যুগযুগান্তর ধরি যোজন যোজন
ফুলিয়া ফুলিয়া উঠে উত্তাল উচ্ছ্বাস -
অশান্ত বিপুল প্রাণ করিছে গর্জন
নীরবে শুনিছে তাই প্রশান্ত আকাশ”
শিলা কখন এসে আমার পেছনে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। বলল, ‘সাড়ে ৮টা বাজে প্রায়। চল নাস্তা খেয়ে আসি।’
ঠিকই তো দেরি হয়ে গিয়েছে। সাড়ে ৯টার পরে বুফে বন্ধ হয়ে যায়। রবি ঠাকুরের ভাবের জগৎ থেকে হঠাৎ করেই খাবারের জগতে চলে এলাম। যম্পেশ করে দুজনে নাস্তা সেরে ১২ তলার খোলা ডেকে সুনীল আকাশের নিচে সান বেডে শরীর এলিয়ে দিলাম। সমূদ্রের মাঝখানে এখন আমরা। যদিও এখন অস্ট্রেলিয়াতে গ্রীষ্মকাল। তবু মাঝ সমূদ্রে একটু শীত শীত করছে। তবে সূর্যের নিচে শুয়ে থাকতে মজাই লাগছে। বড় স্ক্রিনে কী একটা সিনেমা চলছে। আমি ও শিলা সান বেডে শুয়ে শুয়ে কফি পান করছি ও যে যার মতো বই পড়ছি। বেশ কিছুক্ষণ পর সূর্য মামার তেজ বেড়ে গেলে আমি কেবিনে ফিরে আসি কিছু একটা লিখব বলে। আর শিলা গেল ‘লেডিস প্যাম্পার পার্টি’তে। কী ধরনের প্যাম্পার করা হলো জানি না। তবে কেবিনে ফিরে বলল, ‘গোসল করে নামাজ পড়ে নাও। দুপুরের খাবার খেতে যাব।’
ও হ্যাঁ, বলে রাখি, কেবিন স্টুয়ার্ট প্রতিদিন সকালে ‘গুড টাইমস’ নামে একটি চার পৃষ্ঠার রঙিন পত্রিকা দিয়ে যায় আমাদের কেবিনে। এই পত্রিকাতে জাহাজে অনুষ্ঠিত ওইদিনের সমস্ত আকর্ষণীয় কর্মকাণ্ড লেখা থাকে। আমি সেখানে চোখ বুলিয়ে দুপুরের খাবারের পর একটি সেমিনারে গেলাম। সেমিনারটি হলো ‘হাউ টু ইনক্রিজ ইয়োর মেটাবলিজম’। যত যাই হোক খাওয়ার থেকেও ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। সুতরাং ত্যাগের স্বার্থেই আমার এই উদ্যোগ। সেখান থেকে গেলাম পিয়ানো কনসার্টে। শিলা একটু দুপুরে ভাতঘুম দিয়েছে এর মধ্যে। সন্ধ্যায় দুজন মিলে দেখতে গেলাম প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য করা একটি কমেডি শো। শো শেষ করে ফিরতে ফিরতে একটু রাত হয়ে গেল।
আর এভাবেই কেমন করে যেন প্রথম দিন সমূদ্রের মাঝখানে কেটে গেল। রাতে একটি ড্যান্স পার্টি ছিল, আমরা আর যাইনি। দুলুনির জন্য খালি ঘুম পাচ্ছে। তাই আজকের মতো আর কিছু নয়। সোজা বিছানায়।
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
উফ! ভাবা যায় টানা একদিন ও দুই রাত সমূদ্রের ওপর জাহাজের ভেতরে আমরা। তিনবেলা খাওয়াদাওয়া, হাঁটাহাঁটি, নানা ধরনের কর্মকাণ্ড সবই এই জাহাজটির ভেতরে। জাহাজের একটি আ্যপস আছে। আমরা ফোনে ইন্সটল করে নিয়েছি। সেখানে দেখলাম যাত্রী আছে ১৯৯৮ জন। তাহলে জাহাজের ক্রুরা সব মিলিয়ে ২ হাজার ৫০০ লোক তো হবেই।
যেটা বলছিলাম, টানা ৪০ ঘন্টা পর আমরা আজ সাউথ অস্ট্রেলিয়ার ক্যাঙারু আইল্যান্ডে উপস্থিত। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি জাহাজ স্থির হয়ে রয়েছে। আর দূরে ক্যাঙারু আইল্যান্ড দেখা যাচ্ছে। আমাদের জাহাজটি বন্দর থেকে একটু দূরে সমূদ্রের ভেতর নোঙর করে আছে। তাহলে উপায়? কীভাবে আমরা পাড়ে পৌঁছাব? আমি চিন্তিত মুখে রিসেপশন ও লাউঞ্জ এরিয়াতে ঘোরাঘুরি করছি। এর মধ্যেই একজন রিসেপশনিস্ট যেন দেবদূতের মতো আবির্ভূত হলো। তিনি বললেন, ‘কোনো চিন্তা নেই। জাহাজের ৭ নম্বর ডেকের সিলিংয়ে কিছু ছোট ছোট রেসকিউ বোট ঝুলানো আছে, দেখেছো?’ আমি ও শিলা ওই ডেকের চারপাশে হাঁটার সময় দেখেছি এবং সংখ্যাও গুনেছি। প্রায় ১৮টির মতো বোট আছে। একেকটি বোটে ১৫০ জন বসতে পারে। আমি মাথা নেড়ে সায় দিতেই তিনি বললেন, ‘ঐ বোটকে টেনডার বলে। ওটাতে করেই পাড়ে পৌঁছিয়ে দেওয়া হবে আবার ফিরিয়েও আনা হবে।’ তারপর তিনি একটি মেশিন থেকে আমাদের জন্য টেনডার বুকিং করে দিলেন। ভারী মজা পেলাম। আমাদের গ্রুপ নম্বর হলো ১৮।
আমরা আমাদের কেবিনে বসে অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণ পর স্পিকারে ১৮ গ্রুপ শুনে লাইনে দাঁড়ালাম। লাইনে দাঁড়িয়ে দেখি অস্ট্রেলিয়ার বায়ো ডাইভার্সিটির অফিসাররা যাত্রীদের ব্যাগ চেকিং করছে। এ প্রসঙ্গে দুটো কথা বলি। অস্ট্রেলিয়া তার দেশের জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিষয়ে অতিব সচেতন। অস্ট্রেলিয়া যেহেতু সমূদ্রের মধ্যে একটি আইল্যান্ড সেহেতু বিদেশ থেকে কোনো ফল-বীজ-মাটি-পোল্ট্রিসহ আরও নানান জিনিস অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে আনা নিষেধ। যদি কেউ আনে তাহলে তাকে আগে থেকে ডিকলেরাশন দিতে হয়, তখন বায়ো ডাইভারসিটির লোকজন সেগুলো পরীক্ষা করে বাজেয়াপ্ত করে অথবা জীব বৈচিত্র্যের ওপর ক্ষতিকারক না হলে নেওয়ার অনুমতি দেয়। আর কেউ যদি ডিকলেরাশন না দেয় এবং ধরা পড়ে তাহলে জেল-জরিমানা-ডিপোর্টেশন-ভিসা বাতিল করা হয়। তবে মজার কথা হলো, শুধু বিদেশ নয় নিজের দেশের অভ্যন্তরেও একটি স্টেট থেকে অন্য স্টেটে কোনো ফল-বীজ-পোল্ট্রি বহন করতে দেয় না পরীক্ষা ছাড়া। আজ সেই বায়ো ডাইভারসিটির লোকজনের খুব তোড়জোড়। তারা যথেষ্ট কঠিন মুখ করে সবার ব্যাগ খুলে খুলে পরীক্ষা করছে। কেউ জাহাজ থেকে ভয়ংকর আপেল, মারাত্মক কমলা এমনকি নিদেনপক্ষে কোনো বিপদজনক কলা ছলাকলা করে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে কি না!
আমাদের ব্যাগ চেকিং করে ছেড়ে দিল। আমরা টেনডারে উঠে পড়লাম। টেনডারটি মিনিট ১৫–২০–এর মধ্যে আমাদেরকে পাড়ে পৌঁছিয়ে দিল। পাড়ে পৌঁছে আমরা হাঁটতে লাগলাম বাজার বা লোকালয়ের উদ্দেশে। আমার ইচ্ছা একটি প্রাইভেট কার ভাড়া করে পুরো আইল্যান্ড ঘুরব এবং বিকেলে এসে গাড়ি ফেরত দিয়ে দেব। কিন্তু তেমন কোনো রেন্ট–এ–কারের দোকান পেলাম না। হাঁটতে হাঁটতে দেখি একটি বাচ্চা ছেলে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। আমাদের কাছে এসে বলছে, ‘ওদের একটি ফ্যামিলি ট্যুর কোম্পানি আছে। ওদের বাস আমাদেরকে আইল্যান্ডের কিছু অংশ ঘুরিয়ে দেখাবে।’ আমরা ওই ছেলেটির সাথে ওদের দোকানে গেলাম। গিয়ে দেখি ওর বাবা আর বড় দুই বোন একসাথে দোকান চালাচ্ছে। এক বোন টিকিটের অর্থ নিচ্ছে, এক বোন প্যাসেঞ্জার লিষ্ট তৈরি করছে, ওদের বাবা বাসে প্যাসেঞ্জার তুলে দিচ্ছে আর সেই বাচ্চা ছেলেটি মার্কেটিং করছে। বড় ভালো লাগল দৃশ্যটি। আমাদের বাস ঘন্টা দেড়েক পর আসবে। আমরা টিকিট কিনে এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলাম। এখানে একটি মাঠের মধ্যে লোকাল হাট বসেছে। হাটের সেই সব দোকান ঘুরে ঘুরে দেখছি। শিলার ফ্রিজ ম্যাগনেট জমানো শখ। তাই ও আমাদের জাহাজের ছবি সম্বলিত একটি ফ্রিজ ম্যাগনেট কিনেছে।
