logo
মতামত

সম্মানই মধ্যবিত্তের সবচেয়ে বড় সম্পদ

সহিদুল আলম  স্বপন, জেনেভা, সুইজারল্যান্ড
সহিদুল আলম স্বপন, জেনেভা, সুইজারল্যান্ড২২ আগস্ট ২০২৫
Copied!
সম্মানই মধ্যবিত্তের সবচেয়ে বড় সম্পদ
প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় শ্রেণিবিন্যাস যেন এক অদৃশ্য চক্রের মতো। ঊর্ধ্বমুখী স্বপ্ন আর নিম্নমুখী বাস্তবতার মাঝে প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলা একটি শ্রেণি হচ্ছে মধ্যবিত্ত। তারা ধনী নয়, দরিদ্রও নয়। তাদের জীবনযাপন, চাওয়া-পাওয়া, সংকট, আনন্দ সব কিছুতেই মাঝামাঝি এক ভারসাম্যের প্রয়াস। কিন্তু এই শ্রেণির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, সবচেয়ে বড় শক্তি ও অহংকার—তা হলো ‘সম্মান’। এই সম্মানই তাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, যা তারা কোনো কিছুর বিনিময়ে ত্যাগ করতে চায় না, করতে পারে না।

মধ্যবিত্ত: এক নিঃশব্দ সংগ্রামী শ্রেণি

মধ্যবিত্তরা সমাজের সেই স্তর যারা চোখে স্বপ্ন দেখে কিন্তু বাস্তবতা টানে পা দুটো মাটিতে রাখে। একজন সরকারি স্কুলশিক্ষক, একজন ব্যাংকের মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তা, একজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী, একজন ছোট ব্যবসায়ী—তারা সবাই এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। জীবন চালাতে গিয়ে তারা প্রতিদিন হিসাব করে খরচ করে। ঈদের কেনাকাটায় কয়েক মাস আগে থেকে জমানো টাকা খরচ করে। সন্তানদের ভালো স্কুলে পড়াতে গিয়ে নিজের চাহিদাগুলোকে পেছনে ফেলে দেয়।

এই শ্রেণির অধিকাংশ মানুষ সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধে দৃঢ়। তারা হয়তো প্রতিদিন সমাজের অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো তারা সেই অনিয়মের অংশ হতে চায় না। এটাই তাদের সম্মানের জায়গা।

সম্মান—অদৃশ্য অথচ অমূল্য এক পুঁজি

মধ্যবিত্তদের অনেকেরই ব্যাংক ব্যালেন্স নেই, জমি-জমা নেই, বিদেশে পাঠানোর মতো সম্পদ নেই। কিন্তু যা আছে, তা হলো নিজের পরিচয়ের গৌরব, নিজের সততা, নিজের সোজাসাপ্টা জীবনযাপন নিয়ে গর্ব। কোনোদিন ঘুষ খায়নি, কারও টাকা মেরে খায়নি, কারও সামনে মাথা নিচু করেনি—এই গর্বই তাদের বেঁচে থাকার সাহস দেয়।

বাড়িভাড়া দিতে দেরি হলে তারা মালিকের সামনে অসহায় মুখে দাঁড়ায়, দোকানে বাকিতে চাল-ডাল কিনলে সম্মান ধরে রাখার জন্য মাস শেষে সেই টাকা শোধ করে দেয়—কারণ তাদের মনে হয়, কারও কাছে ছোট হয়ে গেলে নিজের সন্তানদের চোখেও ছোট হয়ে যেতে হবে। তারা জানে, টাকাপয়সা হয়তো একদিন আসবে বা আসবে না, কিন্তু একবার যদি সম্মানের পতন ঘটে, সেটা আর কোনোদিন ফিরে আসে না।

কেন সম্মান এত গুরুত্বপূর্ণ?

