
রহমান মৃধা

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছিল রক্ত ও আশার সংমিশ্রণে। একটি পতাকা উড়েছিল, আর তার সঙ্গে জেগে উঠেছিল কোটি মানুষের মুক্তির স্বপ্ন—দারিদ্র্য, দমন ও অবমাননা থেকে মুক্তির স্বপ্ন।
কিন্তু ইতিহাসের নির্মম সত্য হলো, স্বাধীনতা অর্জন করা যায়, স্বাধীনভাবে বাঁচা যায় না সবসময়। ৫০ বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে, তবুও আজও প্রশ্নটা আগের মতোই তীক্ষ্ণ: বাংলাদেশ কি সত্যিই স্বাধীন? নাকি আমরা এখনো এক অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণের জালে আটকে আছি—যেখানে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি ধীরে ধীরে নিজের পথ হারিয়েছে?
স্বাধীনতার পরবর্তী বাস্তবতা, রাষ্ট্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব
স্বাধীনতার পরের বছরগুলোয় দেশটির প্রধান কাজ ছিল— পুনর্গঠন ও স্বপ্নকে প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু রাষ্ট্র যখন ধীরে ধীরে ক্ষমতার কেন্দ্রে বন্দী হয়ে পড়ল, তখন জনগণের কণ্ঠস্বর হারিয়ে গেল প্রশাসনিক কোলাহলে।
১৯৭২ থেকে ১৯৯০—এই সময়টি ছিল অপূর্ণ স্বাধীনতার যুগ। একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি, অন্যদিকে বিদেশি প্রভাব, আর মাঝখানে এক বিভ্রান্ত সমাজ—যে বুঝতে পারছিল না, মুক্তি কোথায়। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রের চেতনা যখন অফিসের ফাইল আর রাজনৈতিক স্লোগানে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল, তখন মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রতিশ্রুতি, মানুষের মর্যাদা হারিয়ে যেতে শুরু করল।
ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা: বন্ধুত্ব ও আধিপত্যের সীমারেখা
ভারত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময় দেখিয়েছে, সেই বন্ধুত্ব ক্রমে রূপ নিয়েছে কৌশলগত নির্ভরতায়। পানি, বিদ্যুৎ, বাণিজ্য, সীমান্ত, গণমাধ্যম— প্রত্যেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
এটি কোনো আক্রমণ নয়। বরং এক নীরব, পরিশীলিত প্রভাব। যা নির্ধারণ করে আমাদের রাষ্ট্রনীতি, নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনীতি, আর দুর্বল করে সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়।
‘বাংলাদেশের সীমান্তে তার আত্মা আটকে আছে— একদিকে নদীর জল বন্ধ, অন্যদিকে টেলিভিশনে অন্যের গান বাজে।’
এই দৃশ্য আজ বাস্তবের থেকেও গভীর— কারণ এটি শুধু রাজনৈতিক নয়, মানসিক উপনিবেশের প্রতিচ্ছবি।
নতুন প্রজন্মের চেতনা: প্রশ্নের মধ্যেই জাগরণ
২০২৪ সাল এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। তরুণ প্রজন্ম, যারা সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে বড় হয়েছে, তারা এখন রাজনীতির ভাষা নতুন করে লিখছে।
তারা বলে, ‘আমরা আর কারও প্রভাব চাই না, কিন্তু নেতৃত্বও চাই ভেতর থেকে।’ এই প্রজন্ম বুঝে গেছে যে, স্বাধীনতার মানে কেবল রাষ্ট্র নয়, বরং চিন্তার স্বাধীনতা।
তাদের মধ্যে এক ধরনের জাগ্রত আত্মসমালোচনা কাজ করছে, আমরা কাকে অনুকরণ করছি? আমরা কেন বারবার অন্যের মাপকাঠিতে নিজেদের পরিমাপ করি?
এই প্রশ্নগুলোই আজকের বাংলাদেশের সবচেয়ে সাহসী পদক্ষেপ।
আত্মসমালোচনার দর্শন: স্বাধীনতার দ্বিতীয় সংজ্ঞা
সত্যিকারের স্বাধীনতা আসে যখন একটি জাতি নিজের ভুলের মুখোমুখি হতে পারে। বাংলাদেশের আজকের সংগ্রাম তাই বাহ্যিক নয়, অভ্যন্তরীণ। আমাদের শত্রু এখন আর বিদেশে নয়; সে লুকিয়ে আছে আমাদের ভেতরে—আমাদের ভয়, নির্ভরতা, উদাসীনতা আর আত্মবিস্মৃতিতে।
‘বাংলাদেশ আজ এক নীরব উপনিবেশ—যার শাসক বিদেশে নয়, বরং নিজের ভেতরের ভয়।’
স্বাধীনতার এই দ্বিতীয় সংজ্ঞা শেখাচ্ছে—রাষ্ট্রের স্বাধীনতা তখনই অর্থবহ, যখন মানুষের আত্মা মুক্ত হয়।
ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপট: বিচ্ছিন্নতা না মুক্তি?
