logo
মতামত

বিমান বাংলাদেশ কেন আন্তর্জাতিক মানের হয়ে উঠতে পারছে না

সহিদুল আলম  স্বপন, জেনেভা, সুইজারল্যান্ড
সহিদুল আলম স্বপন, জেনেভা, সুইজারল্যান্ড৪ দিন আগে
Copied!
বিমান বাংলাদেশ কেন আন্তর্জাতিক মানের হয়ে উঠতে পারছে না
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাবাহী বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস দেশ ও জাতির এক গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়বাহী প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে যাত্রা শুরু করার পর থেকে এটি কেবল যাত্রী পরিবহনের মাধ্যমই নয়, বরং প্রবাসী বাংলাদেশিদের আবেগের এক বড় প্রতীক। কিন্তু দুঃখজনকভাবে প্রায় ৫ দশক পার হলেও বিমান আজও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নিজেকে দাঁড় করাতে পারেনি। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর রাষ্ট্রীয় কিংবা বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো বিশ্ববাজারে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হলেও বিমান বাংলাদেশকে নিয়ে প্রায়শই সমালোচনা হয়—সেবা, দক্ষতা, ব্যবস্থাপনা ও ব্যবসায়িক স্থিতিশীলতা সব দিক থেকেই। প্রশ্ন জাগে, কেন জাতীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইনসটি এখনো আন্তর্জাতিক মানের হতে পারছে না?

দুর্বল ব্যবস্থাপনা দুর্নীতি

বিমানের দুরবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ হলো দুর্বল ব্যবস্থাপনা। গত ৫ দশকে এয়ারলাইনসটির নেতৃত্বে ঘন ঘন পরিবর্তন হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার চেয়ে রাজনৈতিক প্রভাব কিংবা প্রশাসনিক সিনিয়রিটির ভিত্তিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনার বদলে স্বল্পমেয়াদি তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তই প্রাধান্য পেয়েছে।

এ ছাড়া, দুর্নীতি ও অদক্ষতার অভিযোগও দীর্ঘদিন ধরে বিমানের সঙ্গে জড়িত। বিমান কেনাবেচা, যন্ত্রাংশ সংগ্রহ, রক্ষণাবেক্ষণ বা টিকিট বিক্রি—প্রতিটি জায়গায় দুর্নীতির অভিযোগ শোনা যায়। এসব কারণে ব্যয় বৃদ্ধি পায়, অথচ আয়ের উৎসগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায় না। আন্তর্জাতিক মানের কোনো এয়ারলাইনস পরিচালনার জন্য যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রয়োজন, বিমান বাংলাদেশ তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ।

পুরোনো বহর রক্ষণাবেক্ষণ সংকট

যাত্রী সন্তুষ্টি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আধুনিক বহর অপরিহার্য। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ড্রিমলাইনারসহ নতুন কিছু উড়োজাহাজ যুক্ত হয়েছে, তারপরও বহরের গড় বয়স এখনো তুলনামূলক বেশি। অনেক সময় উড়োজাহাজ পড়ে থাকে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। ফলে সময়মতো ফ্লাইট ছাড়তে পারে না, যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ে এবং প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থা বছরে বছরে বহর আধুনিকায়ন করে। উদাহরণস্বরূপ, কাতার এয়ারওয়েজ, এমিরেটস বা সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও আরামের নিশ্চয়তা দিয়ে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে আছে। সেখানে বিমান বাংলাদেশ এখনো সময়োপযোগী রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত সক্ষমতা গড়ে তুলতে পারেনি।

গ্রাহকসেবা পেশাদারির ঘাটতি

একটি এয়ারলাইনসের মান নির্ধারণ হয় কেবল উড়োজাহাজের আধুনিকতায় নয়, বরং গ্রাহক সেবার মানদণ্ডেও। বিমানের ক্ষেত্রে যাত্রীদের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি শোনা যায় খারাপ কাস্টমার সার্ভিস নিয়ে। ফ্লাইট বিলম্ব, লাগেজ হারানো, অমার্জিত আচরণ, সিট বুকিং জটিলতা কিংবা খাবারের নিম্নমান—এসব কারণে যাত্রীরা বিমানের প্রতি আস্থা হারান।

