
সহিদুল আলম স্বপন

যখন কোনো পুরুষ বোর্ডরুম, আদালত বা ঘরোয়া পরিবেশে সিদ্ধান্ত নেন, তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বলা হয় দৃঢ়, কর্তৃত্বপূর্ণ, দূরদর্শী। কিন্তু একই কাজ যখন একজন নারী করেন, তখন সেটিকে প্রায়ই বলা হয় উদারতা, উপহার, আত্মত্যাগের প্রকাশ। এই পার্থক্য ভাষায় সূক্ষ্ম হলেও প্রভাব গভীর। এটি ইঙ্গিত করে যে, নারীদের সিদ্ধান্ত কোনো নিয়ম নয়, বরং ব্যতিক্রম—যেন তাদের কর্তৃত্ব একটি দয়ালু দান, স্বাভাবিক নেতৃত্ব নয়। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি শুধু নারীর ক্ষমতাকেই খাটো করে না, নেতৃত্বের প্রকৃত ধারণাকেও সংকীর্ণ করে।
নারীদের সিদ্ধান্ত কোনো ‘উপহার’ নয় যা তারা অন্যদের ওপর বর্ষণ করেন। এগুলো নেতৃত্বের কাজ—যা অভিজ্ঞতা, কৌশল এবং প্রায়ই কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতার বিপরীতে স্থিতিস্থাপকতার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। এগুলোকে নেতৃত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া মানে একটি প্রোথিত পক্ষপাত ভাঙা এবং নেতৃত্বের প্রকৃত রূপ সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়া প্রসারিত করা।
ভাষার সাংস্কৃতিক ওজন
ভাষা কখনোই নিরপেক্ষ নয়। আমরা নারীদের কাজ বর্ণনা করতে যে শব্দ ব্যবহার করি, তা তাদের কর্তৃত্বকে আমরা কীভাবে দেখি তা নির্ধারণ করে। নারী নেতাদের ‘যত্নশীল’ বা ‘আত্মত্যাগী’ বলে প্রশংসা করা সাধারণ ঘটনা। যদিও এই গুণাবলী প্রশংসনীয় হতে পারে, এগুলো নারীর সিদ্ধান্তকে আবেগীয় পরিশ্রমের সঙ্গে যুক্ত করে, কর্তৃত্বের সঙ্গে নয়। বিপরীতে, পুরুষদের সিদ্ধান্তকে সাধারণত স্পষ্টতা, শক্তি ও দূরদর্শিতার সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়।
এ ধরনের ভাষার প্রভাব গভীর। একজন নারী সিইও যদি কোম্পানির কৌশল পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন, তখন বলা হয় তিনি কর্মীদের প্রয়োজন বুঝেছেন। অথচ আসলে তিনি কোম্পানিকে উদ্ভাবনের দিকে পরিচালিত করছেন। একজন মা যখন কর্মজীবনকে অগ্রাধিকার দেন, তখন বলা হয় তিনি ‘নিজেকে বেছে নিচ্ছেন’—যেন এটি আত্মকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত, অথচ একই পরিস্থিতিতে একজন পুরুষের ক্ষেত্রে সেটিকে দেখা হয় পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেওয়ার কৌশল হিসেবে।
এভাবে নারীর সিদ্ধান্ত সবসময় নৈতিকতার সূক্ষ্ম মানদণ্ডে বিচার করা হয়, আর পুরুষরা কেবল কর্তৃত্বের ওপর দাঁড়িয়েই বৈধতা পান। এই দ্বিমুখী মানদণ্ড নারীদের নেতৃত্বকে খাটো করে।
নেতৃত্ব লিঙ্গভিত্তিক নয়
মূলত নেতৃত্ব মানে দায়িত্ব, দূরদর্শিতা ও জবাবদিহিতা। একজন নেতা সেই ব্যক্তি যিনি একটি দিকনির্দেশনা স্থির করেন এবং তার ফল বহন করেন। নারীরা প্রতিদিনই এটি করেন—বোর্ডরুম, শ্রেণিকক্ষ, হাসপাতাল, সংসদ কিংবা ঘরে। তবুও তাদের কর্তৃত্বকে প্রায়ই ‘উপহার’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, নেতৃত্ব হিসেবে নয়।