দেখতে দেখতে বাসে ওঠার সময় হয়ে আসল। আমরা বাসে করে ক্যাঙারু আইল্যান্ডের কয়েকটি দর্শনীয় স্থান ও সমূদ্র সৈকত ঘুরে ঘুরে দেখছি। সবশেষে ট্যুর গাইড আমাদেরকে আমেরিকান রিভার নামে একটি জায়গায় নিয়ে এসেছে। ট্যুর গাইডের বক্তব্য অনুযায়ী এই জায়গাতে ১৮০৩ সালে কিছু আমেরিকার নাবিক নোঙর করেছিল এবং চার মাস অবস্থান করেছিল। তাই এই অঞ্চলের নাম আমেরিকান রিভার। তবে লোকাল জনশ্রুতি হলো এই জায়গা অনেক আগে আমেরিকান অঙ্গরাজ্য ছিল। জানি না কোনটি সঠিক।
ক্যাঙারু আইল্যান্ডে ৩–৪ বছর আগে এসেছিলাম আমার বন্ধু রুহুল আমিনের পরিবারের সাথে। সেবার এখানে ২ দিন ছিলাম একটি ক্যারাভান পার্কে। তখন আমরা গাড়ি ভাড়া করে পুরো আইল্যান্ড ঘুরেছিলাম। এই আইল্যান্ডে অন্যতম দেখার জায়গা হলো ‘রিমার্কেবল রক’। কমলা রঙের অসংখ্য পাথর দিয়ে প্রকৃতিগত ভাবেই মনুমেন্টের মত একটা জিনিস তৈরি হয়েছে। চমৎকার সুন্দর প্রকৃতির সেই লীলা। এবার সেখানে আর যাওয়া হলো না। বিকেল ৩টার মধ্যেই আমাদের পোর্টে ফিরে আসতে হলো। এরপর আবার টেনডারে করে জাহাজে নিজেদের কেবিন। আহা! খাসা বন্দোবস্ত। ঘোরো ফেরো খাও দাও আর কেবিনে এসে ঘুমাও। একদম আসল স্ট্রেস ফ্রি রিল্যাক্স ট্যুর।
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
এখন ক্রুজ, জাহাজ ও সমূদ্র সবই অনেকটা আয়ত্বে চলে এসেছে। নিয়ম করে আমাদের খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, বই পড়া ও জাহাজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ চলছে। আজ মনে হলো আমরা সুইমিং করব। এই জাহাজে ওপরের তলায় অর্থাৎ ১২ তলার দিকে তিনটি সুইমিং পুল ও ৩/৪টি গরম পানির জ্যাকুযি আছে। সুইমিং পুলের পানি বেশ ঠান্ডা। আজ আমরা সুইমিং পুলে সাঁতরিয়ে গোসল করে নিলাম। তারপর গেলাম জ্যাকুযিতে গা গরম করতে। জ্যাকুযিতে গরম পানিতে শরীর এলিয়ে বসে বসে বড় স্ক্রীনে একটি সিনেমাও দেখে ফেললাম। বাচ্চারা সুইমিং পুলের পাশে ওয়াটার স্লাইডে চড়ে খুব মজা পাচ্ছে। কয়েকজনকে দেখলাম তারের দড়িতে ঝুলে ঝুলে জাহাজের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যাচ্ছে। বেশ একটা অদ্ভূত অনুভূতি! এটা ভাষায় প্রকাশ করে পারব না।
দুপুরে একটু লিখতে বসলাম। গুড টাইমস পত্রিকায় দেখলাম বিকেলের দিকে ‘হোয়াইট ড্যান্স পার্টি’ আছে। আমরা সাদা ড্রেস পরে সেই ড্যান্স পার্টিতে গিয়ে উপস্থিত। এক ডিজের তত্বাবধানে চলছে খোলা আরাশের নিচে ড্যান্স পার্টি ও নানান ধরনের খেলাধূলা। আমরা কিছুক্ষণ অংশগ্রহণ করলাম। কিন্তু আমার এই বিশাল বপু ও ভুঁড়ি নিয়ে আমি আর কতক্ষণ পারব। তাই ওপরে এসে স্কাই-বারের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হাতে একটি জুসের গ্লাস নিয়ে উপভোগ করছি সেই ’হোয়াইট ড্যান্স পার্টি’।
আজ আর বেশি রাত করলাম না। ডিনার সেরে শুয়ে পড়লাম। আগামীকাল তাসমানিয়ার পোর্ট আর্থার ভ্রমণ আছে।
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
আজ আমাদের ক্রুজ ট্যুরের ৫ম দিন। গত দেড় দিন টানা সমূদ্রে চলার পর আমাদের চলমান বাড়িখানা আজ তাসমানিয়ার পোর্ট আর্থারে নোঙর ফেলেছে। সকাল থেকে ছিপ ছিপ বৃষ্টি পড়ছে। গত রাত্তিরে সমূদ্র বোধহয় বেশ উত্তাল ছিল। ‘বোধহয় উত্তাল’ বললাম এই কারণে যে গতকাল রাতে বিছানায় শুয়ে বেশ ভাল দুলুনি অনূভব করছিলাম। এক পর্যায়ে স্বপ্ন দেখলাম যে, আমি জাহাজের জানালা ভেঙে সমূদ্রে পড়ে গিয়েছি। শিলাকে কথাটা খুব গম্ভীর মুখে বলতেই ও হেসে বলল, ‘ঠিকই বলেছ যে তুমি সমূদ্রে পড়ে গিয়েছিলে। তারপর সবাই মাছ ধরার জালে করে তোমাকে জাহাজে উঠিয়েছে।’ শিলা আমাকে খুব একটা পাত্তা দিল না।
সকালে অবশ্য আমার ধারণা কিছুটা সত্যি হলো। ক্যাপ্টেন সাহেব বেশ একটা চিন্তিত কণ্ঠস্বরে বলতে লাগলেন যে, ‘সমূদ্রে বেশ ঢেউ আছে। ফলে ছোট ছোট টেনডার দিয়ে পোর্ট আর্থারে যাওয়া যাবে কি না পরীক্ষা করে দেখতে হবে। প্রথমে একটি খালি টেনডার যাবে। সেই টেনডারটি নির্বিঘ্নে ফিরে এলে তখন যাত্রীরা যাবে।’
আমি আমার কল্পনার মানসচক্ষে ক্যাপ্টেন সাহেবকে দেখছি যে তিনি চিন্তিত মুখে ঘরময় পায়চারী করছেন আর ভাবছেন।
অবশেষে সব শঙ্কাকে ডংকা বাজিয়ে টেনডারটি ফিরে আসল সহি সালামতে। ক্যাপ্টেন সাহেব এবার আমাদের যাবার অনুমতি দিলেন। বাইরে তখনো বৃষ্টিসহ বাতাস বইছে। শিলা ইতিমধ্যে একটি ছাতা কিনে ফেলেছে। আমরা ও অন্য সহযাত্রীরা টেনডারে উঠে পড়লাম। আজ আর টেনডারের ছাদে যাত্রীদের উঠতে দিচ্ছে না। মনে হয় ক্যাপ্টেন সাহেবের বারণ।
মিনিট ১৫–র মধ্যে আমরা পোর্ট আর্থারে পৌছে গেলাম। টেনডার থেকে নেমে দেখি বড় একটি সাইনবোর্ডে লেখা ‘পোর্ট আর্থার হিস্টোরিক্যাল সাইট’। বরাবরই ইতিহাস ছুঁয়ে দেখতে আমার বেশ ভালো লাগে। ইতিহাস দেখে আমার মন চনমন করে উঠল। একটু পর শিলা বলল, ‘এটি একটি কারাগার ও মিলিটারি ব্যারাকের ধ্বংসাবশেষ।’ আমরা হাঁটতে হাঁটতে চললাম সেটি দেখতে। ছবি তুলতে তুলতে এগোচ্ছি আমি। কিছুক্ষণ পর শুনি শিলার ডাকাডাকি। চারপাশে তাঁকিয়ে দেখি ও নেই। তাহলে ডাক আসছে কোথা থেকে! পরে এদিক ওদিক খুঁজে দেখি, ও কারাগারের ভেতর ঢুকে জানালা গরাদে মুখ লাগিয়ে আমাকে ডাকছে। আমি ওর একটা ছবি তুলে দিলাম। ও গান গাইতে লাগল, ‘আমি বন্দী কারাগারে….।’
কারাগারটি প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো। এর নাম The Penitentiary, ১৮৪৫ সালের দিকে বিল্ডিং বানানো হয়েছিল আটা ময়দার কারখানা হিসাবে। পরে ১৮৫৪ সালে এটিকে কারাগারে রূপান্তরিত করা হয়। ব্রিটেন থেকে সাজাপ্রাপ্তদেরকে এখানে এনে জেলে রাখা হতো। কী অমানবিক ব্রিটেনের সেই সময়কার সরকার, আইন ও প্রশাসন! মাত্র একটি রুটি চুরির অপরাধে কত মানুষকে ১৫ বছর, ২০ বছর কারাবাস ও দেশান্তরের দণ্ড দিয়েছে ব্রিটিশ রাজ। কেন জানি না বাইবেলের সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ছে। যিশু খ্রিষ্ট বলেছিলেন, ‘Man shall not live by bread alone…’ তাঁর বেঁচে থাকতে হলে আরও অনেক কিছু লাগে। যেমন; ভালোবাসা, পরিবার, দেশ, পরিজন ইত্যাদি।
কারাগারের ভেতরে ঘুরে ঘুরে দেখছি আমরা। দেয়ালগুলো ১.৫-২ ফুট পুরু হবে। তাতে লোহার গরাদ বসানো। ভেতরে গোছল ও খাওয়াদাওয়ার জায়গা আছে। নিচতলায় বেশ কিছু সলিটারি সেল রয়েছে। এত ছোট সেল যে একটা মানুষ ঠিকমত দাঁড়াতে বা শুতে পারবে না। কয়েকটি সলিটারি সেলের মধ্যে বিভিন্ন কয়েদিদের নাম, অপরাধের ধরণ ও সাজার মেয়াদ লিখে রাখা হয়েছে। সেগুলো দেখতে দেখতে মনটা খারাপ হয়ে গেল। শিলা ঠিক এই সময় একটি দামি কথা বলল, ‘কনভিক্টেড হওয়ার পরও তারা আজ ইতিহাসের অংশ।’
আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। ও আবার বলল, ‘কত তুচ্ছ কারণে, তাদেরকে এত বড় শাস্তি দিয়েছিল! ভাবা যায়!’