সমাজে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকাটা মধ্যবিত্তদের আত্মপরিচয়ের একটা বড় অংশ। একজন বাবা যখন তার ছেলেকে বোঝান, ‘আমার তোকে বড় অফিসার বানানোর সামর্থ্য হয়তো নেই, কিন্তু তুই যেন কারও সামনে মাথা নিচু না করিস’—এটা শুধুই পিতৃত্বের আহ্বান নয়, এটা একটি মূল্যবোধের চর্চা।

সম্মান মানে শুধু বাইরের লোকজনের চোখে নিজের অবস্থান নয়। সম্মান মানে নিজের চোখে নিজের মর্যাদা রক্ষা করা। এই শ্রেণি নিজেদের ব্যর্থতাকে সহজভাবে নেয় না, কারণ তারা জানে, তাদের সাফল্য অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা, আবার তাদের পতন অনেকের কাছে উপহাসের খোরাক।

সম্মানের বিনিময়ে আপস নয়: বাস্তব উদাহরণ

একজন স্কুলশিক্ষক, যিনি তিন দশক ধরে ছাত্র পড়িয়ে যাচ্ছেন, হয়তো জীবনে একটি ব্যক্তিগত গাড়িও কিনতে পারেননি, কিন্তু আজও তার শত শত ছাত্র তার পা ছুঁয়ে সালাম করে। এটা সম্মানের প্রতীক।

একজন অফিস কর্মচারী, যিনি অনেক প্রলোভন সত্ত্বেও কোনো দুর্নীতির সঙ্গে নিজেকে জড়াননি, হয়তো প্রমোশন পাননি, কিন্তু তার সন্তানের চোখে তিনি একজন নায়ক। এই অভ্যন্তরীণ সম্মান, এই আত্মিক স্বীকৃতি টাকায় কেনা যায় না।

আরেকটি উদাহরণ ধরা যাক—একজন গৃহিণী, যিনি সংসারের হাজারো অভাবের মাঝেও পরিবারের মান-সম্মান রক্ষা করে চলেছেন, আত্মীয়দের সামনে কখনো নিজের কষ্টের কথা বলেন না—তার এই আত্মসংযম, আত্মত্যাগও এক ধরনের সম্মান রক্ষা।

সম্মান হারানোর ভয়, এক মানসিক যন্ত্রণা

সম্মান হারানোর ভয় মধ্যবিত্তদের মানসিকভাবে সবসময় গ্রাস করে রাখে। চাকরি চলে যাওয়ার ভয়, সন্তান ব্যর্থ হলে আত্মীয়দের কথা শুনতে হবে—এইসব বিষয়গুলো তাদের ভেতরে স্থায়ী এক চাপ তৈরি করে। কিন্তু তবুও তারা আপস করে না। তারা জানে, একবার দুর্নীতির পথে পা দিলে আর ফেরার পথ থাকে না। একবার আত্মসম্মান বিসর্জন দিলে সমাজ তাকে আর সে জায়গায় ফিরিয়ে নেয় না।

এই সম্মান রক্ষার জন্যই অনেক মধ্যবিত্ত মানুষ সীমাহীন কষ্ট সহ্য করে, আত্মত্যাগ করে, নিজের চাওয়া-পাওয়া বিসর্জন দেয়। একটা ভালো জামার বদলে সন্তানের বই কেনে, নিজের চিকিৎসা বাদ দিয়ে মায়ের ওষুধ কেনে।

নতুন প্রজন্ম ও সম্মানের সংকট

বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই সম্মান আর টাকার ফারাকটা বোঝে না। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে যেভাবে ‘দেখানোর সংস্কৃতি’ চালু হয়েছে, সেখানে মনে হচ্ছে সম্মান মানে শুধু ব্র্যান্ডেড জামা, দামি গাড়ি আর বিদেশ ভ্রমণ। এই প্রবণতা মধ্যবিত্ত মানসিকতাকে আহত করছে।

তরুণদের শেখাতে হবে, সম্মান হলো দায়িত্বশীল আচরণ, সততা, আত্মমর্যাদা ও মানবিকতার সমষ্টি। কেবল বাহ্যিক চাকচিক্য দিয়ে কারও সম্মান তৈরি হয় না।

