
শাহাবুদ্দিন শুভ

ফ্রান্সের প্যারিসে আসার পর থেকেই একটা চিন্তা আমাকে প্রায় তাড়া করত, বাংলা বই কি এখানে পাওয়া যাবে? প্রবাসে থাকলে বইয়ের অভাবটা খুব তীব্রভাবে টের পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে মনে হতো, যদি লন্ডনে থাকতাম! শুনেছি লন্ডনের সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে নাকি প্রচুর বাংলা বই রয়েছে। তাই ভেবেছিলাম ফ্রান্সে নিশ্চয়ই এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে হাজার হাজার বাংলা বই পাওয়া যায়।
কিন্তু আমার সেই ধারণা একেবারে ভুল প্রমাণ করল বুলাক (বিইউএলএসি—Bibliothèque universitaire des langues et civilisations)। প্যারিসের হৃদয়ে অবস্থিত এই লাইব্রেরি শুধু বইয়ের সংগ্রহশালা নয়; এটি বিশ্বের ভাষা, সাহিত্য ও সভ্যতার এক মহাঅভিভাবক। এখানে রয়েছে ৩৫০টি ভাষার বই, ৮০টিরও বেশি লিপিতে লেখা নথি, আর প্রায় ১৫ লাখেরও বেশি সংগ্রহ। এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে বাংলা ভাষার এক বিশাল ভাণ্ডার—যা ইউরোপে অন্যতম ।
বাংলা বিভাগের গ্রন্থাগারিক প্রদীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ
একদিন নির্ধারিত সময়ে বাংলা বিভাগের দায়িত্বে থাকা প্রদীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করতে বিইউএলএসিতে গেলাম। সময় ছিল বিকেল ৪টা, কিন্তু কৌতূহল আর উত্তেজনায় প্রায় ৪৫ মিনিট আগেই পৌঁছে যাই। গিয়ে দেখি দাদা আমার সঙ্গে আলোচনা করার জন্য প্রস্তুত—কাগজপত্র গুছিয়ে রেখেছেন, কিছু আনুষ্ঠানিক বিষয়ও আগেই সেরে ফেলেছেন। রিসিপশনের ভদ্রমহিলাও শুনে অবাক হলেন যে, একজন বাংলাদেশি সাংবাদিক এসেছে বাংলা সংগ্রহ দেখতে।
দাদার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বুঝলাম—ফ্রান্সে বাংলা বইয়ের প্রতি তাদের আগ্রহ নতুন নয়। বরং এর একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।

বাংলা ভাষার সঙ্গে ফরাসিদের পরিচয়
ফরাসিদের সামনে বাংলা ভাষা প্রথম পরিচিত হয় ১৯১৩ সালে, যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পান। তার গীতাঞ্জলি যখন ইংরেজি থেকে ফরাসিতে অনূদিত হয়, তখনই ফরাসি পাঠকেরা জানতে পারেন—‘বাংলা’ নামে একটি ভাষা আছে, যার সাহিত্য এত গভীর ও সমৃদ্ধ। পরে রবীন্দ্রনাথের প্যারিস সফরগুলো এবং তার বিশ্বব্যাপী আড্ডা–আলোচনা ফরাসি সাহিত্য সমাজে বাংলার প্রতি আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দেয়।
তবে ধারাবাহিক বাংলা শিক্ষা বা গবেষণা তখন স্থায়ী হয়নি। পরে ১৯৬০-এর দশক থেকে বুলাক নিয়মিতভাবে বাংলা বই সংগ্রহ করা শুরু করে। প্রথমে বই আসত ডোনেশনের মাধ্যমে। পরে ফরাসি সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়—ফলে কলকাতা ও ঢাকা থেকে নিয়মিতভাবে বই সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সংগ্রহ রূপ নেয় এক বিশাল আর্কাইভে।