আসলেই ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। যার যা প্রাপ্য তাকে কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দেয়। সেই ২০০ বছর আগে যারা কয়েদি ছিল তারা আজ ইতিহাসের অংশ আর যারা তাদেরকে লঘু অপরাধে গুরুদণ্ড দিয়েছিলেন তারা হয় ইতিহাস থেকে হারিয়ে গিয়েছে না হয় ইতিহাসে কুখ্যাত হিসাবে ঠাঁই পেয়েছে।
মনটাকে অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য আমি কারাগারের স্ট্রাকচারাল স্ট্যাবিলিটির দিকে মনোযোগ দিলাম এবং বিভিন্ন এঙ্গেলে ছবি তুলতে লাগলাম। শিলা আমার কাণ্ডকারখানা দেখে হাসতে লাগল। বলল, ‘যার কাজ যা, মনে ফাল দিয়ে ওঠে তা।’
আমি বললাম, ‘দেখ, মুচির চোখ মানুষের জুতার দিকে আর আমার মতো সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের চোখ বিল্ডিংয়ের স্ট্যাবিলিটির দিকে।’
এত পুরোনো একটি ঐতিহাসিক বিল্ডিংকে অস্ট্রেলিয়ার সরকার কী যত্ন করে সংরক্ষণ করছে। ধসে পড়ে যেতে পারে এই ভাবনা থেকে প্রতিটি দেয়ালের ভিতর দিকে তাঁরা স্টিলের ব্রেসিং দিয়ে শক্তপোক্ত করে রেখেছে। আমি একসময় বাংলাদেশের খ্যাতনামা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর শিষ্য ছিলাম। আমার প্রথম প্রজেক্টই ছিল বঙ্গবাজারের একটি বিল্ডিংকে স্ট্রাকচারালি রেনোভেট করা। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আজ এই কারাগারের রেনোভেশন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করে নিচ্ছিলাম।
কারাগার থেকে বের হয়ে পুরো কমপ্লেক্সটি ঘুরে ঘুরে দেখছি। কারাগারের এক পাশেই রয়েছে পুলিশ স্টেশন ও পুলিশদের থাকার জায়গা। একটু অদূরে রয়েছে ল-কোর্ট, হাসপাতাল, সিনিয়র মিলিটারি অফিসারদের কোয়ার্টারের ধ্বংসাবশেষ ইত্যাদি। ইতিহাসের সবকিছু ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছি। হঠাৎ মনে হলো এত বড় কমপ্লেক্সে খাবার পানি পেত কোথা থেকে? নাকি, সমূদ্রের পানি লবণমুক্ত করে খেত! এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে যখন হাঁটছি তখন লক্ষ করলাম একটি পানি সংরক্ষণের আধার। এটি পাহাড়ে একটু ওপরের দিকে। আলেকজান্ডার ক্রিক নামের একজন ইঞ্জিনিয়ার কয়েদিদের দিয়ে এটি নির্মাণ করেছিলেন পানি সমস্যা সমাধানের জন্য।
এখান থেকে বেরিয়ে দেখি রাস্তার উল্টো দিকে একটি মিউজিয়াম রয়েছে। মিউজিয়ামে ঢুঁ মারতেই হয়। গেলাম দুজনে সেই মিউজিয়ামে। মিউজিয়ামটির নাম ‘পোর্ট আর্থার হিস্টোরিক্যাল সাইট মিউজিয়াম’। এত সুন্দর করে, এত রিসার্চ করে, এত মনোগ্রাহী করে পুরো ২০০ বছরের পুরোনো কারাগার স্থাপনের ইতিহাস প্রদর্শন করছে তা না দেখলে পোর্ট আর্থার ট্যুর অপূর্ণই থেকে যেত।
মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে দেখি একটি সাইনবোর্ডে লেখা ‘সাটল সার্ভিস পোর্ট আর্থার সিটি’ এবং নিচে ২টি ফোন নম্বর। আমার ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি নেটওয়ার্ক এসেছে। এমনিতে জাহাজের ভেতর থাকলে নেটওয়ার্ক একটুও ওয়ার্ক করে না। সাহস করে দিলাম ফোন ২টি নম্বরের একটিতে। ওপাশ থেকে মনে হলো যন্ত্র চালিত কন্ঠস্বর, ‘তুমি এখন ফোন করেছ সাটল সার্ভিস পোর্ট আর্থার সিটিতে ফিলিপ নামের একটি ভদ্রলোকের মোবাইলে।’ আমি পুরো কথাটুকু শুনে চুপচাপ অপেক্ষা করছি যে একটি টুট করে শব্দ হবে তখন আমি আমার কথাটুকু রেকর্ড করে ভয়েস মেইল পাঠিয়ে দেব। হঠাৎ ওপাশ থেকে হ্যালো শুনে বুঝলাম ফিলিপ কথা বলছে। তাঁকে বললাম যে, আমরা সিটি ট্যুরে যেতে চাই। শুনে তিনি বললেন, ‘মিউজিয়ামের আপার লেভেলের পাশে রাস্তায় আসো। আমি ২ মিনিটে আসছি।’ তাঁর সাথে চুক্তি করে আমরা সিটি ঘুরতে গেলাম। ছোট্ট একটি সিটি। ল্যাভেন্ডার ও চকোলেট ফ্যাকটরি ঘুরে ঘন্টাখানেকের মধ্যে আমরা জাহাজে ফিরে এলাম।
জাহাজ আবার চলতে শুরু করেছে। আমরা রাতের খাবার খেয়ে নিজেদের কেবিনে ফিরে এলাম।
২৪ ডিসেম্বর ২০২৪
আজ সকালে ঘুম ভাঙল ক্যাপ্টেন সাহেবের গলা শুনে। তিনি বলছেন, ‘আমরা তাসমানিয়ার হোবার্ট শহরে এসেছি। তোমরা বন্দরে নামার জন্য রেডি হও। আজ আমরা সরাসরি বন্দরের ঘাটে জাহাজ ভিড়াতে পেরেছি।’ তার মানে বুঝলাম আজ আর টেনডার লাগবে না বন্দরে পৌঁছাতে।
চমৎকার!
সকালে ৯টার দিকে জাহাজ থেকে নাস্তা করে বের হয়ে পড়লাম। জাহাজ থেকে নেমে দেখি বেশ বড়সড় একটি বন্দর। বন্দরের কিছুই তো চিনি না। চিন্তায় পড়ে গেলাম যে, কোন বনে যে যাই আর কোন পথে যে ধাই। একটু হাঁটতেই দেখি বন্দরের মধ্যে একটি তথ্যকেন্দ্র। হাফ ছেড়ে বাঁচা গেল। তথ্যকেন্দ্রের ভেতর নানান রকমের শোপিছের দোকান। আমার তো আবার দোকানে দোকানে ঢুকে ঘুরে ঘুরে দেখা অভ্যাস। যাকে ওই ইংরেজিতে বলে উইন্ডো শপিং। শিলার ভাষায় অভ্যাস নয়, এটা বদভ্যাস। কিছুক্ষণ পরে দেখি শিলা হোবার্ট ট্যুরের ব্যবস্থা করে ফেলেছে। পাক্কা পাঁচ ঘন্টা হোবার্ট শহর ও শহরের আশেপাশের দৃষ্টিনন্দন জায়গা ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াবে। এখন একটু মজা পাচ্ছি। যথাসময়ে একজন পিটার নামের ট্যুর গাইড তাঁর মাইক্রোবাস নিয়ে হাজির। মাইক্রোবাসে আমরা দুজন ছাড়া আরও ৮ জন রয়েছে। ‘রইল ঝোলা, চলল ভোলার’ মতো আমি ও শিলা চললাম হোবার্ট পরিভ্রমণে। পেছনে পরে রইল জাহাজখানি। পিটার সাহেব প্রথমে আমাদের হোবার্ট শহরের প্রাণকেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘোরাতে লাগলেন। হোবার্ট শহরের বাড়ি ঘরের স্থাপত্যকলার নকশা দেখছি। অনেকটা ইউরোপিয়ানদের ধাঁচে মনে হলো বাড়িগুলো। ১০০–২০০ বছরের পুরোনো বাড়িও দেখলাম। খুব যত্ন করে রেখেছে সরকার। বাইরের আভরণ সেই ২০০ বছরের পুরোনো হলেও ভেতরে কিছুটা রেনোভেট করে বিভিন্ন নামি ব্র্যান্ডের দোকানের শো-রূম হয়েছে। আমাদের মেলবোর্নেও এরকম আছে, দেখেছি। মাঝে মাঝে পিটার গাড়ি চালাতে চালাতে নানা রকমের তথ্য আমাদের দিচ্ছে। দু–একটা জোকস বলেও হাসানোর চেষ্টা করছে। যেমন; হঠাৎ বলে উঠল, ‘সামনে রেড সিগন্যাল, গাড়ি দাঁড় করাতে হবে। তোমাদের মেলবোর্নেও কি এমন হয়?’ সামান্য কৌতুকপূর্ণ কথা। তারপরও সবাই হেসে উঠছে।
গাড়ি চলতে চলতে লক্ষ করলাম আমরা একটি পাহাড়ের ওপরের দিকে উঠছি। মিনিট ৩০–এর মধ্যে ধীরে ধীরে পিটারের বক্তব্য শুনতে শুনতে কখন যেন পাহাড়ের মগডালে পৌঁছে গেলাম। শিলা বলল, ‘পাহাড়ের আবার মগডাল হয় নাকি! পাহাড়ে হয় চুড়া।’
আমি বললাম,
“জো হুকুম মহারানি
পেটে নেই দানাপানি
বলতো তবে চুপ যাই
বকবকে অসুবিধা নাই।”
শিলা একটু গরম চোখে তাকাল আমার দিকে। আমি এখন চুপ। পাহাড়ের মগডাল থুড়ি চুঁড়ায় উঠে শুনলাম এই পাহাড়ের নাম মাউন্ট ওয়েলিংটন, এটি সমূদ্রপৃষ্ট থেকে ৫০০০ ফুট ওপরে। অস্ট্রেলিয়ায় এসে অবধি এই ওয়েলিংটন নামটা খুব শুনি। রাস্তার নাম, জায়গার নাম ওয়েলিংটন দেখেছি। এখন দেখছি আস্ত পাহাড়েরও নাম এই ওয়েলিংটন ভদ্রলোকের নামে। ভদ্রলোকের সাথে একবার দেখা করতে পারলে মন্দ হয় না। তাহলে এই নামকরণের ইতিহাসটা অন্তত জানা যেত!
মাইক্রোবাস থেকে নামার পালা এবার। পাহাড়ের চুড়া আবৃত হয়ে রয়েছে মেঘের মধ্যে। চারপাশ মনে হচ্ছে কুয়াশাচ্ছন্ন। মনে মনে সূর্য মামাকে দোষারোপ করছি। কী রে মামা, তোমার দাপটে গরমে প্রাণ আই ঢাই হয়ে যায় আর সেই তুমি কি না মেঘের ভয়ে লুকিয়ে তামাশা দেখছ! কিছুক্ষণ পর অবশ্য অল্প কিছু সময়ের জন্য তিনি বের হয়েছিলেন। তাতেই কয়েকটি ছবি তুলতে পেরেছি। মাইক্রোবাস থেকে নামতেই দেখি বাইরে কনকনে ঠান্ডা। অষ্ট্রেলিয়ায় ডিসেম্বর মাস ভয়াবহ গরমের মাস। তাপমাত্রা ৪০–৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে যায়। আর এখানে কি না হাড়কাপুনি ঠান্ডা! সকালে শিলা জাহাজ থেকে নামার সময় জ্যাকেট নিতে বলেছিল। কিন্তু আমি মাতব্বরি করে নিলাম না। মহাজ্ঞানীরা বলেছিলেন, ‘জীবনে বউয়ের কথা শোনা উচিত।’ কিন্তু আমার জ্ঞান অল্প হওয়ায় আমি শুনিনি। শুধুমাত্র এই একটি কারণে আমার মনে হয় মহাজ্ঞানী হওয়া আর হলো না। তবুও আমি দমবার পাত্র নই। ফিনফিনে হালকা টি-শার্ট পরেই মাউন্ট ওয়েলিংটনের মাথায় ঘুরে ঘুরে ছবি তুলতে লাগলাম। পাহাড়ের চুড়ায় প্রচুর পাথর দেখছি সাজানো রয়েছে। সাজানো পাথরগুলোকে দেখে আমার স্টোনহেঞ্জের কথা মনে হচ্ছে। আরেকটু ঘুরতেই দেখি বিশাল উঁচু একটি কংক্রিটের সাইলো বা টাওয়ার। এত উঁচুতে এত উঁচু টাওয়ারের কী দরকার পড়ল? ব্যাপারটা মনে হচ্ছে খুবই কৌতূহলোদ্দীপক! হুম! দেখতে হচ্ছে বিষয়টা। মেঘের কারণে এমনিতেই কিছুই দেখা যায় না এর ওপরে আবার ঠান্ডা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আমি মনে মনে কাঁপতে কাঁপতে বললাম, ‘আমি কী ডরাই সখি ভিখারী রাঘবে!’ টাওয়ারের কাছে গিয়ে দেখালাম যে এটি টেলিভিশনের টাওয়ার।
‘অ এই ব্যাপার! আগে বললেই হতো! সে যাগগে বলবে আবার কে! সবাই তো আমার মতোই ট্যুরিষ্ট।’ আবার মনে মনে বললাম।
আমার কাঁপুনি দেখে অনেকে সান্তনার বাণী দিচ্ছে। শিলা এসব দেখে বলল, ‘তুমি তো দেখি ছুপা রুস্তম। তোমার আনাচে কানাচে কত শুভাকাঙ্খী!’