কোভিড-১৯ মহামারির সময় নারী রাষ্ট্রপ্রধানদের বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়ার কথাই ধরা যাক। নিউজিল্যান্ডের জেসিন্ডা আরডার্ন, জার্মানির অ্যাঞ্জেলা মার্কেল, তাইওয়ানের সাই ইং-ওয়েন—তাদের সফলতাকে গণমাধ্যম প্রায়ই সহমর্মিতা বা লালনশীলতার ফল হিসেবে দেখিয়েছে। অথচ তাদের সাফল্য এসেছে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বৈজ্ঞানিক তথ্যের ওপর নির্ভরশীলতা এবং রাজনৈতিক দৃঢ়তার কারণে। তারা কোনো জাতিকে ‘যত্নের উপহার’ দেননি, তারা নেতৃত্ব দিয়েছেন।
নারীদের নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্যগুলোকে লিঙ্গভিত্তিক ‘নারীসুলভ গুণ’ হিসেবে দেখানো আসলে ক্ষতিকর। এটি বোঝায় যে, তাদের কর্তৃত্ব ব্যতিক্রমী, স্বাভাবিক নয়। অথচ নেতৃত্ব কোনোভাবেই লিঙ্গনির্ভর নয়।
আত্মত্যাগের মিথ
নারীর সিদ্ধান্তকে উপহার হিসেবে উপস্থাপনের আরেকটি উপায় হলো আত্মত্যাগের মিথ। ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের শেখানো হয় তাদের সিদ্ধান্ত যেন সবসময় সেবার সঙ্গে যুক্ত হয়—ভাইবোনকে সাহায্য, পরিবারের জন্য ত্যাগ করা, অন্যদের আগে রাখা।
যখন তারা কর্মজীবনে প্রবেশ করেন, এই প্রত্যাশা তাদের পিছু ছাড়ে না। একজন নারী যখন পদোন্নতির জন্য দৃঢ়ভাবে দরকষাকষি করেন, তখন যদি তিনি বলেন, ‘পরিবারের জন্য করছি’, সেটা বেশি গ্রহণযোগ্য হয়। কিন্তু যদি বলেন ‘আমি যোগ্য, আমি সফল হতে পারব’—তাহলে তাকে স্বার্থপর বা অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষী বলে লেবেল দেওয়া হয়। পুরুষেরা এই সমালোচনার মুখে পড়েন না। তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা স্বাভাবিক, এমনকি প্রত্যাশিত।
ফলে নারীদের সবসময় নিজেদের সিদ্ধান্তকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে বলা হয়, যাতে তাদের কর্তৃত্ব আড়াল হয়। এভাবে তাদের ক্ষমতাকে উপহার হিসেবে দেখানো হয়, নেতৃত্ব হিসেবে নয়।
কৌশল, দান নয়
নারীর সিদ্ধান্তকে নেতৃত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দিলে নেতৃত্বের ধারণাও সমৃদ্ধ হয়। নেতৃত্ব কেবল সাহস বা ব্যক্তিত্ব নয়—এটি হলো জটিল উপাদান বিবেচনা, ফলাফল অনুমান ও দায়িত্ব নেওয়া।
গবেষণায় দেখা গেছে, যেখানে নারীরা নেতৃত্বের ভূমিকায় বেশি আছেন, সেই কোম্পানিগুলো আর্থিকভাবে বেশি সফল ও উদ্ভাবনী। কারণ, তারা কোনো ‘সহমর্মিতার উপহার’ দিচ্ছেন না, বরং ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, ঝুঁকি-সচেতনতা ও কৌশলগত দূরদর্শিতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিচ্ছেন।
রাজনীতিতেও দেখা গেছে, নারী নেতারা তুলনামূলকভাবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক ন্যায়বিচার সম্পর্কিত নীতিকে বেশি অগ্রাধিকার দেন। এগুলো দান নয়, বরং অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনের কৌশলগত সিদ্ধান্ত।
ভুল লেবেল দেওয়ার খরচ
নারীর সিদ্ধান্তকে উপহার হিসেবে দেখানো বাস্তবে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এতে তাদের কর্তৃত্বকে সবসময় প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। তারা একইসঙ্গে দৃঢ় ও সহানুভূতিশীল, সিদ্ধান্তমূলক ও কোমল হতে বাধ্য হন—এটাই ‘ডাবল বাইন্ড’।
এভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নারীরাও নেতৃত্বকে আত্মত্যাগ বা দানের সঙ্গে জড়িত ভেবে সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বেড়ে ওঠেন। অথচ যদি সমাজ নারীর সিদ্ধান্তকে বৈধ নেতৃত্ব হিসেবে স্বীকার করে, তবে তারা নিজেদেরকে প্রকৃত নেতৃত্বের আসনে কল্পনা করতে পারবেন।
নতুনভাবে ভাবা দরকার
এই পক্ষপাত ভাঙতে হলে ভাষা থেকে শুরু করতে হবে। পরেরবার যখন কোনো নারী সিদ্ধান্ত নেবেন—দুরূহ কোনো দায়িত্ব নেওয়া, ব্যবসা শুরু করা বা কোনো প্রতিষ্ঠানের কৌশল বদলানো—তখন আমাদের উচিত সেটিকে ‘উপহার’ না বলে নেতৃত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া।
কর্মক্ষেত্রে নারী সিদ্ধান্তকে ‘কৌশলগত’, ‘উদ্ভাবনী’, ‘দৃঢ়’ বলে স্বীকৃতি দিতে হবে, যেমনটা পুরুষদের ক্ষেত্রে করা হয়। গণমাধ্যমে নারী নেতাদের বর্ণনা থেকে লিঙ্গভিত্তিক বিশেষণ বাদ দিতে হবে। পরিবার ও বিদ্যালয়ে শিশুদের শেখাতে হবে যে মেয়েদের সিদ্ধান্তের মূল্য আছে তাদের কর্তৃত্ব ও দূরদর্শিতার জন্য, শুধু আত্মত্যাগের জন্য নয়।
এই পুনঃসংজ্ঞা মানে সহমর্মিতা বা যত্নকে বাদ দেওয়া নয়। বরং এগুলোকে নেতৃত্বের সরঞ্জাম হিসেবে দেখা—নারীদের বাইরের কোনো ‘উপহার’ হিসেবে নয়।
একজন নারীর সিদ্ধান্ত তার সহকর্মী, সমাজ বা পরিবারের জন্য কোনো উপহার নয়। এটি নেতৃত্বের কাজ—এজেন্সি ও জবাবদিহিতার ভিত্তিতে গৃহীত পদক্ষেপ। অন্যভাবে দেখলে আমরা তার ক্ষমতাকে খাটো করি এবং নেতৃত্বকে কেবল পুরুষালি বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরে রাখি।
নারীর সিদ্ধান্তকে নেতৃত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া শুধু নারীর প্রতি ন্যায্যতা নয়—এটি নেতৃত্বের ধারণাকেও সমৃদ্ধ করে। আজকের সংকটময় বিশ্বে, যেখানে দূরদর্শিতা, সহযোগিতা ও সাহস প্রয়োজন, সেখানে আমরা নেতৃত্বকে ভুলভাবে চিহ্নিত করার সামর্থ্য রাখি না। নারীরা আমাদের দান দিচ্ছেন না। তারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং এখনই সময় আমরা সেটিকে সেই নামেই ডাকি।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
*লেখক সুইজারল্যান্ড-ভিত্তিক প্রাইভেট ব্যাংকিং ফাইন্যান্সিয়াল অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং কলামিস্ট ও কবি

যখন কোনো পুরুষ বোর্ডরুম, আদালত বা ঘরোয়া পরিবেশে সিদ্ধান্ত নেন, তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বলা হয় দৃঢ়, কর্তৃত্বপূর্ণ, দূরদর্শী। কিন্তু একই কাজ যখন একজন নারী করেন, তখন সেটিকে প্রায়ই বলা হয় উদারতা, উপহার, আত্মত্যাগের প্রকাশ। এই পার্থক্য ভাষায় সূক্ষ্ম হলেও প্রভাব গভীর। এটি ইঙ্গিত করে যে, নারীদের সিদ্ধান্ত কোনো নিয়ম নয়, বরং ব্যতিক্রম—যেন তাদের কর্তৃত্ব একটি দয়ালু দান, স্বাভাবিক নেতৃত্ব নয়। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি শুধু নারীর ক্ষমতাকেই খাটো করে না, নেতৃত্বের প্রকৃত ধারণাকেও সংকীর্ণ করে।