যখন নতুন চেতনার জাগরণ ঘটে, তখন সমাজে বিভাজনও জন্ম নেয়। কেউ চায় ভিন্ন পথ, কেউ চায় নতুন কাঠামো, কেউ চায় পুনর্বিবেচনা। বাংলাদেশ এখন সেই মোড়ে দাঁড়িয়ে। যেখানে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা বিচ্ছিন্ন হব, নাকি পুনর্জন্ম নেব?
যেদিন রাষ্ট্র নিজের নীতি নির্ধারণ করবে জনগণের মর্যাদার ভিত্তিতে, সেদিনই শুরু হবে বাংলাদেশের সত্যিকারের স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাওয়া। এটি হবে একটি নীরব বিপ্লব, যেখানে আত্মনির্ভরতা হবে অস্ত্র, আর ন্যায়বোধ হবে সংবিধানের নতুন ভাষা।
স্বাধীনতার অব্যাহত যাত্রা
বাংলাদেশ এখনো জন্ম নিচ্ছে। প্রতিদিন, প্রতিটি মানুষের সিদ্ধান্তে। ৭১ আমাদের দিয়েছে ভূখণ্ড, কিন্তু ২০২৪ আমাদের ফিরিয়ে দিচ্ছে আত্মার আয়না।
‘স্বাধীনতা কোনো সমাপ্তি নয়, এটি এক অবিরাম যাত্রা। আর বাংলাদেশ সেই যাত্রায় আজ নিজের নাম, ভাষা ও আত্মাকে পুনরুদ্ধার করতে চাইছে।’
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
*লেখক গবেষক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। ইমেইল: [email protected]

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছিল রক্ত ও আশার সংমিশ্রণে। একটি পতাকা উড়েছিল, আর তার সঙ্গে জেগে উঠেছিল কোটি মানুষের মুক্তির স্বপ্ন—দারিদ্র্য, দমন ও অবমাননা থেকে মুক্তির স্বপ্ন।
কিন্তু ইতিহাসের নির্মম সত্য হলো, স্বাধীনতা অর্জন করা যায়, স্বাধীনভাবে বাঁচা যায় না সবসময়। ৫০ বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে, তবুও আজও প্রশ্নটা আগের মতোই তীক্ষ্ণ: বাংলাদেশ কি সত্যিই স্বাধীন? নাকি আমরা এখনো এক অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণের জালে আটকে আছি—যেখানে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি ধীরে ধীরে নিজের পথ হারিয়েছে?
স্বাধীনতার পরবর্তী বাস্তবতা, রাষ্ট্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব
স্বাধীনতার পরের বছরগুলোয় দেশটির প্রধান কাজ ছিল— পুনর্গঠন ও স্বপ্নকে প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু রাষ্ট্র যখন ধীরে ধীরে ক্ষমতার কেন্দ্রে বন্দী হয়ে পড়ল, তখন জনগণের কণ্ঠস্বর হারিয়ে গেল প্রশাসনিক কোলাহলে।
১৯৭২ থেকে ১৯৯০—এই সময়টি ছিল অপূর্ণ স্বাধীনতার যুগ। একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি, অন্যদিকে বিদেশি প্রভাব, আর মাঝখানে এক বিভ্রান্ত সমাজ—যে বুঝতে পারছিল না, মুক্তি কোথায়। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রের চেতনা যখন অফিসের ফাইল আর রাজনৈতিক স্লোগানে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল, তখন মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রতিশ্রুতি, মানুষের মর্যাদা হারিয়ে যেতে শুরু করল।
ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা: বন্ধুত্ব ও আধিপত্যের সীমারেখা
ভারত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময় দেখিয়েছে, সেই বন্ধুত্ব ক্রমে রূপ নিয়েছে কৌশলগত নির্ভরতায়। পানি, বিদ্যুৎ, বাণিজ্য, সীমান্ত, গণমাধ্যম— প্রত্যেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
এটি কোনো আক্রমণ নয়। বরং এক নীরব, পরিশীলিত প্রভাব। যা নির্ধারণ করে আমাদের রাষ্ট্রনীতি, নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনীতি, আর দুর্বল করে সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়।
‘বাংলাদেশের সীমান্তে তার আত্মা আটকে আছে— একদিকে নদীর জল বন্ধ, অন্যদিকে টেলিভিশনে অন্যের গান বাজে।’
এই দৃশ্য আজ বাস্তবের থেকেও গভীর— কারণ এটি শুধু রাজনৈতিক নয়, মানসিক উপনিবেশের প্রতিচ্ছবি।
নতুন প্রজন্মের চেতনা: প্রশ্নের মধ্যেই জাগরণ
২০২৪ সাল এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। তরুণ প্রজন্ম, যারা সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে বড় হয়েছে, তারা এখন রাজনীতির ভাষা নতুন করে লিখছে।
তারা বলে, ‘আমরা আর কারও প্রভাব চাই না, কিন্তু নেতৃত্বও চাই ভেতর থেকে।’ এই প্রজন্ম বুঝে গেছে যে, স্বাধীনতার মানে কেবল রাষ্ট্র নয়, বরং চিন্তার স্বাধীনতা।
তাদের মধ্যে এক ধরনের জাগ্রত আত্মসমালোচনা কাজ করছে, আমরা কাকে অনুকরণ করছি? আমরা কেন বারবার অন্যের মাপকাঠিতে নিজেদের পরিমাপ করি?