ওদিকে শুনি পিটার তাড়া দিচ্ছে গাড়িতে চড়বার জন্য। এবারের গন্তব্য সমতলে। মাউন্ট ওয়েলিংটন শৃঙ্গ থেকে অধঃপতনে নেমে যাচ্ছি। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর আমরা একটি সেতু পার হলাম। পিটার কে ‘এই সেতুর নাম কী’ জিজ্ঞেস করতে ভয় পাচ্ছি? পাছে যদি আবার বলে বসে যে ‘এই সেতুর নাম ওয়েলিংটন ব্রিজ।’ যাক বাবা! সেসব কিছুই হলো না। আল্লাহর অশেষ রহমতে পিটার জানাল, এই সেতুর নাম ‘টাসমান ব্রিজ’। ১৬৪২ সালে টাসমান নামের এক ভদ্রলোক এখানে এসে বসত গড়েছিলেন। তাই তাঁর নামানুসারে এর নাম টাসমান ব্রিজ।
টাসমান ব্রিজ হোবার্ট শহরের পূর্ব দিককে পশ্চিম দিকের সাথে সংযোগ করেছে। সেটি পার হয়ে আমরা একটি ছোট ছিমছাম শহর রিচমন্ডে পৌঁছালাম। খুবই ছোট শহর। একটি মাত্র ফার্মেসি, একটি বাজার, একটি পুলিশ স্টেশন, একটি কোর্ট হাউস, একটি রিচমন্ড ব্রিজ ও একটি গির্জা এই নিয়ে শহরটি। তবে রিচমন্ড সেতুটি নির্মিত হয়েছে ১৮২৩ সালে। সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের দিয়ে তৎকালীন সরকার এই সেতুটি নির্মাণ করিয়েছিল। কী অমানবিক! সামান্য একটু খাবার চুরির অপরাধে নিজের আপনজন থেকে কত দূরে দেশান্তরিত হয়ে কয়েদি হিসেবে এই তাসমানিয়ার বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছিল কত অসহায় মানুষ। পুরোনো সব বড় বড় স্থাপনা দেখলাম স্যান্ড স্টোন দিয়ে নির্মিত। তার মানে একেকটি বিশাল বিশাল স্থাপনা বানাতে কত শত কয়েদি কত বছর ধরে পরিশ্রম করেছে।
রিচমন্ড শহরেরই একটি দোকানে ঢুকে দুপুরের পেট পুজো করে ফেললাম। এরপর পিটারের গাড়িতে চেপে বসলাম। এতসব করতে করতে কখন সময় শেষ হয়ে গেল বুঝতে পারিনি। পিটার আমাদের আবার বন্দরে পৌঁছিয়ে দিল। বিদায় নিয়ে আবার জাহাজে নিজের কেবিনে। আজ আবার ক্রিসমাস ইভিনিং। জাহাজের ভেতরে বেশ উৎসবের আমেজ। ক্রিসমাস ট্রি দিয়ে সাজানো হয়েছে রিসেপশন ও লাউঞ্জ এরিয়া। বিভিন্ন কোম্পানি নানা রকম রেড কার্পেট অফার দিচ্ছে। আমরা ডিনার সেরে সেই সব ঘুরে ঘুরে দেখছি আর উপভোগ করছি।
লক্ষ করলাম জাহাজ চলা শুরু করেছে। ‘নোঙর তোলো তোলো সময় যে হলো হলো,’ গানটি বাজছে মনের মধ্যে। আর দুই দিন সমূদ্রে যাত্রা চলবে। এরপর সুইট হোম। আমাদের সুইট মেলবোর্ন।
২৫ ডিসেম্বর ২০২৪
২৫ ডিসেম্বরের সকাল থেকেই ক্রিসমাসের আমেজে আমাদের জাহাজ ও সমূদ্র যেন নতুন রঙে সেজেছে। নীল আকাশের নিচে ঘন নীল-গাঢ় নীল সমূদ্রের জলরাশি। উৎসবের ঢঙে সবকিছু আজ পরিপূর্ণ। জাহাজের সব ক্রুরা মাথায় সান্টাক্লজের ক্যাপ পরে কাজ করছে। জাহাজের প্রতিটি কোণায় কোণায় আজ অনুষ্ঠান, হাসি-আনন্দ, নানান কর্মকাণ্ড। আজ বুফেতেও খ্রিষ্টানদের ক্রিসমাস স্পেশাল টারকি খেতে দিয়েছে। নানা ধরনের কেক-পেষ্ট্রি তো আছেই। একেবারে সাজ সাজ রব।
৭ নম্বর ডেকে দ্য মারকি বলে একটি বলরুম আছে। সেখানে বিগ ক্রিসমাস গেমস শো চলছে। আমরা দেখতে গেলাম সেসব। গেমস শো দেখে গেলাম ব্লু রুম অডিটোরিয়ামে লাইভ মিউজিক শুনতে। সারাদিন বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে কখন যে দিনটি শেষ হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না।
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
আজ আমাদের জাহাজের শেষ দিন। আগামীকাল আমরা মেলবোর্ন পোর্টে নেমে যাব। একদিক দিয়ে মনটা খারাপ লাগছে আবার অন্যদিকে বাড়ির জন্য মন ছটফট করছে। এই কয়েক দিনে জাহাজের সব স্টাফ, ক্রু, রুম স্টুয়ার্ট ও অন্য যাত্রীদের সাথে যেন এক ধরনের আত্মীয়তা হয়ে গিয়েছিল। কাল সকালে যে যার মতো সবাই পৃথিবীর বিভিন্ন কোণে কোণে হারিয়ে যাব। আর কোনো দিন কারও সাথে দেখা হবে কি না জানি না। তবু সবার স্মৃতি ক্যামেরার ছবিতে ও মনের মণিকোঠায় জমা রবে। আজ আবার রবিঠাকুরকে মনে পড়ছে,
“সম্মুখ ঊর্মিরে ডাকে পশ্চাতের ঢেউ
দিব না দিব না যেতে। নাহি শুনে কেউ… …”
আমি আর শিলা সাততলার ডেকের ব্যালকনিতে বসে আছি। এই ব্যালকনিটা জাহাজের পুরো পরীধি ঘুরেছে। এই ব্যালকনি ধরে তিনপাক হাঁটলে ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার হাঁটা হয়। আমরা নিয়ম করে রোজ এখানে হাঁটতাম। কিন্তু আজ শীলা ও আমি দুজন দুজনের পীঠে হেলান দিয়ে এখানে এই নির্জনে বসে আছি।
শীলা গান ধরেছে,
‘সাগরের তীর থেকে
মিষ্টি কিছু হাওয়া এনে
তোমার কপালে ছোঁয়াবো গো
ভাবি মনে মনে।
আকাশের নীল থেকে
তারার ক্লান্তি এনে
তোমার নয়নে ছড়াবো গো
ভাবি মনে মনে…’
ভ্রমণকাহিনি
‘Cruisers are not Losers’
অস্ট্রেলিয়ায় সবচেয়ে লম্বা ছুটি থাকে ক্রিসমাস ও ইংরেজি নববর্ষের সময়টাতে। এই সময়টাতে কখনো কখনো আমরা বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশ বা অন্তত পক্ষে অস্ট্রেলিয়ার ভেতরেই বেশ বড়সড় ঘোরাঘুরি করে থাকি। এই ঘোরাঘুরিতে আমরা সাধারণত সড়কপথ, রেলপথ বা আকাশপথ ব্যবহার করে থাকি। এবারের ছুটিতে আমার মনে হলো জলপথে ভ্রমণ করলে কেমন হয়। অস্ট্রেলিয়ার চারপাশে তো খালি সমূদ্র আর সমূদ্র। সেই সমূদ্র পথই হোক না হয় আমাদের এবারের পথ হারানোর পথ। বিষয়টি আমার মাথায় এসেছিল জুলাই ২০২৪ এর দিকে। তখনই আমরা যোগাযোগ করি একটি ট্যুর কোম্পানির সঙ্গে। ট্যুর কোম্পানি আমাদের জানায়, ‘তোমরা ভালো সময়েই এসেছ। আমরা ক্রুজ ট্যুরের বুকিং নিচ্ছি।’ কোনো আগুপিছু আর ভাবিনি। প্রাথমিক বুকিং করে ফেলি। এরপরে অক্টোবর ২০২৪ মাসে দিলাম ফাইনাল বুকিং। ব্যাস, হয়ে গেল।
অক্টোবরের পর থেকে শুরু হলো আমাদের তোড়জোড়। আমার স্ত্রী শিলা ও আমি খুবই একসাইটেড এই ট্যুর নিয়ে। এই সময়ের মধ্যে শিলা কিছু শপিং করে ফেলেছে। আমার কেমন যেন থ্রিল ফিল হচ্ছে। জীবনে কোনো দিন সমূদ্র যাত্রা করিনি। শুনেছি সমূদ্রের ঢেউয়ের দুলুনিতে সি-সিকনেস হয় অনেকের। অনেক কে নাকি হেলিকপ্টারে ফেরত নিয়ে আসা হয়। কী যে হবে আমাদের!
তবে আমার মনে একটি ভরসা ছিল যে, আমি বাংলাদেশে ঢাকা থেকে আমার বাড়ি চুয়াডাঙ্গা যাবার সময় ফেরি পার হয়েছি শত শত বার। সুতরাং সমূদ্রের ওইটুকু দুলুনিতে কিছু হবে না। শিলাকে কথাটা বলতে ও হেসে বলল, ‘নদীতে ফেরি পারাপার আর সমূদ্র যাত্রা এক হলো? ভালোই বলেছ। তোমাকে দিয়েই হবে।’ ওর কথা শুনে আমার একটু ভয় ভয় করছিল। মনে হচ্ছিল ভূমিতে অবস্থান করেও আমি মাঝেমধ্যে দুলে দুলে উঠছি আর আমার বমি বমি ভাব হচ্ছে। আমি এ সব কিছু শিলার কাছে কায়দা করে চেপে গেলাম। তা না হলে ও আরও হাসাহাসি করত।
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
এইভাবে তালেগোলে ও দুলে দুলে কয়েক মাস পার হয়ে গেল। আজ আমরা যাচ্ছি সমূদ্র ভ্রমণে। একটা উবার ডেকে চেপে বসেছি। আজকের এক্সাইটমেন্ট চরমে আমাদের। উবার কিছুক্ষণ চলার পর আমার মনে হলো যে আমরা সি-পোর্টের দিকে না গিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছি। মেলবোর্নে আছি প্রায় ৮ বছর হলো। মেলবোর্নের অনেক রাস্তায় আমি চিনি। উবার ড্রাইভারকে বলতেই তিনি জিভ কেঁটে স্যরি বলে গাড়ি ঘুরিয়ে ফেললেন। এদিকে আমাদের বোর্ডিংয়ের সময় দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছে। যা হোক, আল্লাহর অশেষ কৃপায় আর ভুলভ্রান্তি না করে ড্রাইভার সাহেব আমাদের সি-পোর্টে পৌঁছিয়ে দিলেন। রাস্তা থেকেই জাহাজখানা চোখে পড়ল। কী বিশাল জাহাজরে বাবা! দানবের মতো লাগছে একদম।
আল্লাহর নাম নিয়ে সমস্ত চেকপোষ্ট পার করে উঠে পড়েলাম জাহাজে। জাহাজে ঢুকে দেখি আমরা একটি ৪/৫ তারকা হোটেলের বলরুমে চলে এসেছি। চোখ ধাঁধানো করে সাজানো। চোখে তখন টাইটানিকের সেই রিসেপশন এরিয়ার রূপ ভাসছে। রিসেপশনিস্টরা আমাদের অভ্যর্থনা করে কেবিন দেখিয়ে দিল। কেবিনের কাছে আসতেই কেবিন স্টুয়ার্ট আমাদের স্বাগত জানাল। তাঁর নাম সোমাং। তিনি বললেন, ‘এই কয়েক দিন আমিই তোমাদের দেখভাল করব। তোমাদের কোনো কিছুর দরকার হলে আমাকে বলবে।’ কেবিনে ঢুকেই আমার মজা লাগতে শুরু করেছে। কী সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো!
