রাশেদুর রহমান
দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি পায় বহুপ্রত্যাশিত কাঙ্ক্ষিত বিজয়। পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান (এ এ কে) নিয়াজি মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন।
ঐতিহাসিক এ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন বাংলাদেশ বাহিনীর উপপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। মুক্তিবাহিনী ও বাংলাদেশ বাহিনীর পক্ষে আরও ছিলেন ‘এস’ ফোর্সের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কে এম সফিউল্লাহ, ২ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর এ টি এম হায়দার ও কাদেরিয়া বাহিনীর কাদের সিদ্দিকীসহ অনেকে।
নিয়াজির আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে সৃষ্টি হয় স্বাধীন বাংলাদেশ নামে নতুন এক রাষ্ট্রের।
এর আগে নিয়াজির নির্দেশে ভোর ৫টা থেকে পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধবিরতি শুরু করে। সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ ভারতীয় বাহিনীর ডিভিশনাল অধিনায়ক মেজর জেনারেল গন্দর্ভ সিং নাগরাকে নিয়ে একটি সামরিক জিপ ঢাকার গাবতলী (মিরপুর) সেতুর কাছে এসে থামে। নিয়াজির জন্য নাগরার বার্তা নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় হেড কোয়ার্টারের দিকে সাদা পতাকা উড়িয়ে একটি জিপে রওনা দেন ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর দুজন সেনা কর্মকর্তা। বার্তাটিতে ইংরেজিতে লেখা ছিল, ‘প্রিয় আবদুল্লাহ, আমরা এখন এখানে আছি। আমরা আপনাকে ঘিরে রেখেছি। আপনার খেলা শেষ। আত্মসমর্পণ অথবা ধ্বংস—যেকোনো একটি বেছে নিন। আমরা আপনাকে আশ্বস্ত করছি, আপনি আত্মসমর্পণ করলে আমরা আপনার সঙ্গে জেনেভা চুক্তি অনুসারে ব্যবহার করব। আমি আপনাকে ব্যক্তিগতভাবেও আশ্বস্ত করছি, আপনার জীবনের ভয় নেই। ইতি মেজর জেনারেল জি সি নাগরা।'’
এর আগেই নিয়াজি যুদ্ধবিরতি ও অস্ত্র সংবরণের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতকে জানানোর জন্য ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল অফিসে নিয়োজিত সামরিক অ্যাটাশেকে অনুরোধ করেন। দিল্লির যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের মাধ্যমে ভারত সরকারকে তা জানানো হয়। বেলা ১১টার দিকে যৌথ বাহিনীর দুই প্রতিনিধি নিয়াজির হেডকোয়ার্টার থেকে ফিরে আসেন।
পরে নিয়াজীর প্রতিনিধি হিসেবে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩৬ ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল জামশেদ গাবতলী সেতুর পাশে নাগরার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
দুপুর ১২টার দিকে জামসেদের সঙ্গে নাগরা সেনানিবাসে নিয়াজির অফিসে পৌঁছান। এরপর শুরু হয় আত্মসমর্পণের শর্তাবলি নিয়ে কথাবার্তা। বেলা ১টা নাগাদ কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছান ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব। ততক্ষণে যৌথ বাহিনী মিরপুর সেতু পেরিয়ে ঢাকায় ঢুকতে শুরু করেছে।
এদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর বিদেশি বেতারে প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীর হাজার হাজার মানুষ মুক্তির উল্লাসে রাস্তায় নেমে আসে। ধানমন্ডিসহ পুরান ঢাকায় বেলা ১১টার দিকেই উল্লসিত জনতা রাস্তায় মিছিল বের করে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর সর্বত্র আত্মপ্রকাশ ঘটে মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধাদের।
বেলা ১টার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে বসে আত্মসমর্পণের দলিল তৈরির বৈঠক হয়। এক পক্ষে নিয়াজি, রাও ফরমান আলী ও জামশেদ, অন্য পক্ষে জ্যাকব ও নাগরা। নিয়াজি আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করতে রাজি হন। সিদ্ধান্ত হয় আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করবেন বিজয়ী যৌথ বাহিনীর প্রধান জগজিৎ সিং অরোরা এবং পরাজিত বাহিনীর পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি।
বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) স্বাক্ষরিত হয় আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক দলিল, একাত্তরের ৭ মার্চ যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বিকেল পৌনে ৪টায় নিয়াজি রেসকোর্স ময়দানে আসেন। সামরিক বিধি অনুসারে বিজয়ী ও পরাজিত সেনারা শেষবারের মতো জেনারেল নিয়াজিকে গার্ড অব অনার জানায়।