এই প্রশ্নগুলোই আজকের বাংলাদেশের সবচেয়ে সাহসী পদক্ষেপ।
আত্মসমালোচনার দর্শন: স্বাধীনতার দ্বিতীয় সংজ্ঞা
সত্যিকারের স্বাধীনতা আসে যখন একটি জাতি নিজের ভুলের মুখোমুখি হতে পারে। বাংলাদেশের আজকের সংগ্রাম তাই বাহ্যিক নয়, অভ্যন্তরীণ। আমাদের শত্রু এখন আর বিদেশে নয়; সে লুকিয়ে আছে আমাদের ভেতরে—আমাদের ভয়, নির্ভরতা, উদাসীনতা আর আত্মবিস্মৃতিতে।
‘বাংলাদেশ আজ এক নীরব উপনিবেশ—যার শাসক বিদেশে নয়, বরং নিজের ভেতরের ভয়।’
স্বাধীনতার এই দ্বিতীয় সংজ্ঞা শেখাচ্ছে—রাষ্ট্রের স্বাধীনতা তখনই অর্থবহ, যখন মানুষের আত্মা মুক্ত হয়।
ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপট: বিচ্ছিন্নতা না মুক্তি?
যখন নতুন চেতনার জাগরণ ঘটে, তখন সমাজে বিভাজনও জন্ম নেয়। কেউ চায় ভিন্ন পথ, কেউ চায় নতুন কাঠামো, কেউ চায় পুনর্বিবেচনা। বাংলাদেশ এখন সেই মোড়ে দাঁড়িয়ে। যেখানে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা বিচ্ছিন্ন হব, নাকি পুনর্জন্ম নেব?
যেদিন রাষ্ট্র নিজের নীতি নির্ধারণ করবে জনগণের মর্যাদার ভিত্তিতে, সেদিনই শুরু হবে বাংলাদেশের সত্যিকারের স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাওয়া। এটি হবে একটি নীরব বিপ্লব, যেখানে আত্মনির্ভরতা হবে অস্ত্র, আর ন্যায়বোধ হবে সংবিধানের নতুন ভাষা।
স্বাধীনতার অব্যাহত যাত্রা
বাংলাদেশ এখনো জন্ম নিচ্ছে। প্রতিদিন, প্রতিটি মানুষের সিদ্ধান্তে। ৭১ আমাদের দিয়েছে ভূখণ্ড, কিন্তু ২০২৪ আমাদের ফিরিয়ে দিচ্ছে আত্মার আয়না।
‘স্বাধীনতা কোনো সমাপ্তি নয়, এটি এক অবিরাম যাত্রা। আর বাংলাদেশ সেই যাত্রায় আজ নিজের নাম, ভাষা ও আত্মাকে পুনরুদ্ধার করতে চাইছে।’
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
*লেখক গবেষক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। ইমেইল: [email protected]
স্বাধীনতার পরের বছরগুলোয় দেশটির প্রধান কাজ ছিল— পুনর্গঠন ও স্বপ্নকে প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু রাষ্ট্র যখন ধীরে ধীরে ক্ষমতার কেন্দ্রে বন্দী হয়ে পড়ল, তখন জনগণের কণ্ঠস্বর হারিয়ে গেল প্রশাসনিক কোলাহলে।
এক বিকেলে করিন বসেছিল এক কফি শপে। জানালার বাইরের তুষার গলে পানিতে পরিণত হচ্ছে, আর তার আঙুল কাপের গায়ে স্থির হয়ে আছে অনেকক্ষণ। অপর প্রান্তের মানুষটি নিজের সাফল্যের গল্প বলছে—করিন হালকা হেসে শুনছে, কিন্তু ভেতরে প্রশ্ন জাগে, ‘কেউ কি আজকাল ভালোবাসে, নাকি শুধু নিজেদের প্রমাণ করে?’
মূলত নেতৃত্ব মানে দায়িত্ব, দূরদর্শিতা ও জবাবদিহিতা। একজন নেতা সেই ব্যক্তি যিনি একটি দিকনির্দেশনা স্থির করেন এবং তার ফল বহন করেন। নারীরা প্রতিদিনই এটি করেন—বোর্ডরুম, শ্রেণিকক্ষ, হাসপাতাল, সংসদ কিংবা ঘরে। তবুও তাদের কর্তৃত্বকে প্রায়ই ‘উপহার’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, নেতৃত্ব হিসেবে নয়।
আমি একজন ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের সুযোগ হয়েছে আমার। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বলতেই হয়—বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বেশ হতাশাজনক।