রাষ্ট্র ও সমাজের ভূমিকা

সম্মানবোধ শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটা সামাজিকভাবে লালন করার বিষয়। সমাজ যদি কেবল বিত্তশালীদের সম্মান দিতে থাকে, তবে মধ্যবিত্তদের এই মানসিক শক্তি ভেঙে যাবে। রাষ্ট্রের নীতিমালায়, শিক্ষাব্যবস্থায়, গণমাধ্যমে এই শ্রেণির সংগ্রাম ও মূল্যবোধকে তুলে ধরা জরুরি।

আমাদের নাটক-সিনেমা, সাহিত্য ও সংবাদমাধ্যমে মধ্যবিত্তের জীবন বাস্তবভাবে উপস্থাপন করা প্রয়োজন। তাদের সম্মান রক্ষার লড়াইটাকে সাহসিকতার দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরতে হবে।

সম্মান কোনো পণ্য নয়, যা টাকার বিনিময়ে কেনা যায়। এটা অর্জিত হয় দীর্ঘ সংগ্রাম, সততার চর্চা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে মধ্যবিত্তরা প্রতিদিন জীবনের নানা সংগ্রামে অবিচল থাকে, সেখানে এই শ্রেণির সম্মান রক্ষা করা শুধু তাদের একার দায়িত্ব নয়—এটা আমাদের সকলের সামাজিক দায়িত্ব।

সম্মান হারালে তারা ভেঙে পড়ে, পরিবার ভেঙে যায়, সমাজে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে—মধ্যবিত্তের সম্মান কেবল তাদের নয়, এটা জাতির সম্মানও। এই সম্মান রক্ষার জন্য আপস নয়, বরং আরও বেশি দায়িত্বশীলতা, সম্মানবোধ ও নৈতিকতার প্রয়োজন।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

*লেখক সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বেসরকারি ব্যাংকিং আর্থিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং কলামিস্ট ও কবি

আরও পড়ুন

আত্মীয়তা রক্তে নয়, আত্মায়—সম্পর্কের প্রকৃত মানে

আত্মীয়তা রক্তে নয়, আত্মায়—সম্পর্কের প্রকৃত মানে

আত্মার আত্মীয়তা জোর করে হয় না। এটি সময়, অভিজ্ঞতা ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। কখনো কোনো কথায়, কখনো এক মুহূর্তের সহানুভূতিতে—মন থেকে মন যুক্ত হয়।

১৬ ঘণ্টা আগে

প্রবাসীদের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা

প্রবাসীদের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা

জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র চার মাস বাকি আছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে সবকিছু সম্পন্ন করা নির্বাচন কমিশনের জন্য কঠিন একটা কাজ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। পাশাপাশি এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক ভুলভ্রান্তিও হতে পারে। কিন্তু তাই বলে, এটার অজুহাতে প্রবাসীদের ভোটাধিকারে বঞ্চিত করা কি সংগত হবে?

১৭ ঘণ্টা আগে

ভোট বিদেশে, দায় দেশে: প্রবাসীদের ভোট ও গণতন্ত্রের পরীক্ষা

ভোট বিদেশে, দায় দেশে: প্রবাসীদের ভোট ও গণতন্ত্রের পরীক্ষা

বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতা বলে, অনেক দেশে প্রবাসী নাগরিকেরা দূতাবাসে গিয়ে আগেভাগে ভোট দেন বা ডাক-ভোটের ব্যবস্থা ব্যবহার করেন। তাতে ভোটারদের আইনগত অধিকার রক্ষা পায়, কিন্তু অংশগ্রহণের হার সাধারণত স্থায়ী বসবাসকারী ভোটারদের তুলনায় কম থাকে।

৩ দিন আগে

আজীবন শেখা ও স্বপ্ন দেখার শক্তি: মানুষকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়

আজীবন শেখা ও স্বপ্ন দেখার শক্তি: মানুষকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়

শেখা মানে শুধু বই পড়া বা ক্লাসে পাঠ শোনা নয়; বরং জীবনকে বোঝা, অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং নিজেকে প্রতিনিয়ত নবায়ন করা। প্রকৃতি, সমাজ, মানুষ—সবাই আমাদের শিক্ষক।

৩ দিন আগে