বিকেল ৪টা। নিয়াজি ও অরোরা এগিয়ে যান ময়দানে রাখা একটি টেবিলের দিকে। টেবিলের এক পাশে দুটি চেয়ার। অরোরা বসেন ডান দিকের চেয়ারে, বাঁয়ে নিয়াজি। অরোরা স্বাক্ষর করার জন্য দলিল এগিয়ে দেন নিয়াজিকে। নিয়াজির কাছে কলম ছিল না। ভারতীয় এক কর্মকর্তা তার কলম এগিয়ে দিলে পরাজয়ের দলিলে স্বাক্ষর করেন নিয়াজি। পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম একটি নিয়মিত সেনাবাহিনী জনসাধারণের সামনে আত্মসমর্পণ করে। দলিলে স্বাক্ষর করে নিয়াজি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে। তখন বিকেল ৪টা ১ মিনিট।
দলিলে স্বাক্ষরের পর নিয়াজি উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর পদমর্যাদার প্রতীক খুলে ফেলেন। কোমরে ঝোলানো রিভলবার বের করে একটি একটি করে সব বুলেট বের করে টেবিলের ওপর রাখেন। তারপর গুলিশূন্য রিভলবার এবং পদমর্যাদার প্রতীকগুলো তুলে দেন অরোরার হাতে।
ঢাকা থেকে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) পাঠানো এক খবরে বলা হয়, আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করার সময় নিয়াজি অশ্রুসিক্ত ছিলেন।
‘ঢাকা স্বাধীন দেশের রাজধানী’: ইন্দিরার ঘোষণা
ভারতীয় সময় বিকেল সাড়ে ৫টা। ভারতের সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভার সব আসন পূর্ণ। সদস্য, সাংবাদিক ও দর্শক। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এসে বলেন, ‘আমি একটা ঘোষণা করতে চাই। আমার ধারণা, এই সভা কিছুকাল যাবৎ এই ঘোষণার প্রতীক্ষায় ছিল। [বাংলাদেশে] পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছে। ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন রাজধানী।’
ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানান এবং মুক্তি বাহিনীর বীরত্বে জয়ধ্বনি দেন।
মুজিবনগরে এদিন
১৬ ডিসেম্বর মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'লাখো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে এসেছে আমাদের এই বিজয়। আজকের ঘটনা থেকে পাকিস্তান ও তার মিত্ররা কিছু শিক্ষা নেবে বলে আশা করি। সবাই জানতেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের পতন আসন্ন। কিন্তু এই ব্যাপারে কিছু সময় নেওয়া হয়েছে। কারণ, বেসামরিক মানুষের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, তাই নীরবে তাদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী। ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে এসেছে আমাদের অনুরোধেই। বাংলাদেশের শত্রুদের আমি স্পষ্ট বলে দিতে চাই, বাংলাদেশের মানুষ বহু রক্ত ও চোখের জলে চিনতে পেরেছে কে শত্রু ও কে মিত্র।'
এ সময় তাজউদ্দীন আহমদ ভারতীয় বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক জগদিৎ সিং অরোরা ও তার অধীনস্থ অফিসার ও সেনাদের ভূয়সী প্রশংসা করেন। একইসঙ্গে তিনি ভারত সরকার, ভারতীয় জনগণ, সোভিয়েত সরকার, পোল্যান্ড ও অন্য মিত্র দেশগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, 'এসব দেশের সাহায্য না পেলে বাংলাদেশ আজ যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, তা সম্ভব হতো না।'
১৬ ডিসেম্বর মুজিবনগর থেকে পাঠানো পৃথক এক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'বাংলাদেশের রাজধানী শিগগির মুজিবনগর থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হচ্ছে। পাকিস্তানিদের যেসব দেশদ্রোহী মদদ দিয়েছিল, তাদের বিচারের জন্য বিচার সংস্থা গঠিত হচ্ছে।'
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১; দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১।
দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি পায় বহুপ্রত্যাশিত কাঙ্ক্ষিত বিজয়। পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান (এ এ কে) নিয়াজি মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন।
ঐতিহাসিক এ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন বাংলাদেশ বাহিনীর উপপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। মুক্তিবাহিনী ও বাংলাদেশ বাহিনীর পক্ষে আরও ছিলেন ‘এস’ ফোর্সের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কে এম সফিউল্লাহ, ২ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর এ টি এম হায়দার ও কাদেরিয়া বাহিনীর কাদের সিদ্দিকীসহ অনেকে।