আমরা কেবিনে ব্যাগ-স্যুটকেস রেখে জাহাজ ঘুরতে বের হলাম। সোমাং বলল, ‘তোমরা ১৪ তলায় যাও। গিয়ে কিছু খেয়ে নাও। তারপর ১২ ও ১৪ তলার খোলা আকাশের নিচের ডেকে ঘুরতে পার।’
আমরা সেইমতো করলাম। জাহাজের ভেতর ২টি ক্যাপসুল লিফটসহ ৮–১০টা অন্য লিফট রয়েছে। লিফটে উঠতে গিয়ে খেয়াল করলাম যে, লিফটের বাটনে ১২ তলার পর ১৪ তলা লেখা। ১৩ তলা নেই। লিফট ছাড়া সিঁড়ি দিয়ে নেমেও আমি ১৩ তলা খুঁজে না পেয়ে শিলাকে বললাম, ‘ব্যাপার কী? জাহাজে ১৩ তলা নেই। ১২ তলার পর সোজা ১৪ তলা। ১৩ তলা নেই কেন?”
শীলা বলল, ‘১৩ হলো এদের ভাষায় আনলাকি থার্টিন। তাই এই ব্যবস্থা।’
আমি না হেসে পারলাম না। একটু জোরেই হেসে ফেলেছি লিফটের মধ্যে। সবাই আমার দিকে তাঁকিয়ে আছে। হয়তো ভাবছে, ব্যাটা পাগল হয়ে গেল নাকি! শিলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাঁকিয়ে আছে। আমি বললাম, ‘এখানে কাজির গরু গোয়ালে আছে কিন্তু কাগজে নেই অবস্থা।’
শিলা বলল, ‘কী রকম?’
আমি বললাম, ‘সংখ্যাতত্ব অনুযায়ী এই ১৪ তলাটাই হলো আসলে ১৩ তলা। কিন্তু কাগজে কলমে লিখে রেখেছে ১৪ তলা। কুসংষ্কার বিশ্বাস আর কাকে বলে!হা–হা–হা।’ আবার আমি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম।
১৪ তলায় ‘দ্যা প্যান্ট্রি’ নামে একটি বুফে আছে। এর ভেতর আছে ৮/১০টি ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট। এখানে এসে যেকোনো কাউন্টার থেকে যত ইচ্ছা খাবার নিয়ে খাওয়া যায়। শেষে আবার ডেজার্ট হিসেবে রয়েছে বিভিন্ন রকমের পেষ্ট্রি। আর এ সবই আমাদের টিকিটের অর্থের মধ্যেই ধরা রয়েছে। মানে কোনো অর্থ আর দিতে হবে না বুফে খাবারের জন্য। মনে মনে সাধু সাধু বলে উঠলাম। অর্থাৎ কি না তিনবেলা যথেচ্ছ ভূঁড়িভোজন ও বিছানায় শুয়ে ঘুমানো আর কোনো চিন্তা নেই। খাবারদাবার ছাড়াও জাহাজের এ মাথা থেকে ও মাথায় বিভিন্ন কার্যক্রম যেমনঃ স্পা, ক্যাসিনো, খেলাধূলা, কারাওকে, গানবাজনা, কমেডি শো, জিম, সুইমিং, থিয়েটারে সিনেমা দেখা, শপিং মলে ঢুঁ মারা, কফি শপ, আইসক্রিম বার ইত্যাদি সব কিছুতে অংশগ্রহণ করা যাবে। সেই সাথে জাহাজের ক্যাপ্টেন ও তার ক্রুরা আমদেরকে তিনটি আইল্যান্ডে নিয়ে যাবেন ও ঘোরাবেন। এ যেন স্বর্গের ছোট দুনিয়াবি ভার্সন! সেদিনের মতো আমরা জাহাজে একটু ঘোরাঘুরি করে কেবিনে চলে এলাম।
২০ ডিসেম্বর ২০২৪
আজ সকালে একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছি। জানালা দিয়ে বাইরে তাঁকিয়ে একটু ভয় হলো। চারিদিকে শুধুই পানি আর পানি। যতদূর দৃষ্টি যায় কোনো ডাঙ্গা দেখতে পাওয়া যায় না। হালকা হালকা করে জাহাজ দুলছে। কোন এক জায়গায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকলে দুলুনি বোঝা যায়। আমি আপন মনে জানালার সামনে রবিঠাকুর আওড়াচ্ছি,
“যুগযুগান্তর ধরি যোজন যোজন
ফুলিয়া ফুলিয়া উঠে উত্তাল উচ্ছ্বাস -
অশান্ত বিপুল প্রাণ করিছে গর্জন
নীরবে শুনিছে তাই প্রশান্ত আকাশ”
শিলা কখন এসে আমার পেছনে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। বলল, ‘সাড়ে ৮টা বাজে প্রায়। চল নাস্তা খেয়ে আসি।’
ঠিকই তো দেরি হয়ে গিয়েছে। সাড়ে ৯টার পরে বুফে বন্ধ হয়ে যায়। রবি ঠাকুরের ভাবের জগৎ থেকে হঠাৎ করেই খাবারের জগতে চলে এলাম। যম্পেশ করে দুজনে নাস্তা সেরে ১২ তলার খোলা ডেকে সুনীল আকাশের নিচে সান বেডে শরীর এলিয়ে দিলাম। সমূদ্রের মাঝখানে এখন আমরা। যদিও এখন অস্ট্রেলিয়াতে গ্রীষ্মকাল। তবু মাঝ সমূদ্রে একটু শীত শীত করছে। তবে সূর্যের নিচে শুয়ে থাকতে মজাই লাগছে। বড় স্ক্রিনে কী একটা সিনেমা চলছে। আমি ও শিলা সান বেডে শুয়ে শুয়ে কফি পান করছি ও যে যার মতো বই পড়ছি। বেশ কিছুক্ষণ পর সূর্য মামার তেজ বেড়ে গেলে আমি কেবিনে ফিরে আসি কিছু একটা লিখব বলে। আর শিলা গেল ‘লেডিস প্যাম্পার পার্টি’তে। কী ধরনের প্যাম্পার করা হলো জানি না। তবে কেবিনে ফিরে বলল, ‘গোসল করে নামাজ পড়ে নাও। দুপুরের খাবার খেতে যাব।’
ও হ্যাঁ, বলে রাখি, কেবিন স্টুয়ার্ট প্রতিদিন সকালে ‘গুড টাইমস’ নামে একটি চার পৃষ্ঠার রঙিন পত্রিকা দিয়ে যায় আমাদের কেবিনে। এই পত্রিকাতে জাহাজে অনুষ্ঠিত ওইদিনের সমস্ত আকর্ষণীয় কর্মকাণ্ড লেখা থাকে। আমি সেখানে চোখ বুলিয়ে দুপুরের খাবারের পর একটি সেমিনারে গেলাম। সেমিনারটি হলো ‘হাউ টু ইনক্রিজ ইয়োর মেটাবলিজম’। যত যাই হোক খাওয়ার থেকেও ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। সুতরাং ত্যাগের স্বার্থেই আমার এই উদ্যোগ। সেখান থেকে গেলাম পিয়ানো কনসার্টে। শিলা একটু দুপুরে ভাতঘুম দিয়েছে এর মধ্যে। সন্ধ্যায় দুজন মিলে দেখতে গেলাম প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য করা একটি কমেডি শো। শো শেষ করে ফিরতে ফিরতে একটু রাত হয়ে গেল।
আর এভাবেই কেমন করে যেন প্রথম দিন সমূদ্রের মাঝখানে কেটে গেল। রাতে একটি ড্যান্স পার্টি ছিল, আমরা আর যাইনি। দুলুনির জন্য খালি ঘুম পাচ্ছে। তাই আজকের মতো আর কিছু নয়। সোজা বিছানায়।
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
উফ! ভাবা যায় টানা একদিন ও দুই রাত সমূদ্রের ওপর জাহাজের ভেতরে আমরা। তিনবেলা খাওয়াদাওয়া, হাঁটাহাঁটি, নানা ধরনের কর্মকাণ্ড সবই এই জাহাজটির ভেতরে। জাহাজের একটি আ্যপস আছে। আমরা ফোনে ইন্সটল করে নিয়েছি। সেখানে দেখলাম যাত্রী আছে ১৯৯৮ জন। তাহলে জাহাজের ক্রুরা সব মিলিয়ে ২ হাজার ৫০০ লোক তো হবেই।
যেটা বলছিলাম, টানা ৪০ ঘন্টা পর আমরা আজ সাউথ অস্ট্রেলিয়ার ক্যাঙারু আইল্যান্ডে উপস্থিত। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি জাহাজ স্থির হয়ে রয়েছে। আর দূরে ক্যাঙারু আইল্যান্ড দেখা যাচ্ছে। আমাদের জাহাজটি বন্দর থেকে একটু দূরে সমূদ্রের ভেতর নোঙর করে আছে। তাহলে উপায়? কীভাবে আমরা পাড়ে পৌঁছাব? আমি চিন্তিত মুখে রিসেপশন ও লাউঞ্জ এরিয়াতে ঘোরাঘুরি করছি। এর মধ্যেই একজন রিসেপশনিস্ট যেন দেবদূতের মতো আবির্ভূত হলো। তিনি বললেন, ‘কোনো চিন্তা নেই। জাহাজের ৭ নম্বর ডেকের সিলিংয়ে কিছু ছোট ছোট রেসকিউ বোট ঝুলানো আছে, দেখেছো?’ আমি ও শিলা ওই ডেকের চারপাশে হাঁটার সময় দেখেছি এবং সংখ্যাও গুনেছি। প্রায় ১৮টির মতো বোট আছে। একেকটি বোটে ১৫০ জন বসতে পারে। আমি মাথা নেড়ে সায় দিতেই তিনি বললেন, ‘ঐ বোটকে টেনডার বলে। ওটাতে করেই পাড়ে পৌঁছিয়ে দেওয়া হবে আবার ফিরিয়েও আনা হবে।’ তারপর তিনি একটি মেশিন থেকে আমাদের জন্য টেনডার বুকিং করে দিলেন। ভারী মজা পেলাম। আমাদের গ্রুপ নম্বর হলো ১৮।
আমরা আমাদের কেবিনে বসে অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণ পর স্পিকারে ১৮ গ্রুপ শুনে লাইনে দাঁড়ালাম। লাইনে দাঁড়িয়ে দেখি অস্ট্রেলিয়ার বায়ো ডাইভার্সিটির অফিসাররা যাত্রীদের ব্যাগ চেকিং করছে। এ প্রসঙ্গে দুটো কথা বলি। অস্ট্রেলিয়া তার দেশের জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিষয়ে অতিব সচেতন। অস্ট্রেলিয়া যেহেতু সমূদ্রের মধ্যে একটি আইল্যান্ড সেহেতু বিদেশ থেকে কোনো ফল-বীজ-মাটি-পোল্ট্রিসহ আরও নানান জিনিস অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে আনা নিষেধ। যদি কেউ আনে তাহলে তাকে আগে থেকে ডিকলেরাশন দিতে হয়, তখন বায়ো ডাইভারসিটির লোকজন সেগুলো পরীক্ষা করে বাজেয়াপ্ত করে অথবা জীব বৈচিত্র্যের ওপর ক্ষতিকারক না হলে নেওয়ার অনুমতি দেয়। আর কেউ যদি ডিকলেরাশন না দেয় এবং ধরা পড়ে তাহলে জেল-জরিমানা-ডিপোর্টেশন-ভিসা বাতিল করা হয়। তবে মজার কথা হলো, শুধু বিদেশ নয় নিজের দেশের অভ্যন্তরেও একটি স্টেট থেকে অন্য স্টেটে কোনো ফল-বীজ-পোল্ট্রি বহন করতে দেয় না পরীক্ষা ছাড়া। আজ সেই বায়ো ডাইভারসিটির লোকজনের খুব তোড়জোড়। তারা যথেষ্ট কঠিন মুখ করে সবার ব্যাগ খুলে খুলে পরীক্ষা করছে। কেউ জাহাজ থেকে ভয়ংকর আপেল, মারাত্মক কমলা এমনকি নিদেনপক্ষে কোনো বিপদজনক কলা ছলাকলা করে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে কি না!