পেশাদার কেবিন ক্রু ও কর্মী প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে বিমানের অনেক ঘাটতি রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানের কেবিন ক্রু প্রশিক্ষণকেন্দ্র থাকলেও তা যথেষ্ট আধুনিক ও হালনাগাদ নয়। যাত্রীদের সন্তুষ্টি নিশ্চিত করতে কেবল প্রযুক্তি নয়, মনোভাবগত পরিবর্তনও জরুরি। এ ক্ষেত্রে বিমান পিছিয়ে আছে বলেই বিদেশগামী অধিকাংশ প্রবাসী বা পর্যটক অন্য আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনসকেই বেছে নেন।

দুর্বল ব্যবসায়িক কৌশল

বিমান বাংলাদেশ এখনো ব্যবসায়িকভাবে শক্ত ভিত্তি তৈরি করতে পারেনি। অনেক রুটে অলাভজনকভাবে ফ্লাইট পরিচালনা করতে হয়েছে শুধু ‘জাতীয় স্বার্থ’ দেখিয়ে। অথচ লাভজনক রুটগুলো অনেক সময় হারাতে হয়েছে সঠিক কৌশল না নেওয়ার কারণে।

উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্যে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি থাকলেও বিমান সেখানকার বাজার পুরোপুরি দখল করতে পারেনি। এমিরেটস, কাতার, ইতিহাদ, সৌদিয়া প্রভৃতি এয়ারলাইনস এই বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে নিয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক ভাড়া, সময়নিষ্ঠা, আধুনিক বহর ও উন্নত সেবা দিয়ে তারা প্রবাসীদের আস্থা অর্জন করেছে। বিমান কৌশলগতভাবে পিছিয়ে থাকায় সম্ভাবনাময় বাজার হাতছাড়া হয়েছে।

রাজনৈতিক প্রভাব স্বায়ত্তশাসনের অভাব

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নামেই এটি অনেক সময় অতিরিক্ত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের শিকার হয়। বোর্ড পরিচালনা থেকে শুরু করে নিয়োগ, পদোন্নতি, এমনকি রুট নির্বাচনের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক প্রভাব প্রকট।

আন্তর্জাতিক মানে প্রতিযোগিতা করতে হলে এয়ারলাইনসকে একটি স্বাধীন ও পেশাদার প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা দরকার। কিন্তু বিমান কখনোই স্বায়ত্তশাসনভিত্তিক নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালিত হয়নি। এই অনিয়মই মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষমতা হ্রাস করেছে।

ব্র্যান্ড ইমেজ আস্থাহীনতা

ব্র্যান্ড ইমেজ যেকোনো এয়ারলাইনসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যাত্রী কেবল নিরাপদ ভ্রমণই চান না, বরং নির্ভরযোগ্যতা ও সম্মানজনক অভিজ্ঞতাও চান। এমিরেটস, কাতার এয়ারওয়েজ কিংবা সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের মতো ব্র্যান্ড শক্তিশালী হওয়ার কারণ তাদের ধারাবাহিকতা, পেশাদারত্ব ও যাত্রী আস্থা।

অন্যদিকে বিমান বাংলাদেশ বারবার ফ্লাইট বিলম্ব, হঠাৎ বাতিল, লাগেজ সমস্যার মতো ঘটনায় সংবাদ শিরোনামে এসেছে। ইতিবাচক প্রচারের বদলে নেতিবাচক খবরে বেশি আলোচিত হওয়ায় বিমানের ব্র্যান্ড ইমেজ দুর্বল হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে সম্প্রসারণের ওপরও।

প্রতিযোগিতার চাপ

বিশ্ব এভিয়েশন বাজার এখন অত্যন্ত প্রতিযোগিতাপূর্ণ। প্রতিবেশী দেশগুলোর এয়ারলাইনস যেমন—ইন্ডিগো, স্পাইসজেট বা এয়ার ইন্ডিয়া—তাদের বহর ও রুট সম্প্রসারণে বিপুল বিনিয়োগ করছে। দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে মধ্যপ্রাচ্যের এয়ারলাইনসগুলো আকাশসীমায় আধিপত্য বিস্তার করছে।

এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে বিমানের প্রয়োজন ছিল দৃঢ় পরিকল্পনা, কৌশল ও অবিচল সেবা মান। কিন্তু বিমান সেসব জায়গায় পিছিয়ে আছে বলেই প্রতিযোগিতায় কার্যত স্থান হারাচ্ছে।

কীভাবে বিমান আন্তর্জাতিক মান অর্জন করতে পারে

পেশাদার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ: রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের দিয়ে এয়ারলাইনস পরিচালনা করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসায়িক পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি।

বহর আধুনিকায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ উন্নয়ন: শুধু নতুন উড়োজাহাজ কেনাই নয়, বিদ্যমান বহরের কার্যকর রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। আধুনিক মেরামত সুবিধা ও টেকনিক্যাল জনবল বাড়াতে হবে।