নারীদের সিদ্ধান্ত কোনো ‘উপহার’ নয় যা তারা অন্যদের ওপর বর্ষণ করেন। এগুলো নেতৃত্বের কাজ—যা অভিজ্ঞতা, কৌশল এবং প্রায়ই কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতার বিপরীতে স্থিতিস্থাপকতার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। এগুলোকে নেতৃত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া মানে একটি প্রোথিত পক্ষপাত ভাঙা এবং নেতৃত্বের প্রকৃত রূপ সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়া প্রসারিত করা।
ভাষার সাংস্কৃতিক ওজন
ভাষা কখনোই নিরপেক্ষ নয়। আমরা নারীদের কাজ বর্ণনা করতে যে শব্দ ব্যবহার করি, তা তাদের কর্তৃত্বকে আমরা কীভাবে দেখি তা নির্ধারণ করে। নারী নেতাদের ‘যত্নশীল’ বা ‘আত্মত্যাগী’ বলে প্রশংসা করা সাধারণ ঘটনা। যদিও এই গুণাবলী প্রশংসনীয় হতে পারে, এগুলো নারীর সিদ্ধান্তকে আবেগীয় পরিশ্রমের সঙ্গে যুক্ত করে, কর্তৃত্বের সঙ্গে নয়। বিপরীতে, পুরুষদের সিদ্ধান্তকে সাধারণত স্পষ্টতা, শক্তি ও দূরদর্শিতার সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়।
এ ধরনের ভাষার প্রভাব গভীর। একজন নারী সিইও যদি কোম্পানির কৌশল পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন, তখন বলা হয় তিনি কর্মীদের প্রয়োজন বুঝেছেন। অথচ আসলে তিনি কোম্পানিকে উদ্ভাবনের দিকে পরিচালিত করছেন। একজন মা যখন কর্মজীবনকে অগ্রাধিকার দেন, তখন বলা হয় তিনি ‘নিজেকে বেছে নিচ্ছেন’—যেন এটি আত্মকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত, অথচ একই পরিস্থিতিতে একজন পুরুষের ক্ষেত্রে সেটিকে দেখা হয় পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেওয়ার কৌশল হিসেবে।
এভাবে নারীর সিদ্ধান্ত সবসময় নৈতিকতার সূক্ষ্ম মানদণ্ডে বিচার করা হয়, আর পুরুষরা কেবল কর্তৃত্বের ওপর দাঁড়িয়েই বৈধতা পান। এই দ্বিমুখী মানদণ্ড নারীদের নেতৃত্বকে খাটো করে।
নেতৃত্ব লিঙ্গভিত্তিক নয়
মূলত নেতৃত্ব মানে দায়িত্ব, দূরদর্শিতা ও জবাবদিহিতা। একজন নেতা সেই ব্যক্তি যিনি একটি দিকনির্দেশনা স্থির করেন এবং তার ফল বহন করেন। নারীরা প্রতিদিনই এটি করেন—বোর্ডরুম, শ্রেণিকক্ষ, হাসপাতাল, সংসদ কিংবা ঘরে। তবুও তাদের কর্তৃত্বকে প্রায়ই ‘উপহার’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, নেতৃত্ব হিসেবে নয়।
কোভিড-১৯ মহামারির সময় নারী রাষ্ট্রপ্রধানদের বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়ার কথাই ধরা যাক। নিউজিল্যান্ডের জেসিন্ডা আরডার্ন, জার্মানির অ্যাঞ্জেলা মার্কেল, তাইওয়ানের সাই ইং-ওয়েন—তাদের সফলতাকে গণমাধ্যম প্রায়ই সহমর্মিতা বা লালনশীলতার ফল হিসেবে দেখিয়েছে। অথচ তাদের সাফল্য এসেছে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বৈজ্ঞানিক তথ্যের ওপর নির্ভরশীলতা এবং রাজনৈতিক দৃঢ়তার কারণে। তারা কোনো জাতিকে ‘যত্নের উপহার’ দেননি, তারা নেতৃত্ব দিয়েছেন।