আমাদের ব্যাগ চেকিং করে ছেড়ে দিল। আমরা টেনডারে উঠে পড়লাম। টেনডারটি মিনিট ১৫–২০–এর মধ্যে আমাদেরকে পাড়ে পৌঁছিয়ে দিল। পাড়ে পৌঁছে আমরা হাঁটতে লাগলাম বাজার বা লোকালয়ের উদ্দেশে। আমার ইচ্ছা একটি প্রাইভেট কার ভাড়া করে পুরো আইল্যান্ড ঘুরব এবং বিকেলে এসে গাড়ি ফেরত দিয়ে দেব। কিন্তু তেমন কোনো রেন্ট–এ–কারের দোকান পেলাম না। হাঁটতে হাঁটতে দেখি একটি বাচ্চা ছেলে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। আমাদের কাছে এসে বলছে, ‘ওদের একটি ফ্যামিলি ট্যুর কোম্পানি আছে। ওদের বাস আমাদেরকে আইল্যান্ডের কিছু অংশ ঘুরিয়ে দেখাবে।’ আমরা ওই ছেলেটির সাথে ওদের দোকানে গেলাম। গিয়ে দেখি ওর বাবা আর বড় দুই বোন একসাথে দোকান চালাচ্ছে। এক বোন টিকিটের অর্থ নিচ্ছে, এক বোন প্যাসেঞ্জার লিষ্ট তৈরি করছে, ওদের বাবা বাসে প্যাসেঞ্জার তুলে দিচ্ছে আর সেই বাচ্চা ছেলেটি মার্কেটিং করছে। বড় ভালো লাগল দৃশ্যটি। আমাদের বাস ঘন্টা দেড়েক পর আসবে। আমরা টিকিট কিনে এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলাম। এখানে একটি মাঠের মধ্যে লোকাল হাট বসেছে। হাটের সেই সব দোকান ঘুরে ঘুরে দেখছি। শিলার ফ্রিজ ম্যাগনেট জমানো শখ। তাই ও আমাদের জাহাজের ছবি সম্বলিত একটি ফ্রিজ ম্যাগনেট কিনেছে।
দেখতে দেখতে বাসে ওঠার সময় হয়ে আসল। আমরা বাসে করে ক্যাঙারু আইল্যান্ডের কয়েকটি দর্শনীয় স্থান ও সমূদ্র সৈকত ঘুরে ঘুরে দেখছি। সবশেষে ট্যুর গাইড আমাদেরকে আমেরিকান রিভার নামে একটি জায়গায় নিয়ে এসেছে। ট্যুর গাইডের বক্তব্য অনুযায়ী এই জায়গাতে ১৮০৩ সালে কিছু আমেরিকার নাবিক নোঙর করেছিল এবং চার মাস অবস্থান করেছিল। তাই এই অঞ্চলের নাম আমেরিকান রিভার। তবে লোকাল জনশ্রুতি হলো এই জায়গা অনেক আগে আমেরিকান অঙ্গরাজ্য ছিল। জানি না কোনটি সঠিক।
ক্যাঙারু আইল্যান্ডে ৩–৪ বছর আগে এসেছিলাম আমার বন্ধু রুহুল আমিনের পরিবারের সাথে। সেবার এখানে ২ দিন ছিলাম একটি ক্যারাভান পার্কে। তখন আমরা গাড়ি ভাড়া করে পুরো আইল্যান্ড ঘুরেছিলাম। এই আইল্যান্ডে অন্যতম দেখার জায়গা হলো ‘রিমার্কেবল রক’। কমলা রঙের অসংখ্য পাথর দিয়ে প্রকৃতিগত ভাবেই মনুমেন্টের মত একটা জিনিস তৈরি হয়েছে। চমৎকার সুন্দর প্রকৃতির সেই লীলা। এবার সেখানে আর যাওয়া হলো না। বিকেল ৩টার মধ্যেই আমাদের পোর্টে ফিরে আসতে হলো। এরপর আবার টেনডারে করে জাহাজে নিজেদের কেবিন। আহা! খাসা বন্দোবস্ত। ঘোরো ফেরো খাও দাও আর কেবিনে এসে ঘুমাও। একদম আসল স্ট্রেস ফ্রি রিল্যাক্স ট্যুর।
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
এখন ক্রুজ, জাহাজ ও সমূদ্র সবই অনেকটা আয়ত্বে চলে এসেছে। নিয়ম করে আমাদের খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, বই পড়া ও জাহাজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ চলছে। আজ মনে হলো আমরা সুইমিং করব। এই জাহাজে ওপরের তলায় অর্থাৎ ১২ তলার দিকে তিনটি সুইমিং পুল ও ৩/৪টি গরম পানির জ্যাকুযি আছে। সুইমিং পুলের পানি বেশ ঠান্ডা। আজ আমরা সুইমিং পুলে সাঁতরিয়ে গোসল করে নিলাম। তারপর গেলাম জ্যাকুযিতে গা গরম করতে। জ্যাকুযিতে গরম পানিতে শরীর এলিয়ে বসে বসে বড় স্ক্রীনে একটি সিনেমাও দেখে ফেললাম। বাচ্চারা সুইমিং পুলের পাশে ওয়াটার স্লাইডে চড়ে খুব মজা পাচ্ছে। কয়েকজনকে দেখলাম তারের দড়িতে ঝুলে ঝুলে জাহাজের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যাচ্ছে। বেশ একটা অদ্ভূত অনুভূতি! এটা ভাষায় প্রকাশ করে পারব না।
দুপুরে একটু লিখতে বসলাম। গুড টাইমস পত্রিকায় দেখলাম বিকেলের দিকে ‘হোয়াইট ড্যান্স পার্টি’ আছে। আমরা সাদা ড্রেস পরে সেই ড্যান্স পার্টিতে গিয়ে উপস্থিত। এক ডিজের তত্বাবধানে চলছে খোলা আরাশের নিচে ড্যান্স পার্টি ও নানান ধরনের খেলাধূলা। আমরা কিছুক্ষণ অংশগ্রহণ করলাম। কিন্তু আমার এই বিশাল বপু ও ভুঁড়ি নিয়ে আমি আর কতক্ষণ পারব। তাই ওপরে এসে স্কাই-বারের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হাতে একটি জুসের গ্লাস নিয়ে উপভোগ করছি সেই ’হোয়াইট ড্যান্স পার্টি’।
আজ আর বেশি রাত করলাম না। ডিনার সেরে শুয়ে পড়লাম। আগামীকাল তাসমানিয়ার পোর্ট আর্থার ভ্রমণ আছে।
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
আজ আমাদের ক্রুজ ট্যুরের ৫ম দিন। গত দেড় দিন টানা সমূদ্রে চলার পর আমাদের চলমান বাড়িখানা আজ তাসমানিয়ার পোর্ট আর্থারে নোঙর ফেলেছে। সকাল থেকে ছিপ ছিপ বৃষ্টি পড়ছে। গত রাত্তিরে সমূদ্র বোধহয় বেশ উত্তাল ছিল। ‘বোধহয় উত্তাল’ বললাম এই কারণে যে গতকাল রাতে বিছানায় শুয়ে বেশ ভাল দুলুনি অনূভব করছিলাম। এক পর্যায়ে স্বপ্ন দেখলাম যে, আমি জাহাজের জানালা ভেঙে সমূদ্রে পড়ে গিয়েছি। শিলাকে কথাটা খুব গম্ভীর মুখে বলতেই ও হেসে বলল, ‘ঠিকই বলেছ যে তুমি সমূদ্রে পড়ে গিয়েছিলে। তারপর সবাই মাছ ধরার জালে করে তোমাকে জাহাজে উঠিয়েছে।’ শিলা আমাকে খুব একটা পাত্তা দিল না।
সকালে অবশ্য আমার ধারণা কিছুটা সত্যি হলো। ক্যাপ্টেন সাহেব বেশ একটা চিন্তিত কণ্ঠস্বরে বলতে লাগলেন যে, ‘সমূদ্রে বেশ ঢেউ আছে। ফলে ছোট ছোট টেনডার দিয়ে পোর্ট আর্থারে যাওয়া যাবে কি না পরীক্ষা করে দেখতে হবে। প্রথমে একটি খালি টেনডার যাবে। সেই টেনডারটি নির্বিঘ্নে ফিরে এলে তখন যাত্রীরা যাবে।’
আমি আমার কল্পনার মানসচক্ষে ক্যাপ্টেন সাহেবকে দেখছি যে তিনি চিন্তিত মুখে ঘরময় পায়চারী করছেন আর ভাবছেন।
অবশেষে সব শঙ্কাকে ডংকা বাজিয়ে টেনডারটি ফিরে আসল সহি সালামতে। ক্যাপ্টেন সাহেব এবার আমাদের যাবার অনুমতি দিলেন। বাইরে তখনো বৃষ্টিসহ বাতাস বইছে। শিলা ইতিমধ্যে একটি ছাতা কিনে ফেলেছে। আমরা ও অন্য সহযাত্রীরা টেনডারে উঠে পড়লাম। আজ আর টেনডারের ছাদে যাত্রীদের উঠতে দিচ্ছে না। মনে হয় ক্যাপ্টেন সাহেবের বারণ।
মিনিট ১৫–র মধ্যে আমরা পোর্ট আর্থারে পৌছে গেলাম। টেনডার থেকে নেমে দেখি বড় একটি সাইনবোর্ডে লেখা ‘পোর্ট আর্থার হিস্টোরিক্যাল সাইট’। বরাবরই ইতিহাস ছুঁয়ে দেখতে আমার বেশ ভালো লাগে। ইতিহাস দেখে আমার মন চনমন করে উঠল। একটু পর শিলা বলল, ‘এটি একটি কারাগার ও মিলিটারি ব্যারাকের ধ্বংসাবশেষ।’ আমরা হাঁটতে হাঁটতে চললাম সেটি দেখতে। ছবি তুলতে তুলতে এগোচ্ছি আমি। কিছুক্ষণ পর শুনি শিলার ডাকাডাকি। চারপাশে তাঁকিয়ে দেখি ও নেই। তাহলে ডাক আসছে কোথা থেকে! পরে এদিক ওদিক খুঁজে দেখি, ও কারাগারের ভেতর ঢুকে জানালা গরাদে মুখ লাগিয়ে আমাকে ডাকছে। আমি ওর একটা ছবি তুলে দিলাম। ও গান গাইতে লাগল, ‘আমি বন্দী কারাগারে….।’
কারাগারটি প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো। এর নাম The Penitentiary, ১৮৪৫ সালের দিকে বিল্ডিং বানানো হয়েছিল আটা ময়দার কারখানা হিসাবে। পরে ১৮৫৪ সালে এটিকে কারাগারে রূপান্তরিত করা হয়। ব্রিটেন থেকে সাজাপ্রাপ্তদেরকে এখানে এনে জেলে রাখা হতো। কী অমানবিক ব্রিটেনের সেই সময়কার সরকার, আইন ও প্রশাসন! মাত্র একটি রুটি চুরির অপরাধে কত মানুষকে ১৫ বছর, ২০ বছর কারাবাস ও দেশান্তরের দণ্ড দিয়েছে ব্রিটিশ রাজ। কেন জানি না বাইবেলের সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ছে। যিশু খ্রিষ্ট বলেছিলেন, ‘Man shall not live by bread alone…’ তাঁর বেঁচে থাকতে হলে আরও অনেক কিছু লাগে। যেমন; ভালোবাসা, পরিবার, দেশ, পরিজন ইত্যাদি।
কারাগারের ভেতরে ঘুরে ঘুরে দেখছি আমরা। দেয়ালগুলো ১.৫-২ ফুট পুরু হবে। তাতে লোহার গরাদ বসানো। ভেতরে গোছল ও খাওয়াদাওয়ার জায়গা আছে। নিচতলায় বেশ কিছু সলিটারি সেল রয়েছে। এত ছোট সেল যে একটা মানুষ ঠিকমত দাঁড়াতে বা শুতে পারবে না। কয়েকটি সলিটারি সেলের মধ্যে বিভিন্ন কয়েদিদের নাম, অপরাধের ধরণ ও সাজার মেয়াদ লিখে রাখা হয়েছে। সেগুলো দেখতে দেখতে মনটা খারাপ হয়ে গেল। শিলা ঠিক এই সময় একটি দামি কথা বলল, ‘কনভিক্টেড হওয়ার পরও তারা আজ ইতিহাসের অংশ।’
আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। ও আবার বলল, ‘কত তুচ্ছ কারণে, তাদেরকে এত বড় শাস্তি দিয়েছিল! ভাবা যায়!’