গ্রাহকসেবায় বিপ্লব: কেবিন ক্রু ও গ্রাউন্ড স্টাফদের আন্তর্জাতিকমানের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সময়নিষ্ঠা, ভদ্রতা ও যাত্রীসেবায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব নিশ্চিত করা উচিত।

লাভজনক রুটে কৌশলগত বিনিয়োগ: মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজারে কার্যকর রুট কৌশল গ্রহণ করতে হবে। লোকসানি রুটে অব্যবস্থাপনার পরিবর্তে যৌথ উদ্যোগ বা কোড শেয়ারিং বিবেচনা করা যেতে পারে।

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি: দুর্নীতি দমন ও আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত না করলে আন্তর্জাতিক আস্থা ফিরবে না। টেন্ডার, ক্রয় ও নিয়োগ প্রক্রিয়া পুরোপুরি স্বচ্ছ করতে হবে।

ব্র্যান্ড ইমেজ পুনর্গঠন: বিমানকে আধুনিক, নির্ভরযোগ্য ও যাত্রীবান্ধব প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করার জন্য প্রচারণা ও ইতিবাচক অভিজ্ঞতা সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস কেবল একটি পরিবহন সংস্থা নয়, এটি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির সঙ্গে জড়িত। জাতীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইনস হিসেবে এর উন্নতি জাতির গর্বের বিষয়। কিন্তু দুর্বল ব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অদক্ষতা ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বিমান আজও আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে পারেনি।

তবে সম্ভাবনা এখনো হারিয়ে যায়নি। সঠিক কৌশল, আধুনিকায়ন ও দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে বিমানকে আন্তর্জাতিক মানের এয়ারলাইনসে রূপ দেওয়া সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা, পেশাদার ব্যবস্থাপনা ও যাত্রীকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। অন্যথায়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস হয়তো থেকে যাবে কেবল আবেগের প্রতীক, কিন্তু কখনোই বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হতে পারবে না।

*লেখক সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বেসরকারি ব্যাংকিং আর্থিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং কলামিস্ট ও কবি।

আরও পড়ুন

প্রবাসে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের এক অভিজ্ঞতা

প্রবাসে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের এক অভিজ্ঞতা

চলতি বছরের এপ্রিলে যুক্তরাজ্যের এঙ্গলিয়া রাসকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে আমি এক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গিয়েছিলাম, যা আজও মনে করলে শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। নির্ধারিত নির্বাচনী বাজেটের বাইরে অসতর্কতাবশত মাত্র ৫ পাউন্ড বেশি খরচ হওয়ায় আমার প্রার্থীতা প্রায় বাতিল হওয়ার পরিস্থিতি হয়েছিল।

৩ ঘণ্টা আগে

আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক ভূমিকম্প এবং দেশটির শরিয়া আইন

আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক ভূমিকম্প এবং দেশটির শরিয়া আইন

আফগানিস্থানে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে নিহতদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। এর জন্য অবশ্য সেখানকার অসম আইনকানুনই দায়ী। ফায়ার ফাইটার ও অন্য রেসকিউ পুরুষ সদস্যদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা ছিল, তারা কেউ যেন কোনো নারীর শরীর স্পর্শ না করে। এ কারণে অনেক আহত নারীকে উদ্ধার করা হয়নি।

১ দিন আগে

চলতে পথে

চলতে পথে

রকি পর্বতমালার এই কোণে প্রকৃতি আমাদের শেখায়—সুন্দরতা, শান্তি এবং সৃষ্টির নিখিলতা কোনো বইয়ে লেখা থাকে না। তাকে অনুভব করতে হয়, তাকে হৃদয়ে ধারণ করতে হয়। আর সেই অনুভূতিই আমাদের মানবিকতা এবং জীবনের গভীরতাকে এক নতুন মাত্রা দেয়।

১ দিন আগে

বিমান বাংলাদেশ কেন আন্তর্জাতিক মানের হয়ে উঠতে পারছে না

বিমান বাংলাদেশ কেন আন্তর্জাতিক মানের হয়ে উঠতে পারছে না

বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাবাহী বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস দেশ ও জাতির এক গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়বাহী প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে যাত্রা শুরু করার পর থেকে এটি কেবল যাত্রী পরিবহনের মাধ্যমই নয়, বরং প্রবাসী বাংলাদেশিদের আবেগের এক বড় প্রতীক।

৪ দিন আগে