বাংলা বইয়ের বিস্ময়কর সংগ্রহ
বুলাক আজ প্রায় ৮ হাজার ৫০০ বাংলা বই আছে। ফরাসি ও ইংরেজি অনুবাদ এবং কলকাতার বই মিলিয়ে এই সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এখানে রয়েছে—
বাংলা ছাপাখানার প্রারম্ভিক বাংলা মুদ্রণ, দুর্লভ পাণ্ডুলিপি, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রকাশিত অসংখ্য গবেষণাধর্মী বই, বাংলাদেশের ইতিহাস–রাজনীতি–ধর্ম–সংস্কৃতির বিস্তৃত দলিল, উপন্যাস–গল্প–কবিতার ক্লাসিক প্রকাশনা, মীর মশাররফ হোসেন থেকে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথমদিকের বই—সবই এখানে সংরক্ষিত।
এমনকি ১৯২২ সালে প্যারিসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের কণ্ঠে রেকর্ড করা দুর্লভ অডিও রেকর্ডিংও রয়েছে বুলাকের সংগ্রহে—যা যেকোনো গবেষকের জন্য এক অসাধারণ সম্পদ। এই সুবিশাল সংগ্রহ দেখে আমি বুঝলাম—বাংলাদেশের অনেক লাইব্রেরিতেও এমন সমৃদ্ধ বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়া কঠিন।
এশিয়া বিভাগ থেকে বেসমেন্ট পর্যন্ত বিস্ময়ের পর বিস্ময়
দাদা আমাকে প্রথমে নিয়ে গেলেন এশিয়া বিভাগের বইয়ের তাকগুলোতে। প্রথম নজরে মনে হয়েছিল, হয়তো খুব বেশি বই নেই। কিন্তু ধীরে ধীরে তাকগুলো একের পর এক দেখার পর বুঝলাম—এটি কেবল সূচনা। দাদা জানালেন, বেসমেন্টে নেমে গেলে আরও কয়েকটি স্তরের বিশাল সংগ্রহ আছে। সেই সব পুরোনো মলাট, প্রাচীন মুদ্রণ, বিরল নথি দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না।

জ্ঞান, গবেষণা ও সভ্যতার মিলনস্থল
বুলাক শুধুই বই পড়ার জায়গা নয় — এটি এক ধরনের বৌদ্ধিক নগরী। এখানে একসঙ্গে সংরক্ষিত রয়েছে প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, বিরল মুদ্রণ, মানচিত্র, গবেষণাপত্র, জার্নাল, নথিপত্র, ডিজিটাল আর্কাইভ — বই, কাগজপত্র এবং নথির ওই বিশাল ভাণ্ডার হাতে ছোঁয়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে। বলকান অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া, চীন–জাপান–কোরিয়া এবং এমনকি ওশেনিয়া ও আমেরিকার স্বদেশভূমিরই নথি-সংগ্রহ এখানে আছে। ১৮০টিরও বেশি দেশ, ৩৫০টি ভাষা এবং ৮০টিরও বেশি লিখন পদ্ধতির (লিপি) নথি-গ্রন্থ বুলাকের কনটেন্টে রয়েছে।
এখানে শুধু সাহিত্য বা ইতিহাস নয় — ভাষাতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, জাতি–সংস্কৃতি, ধর্ম, ভূগোল, এবং নৃতত্ত্বের মতো বিভিন্ন শাখার গবেষণামূলক বই, নথি ও আর্টিফ্যাক্ট পাওয়া যায়। ফলে, যেকোনো ভাষা বা সভ্যতা নিয়ে গভীরভাবে জ্ঞানার্জন বা গবেষণা করতে চাইলে বুলাকের সংগ্রহ, ডিজিটাল রিসোর্স ও আরকাইভগুলো এক অনন্য সুযোগ। এটি ইউরোপের মধ্যে এমন একটি ভিউ-উন্মুক্ত ভাষা ও সভ্যতা কেন্দ্র, যা অধিকাংশ বড়-বড় বিশ্ববিদ্যালয়কেও ছাড়িয়ে যায়।