নারীদের নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্যগুলোকে লিঙ্গভিত্তিক ‘নারীসুলভ গুণ’ হিসেবে দেখানো আসলে ক্ষতিকর। এটি বোঝায় যে, তাদের কর্তৃত্ব ব্যতিক্রমী, স্বাভাবিক নয়। অথচ নেতৃত্ব কোনোভাবেই লিঙ্গনির্ভর নয়।
আত্মত্যাগের মিথ
নারীর সিদ্ধান্তকে উপহার হিসেবে উপস্থাপনের আরেকটি উপায় হলো আত্মত্যাগের মিথ। ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের শেখানো হয় তাদের সিদ্ধান্ত যেন সবসময় সেবার সঙ্গে যুক্ত হয়—ভাইবোনকে সাহায্য, পরিবারের জন্য ত্যাগ করা, অন্যদের আগে রাখা।
যখন তারা কর্মজীবনে প্রবেশ করেন, এই প্রত্যাশা তাদের পিছু ছাড়ে না। একজন নারী যখন পদোন্নতির জন্য দৃঢ়ভাবে দরকষাকষি করেন, তখন যদি তিনি বলেন, ‘পরিবারের জন্য করছি’, সেটা বেশি গ্রহণযোগ্য হয়। কিন্তু যদি বলেন ‘আমি যোগ্য, আমি সফল হতে পারব’—তাহলে তাকে স্বার্থপর বা অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষী বলে লেবেল দেওয়া হয়। পুরুষেরা এই সমালোচনার মুখে পড়েন না। তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা স্বাভাবিক, এমনকি প্রত্যাশিত।
ফলে নারীদের সবসময় নিজেদের সিদ্ধান্তকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে বলা হয়, যাতে তাদের কর্তৃত্ব আড়াল হয়। এভাবে তাদের ক্ষমতাকে উপহার হিসেবে দেখানো হয়, নেতৃত্ব হিসেবে নয়।
কৌশল, দান নয়
নারীর সিদ্ধান্তকে নেতৃত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দিলে নেতৃত্বের ধারণাও সমৃদ্ধ হয়। নেতৃত্ব কেবল সাহস বা ব্যক্তিত্ব নয়—এটি হলো জটিল উপাদান বিবেচনা, ফলাফল অনুমান ও দায়িত্ব নেওয়া।
গবেষণায় দেখা গেছে, যেখানে নারীরা নেতৃত্বের ভূমিকায় বেশি আছেন, সেই কোম্পানিগুলো আর্থিকভাবে বেশি সফল ও উদ্ভাবনী। কারণ, তারা কোনো ‘সহমর্মিতার উপহার’ দিচ্ছেন না, বরং ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, ঝুঁকি-সচেতনতা ও কৌশলগত দূরদর্শিতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিচ্ছেন।
রাজনীতিতেও দেখা গেছে, নারী নেতারা তুলনামূলকভাবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক ন্যায়বিচার সম্পর্কিত নীতিকে বেশি অগ্রাধিকার দেন। এগুলো দান নয়, বরং অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনের কৌশলগত সিদ্ধান্ত।
ভুল লেবেল দেওয়ার খরচ
নারীর সিদ্ধান্তকে উপহার হিসেবে দেখানো বাস্তবে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এতে তাদের কর্তৃত্বকে সবসময় প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। তারা একইসঙ্গে দৃঢ় ও সহানুভূতিশীল, সিদ্ধান্তমূলক ও কোমল হতে বাধ্য হন—এটাই ‘ডাবল বাইন্ড’।
এভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নারীরাও নেতৃত্বকে আত্মত্যাগ বা দানের সঙ্গে জড়িত ভেবে সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বেড়ে ওঠেন। অথচ যদি সমাজ নারীর সিদ্ধান্তকে বৈধ নেতৃত্ব হিসেবে স্বীকার করে, তবে তারা নিজেদেরকে প্রকৃত নেতৃত্বের আসনে কল্পনা করতে পারবেন।
নতুনভাবে ভাবা দরকার