নিয়াজির আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে সৃষ্টি হয় স্বাধীন বাংলাদেশ নামে নতুন এক রাষ্ট্রের।
এর আগে নিয়াজির নির্দেশে ভোর ৫টা থেকে পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধবিরতি শুরু করে। সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ ভারতীয় বাহিনীর ডিভিশনাল অধিনায়ক মেজর জেনারেল গন্দর্ভ সিং নাগরাকে নিয়ে একটি সামরিক জিপ ঢাকার গাবতলী (মিরপুর) সেতুর কাছে এসে থামে। নিয়াজির জন্য নাগরার বার্তা নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় হেড কোয়ার্টারের দিকে সাদা পতাকা উড়িয়ে একটি জিপে রওনা দেন ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর দুজন সেনা কর্মকর্তা। বার্তাটিতে ইংরেজিতে লেখা ছিল, ‘প্রিয় আবদুল্লাহ, আমরা এখন এখানে আছি। আমরা আপনাকে ঘিরে রেখেছি। আপনার খেলা শেষ। আত্মসমর্পণ অথবা ধ্বংস—যেকোনো একটি বেছে নিন। আমরা আপনাকে আশ্বস্ত করছি, আপনি আত্মসমর্পণ করলে আমরা আপনার সঙ্গে জেনেভা চুক্তি অনুসারে ব্যবহার করব। আমি আপনাকে ব্যক্তিগতভাবেও আশ্বস্ত করছি, আপনার জীবনের ভয় নেই। ইতি মেজর জেনারেল জি সি নাগরা।'’
এর আগেই নিয়াজি যুদ্ধবিরতি ও অস্ত্র সংবরণের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতকে জানানোর জন্য ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল অফিসে নিয়োজিত সামরিক অ্যাটাশেকে অনুরোধ করেন। দিল্লির যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের মাধ্যমে ভারত সরকারকে তা জানানো হয়। বেলা ১১টার দিকে যৌথ বাহিনীর দুই প্রতিনিধি নিয়াজির হেডকোয়ার্টার থেকে ফিরে আসেন।
পরে নিয়াজীর প্রতিনিধি হিসেবে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩৬ ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল জামশেদ গাবতলী সেতুর পাশে নাগরার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
দুপুর ১২টার দিকে জামসেদের সঙ্গে নাগরা সেনানিবাসে নিয়াজির অফিসে পৌঁছান। এরপর শুরু হয় আত্মসমর্পণের শর্তাবলি নিয়ে কথাবার্তা। বেলা ১টা নাগাদ কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছান ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব। ততক্ষণে যৌথ বাহিনী মিরপুর সেতু পেরিয়ে ঢাকায় ঢুকতে শুরু করেছে।
এদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর বিদেশি বেতারে প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীর হাজার হাজার মানুষ মুক্তির উল্লাসে রাস্তায় নেমে আসে। ধানমন্ডিসহ পুরান ঢাকায় বেলা ১১টার দিকেই উল্লসিত জনতা রাস্তায় মিছিল বের করে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর সর্বত্র আত্মপ্রকাশ ঘটে মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধাদের।
বেলা ১টার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে বসে আত্মসমর্পণের দলিল তৈরির বৈঠক হয়। এক পক্ষে নিয়াজি, রাও ফরমান আলী ও জামশেদ, অন্য পক্ষে জ্যাকব ও নাগরা। নিয়াজি আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করতে রাজি হন। সিদ্ধান্ত হয় আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করবেন বিজয়ী যৌথ বাহিনীর প্রধান জগজিৎ সিং অরোরা এবং পরাজিত বাহিনীর পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি।
বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) স্বাক্ষরিত হয় আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক দলিল, একাত্তরের ৭ মার্চ যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বিকেল পৌনে ৪টায় নিয়াজি রেসকোর্স ময়দানে আসেন। সামরিক বিধি অনুসারে বিজয়ী ও পরাজিত সেনারা শেষবারের মতো জেনারেল নিয়াজিকে গার্ড অব অনার জানায়।
বিকেল ৪টা। নিয়াজি ও অরোরা এগিয়ে যান ময়দানে রাখা একটি টেবিলের দিকে। টেবিলের এক পাশে দুটি চেয়ার। অরোরা বসেন ডান দিকের চেয়ারে, বাঁয়ে নিয়াজি। অরোরা স্বাক্ষর করার জন্য দলিল এগিয়ে দেন নিয়াজিকে। নিয়াজির কাছে কলম ছিল না। ভারতীয় এক কর্মকর্তা তার কলম এগিয়ে দিলে পরাজয়ের দলিলে স্বাক্ষর করেন নিয়াজি। পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম একটি নিয়মিত সেনাবাহিনী জনসাধারণের সামনে আত্মসমর্পণ করে। দলিলে স্বাক্ষর করে নিয়াজি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে। তখন বিকেল ৪টা ১ মিনিট।