অতীতে ছাপাখানায় প্রথম মুদ্রণের বাংলা ছাপ, বিরল পাণ্ডুলিপি, প্রাচীন ইতিহাস, সাংস্কৃতিক–সামাজিক গবেষণা, পৃথিবীর নানা কোণের ইতিহাস-সংস্কৃতি —সবই বুলাকে পাওয়া যায়। এই ভাণ্ডার শুধু পঠন বা পড়াশোনা নয়, বরং গবেষণা, পুরনো সংস্কৃতি বুঝে–বোঝার, ভাষা ও সভ্যতা নিয়ে আন্তর্জাতিক সংলাপের জন্য একটি স্থায়ী প্ল্যাটফর্ম।
ছাত্র–ছাত্রী এবং ভাষা শিক্ষার্থীদের জন্য বুলাক
বুলাকের সংগ্রহ কেবল গবেষক বা প্রফেশনালদের জন্য নয়। যারা ভাষা শেখার প্রবৃত্তি রাখে — বিশেষত ছাত্র, রাজনৈতিক অভিবাসী, বাঙালি বংশোদ্ভূত তরুণ–তরুণী, অথবা যারা মাতৃভাষা, ইতিহাস বা সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে সংযোগ রাখতে চায় — তারা বুলাককে এক মূল্যবান রিসোর্স হিসেবে পাবে।

বুলাকের সংগ্রহে কেবল বাংলা নয়, পৃথিবীর প্রায় ৩৫০টি ভাষার বই ও নথি রয়েছে। নতুন ভাষা শেখা, পুরনো ভাষার শেখায় ডুব দেওয়া বা নিজের সাংস্কৃতিক–ভাষাগত শিকড়ের সঙ্গে পরিচয় রক্ষা করার জন্য এটি একটি আদর্শ জায়গা। ছাপা বই, পাণ্ডুলিপি, ইতিহাস ও ভাষাগত গবেষণা — সবকিছু একত্রে মিলিয়ে বিইউএলএসিতে পাঠ্য-আলোচনা বা ভাষা অধ্যয়ন করা যায়। এ ছাড়া, বুলাকের ডিজিটাল রিসোর্স এবং অনলাইন কাতালগ সুবিধা অন্তর্ভুক্ত, যা দীর্ঘ-দূরেও আপনাকে একটি লাইব্রেরার মতো সমৃদ্ধ পাঠের সুযোগ দেয়।
ফলে, যদি আপনি যেকোনো ভাষা, তার ইতিহাস বা সংস্কৃতি সম্পর্কে শিখতে চান — বুলাক অন্তত একবার ভিজিট করার মতো একটি জ্ঞানভাণ্ডার।
সদস্য হওয়ার সুযোগ সবার জন্য
বুলাকের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো—এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। ছাত্রছাত্রী, গবেষক, শিক্ষক, কিংবা সাধারণ পাঠক—যে কেউ সহজ রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে সদস্য হতে পারেন। সদস্য হলে পাওয়া যায় পাঠকক্ষ ব্যবহারের সুযোগ, ডিজিটাল রিসোর্স অ্যাক্সেস, এবং যোগ্য হলে বই ধার নেওয়ার সুবিধা।
এখানে নিয়মিত আসে দুই ধরনের শিক্ষার্থী—ফরাসিরা যারা বাংলা শিখতে আগ্রহী, এবং বাংলাদেশি তরুণ–তরুণীরা যারা ফ্রান্সে বড় হলেও মাতৃভাষার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায়। এ ছাড়া, INALCO-র গবেষক ও অধ্যাপকেরা বুলাকের অন্যতম প্রধান ব্যবহারকারী।

বাংলার সঙ্গে ফরাসিদের সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন
ফ্রান্সে বাংলা ভাষা প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, বিশেষত ঢাকা শাখা। লালনসহ বাংলা সাহিত্যকে ফরাসিতে অনুবাদ করার উদ্যোগগুলো ফরাসিদের আরও কাছে এনেছে বাংলা ভাষাকে। গত দুই দশকে বাংলাদেশ থেকে যারা পেশাগত, গবেষণা বা শিক্ষার কারণে ফ্রান্সে এসেছেন—তারাও এই সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ধারাকে মজবুত করেছেন।