এই পক্ষপাত ভাঙতে হলে ভাষা থেকে শুরু করতে হবে। পরেরবার যখন কোনো নারী সিদ্ধান্ত নেবেন—দুরূহ কোনো দায়িত্ব নেওয়া, ব্যবসা শুরু করা বা কোনো প্রতিষ্ঠানের কৌশল বদলানো—তখন আমাদের উচিত সেটিকে ‘উপহার’ না বলে নেতৃত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া।
কর্মক্ষেত্রে নারী সিদ্ধান্তকে ‘কৌশলগত’, ‘উদ্ভাবনী’, ‘দৃঢ়’ বলে স্বীকৃতি দিতে হবে, যেমনটা পুরুষদের ক্ষেত্রে করা হয়। গণমাধ্যমে নারী নেতাদের বর্ণনা থেকে লিঙ্গভিত্তিক বিশেষণ বাদ দিতে হবে। পরিবার ও বিদ্যালয়ে শিশুদের শেখাতে হবে যে মেয়েদের সিদ্ধান্তের মূল্য আছে তাদের কর্তৃত্ব ও দূরদর্শিতার জন্য, শুধু আত্মত্যাগের জন্য নয়।
এই পুনঃসংজ্ঞা মানে সহমর্মিতা বা যত্নকে বাদ দেওয়া নয়। বরং এগুলোকে নেতৃত্বের সরঞ্জাম হিসেবে দেখা—নারীদের বাইরের কোনো ‘উপহার’ হিসেবে নয়।
একজন নারীর সিদ্ধান্ত তার সহকর্মী, সমাজ বা পরিবারের জন্য কোনো উপহার নয়। এটি নেতৃত্বের কাজ—এজেন্সি ও জবাবদিহিতার ভিত্তিতে গৃহীত পদক্ষেপ। অন্যভাবে দেখলে আমরা তার ক্ষমতাকে খাটো করি এবং নেতৃত্বকে কেবল পুরুষালি বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরে রাখি।
নারীর সিদ্ধান্তকে নেতৃত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া শুধু নারীর প্রতি ন্যায্যতা নয়—এটি নেতৃত্বের ধারণাকেও সমৃদ্ধ করে। আজকের সংকটময় বিশ্বে, যেখানে দূরদর্শিতা, সহযোগিতা ও সাহস প্রয়োজন, সেখানে আমরা নেতৃত্বকে ভুলভাবে চিহ্নিত করার সামর্থ্য রাখি না। নারীরা আমাদের দান দিচ্ছেন না। তারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং এখনই সময় আমরা সেটিকে সেই নামেই ডাকি।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
*লেখক সুইজারল্যান্ড-ভিত্তিক প্রাইভেট ব্যাংকিং ফাইন্যান্সিয়াল অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং কলামিস্ট ও কবি
এক বিকেলে করিন বসেছিল এক কফি শপে। জানালার বাইরের তুষার গলে পানিতে পরিণত হচ্ছে, আর তার আঙুল কাপের গায়ে স্থির হয়ে আছে অনেকক্ষণ। অপর প্রান্তের মানুষটি নিজের সাফল্যের গল্প বলছে—করিন হালকা হেসে শুনছে, কিন্তু ভেতরে প্রশ্ন জাগে, ‘কেউ কি আজকাল ভালোবাসে, নাকি শুধু নিজেদের প্রমাণ করে?’
মূলত নেতৃত্ব মানে দায়িত্ব, দূরদর্শিতা ও জবাবদিহিতা। একজন নেতা সেই ব্যক্তি যিনি একটি দিকনির্দেশনা স্থির করেন এবং তার ফল বহন করেন। নারীরা প্রতিদিনই এটি করেন—বোর্ডরুম, শ্রেণিকক্ষ, হাসপাতাল, সংসদ কিংবা ঘরে। তবুও তাদের কর্তৃত্বকে প্রায়ই ‘উপহার’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, নেতৃত্ব হিসেবে নয়।
আমি একজন ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের সুযোগ হয়েছে আমার। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বলতেই হয়—বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বেশ হতাশাজনক।
শেষ পর্যন্ত প্লাবন একদিন থেমে গিয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করল—‘যে ভবিষ্যতের জন্য আমি বেঁচে আছি, সেটি কখন আসবে? আমি তো সবসময় ভবিষ্যতের অপেক্ষায় থেকেছি, অথচ আজও সেটি “আগামীকাল”। তাহলে কি আমি আসলে কখনো বাঁচিনি?’