দলিলে স্বাক্ষরের পর নিয়াজি উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর পদমর্যাদার প্রতীক খুলে ফেলেন। কোমরে ঝোলানো রিভলবার বের করে একটি একটি করে সব বুলেট বের করে টেবিলের ওপর রাখেন। তারপর গুলিশূন্য রিভলবার এবং পদমর্যাদার প্রতীকগুলো তুলে দেন অরোরার হাতে।
ঢাকা থেকে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) পাঠানো এক খবরে বলা হয়, আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করার সময় নিয়াজি অশ্রুসিক্ত ছিলেন।
‘ঢাকা স্বাধীন দেশের রাজধানী’: ইন্দিরার ঘোষণা
ভারতীয় সময় বিকেল সাড়ে ৫টা। ভারতের সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভার সব আসন পূর্ণ। সদস্য, সাংবাদিক ও দর্শক। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এসে বলেন, ‘আমি একটা ঘোষণা করতে চাই। আমার ধারণা, এই সভা কিছুকাল যাবৎ এই ঘোষণার প্রতীক্ষায় ছিল। [বাংলাদেশে] পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছে। ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন রাজধানী।’
ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানান এবং মুক্তি বাহিনীর বীরত্বে জয়ধ্বনি দেন।
মুজিবনগরে এদিন
১৬ ডিসেম্বর মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'লাখো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে এসেছে আমাদের এই বিজয়। আজকের ঘটনা থেকে পাকিস্তান ও তার মিত্ররা কিছু শিক্ষা নেবে বলে আশা করি। সবাই জানতেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের পতন আসন্ন। কিন্তু এই ব্যাপারে কিছু সময় নেওয়া হয়েছে। কারণ, বেসামরিক মানুষের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, তাই নীরবে তাদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী। ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে এসেছে আমাদের অনুরোধেই। বাংলাদেশের শত্রুদের আমি স্পষ্ট বলে দিতে চাই, বাংলাদেশের মানুষ বহু রক্ত ও চোখের জলে চিনতে পেরেছে কে শত্রু ও কে মিত্র।'
এ সময় তাজউদ্দীন আহমদ ভারতীয় বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক জগদিৎ সিং অরোরা ও তার অধীনস্থ অফিসার ও সেনাদের ভূয়সী প্রশংসা করেন। একইসঙ্গে তিনি ভারত সরকার, ভারতীয় জনগণ, সোভিয়েত সরকার, পোল্যান্ড ও অন্য মিত্র দেশগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, 'এসব দেশের সাহায্য না পেলে বাংলাদেশ আজ যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, তা সম্ভব হতো না।'
১৬ ডিসেম্বর মুজিবনগর থেকে পাঠানো পৃথক এক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'বাংলাদেশের রাজধানী শিগগির মুজিবনগর থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হচ্ছে। পাকিস্তানিদের যেসব দেশদ্রোহী মদদ দিয়েছিল, তাদের বিচারের জন্য বিচার সংস্থা গঠিত হচ্ছে।'
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১; দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১।
যোগ্যতার চাইতে প্রাপ্তি বেশি হয়ে গেলে তখন সে লাগামহীন হয়ে ওঠে। এ অনেকটা মাটি ও খুঁটির মতো অবস্থা। খুঁটি শক্ত না হলে ঘর নড়বড়ে হবে আবার মাটি উর্বর না হলে খাওয়াপড়া জুটবে না। মানুষের চিন্তার সমৃদ্ধির জন্য পড়াশোনা কিংবা জ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই।
পশ্চিম মধ্য বঙ্গোপসাগরে থাকা সুস্পষ্ট লঘুচাপ নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় নিম্নচাপটি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১ হাজার ৩৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল।
কথাসাহিত্যিক ও গবেষক সিরাজুল ইসলাম মুনির সমকালীন বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে সুপরিচিত নাম। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির সমৃদ্ধ বহুমাত্রিকতা সৃষ্টি করেছে শক্তিশালী স্বতন্ত্র অবস্থান। সাবলীল শব্দ ব্যঞ্জনার প্রকাশে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন জীবন, দেশাত্মবোধ বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন মাত্রাকে।