প্রবাসে থেকেও শেকড়ের সন্ধান
বুলাকে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছিল—প্যারিসের মাঝখানে যেন একটি ছোট বাংলাদেশ তৈরি হয়ে আছে, যেখানে বইয়ের পাতা উল্টালে ভেসে ওঠে আমাদের ভাষা, ইতিহাস, সাহিত্য ও সংস্কৃতির স্পন্দন। প্রবাসে থাকলেও এখানে এসে নিজের শেকড়কে নতুন করে চিনে নেয়া যায়। বুলাক আমাকে বুঝিয়েছে—ভাষা এবং জ্ঞানের কোনো সীমান্ত নেই। আর বাংলা ভাষার জন্য প্যারিসে এমন এক বিশাল ভাণ্ডার থাকা—আসলেই গর্বের।
*লেখক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইমেইল: [email protected]

ফ্রান্সের প্যারিসে আসার পর থেকেই একটা চিন্তা আমাকে প্রায় তাড়া করত, বাংলা বই কি এখানে পাওয়া যাবে? প্রবাসে থাকলে বইয়ের অভাবটা খুব তীব্রভাবে টের পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে মনে হতো, যদি লন্ডনে থাকতাম! শুনেছি লন্ডনের সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে নাকি প্রচুর বাংলা বই রয়েছে। তাই ভেবেছিলাম ফ্রান্সে নিশ্চয়ই এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে হাজার হাজার বাংলা বই পাওয়া যায়।
কিন্তু আমার সেই ধারণা একেবারে ভুল প্রমাণ করল বুলাক (বিইউএলএসি—Bibliothèque universitaire des langues et civilisations)। প্যারিসের হৃদয়ে অবস্থিত এই লাইব্রেরি শুধু বইয়ের সংগ্রহশালা নয়; এটি বিশ্বের ভাষা, সাহিত্য ও সভ্যতার এক মহাঅভিভাবক। এখানে রয়েছে ৩৫০টি ভাষার বই, ৮০টিরও বেশি লিপিতে লেখা নথি, আর প্রায় ১৫ লাখেরও বেশি সংগ্রহ। এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে বাংলা ভাষার এক বিশাল ভাণ্ডার—যা ইউরোপে অন্যতম ।
বাংলা বিভাগের গ্রন্থাগারিক প্রদীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ
একদিন নির্ধারিত সময়ে বাংলা বিভাগের দায়িত্বে থাকা প্রদীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করতে বিইউএলএসিতে গেলাম। সময় ছিল বিকেল ৪টা, কিন্তু কৌতূহল আর উত্তেজনায় প্রায় ৪৫ মিনিট আগেই পৌঁছে যাই। গিয়ে দেখি দাদা আমার সঙ্গে আলোচনা করার জন্য প্রস্তুত—কাগজপত্র গুছিয়ে রেখেছেন, কিছু আনুষ্ঠানিক বিষয়ও আগেই সেরে ফেলেছেন। রিসিপশনের ভদ্রমহিলাও শুনে অবাক হলেন যে, একজন বাংলাদেশি সাংবাদিক এসেছে বাংলা সংগ্রহ দেখতে।
দাদার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বুঝলাম—ফ্রান্সে বাংলা বইয়ের প্রতি তাদের আগ্রহ নতুন নয়। বরং এর একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।

বাংলা ভাষার সঙ্গে ফরাসিদের পরিচয়