আসলেই ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। যার যা প্রাপ্য তাকে কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দেয়। সেই ২০০ বছর আগে যারা কয়েদি ছিল তারা আজ ইতিহাসের অংশ আর যারা তাদেরকে লঘু অপরাধে গুরুদণ্ড দিয়েছিলেন তারা হয় ইতিহাস থেকে হারিয়ে গিয়েছে না হয় ইতিহাসে কুখ্যাত হিসাবে ঠাঁই পেয়েছে।
মনটাকে অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য আমি কারাগারের স্ট্রাকচারাল স্ট্যাবিলিটির দিকে মনোযোগ দিলাম এবং বিভিন্ন এঙ্গেলে ছবি তুলতে লাগলাম। শিলা আমার কাণ্ডকারখানা দেখে হাসতে লাগল। বলল, ‘যার কাজ যা, মনে ফাল দিয়ে ওঠে তা।’
আমি বললাম, ‘দেখ, মুচির চোখ মানুষের জুতার দিকে আর আমার মতো সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের চোখ বিল্ডিংয়ের স্ট্যাবিলিটির দিকে।’
এত পুরোনো একটি ঐতিহাসিক বিল্ডিংকে অস্ট্রেলিয়ার সরকার কী যত্ন করে সংরক্ষণ করছে। ধসে পড়ে যেতে পারে এই ভাবনা থেকে প্রতিটি দেয়ালের ভিতর দিকে তাঁরা স্টিলের ব্রেসিং দিয়ে শক্তপোক্ত করে রেখেছে। আমি একসময় বাংলাদেশের খ্যাতনামা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর শিষ্য ছিলাম। আমার প্রথম প্রজেক্টই ছিল বঙ্গবাজারের একটি বিল্ডিংকে স্ট্রাকচারালি রেনোভেট করা। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আজ এই কারাগারের রেনোভেশন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করে নিচ্ছিলাম।
কারাগার থেকে বের হয়ে পুরো কমপ্লেক্সটি ঘুরে ঘুরে দেখছি। কারাগারের এক পাশেই রয়েছে পুলিশ স্টেশন ও পুলিশদের থাকার জায়গা। একটু অদূরে রয়েছে ল-কোর্ট, হাসপাতাল, সিনিয়র মিলিটারি অফিসারদের কোয়ার্টারের ধ্বংসাবশেষ ইত্যাদি। ইতিহাসের সবকিছু ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছি। হঠাৎ মনে হলো এত বড় কমপ্লেক্সে খাবার পানি পেত কোথা থেকে? নাকি, সমূদ্রের পানি লবণমুক্ত করে খেত! এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে যখন হাঁটছি তখন লক্ষ করলাম একটি পানি সংরক্ষণের আধার। এটি পাহাড়ে একটু ওপরের দিকে। আলেকজান্ডার ক্রিক নামের একজন ইঞ্জিনিয়ার কয়েদিদের দিয়ে এটি নির্মাণ করেছিলেন পানি সমস্যা সমাধানের জন্য।
এখান থেকে বেরিয়ে দেখি রাস্তার উল্টো দিকে একটি মিউজিয়াম রয়েছে। মিউজিয়ামে ঢুঁ মারতেই হয়। গেলাম দুজনে সেই মিউজিয়ামে। মিউজিয়ামটির নাম ‘পোর্ট আর্থার হিস্টোরিক্যাল সাইট মিউজিয়াম’। এত সুন্দর করে, এত রিসার্চ করে, এত মনোগ্রাহী করে পুরো ২০০ বছরের পুরোনো কারাগার স্থাপনের ইতিহাস প্রদর্শন করছে তা না দেখলে পোর্ট আর্থার ট্যুর অপূর্ণই থেকে যেত।
মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে দেখি একটি সাইনবোর্ডে লেখা ‘সাটল সার্ভিস পোর্ট আর্থার সিটি’ এবং নিচে ২টি ফোন নম্বর। আমার ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি নেটওয়ার্ক এসেছে। এমনিতে জাহাজের ভেতর থাকলে নেটওয়ার্ক একটুও ওয়ার্ক করে না। সাহস করে দিলাম ফোন ২টি নম্বরের একটিতে। ওপাশ থেকে মনে হলো যন্ত্র চালিত কন্ঠস্বর, ‘তুমি এখন ফোন করেছ সাটল সার্ভিস পোর্ট আর্থার সিটিতে ফিলিপ নামের একটি ভদ্রলোকের মোবাইলে।’ আমি পুরো কথাটুকু শুনে চুপচাপ অপেক্ষা করছি যে একটি টুট করে শব্দ হবে তখন আমি আমার কথাটুকু রেকর্ড করে ভয়েস মেইল পাঠিয়ে দেব। হঠাৎ ওপাশ থেকে হ্যালো শুনে বুঝলাম ফিলিপ কথা বলছে। তাঁকে বললাম যে, আমরা সিটি ট্যুরে যেতে চাই। শুনে তিনি বললেন, ‘মিউজিয়ামের আপার লেভেলের পাশে রাস্তায় আসো। আমি ২ মিনিটে আসছি।’ তাঁর সাথে চুক্তি করে আমরা সিটি ঘুরতে গেলাম। ছোট্ট একটি সিটি। ল্যাভেন্ডার ও চকোলেট ফ্যাকটরি ঘুরে ঘন্টাখানেকের মধ্যে আমরা জাহাজে ফিরে এলাম।
জাহাজ আবার চলতে শুরু করেছে। আমরা রাতের খাবার খেয়ে নিজেদের কেবিনে ফিরে এলাম।
২৪ ডিসেম্বর ২০২৪
আজ সকালে ঘুম ভাঙল ক্যাপ্টেন সাহেবের গলা শুনে। তিনি বলছেন, ‘আমরা তাসমানিয়ার হোবার্ট শহরে এসেছি। তোমরা বন্দরে নামার জন্য রেডি হও। আজ আমরা সরাসরি বন্দরের ঘাটে জাহাজ ভিড়াতে পেরেছি।’ তার মানে বুঝলাম আজ আর টেনডার লাগবে না বন্দরে পৌঁছাতে।
চমৎকার!
সকালে ৯টার দিকে জাহাজ থেকে নাস্তা করে বের হয়ে পড়লাম। জাহাজ থেকে নেমে দেখি বেশ বড়সড় একটি বন্দর। বন্দরের কিছুই তো চিনি না। চিন্তায় পড়ে গেলাম যে, কোন বনে যে যাই আর কোন পথে যে ধাই। একটু হাঁটতেই দেখি বন্দরের মধ্যে একটি তথ্যকেন্দ্র। হাফ ছেড়ে বাঁচা গেল। তথ্যকেন্দ্রের ভেতর নানান রকমের শোপিছের দোকান। আমার তো আবার দোকানে দোকানে ঢুকে ঘুরে ঘুরে দেখা অভ্যাস। যাকে ওই ইংরেজিতে বলে উইন্ডো শপিং। শিলার ভাষায় অভ্যাস নয়, এটা বদভ্যাস। কিছুক্ষণ পরে দেখি শিলা হোবার্ট ট্যুরের ব্যবস্থা করে ফেলেছে। পাক্কা পাঁচ ঘন্টা হোবার্ট শহর ও শহরের আশেপাশের দৃষ্টিনন্দন জায়গা ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াবে। এখন একটু মজা পাচ্ছি। যথাসময়ে একজন পিটার নামের ট্যুর গাইড তাঁর মাইক্রোবাস নিয়ে হাজির। মাইক্রোবাসে আমরা দুজন ছাড়া আরও ৮ জন রয়েছে। ‘রইল ঝোলা, চলল ভোলার’ মতো আমি ও শিলা চললাম হোবার্ট পরিভ্রমণে। পেছনে পরে রইল জাহাজখানি। পিটার সাহেব প্রথমে আমাদের হোবার্ট শহরের প্রাণকেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘোরাতে লাগলেন। হোবার্ট শহরের বাড়ি ঘরের স্থাপত্যকলার নকশা দেখছি। অনেকটা ইউরোপিয়ানদের ধাঁচে মনে হলো বাড়িগুলো। ১০০–২০০ বছরের পুরোনো বাড়িও দেখলাম। খুব যত্ন করে রেখেছে সরকার। বাইরের আভরণ সেই ২০০ বছরের পুরোনো হলেও ভেতরে কিছুটা রেনোভেট করে বিভিন্ন নামি ব্র্যান্ডের দোকানের শো-রূম হয়েছে। আমাদের মেলবোর্নেও এরকম আছে, দেখেছি। মাঝে মাঝে পিটার গাড়ি চালাতে চালাতে নানা রকমের তথ্য আমাদের দিচ্ছে। দু–একটা জোকস বলেও হাসানোর চেষ্টা করছে। যেমন; হঠাৎ বলে উঠল, ‘সামনে রেড সিগন্যাল, গাড়ি দাঁড় করাতে হবে। তোমাদের মেলবোর্নেও কি এমন হয়?’ সামান্য কৌতুকপূর্ণ কথা। তারপরও সবাই হেসে উঠছে।
গাড়ি চলতে চলতে লক্ষ করলাম আমরা একটি পাহাড়ের ওপরের দিকে উঠছি। মিনিট ৩০–এর মধ্যে ধীরে ধীরে পিটারের বক্তব্য শুনতে শুনতে কখন যেন পাহাড়ের মগডালে পৌঁছে গেলাম। শিলা বলল, ‘পাহাড়ের আবার মগডাল হয় নাকি! পাহাড়ে হয় চুড়া।’
আমি বললাম,
“জো হুকুম মহারানি
পেটে নেই দানাপানি
বলতো তবে চুপ যাই
বকবকে অসুবিধা নাই।”
শিলা একটু গরম চোখে তাকাল আমার দিকে। আমি এখন চুপ। পাহাড়ের মগডাল থুড়ি চুঁড়ায় উঠে শুনলাম এই পাহাড়ের নাম মাউন্ট ওয়েলিংটন, এটি সমূদ্রপৃষ্ট থেকে ৫০০০ ফুট ওপরে। অস্ট্রেলিয়ায় এসে অবধি এই ওয়েলিংটন নামটা খুব শুনি। রাস্তার নাম, জায়গার নাম ওয়েলিংটন দেখেছি। এখন দেখছি আস্ত পাহাড়েরও নাম এই ওয়েলিংটন ভদ্রলোকের নামে। ভদ্রলোকের সাথে একবার দেখা করতে পারলে মন্দ হয় না। তাহলে এই নামকরণের ইতিহাসটা অন্তত জানা যেত!