ফরাসিদের সামনে বাংলা ভাষা প্রথম পরিচিত হয় ১৯১৩ সালে, যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পান। তার গীতাঞ্জলি যখন ইংরেজি থেকে ফরাসিতে অনূদিত হয়, তখনই ফরাসি পাঠকেরা জানতে পারেন—‘বাংলা’ নামে একটি ভাষা আছে, যার সাহিত্য এত গভীর ও সমৃদ্ধ। পরে রবীন্দ্রনাথের প্যারিস সফরগুলো এবং তার বিশ্বব্যাপী আড্ডা–আলোচনা ফরাসি সাহিত্য সমাজে বাংলার প্রতি আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দেয়।
তবে ধারাবাহিক বাংলা শিক্ষা বা গবেষণা তখন স্থায়ী হয়নি। পরে ১৯৬০-এর দশক থেকে বুলাক নিয়মিতভাবে বাংলা বই সংগ্রহ করা শুরু করে। প্রথমে বই আসত ডোনেশনের মাধ্যমে। পরে ফরাসি সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়—ফলে কলকাতা ও ঢাকা থেকে নিয়মিতভাবে বই সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সংগ্রহ রূপ নেয় এক বিশাল আর্কাইভে।

বাংলা বইয়ের বিস্ময়কর সংগ্রহ
বুলাক আজ প্রায় ৮ হাজার ৫০০ বাংলা বই আছে। ফরাসি ও ইংরেজি অনুবাদ এবং কলকাতার বই মিলিয়ে এই সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এখানে রয়েছে—
বাংলা ছাপাখানার প্রারম্ভিক বাংলা মুদ্রণ, দুর্লভ পাণ্ডুলিপি, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রকাশিত অসংখ্য গবেষণাধর্মী বই, বাংলাদেশের ইতিহাস–রাজনীতি–ধর্ম–সংস্কৃতির বিস্তৃত দলিল, উপন্যাস–গল্প–কবিতার ক্লাসিক প্রকাশনা, মীর মশাররফ হোসেন থেকে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথমদিকের বই—সবই এখানে সংরক্ষিত।
এমনকি ১৯২২ সালে প্যারিসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের কণ্ঠে রেকর্ড করা দুর্লভ অডিও রেকর্ডিংও রয়েছে বুলাকের সংগ্রহে—যা যেকোনো গবেষকের জন্য এক অসাধারণ সম্পদ। এই সুবিশাল সংগ্রহ দেখে আমি বুঝলাম—বাংলাদেশের অনেক লাইব্রেরিতেও এমন সমৃদ্ধ বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়া কঠিন।
এশিয়া বিভাগ থেকে বেসমেন্ট পর্যন্ত বিস্ময়ের পর বিস্ময়
দাদা আমাকে প্রথমে নিয়ে গেলেন এশিয়া বিভাগের বইয়ের তাকগুলোতে। প্রথম নজরে মনে হয়েছিল, হয়তো খুব বেশি বই নেই। কিন্তু ধীরে ধীরে তাকগুলো একের পর এক দেখার পর বুঝলাম—এটি কেবল সূচনা। দাদা জানালেন, বেসমেন্টে নেমে গেলে আরও কয়েকটি স্তরের বিশাল সংগ্রহ আছে। সেই সব পুরোনো মলাট, প্রাচীন মুদ্রণ, বিরল নথি দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না।

জ্ঞান, গবেষণা ও সভ্যতার মিলনস্থল
বুলাক শুধুই বই পড়ার জায়গা নয় — এটি এক ধরনের বৌদ্ধিক নগরী। এখানে একসঙ্গে সংরক্ষিত রয়েছে প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, বিরল মুদ্রণ, মানচিত্র, গবেষণাপত্র, জার্নাল, নথিপত্র, ডিজিটাল আর্কাইভ — বই, কাগজপত্র এবং নথির ওই বিশাল ভাণ্ডার হাতে ছোঁয়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে। বলকান অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া, চীন–জাপান–কোরিয়া এবং এমনকি ওশেনিয়া ও আমেরিকার স্বদেশভূমিরই নথি-সংগ্রহ এখানে আছে। ১৮০টিরও বেশি দেশ, ৩৫০টি ভাষা এবং ৮০টিরও বেশি লিখন পদ্ধতির (লিপি) নথি-গ্রন্থ বুলাকের কনটেন্টে রয়েছে।
এখানে শুধু সাহিত্য বা ইতিহাস নয় — ভাষাতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, জাতি–সংস্কৃতি, ধর্ম, ভূগোল, এবং নৃতত্ত্বের মতো বিভিন্ন শাখার গবেষণামূলক বই, নথি ও আর্টিফ্যাক্ট পাওয়া যায়। ফলে, যেকোনো ভাষা বা সভ্যতা নিয়ে গভীরভাবে জ্ঞানার্জন বা গবেষণা করতে চাইলে বুলাকের সংগ্রহ, ডিজিটাল রিসোর্স ও আরকাইভগুলো এক অনন্য সুযোগ। এটি ইউরোপের মধ্যে এমন একটি ভিউ-উন্মুক্ত ভাষা ও সভ্যতা কেন্দ্র, যা অধিকাংশ বড়-বড় বিশ্ববিদ্যালয়কেও ছাড়িয়ে যায়।
অতীতে ছাপাখানায় প্রথম মুদ্রণের বাংলা ছাপ, বিরল পাণ্ডুলিপি, প্রাচীন ইতিহাস, সাংস্কৃতিক–সামাজিক গবেষণা, পৃথিবীর নানা কোণের ইতিহাস-সংস্কৃতি —সবই বুলাকে পাওয়া যায়। এই ভাণ্ডার শুধু পঠন বা পড়াশোনা নয়, বরং গবেষণা, পুরনো সংস্কৃতি বুঝে–বোঝার, ভাষা ও সভ্যতা নিয়ে আন্তর্জাতিক সংলাপের জন্য একটি স্থায়ী প্ল্যাটফর্ম।
ছাত্র–ছাত্রী এবং ভাষা শিক্ষার্থীদের জন্য বুলাক
বুলাকের সংগ্রহ কেবল গবেষক বা প্রফেশনালদের জন্য নয়। যারা ভাষা শেখার প্রবৃত্তি রাখে — বিশেষত ছাত্র, রাজনৈতিক অভিবাসী, বাঙালি বংশোদ্ভূত তরুণ–তরুণী, অথবা যারা মাতৃভাষা, ইতিহাস বা সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে সংযোগ রাখতে চায় — তারা বুলাককে এক মূল্যবান রিসোর্স হিসেবে পাবে।

বুলাকের সংগ্রহে কেবল বাংলা নয়, পৃথিবীর প্রায় ৩৫০টি ভাষার বই ও নথি রয়েছে। নতুন ভাষা শেখা, পুরনো ভাষার শেখায় ডুব দেওয়া বা নিজের সাংস্কৃতিক–ভাষাগত শিকড়ের সঙ্গে পরিচয় রক্ষা করার জন্য এটি একটি আদর্শ জায়গা। ছাপা বই, পাণ্ডুলিপি, ইতিহাস ও ভাষাগত গবেষণা — সবকিছু একত্রে মিলিয়ে বিইউএলএসিতে পাঠ্য-আলোচনা বা ভাষা অধ্যয়ন করা যায়। এ ছাড়া, বুলাকের ডিজিটাল রিসোর্স এবং অনলাইন কাতালগ সুবিধা অন্তর্ভুক্ত, যা দীর্ঘ-দূরেও আপনাকে একটি লাইব্রেরার মতো সমৃদ্ধ পাঠের সুযোগ দেয়।
ফলে, যদি আপনি যেকোনো ভাষা, তার ইতিহাস বা সংস্কৃতি সম্পর্কে শিখতে চান — বুলাক অন্তত একবার ভিজিট করার মতো একটি জ্ঞানভাণ্ডার।
সদস্য হওয়ার সুযোগ সবার জন্য
বুলাকের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো—এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। ছাত্রছাত্রী, গবেষক, শিক্ষক, কিংবা সাধারণ পাঠক—যে কেউ সহজ রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে সদস্য হতে পারেন। সদস্য হলে পাওয়া যায় পাঠকক্ষ ব্যবহারের সুযোগ, ডিজিটাল রিসোর্স অ্যাক্সেস, এবং যোগ্য হলে বই ধার নেওয়ার সুবিধা।
এখানে নিয়মিত আসে দুই ধরনের শিক্ষার্থী—ফরাসিরা যারা বাংলা শিখতে আগ্রহী, এবং বাংলাদেশি তরুণ–তরুণীরা যারা ফ্রান্সে বড় হলেও মাতৃভাষার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায়। এ ছাড়া, INALCO-র গবেষক ও অধ্যাপকেরা বুলাকের অন্যতম প্রধান ব্যবহারকারী।

বাংলার সঙ্গে ফরাসিদের সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন
ফ্রান্সে বাংলা ভাষা প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, বিশেষত ঢাকা শাখা। লালনসহ বাংলা সাহিত্যকে ফরাসিতে অনুবাদ করার উদ্যোগগুলো ফরাসিদের আরও কাছে এনেছে বাংলা ভাষাকে। গত দুই দশকে বাংলাদেশ থেকে যারা পেশাগত, গবেষণা বা শিক্ষার কারণে ফ্রান্সে এসেছেন—তারাও এই সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ধারাকে মজবুত করেছেন।
প্রবাসে থেকেও শেকড়ের সন্ধান
বুলাকে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছিল—প্যারিসের মাঝখানে যেন একটি ছোট বাংলাদেশ তৈরি হয়ে আছে, যেখানে বইয়ের পাতা উল্টালে ভেসে ওঠে আমাদের ভাষা, ইতিহাস, সাহিত্য ও সংস্কৃতির স্পন্দন। প্রবাসে থাকলেও এখানে এসে নিজের শেকড়কে নতুন করে চিনে নেয়া যায়। বুলাক আমাকে বুঝিয়েছে—ভাষা এবং জ্ঞানের কোনো সীমান্ত নেই। আর বাংলা ভাষার জন্য প্যারিসে এমন এক বিশাল ভাণ্ডার থাকা—আসলেই গর্বের।
*লেখক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইমেইল: [email protected]
সাহিত্য কর্ম আর সমাজ সংস্কারক তাকে পরিণত বয়সে তার স্বামী দেখে যেতে পারেননি। কত আনন্দিতই না তিনি হতেন। আসলে নারী বা পুরুষ অনেকে অপরের পরিপূরক, প্রতিদ্বন্দ্বী নন, এটা যত তাড়াতাড়ি সবাই বোঝেন ততই ভালো।
বুলাকআজ প্রায় ৮ হাজার ৫০০ বাংলা বই আছে। ফরাসি ও ইংরেজি অনুবাদ এবং কলকাতার বই মিলিয়ে এই সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এখানে রয়েছে—বাংলা ছাপাখানার প্রারম্ভিক বাংলা মুদ্রণ, দুর্লভ পাণ্ডুলিপি, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রকাশিত অসংখ্য গবেষণাধর্মী বই।
লন্ডন তখন ছিল প্রাণচঞ্চল—নাট্যশালা, সংগীত, কবি, রাজনীতি, শিল্প—সব মিলিয়ে এক মাথা ঘোরানো পৃথিবী। সেখানে প্রথমে উইলিয়াম খুব সাধারণ কাজ করত—কেউ বলে ঘোড়ার দেখাশোনা, কেউ বলে মঞ্চ সাজানোর কাজ। কিন্তু তার মন লিখতে চাইত, আর চোখ ছিল ভবিষ্যতের দিকে।
বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও গবেষণায় বিনিয়োগ এখনো সন্তোষজনক নয়। তবে কৃষিক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়। অন্য ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন গবেষণা থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। প্রযুক্তি, চিকিৎসা, সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ, খনিজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থাপনায় এখনো বড় ঘাটতি আছে।