মাইক্রোবাস থেকে নামার পালা এবার। পাহাড়ের চুড়া আবৃত হয়ে রয়েছে মেঘের মধ্যে। চারপাশ মনে হচ্ছে কুয়াশাচ্ছন্ন। মনে মনে সূর্য মামাকে দোষারোপ করছি। কী রে মামা, তোমার দাপটে গরমে প্রাণ আই ঢাই হয়ে যায় আর সেই তুমি কি না মেঘের ভয়ে লুকিয়ে তামাশা দেখছ! কিছুক্ষণ পর অবশ্য অল্প কিছু সময়ের জন্য তিনি বের হয়েছিলেন। তাতেই কয়েকটি ছবি তুলতে পেরেছি। মাইক্রোবাস থেকে নামতেই দেখি বাইরে কনকনে ঠান্ডা। অষ্ট্রেলিয়ায় ডিসেম্বর মাস ভয়াবহ গরমের মাস। তাপমাত্রা ৪০–৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে যায়। আর এখানে কি না হাড়কাপুনি ঠান্ডা! সকালে শিলা জাহাজ থেকে নামার সময় জ্যাকেট নিতে বলেছিল। কিন্তু আমি মাতব্বরি করে নিলাম না। মহাজ্ঞানীরা বলেছিলেন, ‘জীবনে বউয়ের কথা শোনা উচিত।’ কিন্তু আমার জ্ঞান অল্প হওয়ায় আমি শুনিনি। শুধুমাত্র এই একটি কারণে আমার মনে হয় মহাজ্ঞানী হওয়া আর হলো না। তবুও আমি দমবার পাত্র নই। ফিনফিনে হালকা টি-শার্ট পরেই মাউন্ট ওয়েলিংটনের মাথায় ঘুরে ঘুরে ছবি তুলতে লাগলাম। পাহাড়ের চুড়ায় প্রচুর পাথর দেখছি সাজানো রয়েছে। সাজানো পাথরগুলোকে দেখে আমার স্টোনহেঞ্জের কথা মনে হচ্ছে। আরেকটু ঘুরতেই দেখি বিশাল উঁচু একটি কংক্রিটের সাইলো বা টাওয়ার। এত উঁচুতে এত উঁচু টাওয়ারের কী দরকার পড়ল? ব্যাপারটা মনে হচ্ছে খুবই কৌতূহলোদ্দীপক! হুম! দেখতে হচ্ছে বিষয়টা। মেঘের কারণে এমনিতেই কিছুই দেখা যায় না এর ওপরে আবার ঠান্ডা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আমি মনে মনে কাঁপতে কাঁপতে বললাম, ‘আমি কী ডরাই সখি ভিখারী রাঘবে!’ টাওয়ারের কাছে গিয়ে দেখালাম যে এটি টেলিভিশনের টাওয়ার।
‘অ এই ব্যাপার! আগে বললেই হতো! সে যাগগে বলবে আবার কে! সবাই তো আমার মতোই ট্যুরিষ্ট।’ আবার মনে মনে বললাম।
আমার কাঁপুনি দেখে অনেকে সান্তনার বাণী দিচ্ছে। শিলা এসব দেখে বলল, ‘তুমি তো দেখি ছুপা রুস্তম। তোমার আনাচে কানাচে কত শুভাকাঙ্খী!’
ওদিকে শুনি পিটার তাড়া দিচ্ছে গাড়িতে চড়বার জন্য। এবারের গন্তব্য সমতলে। মাউন্ট ওয়েলিংটন শৃঙ্গ থেকে অধঃপতনে নেমে যাচ্ছি। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর আমরা একটি সেতু পার হলাম। পিটার কে ‘এই সেতুর নাম কী’ জিজ্ঞেস করতে ভয় পাচ্ছি? পাছে যদি আবার বলে বসে যে ‘এই সেতুর নাম ওয়েলিংটন ব্রিজ।’ যাক বাবা! সেসব কিছুই হলো না। আল্লাহর অশেষ রহমতে পিটার জানাল, এই সেতুর নাম ‘টাসমান ব্রিজ’। ১৬৪২ সালে টাসমান নামের এক ভদ্রলোক এখানে এসে বসত গড়েছিলেন। তাই তাঁর নামানুসারে এর নাম টাসমান ব্রিজ।
টাসমান ব্রিজ হোবার্ট শহরের পূর্ব দিককে পশ্চিম দিকের সাথে সংযোগ করেছে। সেটি পার হয়ে আমরা একটি ছোট ছিমছাম শহর রিচমন্ডে পৌঁছালাম। খুবই ছোট শহর। একটি মাত্র ফার্মেসি, একটি বাজার, একটি পুলিশ স্টেশন, একটি কোর্ট হাউস, একটি রিচমন্ড ব্রিজ ও একটি গির্জা এই নিয়ে শহরটি। তবে রিচমন্ড সেতুটি নির্মিত হয়েছে ১৮২৩ সালে। সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের দিয়ে তৎকালীন সরকার এই সেতুটি নির্মাণ করিয়েছিল। কী অমানবিক! সামান্য একটু খাবার চুরির অপরাধে নিজের আপনজন থেকে কত দূরে দেশান্তরিত হয়ে কয়েদি হিসেবে এই তাসমানিয়ার বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছিল কত অসহায় মানুষ। পুরোনো সব বড় বড় স্থাপনা দেখলাম স্যান্ড স্টোন দিয়ে নির্মিত। তার মানে একেকটি বিশাল বিশাল স্থাপনা বানাতে কত শত কয়েদি কত বছর ধরে পরিশ্রম করেছে।
রিচমন্ড শহরেরই একটি দোকানে ঢুকে দুপুরের পেট পুজো করে ফেললাম। এরপর পিটারের গাড়িতে চেপে বসলাম। এতসব করতে করতে কখন সময় শেষ হয়ে গেল বুঝতে পারিনি। পিটার আমাদের আবার বন্দরে পৌঁছিয়ে দিল। বিদায় নিয়ে আবার জাহাজে নিজের কেবিনে। আজ আবার ক্রিসমাস ইভিনিং। জাহাজের ভেতরে বেশ উৎসবের আমেজ। ক্রিসমাস ট্রি দিয়ে সাজানো হয়েছে রিসেপশন ও লাউঞ্জ এরিয়া। বিভিন্ন কোম্পানি নানা রকম রেড কার্পেট অফার দিচ্ছে। আমরা ডিনার সেরে সেই সব ঘুরে ঘুরে দেখছি আর উপভোগ করছি।
লক্ষ করলাম জাহাজ চলা শুরু করেছে। ‘নোঙর তোলো তোলো সময় যে হলো হলো,’ গানটি বাজছে মনের মধ্যে। আর দুই দিন সমূদ্রে যাত্রা চলবে। এরপর সুইট হোম। আমাদের সুইট মেলবোর্ন।
২৫ ডিসেম্বর ২০২৪
২৫ ডিসেম্বরের সকাল থেকেই ক্রিসমাসের আমেজে আমাদের জাহাজ ও সমূদ্র যেন নতুন রঙে সেজেছে। নীল আকাশের নিচে ঘন নীল-গাঢ় নীল সমূদ্রের জলরাশি। উৎসবের ঢঙে সবকিছু আজ পরিপূর্ণ। জাহাজের সব ক্রুরা মাথায় সান্টাক্লজের ক্যাপ পরে কাজ করছে। জাহাজের প্রতিটি কোণায় কোণায় আজ অনুষ্ঠান, হাসি-আনন্দ, নানান কর্মকাণ্ড। আজ বুফেতেও খ্রিষ্টানদের ক্রিসমাস স্পেশাল টারকি খেতে দিয়েছে। নানা ধরনের কেক-পেষ্ট্রি তো আছেই। একেবারে সাজ সাজ রব।
৭ নম্বর ডেকে দ্য মারকি বলে একটি বলরুম আছে। সেখানে বিগ ক্রিসমাস গেমস শো চলছে। আমরা দেখতে গেলাম সেসব। গেমস শো দেখে গেলাম ব্লু রুম অডিটোরিয়ামে লাইভ মিউজিক শুনতে। সারাদিন বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে কখন যে দিনটি শেষ হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না।
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
আজ আমাদের জাহাজের শেষ দিন। আগামীকাল আমরা মেলবোর্ন পোর্টে নেমে যাব। একদিক দিয়ে মনটা খারাপ লাগছে আবার অন্যদিকে বাড়ির জন্য মন ছটফট করছে। এই কয়েক দিনে জাহাজের সব স্টাফ, ক্রু, রুম স্টুয়ার্ট ও অন্য যাত্রীদের সাথে যেন এক ধরনের আত্মীয়তা হয়ে গিয়েছিল। কাল সকালে যে যার মতো সবাই পৃথিবীর বিভিন্ন কোণে কোণে হারিয়ে যাব। আর কোনো দিন কারও সাথে দেখা হবে কি না জানি না। তবু সবার স্মৃতি ক্যামেরার ছবিতে ও মনের মণিকোঠায় জমা রবে। আজ আবার রবিঠাকুরকে মনে পড়ছে,
“সম্মুখ ঊর্মিরে ডাকে পশ্চাতের ঢেউ
দিব না দিব না যেতে। নাহি শুনে কেউ… …”
আমি আর শিলা সাততলার ডেকের ব্যালকনিতে বসে আছি। এই ব্যালকনিটা জাহাজের পুরো পরীধি ঘুরেছে। এই ব্যালকনি ধরে তিনপাক হাঁটলে ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার হাঁটা হয়। আমরা নিয়ম করে রোজ এখানে হাঁটতাম। কিন্তু আজ শীলা ও আমি দুজন দুজনের পীঠে হেলান দিয়ে এখানে এই নির্জনে বসে আছি।
শীলা গান ধরেছে,
‘সাগরের তীর থেকে
মিষ্টি কিছু হাওয়া এনে
তোমার কপালে ছোঁয়াবো গো
ভাবি মনে মনে।
আকাশের নীল থেকে
তারার ক্লান্তি এনে
তোমার নয়নে ছড়াবো গো
ভাবি মনে মনে…’
এখন থেকে উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থার (জিসিসি) ছয় দেশের বাসিন্দারা ট্যুরিস্ট ও ট্রানজিট ভিসা দিয়েও ওমরাহ পালন করতে পারবেন। সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয়ের বরাতে এ খবর জানিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম গালফ নিউজ।
কুয়েতে ১০ বছরের কম শিশুকে পার্ক করা গাড়িতে একা রেখে গেলে গাড়িচালককে ৫০০ দিনার জরিমানা বা কারাদণ্ডের শাস্তি দেওয়া হবে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম আরব টাইমস কুয়েতকে এ তথ্য জানিয়েছেন কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ট্রাফিক সেক্টরের সমন্বয় ও ফলোআপ বিভাগের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ আল-সুভান।
কানাডার সঙ্গে বাণিজ্যিক টানাপোড়েন সাময়িকভাবে শিথিল করেছেন যুক্তরাষ্টের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২ দফা ফোনালাপের পর তিনি কানাডার পণ্যের ওপর আরোপিত ২৫ শতাংশ শুল্ক আগামী ৩০ দিনের জন্য স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন।