বিডিজেন ডেস্ক
সাক্ষাৎকার/আলাপচারিতা
কথাসাহিত্যিক ও গবেষক সিরাজুল ইসলাম মুনির সমকালীন বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে সুপরিচিত নাম। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির সমৃদ্ধ বহুমাত্রিকতা সৃষ্টি করেছে শক্তিশালী স্বতন্ত্র অবস্থান। সাবলীল শব্দ ব্যঞ্জনার প্রকাশে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন জীবন, দেশাত্মবোধ বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন মাত্রাকে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসনির্ভর উপন্যাস, গল্প এবং জাতির জনককে নিবেদিত উপন্যাস ও গবেষণা, বাংলাদেশের নদী ও চর অঞ্চল, সমুদ্র তীরবর্তী মানুষের জীবনসংগ্রাম কেন্দ্রিক জীবনমুখী উপন্যাস, কিশোর গল্প, ভ্রমণ কাহিনি, বিশ্ব ইতিহাসসহ বিভিন্ন শাখায় তাঁর সাহিত্য প্রতিভার সফল ও তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিফলন লক্ষ্যনীয়। সাহিত্য সৃষ্টির পাশাপাশি বাংলাদেশ টেলিভিশনে বইবিষয়ক অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় ও সাংবাদিকতা, সমাজ উন্নয়নমূলক সংস্কারে তাঁর দীর্ঘ দৃপ্ত পদচারণায় মুখরিত হয়েছে বারবার। এক আলাপচারিতায় তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর সাহিত্যকর্ম এবং জীবনপরিধি ও দর্শনের উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন দিকসমূহ।
আপনাকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও সালাম সিরাজুল ইসলাম মুনির ভাই। সমকালীন সাহিত্যজগতে আপনার যাত্রা শুরুর গল্পটি আমাদের জানাবেন কী?
সিরাজুল ইসলাম মুনির: সমকালীন সাহিত্য বলতে নানারকম ব্যাখ্যা আমাদের সামনে চলে আসে। কেউ বলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়, কেউ বলেন ত্রিশের দশক থেকে শুরু, কেউ বলেন চলমান সাহিত্য (contemporary literature) যা ঘটিত সময়ে লেখা সাহিত্য এমন নানাভাবে বিভাজন করেন। কেউ আধুনিক, উত্তরাধুনিক নামে ভাগ করেন, কেউ জাদুবাস্তবতা, পরাবাস্তবতার কথা বলেন। বাংলা সাহিত্য আবার দেশভাগ এবং আমাদের স্বাধীনতাত্তোর সময় এবং আরও পরে শুন্য দশকের হিসাব ধরেও বিভাজন করেন কেউ। আমি এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই। সত্তর দশক থেকে নানা উপলক্ষে ও কিছুটা শখে লেখালেখির শুরু সত্য। তারপর প্রায় একযুগেরও বেশি সময় বিরতির পর আশির দশকের শেষদিকে এসে প্রয়াত কবি আবিদ আজাদের প্রেরণায় লেখালেখিতে ফেরা। আমার মনে হয়, যেভাবে সমকালীন সাহিত্যের সংজ্ঞা আরোপ করা হয়, সেভাবে সমকালীন সাহিত্যের সঙ্গী আমি হতে পারিনি। আমি আমার সমকালে আমার যোগ্যতা ও ক্ষমতা অনুসারে যেভাবে পেরেছি, সেভাবে সাহিত্য রচনা করেছি।
তবে আমার প্রথম রচনটি সম্পর্কে একটুখানি বলতে পারি। উনিশশো' সত্তরের ১২ নবেম্বর প্রবল ঘুর্ণিঝড় ও সুনামিসদৃশ ঘুর্ণিঝড় বাংলাদেশের উপকূলভাগকে লন্ডভন্ড করে দেয়। বারো লাখ মানুষ প্রাণ হারায়, পাঁচ লাখ গবাদিপশু ভেসে যায়, সুন্দরবনসহ পূর্ব বাংলার সমগ্র উপকূলবর্তী বাড়িঘর তছনছ হয়ে যায়। আমার গ্রামের বাড়িও সমুদ্র উপকূলে, মেঘনার মোহনায়। বাবা-মা, ভাই-বোন নিকট-স্বজন সবাই সেখানে থাকতেন। শৈশবেই আমি চাচার সঙ্গে চলে গিয়েছিলাম ফেঞ্চুগঞ্জ, সেখানেই আমার বড়ো হওয়া। জলোচ্ছ্বাস যখন হলো তখন আমি ফেঞ্চুগঞ্জে, এসএসসি পরীক্ষার্থী। জলোচ্ছ্বাসের পাঁচ দিন পর সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম, কী ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে গেছে। তারও কয়েক দিন পর আমি কাকুর সঙ্গে গ্রামে গেলাম। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত যওয়ার রাস্তাঘাট সব ভেঙে গেছে, জলোচ্ছ্বাসে হাজার হাজার মানুষ সমুদ্রে ভেসে গেছে। সারাদেশ থেকে স্বেচ্ছাসেবক ও উদ্ধারকর্মীরা ছুটে আসেন, তারা শত শত মরদেহকে মাটিচাপা দেন। বাতাসে লাশের গন্ধ, যারা বেঁচে আছে লোনাপানি তাদের শরীরকে পুড়ে কালো করে ফেলেছে। ঝড়ে বাড়ির গাছগাছালি উড়ে গেছে, উঁচু গাছগুলোও পাতাশূন্য, ভিটায় ঘর নেই, ভেসে গেছে ঘর। শুন্যভিটায় বেঁচে থাকা মানুষগুলো অন্নহীন, বস্ত্রহীন জীবনযাপন করছে। একফোঁটা খাবারের পানি নেই, তাদের কারও বাবা, স্বামী, সন্তান, স্ত্রী ভেসে গেছে—কী দুঃসহ বেদনাভরা মানুষের জীবন! নদীর চরে মাটিচাপা দেওয়া লাশ নিয়ে টানাটানি করে শকুন আর কুকুর। বাতাসে কান পাতলেই শোনা যায় মানুষের গুমরে কান্না। সৌভাগ্য বশত, আমাদের বাড়ির সবাই বেঁচে গেলেও আমার বহু স্বজন সমুদ্রের জোয়ারে ভেসে গেছে। বেঁচে থাকা মরে যাওয়া নিয়ে কত কত অলৌকিক গল্প তৈরি হয়ে গেছে তখন। আমরা এক সপ্তাহ গ্রামে ছিলাম। এক সপ্তাহ পর ফিরে এসে এইসব দুঃখব্যাথা নিয়ে আমি একটা দীর্ঘ কবিতা লিখলাম, কাঁদে বাঙলা। আমার প্রথম লেখা কবিতা সেটা। সে বছর স্কুলের শেষ বার্ষিক পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমি 'কাঁদে বাংলা' কবিতাটি আবৃতি করি এবং প্রথম পুরষ্কার পাই। একজন কবি হিসেবে সেটা আমার প্রথম স্বীকৃতিও।
ছোটগল্প, নিবন্ধ, কিশোরগল্প, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপন্যাস, স্মৃতিচারণমূলক জীবনধর্মী উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনি বিবিধ ক্ষেত্রেই আপনার সফল পদচারণায় মূখর হয়েছে। লেখক জীবনের সফল ও দীর্ঘ যাত্রাপথে কোন্ ক্ষেত্রে লিখতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেছিলেন? আপনার স্বলিখিত সবচাইতে প্রিয় বই/গবেষণাকর্ম কোনটি?
সিরাজুল ইসলাম মুনির: সমুদ্র উপকূলবর্তী মানুষের জীবনশৈলী, তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ -বেদনা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, নতুন চরে মানুষের নতুন বসতি, নদীকে ঘিরে মানুষের জীবিকা, বেঁচে থাকার সংগ্রাম-এইসব নানা অনুষঙ্গ আমার লেখায় এসেছে এবং আমি এইসব বিষয় নিয়ে লিখতে স্বাচ্ছন্দও বোধকরি।
আমার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস 'আবর্ত' (১৯৮৭) নতুন চরে সর্বহারা-নদীসিকস্তি মানুষের নতুন বসতি স্থাপনের গল্প, উপকূলীয় অঞ্চলে মানুষের সৃজনকরা বিশাল বনভূমি উজাড়ের এক মর্মন্তুদ ঘটনার গল্প নিয়ে লেখা উপন্যাস 'রক্তভেজা অববাহিকা'(২০০৭), আর পদ্মা নদীর দুই পারের দুই বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক জীবন ও পদ্মাচরের মানুষের নানা টানাপোড়েন নিয়ে লেখা উপন্যাস 'পদ্মা উপাখ্যান'(২০০৪)। আমার লেখা সব বই–ই আমার প্রিয়বই। তবে এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস।
সরাসরি গবেষণাগ্রন্থ বলতে যা বোঝায়, সেরকম ফরম্যাটে ফেলে বই আমি লিখনি। তবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখা আমার বই 'বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: পূর্বাপর অনুসন্ধান' একটি গবেষণামূলক বই। তা ছাড়া, মুক্তিযুদ্ধকে আখ্যান করে লেখা বাংলা সাহিত্যের বৃহত্তম ঐতিহাসিক উপন্যাস 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে'(২০১৮) একটি উপন্যাস হলেও এটা লিখতে গিয়ে প্রচুর পড়াশোনা ও গবেষণা করতে হয়েছে। জাতির পিতার জীবনভিত্তিক বৃহদায়তন উপন্যাস 'রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি'র (২০২১) বেলায়ও একইকথা প্রযোজ্য। এ ছাড়াও, আমার সম্পাদনায় আগামী প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে বঙ্গবন্ধুর ওপর ১০২ জন লেখকের ছোটগল্পের সংকলন 'বঙ্গবন্ধু: শতবর্ষে শতগল্প' ও ৫০ জন লেখকের কিশোরগল্প সংকলন 'আমাদের বঙ্গবন্ধু: কিশোর গল্প', আমার নিজের ছোটগল্প সংকলন 'বঙ্গবন্ধু হৃদয়ের গহিনে'।
আপনার প্রকাশিত বই কয়টি? কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বইয়ের নাম উল্লেখ করবেন?
সিরাজুল ইসলাম মুনির: এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা সাইত্রিশ। মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক উপন্যাস এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক উপন্যাস 'রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি', আবর্ত, রক্তভেজা অববাহিকা, পদ্মা উপাখ্যান, যখন প্রপাত, প্রিয় প্রেম, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, রাজনীতি রানুদি ও রঙধনু বৃষ্টি, বিলোনিয়া, তার ফিরে আসা, এক অভিমানী বালকের গল্প, কাবাঘর তাওয়াফের উপর দীর্ঘতম কবিতাগ্রন্থ 'পৃথিবীর ভরকেদ্র', ভ্রমণগ্রন্থ মেপল পাতার দেশে, মহাচীনের মহাজাগরণ, বঙ্গবন্ধুর জীবনীগ্রন্থ ' জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান' প্রভৃতি।
বাংলা অথবা বিশ্বসাহিত্যের কোনো সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব বা বিশেষ কোনো বিশেষ চরিত্র আপনাকে অনুপ্রাণিত করে কী? লেখালেখির জগতে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন কী? বেতারকেন্দ্র ও টেলিভিশনে বই প্রকাশনা বিষয়ক অনুষ্ঠানে উপস্থাপনার দীর্ঘকালীন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করুন?
সিরাজুল ইসলাম মুনির: এ প্রশ্নটার মুখোমুখি আমি আরও অনেকবার হয়েছি। আসলে একেকজন মানুষ একেকভাবে বেড়ে ওঠে। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির অবস্থানগত ও পরিবেশগত দুরত্ব তো থাকবেই। সেটা কোনো সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব অথবা সাহিত্যের কোনো বিশেষ চরিত্র, যেটাই হোক না কেন। সেজন্যই আমি প্রায়ই কথাটা বলি, আমি আমার মতো, অন্য কারও মতো নই। লেখালেখির ক্ষেত্রেও একই কথা। কোনো বিশেষ লেখকের লেখায় আমি প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত নই অথবা বিশেষ কারও লেখা অনুসরণ করি না। যা লিখি তা আমার দেখার জগত ও পরিবেশ প্রতিবেশ থেকে পাওয়া। আবার এভাবেও বলা যেতে পারে,আমার অধ্যয়নকৃত/পঠিত সকল লেখাই কোনো না কোনোভাবে আমার অজ্ঞাতে আমার লেখায় চোরাগোপ্তা প্রভাব ফেলেছে। অন্য সবার মতো আমারও প্রতিবন্ধকতা একটাই,জীবিকার জন্য অন্যত্র সময় ব্যয় করা। জীবিকার লড়াই করতে করতে অনেক সম্ভাবনাময় লেখকও অকালে ঝরে যায়।
মিডিয়ার সঙ্গে আমি যুক্ত হই সিলেট এমসি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময়। সিলেট বেতারকেন্দ্র থেকে আমি খবর পড়তাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় রেডিও বাংলাদেশ, চট্টগ্রামে খবর পড়লাম। তারপর সরকারি চাকরির কারণে মফস্বলি জীবন। ১৯৯৩ সালে কবি আবিদ আজাদের উপস্থাপনায় গ্রন্থ ও প্রকাশনা বিষয়ক অনুষ্ঠান বইপত্রেসহ উপস্থাপক হিসেবে কাজ শুরু করলাম। আবিদ ভাইয়ের মৃত্যুর পর আমি বইপত্রের গ্রন্থনা ও উপস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করি। সে সময় মাঝেমধ্যে কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ এবং তাঁর মৃত্যুর পর কবি আসাদ চৌধুরী মূল উপস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
বইপত্র অনুষ্ঠানটি দীর্ঘ ১৪ বছর প্রচারিত হয়েছিল। আমার ঢাকার বাইরে বদলির কারণে মাঝখানে দুই বছর অনুষ্ঠানটি বন্ধ ছিল। সরকার বদল হলে বিটিভির অনুষ্ঠান পরিকল্পনাও অনেক পরিবর্তন ঘটে। বইপত্র'র ওপরও এমন খড়গ নেমে আসে, পরে যাচাই-বাছাইয়ের পর পুনরায় অনুমতি মেলে। আসলে বইপত্র'র অনুষ্ঠান পরিকল্পনার মধ্যে কোনো রাজনৈতিক বিতর্ককে টেনে আনা হয়নি। আমি সবসময়ই চেষ্টা করেছি অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তচিন্তাবিষয়ক বই, বইয়ের লেখক, বইয়ের প্রকাশককে অনুষ্ঠানের সঙ্গ যুক্ত করতে, এটা ছিল আমার নিজের বিশ্বাসের জায়গা।
দীর্ঘ ১৪ বছর একটা গুরুত্বপূর্ণ সৃজনশীল অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকা, অভিজ্ঞতা তো অনেক হয়েছে, কিন্তু সব কথা এই পরিসরে বলা তো সম্ভব নয় ভাই। টেলিভিশনের মেকআপ ম্যান থেকে শুরু করে কলাকুশলী, প্রযোজক, সহযোগী, বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা যাদের প্রায় সকলেই সৃজনশীল মানুষ, লেখক অথবা নির্মাতা, তারা তো আছেন, তারপর ইনডোর-আউটডোরের রেকর্ডিং, ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রতিবেদন নির্মাণের জন্য টেলিভিশন ক্রু ও টিম নিয়ে যাওয়া- কত কী স্মৃতির বিষয় তো রয়েছেই। তারপর রাজধানী ঢাকা ও বাংলাদেশের অন্য শহরে থাকা কবি-লেখক-গবেষক এমনকি প্রবাসের অনেক লেখক-সাংবাদিকও বইপত্র অনুষ্ঠানে এসেছিলেন, তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি, তাদের জীবনের নানাকথা শুনেছি। সবশেষে, একটা কথা না বললেই নয়, বইপত্র অনুষ্ঠানটা করতে গিয়ে আমি জীবনের অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করেছি, ওই সময়টায় আমি লেখালেখিতে মনোযোগী থাকলেই বোধহয় ভালো হতো।
আপনি 'মানবতা' 'মানবাধিকার' ও 'প্রেম'-এই বিষয়গুলোকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেন? আপনার বিবেচনায় সুলেখক হওয়ার পূর্বশর্তগুলো কী কী?
সিরাজুল ইসলাম মুনির: মানবতা, মানবাধিকার এক ব্যাপক অর্থবহ বিষয়। জাতিসংঘ গৃহীত UDHR (Universal decleration of Human Rights) এর মানবাধিকারের ঘোষণার সর্বজনীন সংজ্ঞার শুরুতেই বলা হয়েছে, "All human beings are born free & equal in dignity & rights". এ ছাড়া ম্যাগনাকার্টা, সাইরাস সিলিন্ডার, মদিনার সনদের উদাহরণ তো মানবজাতির সামনে রয়েছেই। পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি ধর্মমতেই মানবতা, মানবাধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো যে ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের অধিকার ও নিরাপত্তার জন্য এইসব সংজ্ঞা, চুক্তি ও ধর্মীয় অনুশাসন প্রবর্তিত হয়েছে, তারাই প্রতিনিয়ত সেটা ভেঙে ফেলতে বা লঙ্ঘন করতে তৎপর রয়েছে। অনুন্নত দারিদ্র্যপীড়িত দেশে ব্যক্তিপর্যায়ে আবার কখনো সরকার তার জনসাধারণের ওপর নিপীড়ন করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। আর উন্নত দেশগুলো মুখে খুব মানবাধিকারের কথা বলে, কিন্তু তাদের আধিপত্যবাদী মনোভাব, ক্ষমতার অহংবোধ, অন্য দেশের সম্পদ কুক্ষিগতকরণ ও অস্ত্র বাণিজ্যের জন্য দেশে দেশে যুদ্ধ, হত্যা, লুন্ঠনসহ নানাভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। শীতল-যুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীতে এককেন্দ্রিক ক্ষমতার দম্ভ ও হুংকারধ্বনির বিপরীতে পুনর্বার ক্ষমতার নতুন মোর্চা গড়ে উঠছে, যা বিশ্বকে পুনর্বার অশান্ত করে তুলতে পারে।
বৃহৎ পরিসরের আলোচনা বাদ দিলে একজন ব্যক্তির জীবনেও মানবতা, মানবাধিকার ও প্রেমের ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে হবে। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই মানবতাবোধ থাকতে হবে, ব্যক্তির অধিকার দেওয়া ও পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আর বিপরীত লিঙ্গের কারও প্রতি আকর্ষণই কেবল প্রেম নয়, 'জীবে (সকল মানুষসহ) দয়া করে যে-জন, সেজন সেবিছে ঈশ্বর'- এমন মহাবাক্যের অনুসরণ করতে হবে। আমার মতে সুলেখক হওয়ার পূর্বশর্ত হলো কেবল পড়া, পড়া, পড়া আর নিজের সাধনা চেষ্টা ও চর্চা।
'ভালো বই পাঠের মাধ্যমে একটি সুন্দর মননশীল প্রজন্ম ও সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব'-এই চিন্তার প্রেক্ষিতে আপনার মতামত কী? আপনি কী মনে করেন প্রযুক্তির ওপরে মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতা আমাদের বইপড়ার চর্চাকে হ্রাস করছে?
সিরাজুল ইসলাম মুনির: একটা সময় তো এমনই ছিল, যখন বই ছিল শিশু-কিশোরদের একমাত্র বিনোদন ও তাদের মানস গঠনের একমাত্র মাধ্যম এবং তারই ফলশ্রুতিতে একটা সময়কাল পর্যন্ত আমরা উন্নত ও সৎ চরিত্রের মানুষের দেখা পাই। বলতে দ্বিধা নেই ওই প্রজন্মের মানুষের পক্ষেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সংগ্রামের পথ বেয়ে একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল। আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এই প্রয়োজনটা যদি এখন অনুভূত হতো, তাহলে বর্তমান সময়ের এই যে বিভ্রান্ত তরুণ ও যুবসমাজ একইসঙ্গে নেতৃত্ব দেওয়ার উপযুক্ত বয়সী দুর্নীতিগ্রস্থ মানুষজনের পক্ষে সম্ভব হতো না। এটাকে একতরফা ভালো বই না পড়াকে কারণ হিসেবে বলা যায় না। হাঁ, প্রযুক্তির উৎকর্ষতা বই না পড়ার একটা কারণ তো বটেই। প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে বিনোদনের নানা মাধ্যম। কেবল প্রযুক্তিকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। আমরা শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিকায়ণ করতে পারিনি। অথর্ব ও মাথামোটা কিছু লোক শিক্ষার কারিকুলাম তৈরি করে, তারা শিক্ষা পদ্ধতিকে কয়েকটি ধারায় ভাগ করেছে, একমূখী শিক্ষানীতি না থাকায় শিশুকিশোররা একইরকম মানবিক গুণাবলি নিয়ে বেড়ে ওঠে না। ভুল শিক্ষানীতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, প্রতিটি উপজেলায় একটা স্কুলকে মডেল স্কুল ঘোষণার নামে তারা উপজেলার অন্য দশটি স্কুলের ছেলেমেয়েদের ভালো শিক্ষা পাবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, অথচ তারা নির্দোষ ছিল। আজকাল আবার শিক্ষাপ্রতিবন্ধক কিছু অদ্ভুত ভর্তি নীতিমালা শুরু করেছে যা দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত করবে। তো এতসব প্রতিবন্ধকতার সমস্যা কেবল প্রযুক্তির ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। প্রযুক্তি বরং নানাবিধ জ্ঞানের ভান্ডারকে অনুসন্ধিৎসু পাঠকের সামনে নিয়ে এসেছে, যা বইয়ের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে একজন পাঠকের পক্ষে পাঠ করা সম্ভব হয় না।
আরেকটা কথা, বইপড়া মানে কেবল সাহিত্যপাঠ নয়, জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখায় ঋদ্ধ হতে পারলেই বরং একটা দেশ ও সমাজের অগ্রগতি সম্ভব হবে।
আপনার জন্মস্থান, শিক্ষা, পেশা ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দিবেন কী? হঠাৎ মিলে যাওয়া আপনি অবসর সময় কীভাবে অতিবাহিত করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন? আপনার কোনো বিশেষ শখ আছে কী?
সিরাজুল ইসলাম মুনির: আমি জন্মেছিলাম সমুদ্র উপকূলবর্তী মেঘনার মোহনার উথাল-পাতাল জলবেষ্টিত একটা চরগ্রাম চর জুবিলিতে। পরবর্তীতে তা উপকূলীয় উপজেলা সুবর্ণচরের অংশ হয়। আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে এনজিএফএফ, ফেঞ্চুগঞ্জ। এনজিএফএফ স্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর সিলেট এমসি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছি। তারপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর। পড়াশোনা শেষ করে কিছুদিন অধুনালুপ্ত দৈনিক গণকণ্ঠে মফস্বল বিভাগের সম্পাদক তারপর কিছুদিন আদমজী জুটমিলসে প্রোডাকশন অফিসার হিসেবে চাকরি করলাম। তারপর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগে সরকারি চাকরিতে যোগদান এবং ২০১৬ সালের জুলাইতে অবসরগ্রহণ। আমার স্ত্রীর নাম জোহরা সুলতানা। চাকরিজীবনে তিনি আমার সহকর্মী ছিলেন। আমাদের দুই সন্তান, শাহরিয়ার রাইসুল ইসলাম ও শাহমান রাউফুল ইসলাম। শাহরিয়ার কানাডার অভিবাসী, শাহমান ইঞ্জিনিয়ার,বাংলাদেশে থাকে।
আমার চাকরিজীবন ছিল বৈচিত্র্যে ভরপূর, রোমাঞ্চকর নানা অভিজ্ঞতায় পূর্ণ। সে-সবের কিঞ্চিৎ আমি আমার আত্মজৈবনিক রচনা 'জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণে' বর্ণনা করেছি। কিন্তু তারপরও চব্বিশ ঘন্টার অত্যাবশ্যকীয় চাকরির শেকলপরা জীবন ছিল সেটা। যেদিন অবসর পেলাম, মনে হল আমার পায়ের শেকলটা খুলে গেছে, আমি স্বাধীন হয়েছি। কৈশোরে স্কুল ছেড়ে পরিবারের বন্ধন ছেড়ে যেদিন আমি কলেজে ভর্তি হওয়ার আনন্দে জেলা শহরে যাচ্ছিলাম, সেদিন আমার মনে হয়েছিল আমার পিঠে পাখা গজিয়েছে, অবসরের দিনটাকেও আমার শেকল খোলার দিন মনে হয়েছিল। জানেন, সেদিন থেকেই আমি লেখালেখিতে সম্পূর্ণ সময় দিতে পারছি। এখন আমার নিরবচ্ছিন্ন পড়াশোনা আর লেখালেখি।
বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার সময়টা আমার কাছে উন্মাদনার,ওই সময় খেলা দেখার চেয়ে বড় কোনো শখ নেই। গান শোনা,বই পড়া,রাজনীতি চর্চা করা- এগুলো সবসময় পছন্দের তালিকায় থাকে।
আপনার বিবেচনায় বাংলাদেশের ইতিহাস নির্ভর এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক পর্যাপ্ত ও মানসম্মত প্রকাশনা এবং গবেষণা হচ্ছে কী, সেই প্রসঙ্গে আপনার কোনো নির্দেশনা আছে কী?
সিরাজুল ইসলাম মুনির: বলতে দ্বিধা নেই, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আপনার জিজ্ঞাসিত বিষয়ে তেমন কোনো কাজ হয়নি। যেটুকুই বা হয়েছে তা নির্মোহভাবে সঠিক ইতিহাসকে প্রতিনিধিত্ব করে না। লেখক বা গবেষকের দলীয় অবস্থান অথবা তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস প্রাধান্য পেয়েছে। আবার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতার জন্মশতবর্ষকে সামনে রেখে সরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু কাজ হয়েছে। আবার এটাও লক্ষ্য করা গেছে প্রকাশকরা ব্যবসায়িক স্বার্থে অনেক অ-লেখক ও এই বিষয়ে অনভিজ্ঞ লেখককে দিয়ে কাট-পেস্ট করিয়ে অনেক বই বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর ওপর হাজার হাজার বই রচনা করিয়েছেন এবং নানা কৌশলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বই বিপণন করিয়েছেন। এটা দুর্ভাগ্যজনক। কারণ এইসব বই স্কুল কলেজ অথবা সরকার ঘোষিত মুজিব কর্নারে চলে যাবে। সরকারি কোনো প্রতিনিধিদল বা প্রতিষ্ঠান এই বইগুলোকে স্ক্রিনিং করলে ভালো হতো।
মানসম্মত প্রকাশনা বলতে হাসান হাফিজুর রহমান কর্তৃক সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ১৫ খন্ড এখন পর্যন্ত আমার বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে শেখ হাসিনা কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই সম্পাদনা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা এবং শেখ হাসিনার লেখা অনেকগুলো বই স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের আকরগ্রন্থ। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ইউপিএল ও আগামী প্রকাশনী থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর ওপর কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশিত হয়েছে। দুঃখিত, আমি নির্দেশনা দেবার কেউ নই।
দেশে ও প্রবাসের আগামী প্রজন্মের সফল বিকাশের জন্য আপনার কোনো মতামত আছে কী? আপনি কী মনে করেন অনুবাদ সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ?
সিরাজুল ইসলাম মুনির: সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় নানারূপ পরিবর্তনের নামে পুরো ব্যবস্থাটাকে একটা আবর্জনায় পরিণত করেছে। তথাকথিত মাথামোটা আমলাদের বাদ দিয়ে এইক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে উন্নত দেশগুলোর আদলে বহবিধ ধারায় চলমান শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তে একমুখী শিক্ষাব্যাবস্থা চালু করতে হবে এবং তাহলেই কেবল নতুন প্রজন্মের সফল বিকাশ সম্ভব হবে। প্রবাসে যেসব বাঙালিরা অভিবাসী হয়েছেন তাদের জন্য একটা অনুরোধ এই যে, বাড়িতে বাচ্চাদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলুন। তাদেরকে অন্তত পড়তে ও লিখতে পারার মতো বাংলা শেখান। না হয় একদিন তারা ভুলে যাবে বাংলাদেশ একদিন তার পূর্ব পুরুষের দেশ ছিল।
অনুবাদ সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই, পৃথিবীর নানা ভাষার সাহিত্য ইংরেজি থেকে অনুদিত হয়ে বাংলা ভাষার পাঠকের কাছে অনেক বছর থেকে পৌঁছে যাচ্ছে। কলকাতা এব্যাপারে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছে। বাংলা ভাষায় লেখা সাহিত্যের খুব কম বই-ই ইংরেজি বা অন্য ভাষায় অনুদিত হয়েছে। তবে অভিবাসী অনেক বাঙালি লেখক অথবা যারা ইংরেজি মাধ্যমে লেখেন এবং বিদেশি প্রকাশনা সংস্থাগুলো থেকে প্রকাশিত হয় তাদের লেখা সহজেই বিশ্বসাহিত্যের অংশীদার হতে পারছে।
আপনার জীবনের কয়েকটি স্মরণীয় ঘটনা (ইতিবাচক/ নেতিবাচক) আমাদের অবহিত করাবেন কী? লেখক, সাংবাদিকতা, উপস্থাপনা এবং পেশাগত জীবনের কোন্ দিকটা আপনাকে কী বিশেষ আকৃষ্ট করে?
সিরাজুল ইসলাম মুনির: এসব বলতে গেলে অনেক সময়ের ব্যাপার, অনেক সময় নিয়ে বলতে হবে। দুটো বলি, প্রথমটা হলো, যখন সদ্যভূমিষ্ট আমার বড় ছেলের মুখ দেখলাম, আমি চোখের সামনে 'ছোট্ট আমি'কে দেখলাম, আমি বিস্ময়ে অবিভূত হয়ে পড়ি। পরে আমি তার নাম রাখলাম 'আনন'। আনন অর্থ মুখ এবং সেটা আমারই মুখের আদল বলে। আর দ্বিতীয়টি হলো, আমার বাবার মৃত্যু সংবাদ। ২০২০ সালে আমি ছেলের কাছে কানাডায় আসি। আমার বাবা গ্রামের বাড়িতেই ছিলেন এবং সুস্থই ছিলেন। হঠাৎ খবর এল, তিনি নেই। সকালে সবার সঙ্গে কথা বললেন, নাস্তা করলেন, বিছানায় শুয়ে রেস্ট নিচ্ছিলেন এবং এরইমধ্যে তাঁর পরপারের ডাক এল। বাবার সঙ্গে আমার শেষ বিদায় হলো না।
আমি নিশ্চিত জানি, আমার বাবার চেয়ে কেউ আমাকে বেশি ভালোবাসেননি। বাবার মুখটা কখনো আমার মন থেকে হারিয়ে যায় না।
আপনার সমৃদ্ধ সাহিত্য জীবনে প্রাপ্ত কয়েকটি স্বীকৃতির বিষয়ে বলুন। সাহিত্য ও সমাজ উন্নয়ন নির্ভর আপনার আগামীর কোনো কর্ম পরিকল্পনা কী কী?
সিরাজুল ইসলাম মুনির: সমৃদ্ধ সাহিত্য-জীবন আমার কী হয়েছে? আমি নিজের ভালোলাগা থেকে লিখি এবং যে-কটা দিন বেঁচে থাকব, লিখব। স্বীকৃতির কথা বলছেন, না ভাই, তেমন উল্লেখযোগ্য ঘটনা এখনো ঘটেনি। 'পদ্মা উপাখ্যান' উপন্যাসের জন্য রাজশাহী সাহিত্য পরিষদ পুরষ্কার, সাহিত্যে অবদানের জন্য কিউট সাহিত্য পুরষ্কার, আবুজাফর ওবায়দুল্লাহ সাহিত্য পুরষ্কার আর ঐতিহাসিক উপন্যাস 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে'র জন্য দিগন্ত সাহিত্যধারা পুরষ্কার ও আগরতলা থেকে বঙ্গবন্ধু জন্মশতবর্ষ উদযাপন পরিষদ ও মৌমিতা প্রকাশনী থেকে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। তবে দুঃখের ব্যাপার হলো আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক যে পুরষ্কারগুলো দেওয়া হয়, তার অধিকাংশই লবিং করে পেতে হয়। সাম্প্রতিককালে তরুণ লেখকদের (৫০ বছর) জন্য ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরষ্কার, কালিকলম-আইএফআাইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরষ্কার, এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ুন আহমেদ সাহিত্য পুরষ্কার প্রবর্তন হওয়ায় যোগ্যদের মূল্যায়ণ হচ্ছে।
সমাজ উন্নয়ন নির্ভর কিছু কাজ আমি ইতিমধ্যেই করেছি এবং মৃত্যু পর্যন্ত এই কাজগুলো করে যাব। আগেই বলেছি, একসময় আমাদের গ্রামটা সমুদ্রের তলদেশ থেকে জেগে উঠেছিল। আমরা দেশের মূলভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। তারপর দীর্ঘসময় ধরে ভাঙা-গড়ার খেলা চলতে চলতে একসময় মূলভূমির সঙ্গে একীভূত হয় সমগ্র অঞ্চল এবং বর্তমানে সেটা এখন বিশাল উপজেলা, নাম সুবর্ণচর। স্বাভাবিক কারণেই সুবর্ণচর ছিল শিক্ষায় অনগ্রসর একটি অঞ্চল। আমি ১৯৯৩ সালে জুবিলি হাবিবউল্লাহ মিয়ার হাট হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করি। একটা সময় ছিল, বাচ্চাদের স্কুলে দেওয়ার জন্য আমরা তাদের বাবা-মার কাছে ছুটে গেছি। তখন স্কুলে না পাঠানোর জন্য তাদের কতো অজুহাত ছিল! অনেক মোটিভেশন করতে হয়েছে, এখন সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। আসন্ন সন্তানসম্ভাবা মায়েরা এখন স্বপ্ন দেখেন কখন তার সন্তানটি পৃথিবীতে আসবে, বড়ো হবে আর স্কুলে যাবে। ২০২৩ সালে স্কুলকে কলেজ পর্যায়ে উন্নীত করেছি। বর্তমান নাম 'জুবিলি হাবিবউল্লাহ মিয়ার হাট স্কুল অ্যান্ড কলেজ'। আমরা স্কুলে স্থান সংকুলান করতে পারি না। তাই সম্প্রতি সেখানে আমরা আরও একটা মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি। তার নাম দিয়েছি 'হাবিব উল্লাহ মিয়ার হাট বালিকা বিদ্যালয়'। এ ছাড়া, সেখানে বিপুল গ্রন্থসমৃদ্ধ 'বজলের রহমান স্মৃতি পাঠাগার' করেছি, যা একইসঙ্গে স্কুলের পাঠাগার হিসেবে পরিচালিত হয়। সুবর্ণচরের যে অঞ্চলকে ঘিরে আমার কার্যক্রম, আনন্দের সঙ্গেই বলতে হয়, একসময় আমাদের বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়িতে শিক্ষিত মানুষ ছিল না, আর এখন এমন একটি বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে বাড়িতে মাস্টার্স ডিগ্রি পাস ছেলে বা মেয়ে নেই।
আমাদের সময় দেবার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি
আন্তরিক ধন্যবাদ আপনাকে সংশ্লিষ্ট সবার জন্যl
সাক্ষাৎকার/আলাপচারিতা
কথাসাহিত্যিক ও গবেষক সিরাজুল ইসলাম মুনির সমকালীন বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে সুপরিচিত নাম। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির সমৃদ্ধ বহুমাত্রিকতা সৃষ্টি করেছে শক্তিশালী স্বতন্ত্র অবস্থান। সাবলীল শব্দ ব্যঞ্জনার প্রকাশে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন জীবন, দেশাত্মবোধ বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন মাত্রাকে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসনির্ভর উপন্যাস, গল্প এবং জাতির জনককে নিবেদিত উপন্যাস ও গবেষণা, বাংলাদেশের নদী ও চর অঞ্চল, সমুদ্র তীরবর্তী মানুষের জীবনসংগ্রাম কেন্দ্রিক জীবনমুখী উপন্যাস, কিশোর গল্প, ভ্রমণ কাহিনি, বিশ্ব ইতিহাসসহ বিভিন্ন শাখায় তাঁর সাহিত্য প্রতিভার সফল ও তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিফলন লক্ষ্যনীয়। সাহিত্য সৃষ্টির পাশাপাশি বাংলাদেশ টেলিভিশনে বইবিষয়ক অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় ও সাংবাদিকতা, সমাজ উন্নয়নমূলক সংস্কারে তাঁর দীর্ঘ দৃপ্ত পদচারণায় মুখরিত হয়েছে বারবার। এক আলাপচারিতায় তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর সাহিত্যকর্ম এবং জীবনপরিধি ও দর্শনের উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন দিকসমূহ।
আপনাকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও সালাম সিরাজুল ইসলাম মুনির ভাই। সমকালীন সাহিত্যজগতে আপনার যাত্রা শুরুর গল্পটি আমাদের জানাবেন কী?
সিরাজুল ইসলাম মুনির: সমকালীন সাহিত্য বলতে নানারকম ব্যাখ্যা আমাদের সামনে চলে আসে। কেউ বলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়, কেউ বলেন ত্রিশের দশক থেকে শুরু, কেউ বলেন চলমান সাহিত্য (contemporary literature) যা ঘটিত সময়ে লেখা সাহিত্য এমন নানাভাবে বিভাজন করেন। কেউ আধুনিক, উত্তরাধুনিক নামে ভাগ করেন, কেউ জাদুবাস্তবতা, পরাবাস্তবতার কথা বলেন। বাংলা সাহিত্য আবার দেশভাগ এবং আমাদের স্বাধীনতাত্তোর সময় এবং আরও পরে শুন্য দশকের হিসাব ধরেও বিভাজন করেন কেউ। আমি এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই। সত্তর দশক থেকে নানা উপলক্ষে ও কিছুটা শখে লেখালেখির শুরু সত্য। তারপর প্রায় একযুগেরও বেশি সময় বিরতির পর আশির দশকের শেষদিকে এসে প্রয়াত কবি আবিদ আজাদের প্রেরণায় লেখালেখিতে ফেরা। আমার মনে হয়, যেভাবে সমকালীন সাহিত্যের সংজ্ঞা আরোপ করা হয়, সেভাবে সমকালীন সাহিত্যের সঙ্গী আমি হতে পারিনি। আমি আমার সমকালে আমার যোগ্যতা ও ক্ষমতা অনুসারে যেভাবে পেরেছি, সেভাবে সাহিত্য রচনা করেছি।
তবে আমার প্রথম রচনটি সম্পর্কে একটুখানি বলতে পারি। উনিশশো' সত্তরের ১২ নবেম্বর প্রবল ঘুর্ণিঝড় ও সুনামিসদৃশ ঘুর্ণিঝড় বাংলাদেশের উপকূলভাগকে লন্ডভন্ড করে দেয়। বারো লাখ মানুষ প্রাণ হারায়, পাঁচ লাখ গবাদিপশু ভেসে যায়, সুন্দরবনসহ পূর্ব বাংলার সমগ্র উপকূলবর্তী বাড়িঘর তছনছ হয়ে যায়। আমার গ্রামের বাড়িও সমুদ্র উপকূলে, মেঘনার মোহনায়। বাবা-মা, ভাই-বোন নিকট-স্বজন সবাই সেখানে থাকতেন। শৈশবেই আমি চাচার সঙ্গে চলে গিয়েছিলাম ফেঞ্চুগঞ্জ, সেখানেই আমার বড়ো হওয়া। জলোচ্ছ্বাস যখন হলো তখন আমি ফেঞ্চুগঞ্জে, এসএসসি পরীক্ষার্থী। জলোচ্ছ্বাসের পাঁচ দিন পর সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম, কী ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে গেছে। তারও কয়েক দিন পর আমি কাকুর সঙ্গে গ্রামে গেলাম। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত যওয়ার রাস্তাঘাট সব ভেঙে গেছে, জলোচ্ছ্বাসে হাজার হাজার মানুষ সমুদ্রে ভেসে গেছে। সারাদেশ থেকে স্বেচ্ছাসেবক ও উদ্ধারকর্মীরা ছুটে আসেন, তারা শত শত মরদেহকে মাটিচাপা দেন। বাতাসে লাশের গন্ধ, যারা বেঁচে আছে লোনাপানি তাদের শরীরকে পুড়ে কালো করে ফেলেছে। ঝড়ে বাড়ির গাছগাছালি উড়ে গেছে, উঁচু গাছগুলোও পাতাশূন্য, ভিটায় ঘর নেই, ভেসে গেছে ঘর। শুন্যভিটায় বেঁচে থাকা মানুষগুলো অন্নহীন, বস্ত্রহীন জীবনযাপন করছে। একফোঁটা খাবারের পানি নেই, তাদের কারও বাবা, স্বামী, সন্তান, স্ত্রী ভেসে গেছে—কী দুঃসহ বেদনাভরা মানুষের জীবন! নদীর চরে মাটিচাপা দেওয়া লাশ নিয়ে টানাটানি করে শকুন আর কুকুর। বাতাসে কান পাতলেই শোনা যায় মানুষের গুমরে কান্না। সৌভাগ্য বশত, আমাদের বাড়ির সবাই বেঁচে গেলেও আমার বহু স্বজন সমুদ্রের জোয়ারে ভেসে গেছে। বেঁচে থাকা মরে যাওয়া নিয়ে কত কত অলৌকিক গল্প তৈরি হয়ে গেছে তখন। আমরা এক সপ্তাহ গ্রামে ছিলাম। এক সপ্তাহ পর ফিরে এসে এইসব দুঃখব্যাথা নিয়ে আমি একটা দীর্ঘ কবিতা লিখলাম, কাঁদে বাঙলা। আমার প্রথম লেখা কবিতা সেটা। সে বছর স্কুলের শেষ বার্ষিক পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমি 'কাঁদে বাংলা' কবিতাটি আবৃতি করি এবং প্রথম পুরষ্কার পাই। একজন কবি হিসেবে সেটা আমার প্রথম স্বীকৃতিও।
ছোটগল্প, নিবন্ধ, কিশোরগল্প, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপন্যাস, স্মৃতিচারণমূলক জীবনধর্মী উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনি বিবিধ ক্ষেত্রেই আপনার সফল পদচারণায় মূখর হয়েছে। লেখক জীবনের সফল ও দীর্ঘ যাত্রাপথে কোন্ ক্ষেত্রে লিখতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেছিলেন? আপনার স্বলিখিত সবচাইতে প্রিয় বই/গবেষণাকর্ম কোনটি?
সিরাজুল ইসলাম মুনির: সমুদ্র উপকূলবর্তী মানুষের জীবনশৈলী, তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ -বেদনা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, নতুন চরে মানুষের নতুন বসতি, নদীকে ঘিরে মানুষের জীবিকা, বেঁচে থাকার সংগ্রাম-এইসব নানা অনুষঙ্গ আমার লেখায় এসেছে এবং আমি এইসব বিষয় নিয়ে লিখতে স্বাচ্ছন্দও বোধকরি।
আমার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস 'আবর্ত' (১৯৮৭) নতুন চরে সর্বহারা-নদীসিকস্তি মানুষের নতুন বসতি স্থাপনের গল্প, উপকূলীয় অঞ্চলে মানুষের সৃজনকরা বিশাল বনভূমি উজাড়ের এক মর্মন্তুদ ঘটনার গল্প নিয়ে লেখা উপন্যাস 'রক্তভেজা অববাহিকা'(২০০৭), আর পদ্মা নদীর দুই পারের দুই বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক জীবন ও পদ্মাচরের মানুষের নানা টানাপোড়েন নিয়ে লেখা উপন্যাস 'পদ্মা উপাখ্যান'(২০০৪)। আমার লেখা সব বই–ই আমার প্রিয়বই। তবে এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস।
সরাসরি গবেষণাগ্রন্থ বলতে যা বোঝায়, সেরকম ফরম্যাটে ফেলে বই আমি লিখনি। তবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখা আমার বই 'বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: পূর্বাপর অনুসন্ধান' একটি গবেষণামূলক বই। তা ছাড়া, মুক্তিযুদ্ধকে আখ্যান করে লেখা বাংলা সাহিত্যের বৃহত্তম ঐতিহাসিক উপন্যাস 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে'(২০১৮) একটি উপন্যাস হলেও এটা লিখতে গিয়ে প্রচুর পড়াশোনা ও গবেষণা করতে হয়েছে। জাতির পিতার জীবনভিত্তিক বৃহদায়তন উপন্যাস 'রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি'র (২০২১) বেলায়ও একইকথা প্রযোজ্য। এ ছাড়াও, আমার সম্পাদনায় আগামী প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে বঙ্গবন্ধুর ওপর ১০২ জন লেখকের ছোটগল্পের সংকলন 'বঙ্গবন্ধু: শতবর্ষে শতগল্প' ও ৫০ জন লেখকের কিশোরগল্প সংকলন 'আমাদের বঙ্গবন্ধু: কিশোর গল্প', আমার নিজের ছোটগল্প সংকলন 'বঙ্গবন্ধু হৃদয়ের গহিনে'।
আপনার প্রকাশিত বই কয়টি? কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বইয়ের নাম উল্লেখ করবেন?
সিরাজুল ইসলাম মুনির: এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা সাইত্রিশ। মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক উপন্যাস এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক উপন্যাস 'রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি', আবর্ত, রক্তভেজা অববাহিকা, পদ্মা উপাখ্যান, যখন প্রপাত, প্রিয় প্রেম, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, রাজনীতি রানুদি ও রঙধনু বৃষ্টি, বিলোনিয়া, তার ফিরে আসা, এক অভিমানী বালকের গল্প, কাবাঘর তাওয়াফের উপর দীর্ঘতম কবিতাগ্রন্থ 'পৃথিবীর ভরকেদ্র', ভ্রমণগ্রন্থ মেপল পাতার দেশে, মহাচীনের মহাজাগরণ, বঙ্গবন্ধুর জীবনীগ্রন্থ ' জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান' প্রভৃতি।
বাংলা অথবা বিশ্বসাহিত্যের কোনো সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব বা বিশেষ কোনো বিশেষ চরিত্র আপনাকে অনুপ্রাণিত করে কী? লেখালেখির জগতে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন কী? বেতারকেন্দ্র ও টেলিভিশনে বই প্রকাশনা বিষয়ক অনুষ্ঠানে উপস্থাপনার দীর্ঘকালীন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করুন?
সিরাজুল ইসলাম মুনির: এ প্রশ্নটার মুখোমুখি আমি আরও অনেকবার হয়েছি। আসলে একেকজন মানুষ একেকভাবে বেড়ে ওঠে। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির অবস্থানগত ও পরিবেশগত দুরত্ব তো থাকবেই। সেটা কোনো সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব অথবা সাহিত্যের কোনো বিশেষ চরিত্র, যেটাই হোক না কেন। সেজন্যই আমি প্রায়ই কথাটা বলি, আমি আমার মতো, অন্য কারও মতো নই। লেখালেখির ক্ষেত্রেও একই কথা। কোনো বিশেষ লেখকের লেখায় আমি প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত নই অথবা বিশেষ কারও লেখা অনুসরণ করি না। যা লিখি তা আমার দেখার জগত ও পরিবেশ প্রতিবেশ থেকে পাওয়া। আবার এভাবেও বলা যেতে পারে,আমার অধ্যয়নকৃত/পঠিত সকল লেখাই কোনো না কোনোভাবে আমার অজ্ঞাতে আমার লেখায় চোরাগোপ্তা প্রভাব ফেলেছে। অন্য সবার মতো আমারও প্রতিবন্ধকতা একটাই,জীবিকার জন্য অন্যত্র সময় ব্যয় করা। জীবিকার লড়াই করতে করতে অনেক সম্ভাবনাময় লেখকও অকালে ঝরে যায়।
মিডিয়ার সঙ্গে আমি যুক্ত হই সিলেট এমসি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময়। সিলেট বেতারকেন্দ্র থেকে আমি খবর পড়তাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় রেডিও বাংলাদেশ, চট্টগ্রামে খবর পড়লাম। তারপর সরকারি চাকরির কারণে মফস্বলি জীবন। ১৯৯৩ সালে কবি আবিদ আজাদের উপস্থাপনায় গ্রন্থ ও প্রকাশনা বিষয়ক অনুষ্ঠান বইপত্রেসহ উপস্থাপক হিসেবে কাজ শুরু করলাম। আবিদ ভাইয়ের মৃত্যুর পর আমি বইপত্রের গ্রন্থনা ও উপস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করি। সে সময় মাঝেমধ্যে কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ এবং তাঁর মৃত্যুর পর কবি আসাদ চৌধুরী মূল উপস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
বইপত্র অনুষ্ঠানটি দীর্ঘ ১৪ বছর প্রচারিত হয়েছিল। আমার ঢাকার বাইরে বদলির কারণে মাঝখানে দুই বছর অনুষ্ঠানটি বন্ধ ছিল। সরকার বদল হলে বিটিভির অনুষ্ঠান পরিকল্পনাও অনেক পরিবর্তন ঘটে। বইপত্র'র ওপরও এমন খড়গ নেমে আসে, পরে যাচাই-বাছাইয়ের পর পুনরায় অনুমতি মেলে। আসলে বইপত্র'র অনুষ্ঠান পরিকল্পনার মধ্যে কোনো রাজনৈতিক বিতর্ককে টেনে আনা হয়নি। আমি সবসময়ই চেষ্টা করেছি অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তচিন্তাবিষয়ক বই, বইয়ের লেখক, বইয়ের প্রকাশককে অনুষ্ঠানের সঙ্গ যুক্ত করতে, এটা ছিল আমার নিজের বিশ্বাসের জায়গা।
দীর্ঘ ১৪ বছর একটা গুরুত্বপূর্ণ সৃজনশীল অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকা, অভিজ্ঞতা তো অনেক হয়েছে, কিন্তু সব কথা এই পরিসরে বলা তো সম্ভব নয় ভাই। টেলিভিশনের মেকআপ ম্যান থেকে শুরু করে কলাকুশলী, প্রযোজক, সহযোগী, বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা যাদের প্রায় সকলেই সৃজনশীল মানুষ, লেখক অথবা নির্মাতা, তারা তো আছেন, তারপর ইনডোর-আউটডোরের রেকর্ডিং, ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রতিবেদন নির্মাণের জন্য টেলিভিশন ক্রু ও টিম নিয়ে যাওয়া- কত কী স্মৃতির বিষয় তো রয়েছেই। তারপর রাজধানী ঢাকা ও বাংলাদেশের অন্য শহরে থাকা কবি-লেখক-গবেষক এমনকি প্রবাসের অনেক লেখক-সাংবাদিকও বইপত্র অনুষ্ঠানে এসেছিলেন, তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি, তাদের জীবনের নানাকথা শুনেছি। সবশেষে, একটা কথা না বললেই নয়, বইপত্র অনুষ্ঠানটা করতে গিয়ে আমি জীবনের অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করেছি, ওই সময়টায় আমি লেখালেখিতে মনোযোগী থাকলেই বোধহয় ভালো হতো।
আপনি 'মানবতা' 'মানবাধিকার' ও 'প্রেম'-এই বিষয়গুলোকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেন? আপনার বিবেচনায় সুলেখক হওয়ার পূর্বশর্তগুলো কী কী?
সিরাজুল ইসলাম মুনির: মানবতা, মানবাধিকার এক ব্যাপক অর্থবহ বিষয়। জাতিসংঘ গৃহীত UDHR (Universal decleration of Human Rights) এর মানবাধিকারের ঘোষণার সর্বজনীন সংজ্ঞার শুরুতেই বলা হয়েছে, "All human beings are born free & equal in dignity & rights". এ ছাড়া ম্যাগনাকার্টা, সাইরাস সিলিন্ডার, মদিনার সনদের উদাহরণ তো মানবজাতির সামনে রয়েছেই। পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি ধর্মমতেই মানবতা, মানবাধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো যে ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের অধিকার ও নিরাপত্তার জন্য এইসব সংজ্ঞা, চুক্তি ও ধর্মীয় অনুশাসন প্রবর্তিত হয়েছে, তারাই প্রতিনিয়ত সেটা ভেঙে ফেলতে বা লঙ্ঘন করতে তৎপর রয়েছে। অনুন্নত দারিদ্র্যপীড়িত দেশে ব্যক্তিপর্যায়ে আবার কখনো সরকার তার জনসাধারণের ওপর নিপীড়ন করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। আর উন্নত দেশগুলো মুখে খুব মানবাধিকারের কথা বলে, কিন্তু তাদের আধিপত্যবাদী মনোভাব, ক্ষমতার অহংবোধ, অন্য দেশের সম্পদ কুক্ষিগতকরণ ও অস্ত্র বাণিজ্যের জন্য দেশে দেশে যুদ্ধ, হত্যা, লুন্ঠনসহ নানাভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। শীতল-যুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীতে এককেন্দ্রিক ক্ষমতার দম্ভ ও হুংকারধ্বনির বিপরীতে পুনর্বার ক্ষমতার নতুন মোর্চা গড়ে উঠছে, যা বিশ্বকে পুনর্বার অশান্ত করে তুলতে পারে।
বৃহৎ পরিসরের আলোচনা বাদ দিলে একজন ব্যক্তির জীবনেও মানবতা, মানবাধিকার ও প্রেমের ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে হবে। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই মানবতাবোধ থাকতে হবে, ব্যক্তির অধিকার দেওয়া ও পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আর বিপরীত লিঙ্গের কারও প্রতি আকর্ষণই কেবল প্রেম নয়, 'জীবে (সকল মানুষসহ) দয়া করে যে-জন, সেজন সেবিছে ঈশ্বর'- এমন মহাবাক্যের অনুসরণ করতে হবে। আমার মতে সুলেখক হওয়ার পূর্বশর্ত হলো কেবল পড়া, পড়া, পড়া আর নিজের সাধনা চেষ্টা ও চর্চা।
'ভালো বই পাঠের মাধ্যমে একটি সুন্দর মননশীল প্রজন্ম ও সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব'-এই চিন্তার প্রেক্ষিতে আপনার মতামত কী? আপনি কী মনে করেন প্রযুক্তির ওপরে মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতা আমাদের বইপড়ার চর্চাকে হ্রাস করছে?
সিরাজুল ইসলাম মুনির: একটা সময় তো এমনই ছিল, যখন বই ছিল শিশু-কিশোরদের একমাত্র বিনোদন ও তাদের মানস গঠনের একমাত্র মাধ্যম এবং তারই ফলশ্রুতিতে একটা সময়কাল পর্যন্ত আমরা উন্নত ও সৎ চরিত্রের মানুষের দেখা পাই। বলতে দ্বিধা নেই ওই প্রজন্মের মানুষের পক্ষেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সংগ্রামের পথ বেয়ে একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল। আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এই প্রয়োজনটা যদি এখন অনুভূত হতো, তাহলে বর্তমান সময়ের এই যে বিভ্রান্ত তরুণ ও যুবসমাজ একইসঙ্গে নেতৃত্ব দেওয়ার উপযুক্ত বয়সী দুর্নীতিগ্রস্থ মানুষজনের পক্ষে সম্ভব হতো না। এটাকে একতরফা ভালো বই না পড়াকে কারণ হিসেবে বলা যায় না। হাঁ, প্রযুক্তির উৎকর্ষতা বই না পড়ার একটা কারণ তো বটেই। প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে বিনোদনের নানা মাধ্যম। কেবল প্রযুক্তিকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। আমরা শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিকায়ণ করতে পারিনি। অথর্ব ও মাথামোটা কিছু লোক শিক্ষার কারিকুলাম তৈরি করে, তারা শিক্ষা পদ্ধতিকে কয়েকটি ধারায় ভাগ করেছে, একমূখী শিক্ষানীতি না থাকায় শিশুকিশোররা একইরকম মানবিক গুণাবলি নিয়ে বেড়ে ওঠে না। ভুল শিক্ষানীতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, প্রতিটি উপজেলায় একটা স্কুলকে মডেল স্কুল ঘোষণার নামে তারা উপজেলার অন্য দশটি স্কুলের ছেলেমেয়েদের ভালো শিক্ষা পাবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, অথচ তারা নির্দোষ ছিল। আজকাল আবার শিক্ষাপ্রতিবন্ধক কিছু অদ্ভুত ভর্তি নীতিমালা শুরু করেছে যা দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত করবে। তো এতসব প্রতিবন্ধকতার সমস্যা কেবল প্রযুক্তির ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। প্রযুক্তি বরং নানাবিধ জ্ঞানের ভান্ডারকে অনুসন্ধিৎসু পাঠকের সামনে নিয়ে এসেছে, যা বইয়ের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে একজন পাঠকের পক্ষে পাঠ করা সম্ভব হয় না।
আরেকটা কথা, বইপড়া মানে কেবল সাহিত্যপাঠ নয়, জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখায় ঋদ্ধ হতে পারলেই বরং একটা দেশ ও সমাজের অগ্রগতি সম্ভব হবে।
আপনার জন্মস্থান, শিক্ষা, পেশা ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দিবেন কী? হঠাৎ মিলে যাওয়া আপনি অবসর সময় কীভাবে অতিবাহিত করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন? আপনার কোনো বিশেষ শখ আছে কী?
সিরাজুল ইসলাম মুনির: আমি জন্মেছিলাম সমুদ্র উপকূলবর্তী মেঘনার মোহনার উথাল-পাতাল জলবেষ্টিত একটা চরগ্রাম চর জুবিলিতে। পরবর্তীতে তা উপকূলীয় উপজেলা সুবর্ণচরের অংশ হয়। আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে এনজিএফএফ, ফেঞ্চুগঞ্জ। এনজিএফএফ স্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর সিলেট এমসি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছি। তারপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর। পড়াশোনা শেষ করে কিছুদিন অধুনালুপ্ত দৈনিক গণকণ্ঠে মফস্বল বিভাগের সম্পাদক তারপর কিছুদিন আদমজী জুটমিলসে প্রোডাকশন অফিসার হিসেবে চাকরি করলাম। তারপর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগে সরকারি চাকরিতে যোগদান এবং ২০১৬ সালের জুলাইতে অবসরগ্রহণ। আমার স্ত্রীর নাম জোহরা সুলতানা। চাকরিজীবনে তিনি আমার সহকর্মী ছিলেন। আমাদের দুই সন্তান, শাহরিয়ার রাইসুল ইসলাম ও শাহমান রাউফুল ইসলাম। শাহরিয়ার কানাডার অভিবাসী, শাহমান ইঞ্জিনিয়ার,বাংলাদেশে থাকে।
আমার চাকরিজীবন ছিল বৈচিত্র্যে ভরপূর, রোমাঞ্চকর নানা অভিজ্ঞতায় পূর্ণ। সে-সবের কিঞ্চিৎ আমি আমার আত্মজৈবনিক রচনা 'জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণে' বর্ণনা করেছি। কিন্তু তারপরও চব্বিশ ঘন্টার অত্যাবশ্যকীয় চাকরির শেকলপরা জীবন ছিল সেটা। যেদিন অবসর পেলাম, মনে হল আমার পায়ের শেকলটা খুলে গেছে, আমি স্বাধীন হয়েছি। কৈশোরে স্কুল ছেড়ে পরিবারের বন্ধন ছেড়ে যেদিন আমি কলেজে ভর্তি হওয়ার আনন্দে জেলা শহরে যাচ্ছিলাম, সেদিন আমার মনে হয়েছিল আমার পিঠে পাখা গজিয়েছে, অবসরের দিনটাকেও আমার শেকল খোলার দিন মনে হয়েছিল। জানেন, সেদিন থেকেই আমি লেখালেখিতে সম্পূর্ণ সময় দিতে পারছি। এখন আমার নিরবচ্ছিন্ন পড়াশোনা আর লেখালেখি।
বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার সময়টা আমার কাছে উন্মাদনার,ওই সময় খেলা দেখার চেয়ে বড় কোনো শখ নেই। গান শোনা,বই পড়া,রাজনীতি চর্চা করা- এগুলো সবসময় পছন্দের তালিকায় থাকে।
আপনার বিবেচনায় বাংলাদেশের ইতিহাস নির্ভর এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক পর্যাপ্ত ও মানসম্মত প্রকাশনা এবং গবেষণা হচ্ছে কী, সেই প্রসঙ্গে আপনার কোনো নির্দেশনা আছে কী?
সিরাজুল ইসলাম মুনির: বলতে দ্বিধা নেই, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আপনার জিজ্ঞাসিত বিষয়ে তেমন কোনো কাজ হয়নি। যেটুকুই বা হয়েছে তা নির্মোহভাবে সঠিক ইতিহাসকে প্রতিনিধিত্ব করে না। লেখক বা গবেষকের দলীয় অবস্থান অথবা তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস প্রাধান্য পেয়েছে। আবার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতার জন্মশতবর্ষকে সামনে রেখে সরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু কাজ হয়েছে। আবার এটাও লক্ষ্য করা গেছে প্রকাশকরা ব্যবসায়িক স্বার্থে অনেক অ-লেখক ও এই বিষয়ে অনভিজ্ঞ লেখককে দিয়ে কাট-পেস্ট করিয়ে অনেক বই বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর ওপর হাজার হাজার বই রচনা করিয়েছেন এবং নানা কৌশলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বই বিপণন করিয়েছেন। এটা দুর্ভাগ্যজনক। কারণ এইসব বই স্কুল কলেজ অথবা সরকার ঘোষিত মুজিব কর্নারে চলে যাবে। সরকারি কোনো প্রতিনিধিদল বা প্রতিষ্ঠান এই বইগুলোকে স্ক্রিনিং করলে ভালো হতো।
মানসম্মত প্রকাশনা বলতে হাসান হাফিজুর রহমান কর্তৃক সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ১৫ খন্ড এখন পর্যন্ত আমার বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে শেখ হাসিনা কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই সম্পাদনা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা এবং শেখ হাসিনার লেখা অনেকগুলো বই স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের আকরগ্রন্থ। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ইউপিএল ও আগামী প্রকাশনী থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর ওপর কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশিত হয়েছে। দুঃখিত, আমি নির্দেশনা দেবার কেউ নই।
দেশে ও প্রবাসের আগামী প্রজন্মের সফল বিকাশের জন্য আপনার কোনো মতামত আছে কী? আপনি কী মনে করেন অনুবাদ সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ?
সিরাজুল ইসলাম মুনির: সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় নানারূপ পরিবর্তনের নামে পুরো ব্যবস্থাটাকে একটা আবর্জনায় পরিণত করেছে। তথাকথিত মাথামোটা আমলাদের বাদ দিয়ে এইক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে উন্নত দেশগুলোর আদলে বহবিধ ধারায় চলমান শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তে একমুখী শিক্ষাব্যাবস্থা চালু করতে হবে এবং তাহলেই কেবল নতুন প্রজন্মের সফল বিকাশ সম্ভব হবে। প্রবাসে যেসব বাঙালিরা অভিবাসী হয়েছেন তাদের জন্য একটা অনুরোধ এই যে, বাড়িতে বাচ্চাদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলুন। তাদেরকে অন্তত পড়তে ও লিখতে পারার মতো বাংলা শেখান। না হয় একদিন তারা ভুলে যাবে বাংলাদেশ একদিন তার পূর্ব পুরুষের দেশ ছিল।
অনুবাদ সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই, পৃথিবীর নানা ভাষার সাহিত্য ইংরেজি থেকে অনুদিত হয়ে বাংলা ভাষার পাঠকের কাছে অনেক বছর থেকে পৌঁছে যাচ্ছে। কলকাতা এব্যাপারে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছে। বাংলা ভাষায় লেখা সাহিত্যের খুব কম বই-ই ইংরেজি বা অন্য ভাষায় অনুদিত হয়েছে। তবে অভিবাসী অনেক বাঙালি লেখক অথবা যারা ইংরেজি মাধ্যমে লেখেন এবং বিদেশি প্রকাশনা সংস্থাগুলো থেকে প্রকাশিত হয় তাদের লেখা সহজেই বিশ্বসাহিত্যের অংশীদার হতে পারছে।
আপনার জীবনের কয়েকটি স্মরণীয় ঘটনা (ইতিবাচক/ নেতিবাচক) আমাদের অবহিত করাবেন কী? লেখক, সাংবাদিকতা, উপস্থাপনা এবং পেশাগত জীবনের কোন্ দিকটা আপনাকে কী বিশেষ আকৃষ্ট করে?
সিরাজুল ইসলাম মুনির: এসব বলতে গেলে অনেক সময়ের ব্যাপার, অনেক সময় নিয়ে বলতে হবে। দুটো বলি, প্রথমটা হলো, যখন সদ্যভূমিষ্ট আমার বড় ছেলের মুখ দেখলাম, আমি চোখের সামনে 'ছোট্ট আমি'কে দেখলাম, আমি বিস্ময়ে অবিভূত হয়ে পড়ি। পরে আমি তার নাম রাখলাম 'আনন'। আনন অর্থ মুখ এবং সেটা আমারই মুখের আদল বলে। আর দ্বিতীয়টি হলো, আমার বাবার মৃত্যু সংবাদ। ২০২০ সালে আমি ছেলের কাছে কানাডায় আসি। আমার বাবা গ্রামের বাড়িতেই ছিলেন এবং সুস্থই ছিলেন। হঠাৎ খবর এল, তিনি নেই। সকালে সবার সঙ্গে কথা বললেন, নাস্তা করলেন, বিছানায় শুয়ে রেস্ট নিচ্ছিলেন এবং এরইমধ্যে তাঁর পরপারের ডাক এল। বাবার সঙ্গে আমার শেষ বিদায় হলো না।
আমি নিশ্চিত জানি, আমার বাবার চেয়ে কেউ আমাকে বেশি ভালোবাসেননি। বাবার মুখটা কখনো আমার মন থেকে হারিয়ে যায় না।
আপনার সমৃদ্ধ সাহিত্য জীবনে প্রাপ্ত কয়েকটি স্বীকৃতির বিষয়ে বলুন। সাহিত্য ও সমাজ উন্নয়ন নির্ভর আপনার আগামীর কোনো কর্ম পরিকল্পনা কী কী?
সিরাজুল ইসলাম মুনির: সমৃদ্ধ সাহিত্য-জীবন আমার কী হয়েছে? আমি নিজের ভালোলাগা থেকে লিখি এবং যে-কটা দিন বেঁচে থাকব, লিখব। স্বীকৃতির কথা বলছেন, না ভাই, তেমন উল্লেখযোগ্য ঘটনা এখনো ঘটেনি। 'পদ্মা উপাখ্যান' উপন্যাসের জন্য রাজশাহী সাহিত্য পরিষদ পুরষ্কার, সাহিত্যে অবদানের জন্য কিউট সাহিত্য পুরষ্কার, আবুজাফর ওবায়দুল্লাহ সাহিত্য পুরষ্কার আর ঐতিহাসিক উপন্যাস 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে'র জন্য দিগন্ত সাহিত্যধারা পুরষ্কার ও আগরতলা থেকে বঙ্গবন্ধু জন্মশতবর্ষ উদযাপন পরিষদ ও মৌমিতা প্রকাশনী থেকে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। তবে দুঃখের ব্যাপার হলো আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক যে পুরষ্কারগুলো দেওয়া হয়, তার অধিকাংশই লবিং করে পেতে হয়। সাম্প্রতিককালে তরুণ লেখকদের (৫০ বছর) জন্য ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরষ্কার, কালিকলম-আইএফআাইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরষ্কার, এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ুন আহমেদ সাহিত্য পুরষ্কার প্রবর্তন হওয়ায় যোগ্যদের মূল্যায়ণ হচ্ছে।
সমাজ উন্নয়ন নির্ভর কিছু কাজ আমি ইতিমধ্যেই করেছি এবং মৃত্যু পর্যন্ত এই কাজগুলো করে যাব। আগেই বলেছি, একসময় আমাদের গ্রামটা সমুদ্রের তলদেশ থেকে জেগে উঠেছিল। আমরা দেশের মূলভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। তারপর দীর্ঘসময় ধরে ভাঙা-গড়ার খেলা চলতে চলতে একসময় মূলভূমির সঙ্গে একীভূত হয় সমগ্র অঞ্চল এবং বর্তমানে সেটা এখন বিশাল উপজেলা, নাম সুবর্ণচর। স্বাভাবিক কারণেই সুবর্ণচর ছিল শিক্ষায় অনগ্রসর একটি অঞ্চল। আমি ১৯৯৩ সালে জুবিলি হাবিবউল্লাহ মিয়ার হাট হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করি। একটা সময় ছিল, বাচ্চাদের স্কুলে দেওয়ার জন্য আমরা তাদের বাবা-মার কাছে ছুটে গেছি। তখন স্কুলে না পাঠানোর জন্য তাদের কতো অজুহাত ছিল! অনেক মোটিভেশন করতে হয়েছে, এখন সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। আসন্ন সন্তানসম্ভাবা মায়েরা এখন স্বপ্ন দেখেন কখন তার সন্তানটি পৃথিবীতে আসবে, বড়ো হবে আর স্কুলে যাবে। ২০২৩ সালে স্কুলকে কলেজ পর্যায়ে উন্নীত করেছি। বর্তমান নাম 'জুবিলি হাবিবউল্লাহ মিয়ার হাট স্কুল অ্যান্ড কলেজ'। আমরা স্কুলে স্থান সংকুলান করতে পারি না। তাই সম্প্রতি সেখানে আমরা আরও একটা মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি। তার নাম দিয়েছি 'হাবিব উল্লাহ মিয়ার হাট বালিকা বিদ্যালয়'। এ ছাড়া, সেখানে বিপুল গ্রন্থসমৃদ্ধ 'বজলের রহমান স্মৃতি পাঠাগার' করেছি, যা একইসঙ্গে স্কুলের পাঠাগার হিসেবে পরিচালিত হয়। সুবর্ণচরের যে অঞ্চলকে ঘিরে আমার কার্যক্রম, আনন্দের সঙ্গেই বলতে হয়, একসময় আমাদের বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়িতে শিক্ষিত মানুষ ছিল না, আর এখন এমন একটি বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে বাড়িতে মাস্টার্স ডিগ্রি পাস ছেলে বা মেয়ে নেই।
আমাদের সময় দেবার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি
আন্তরিক ধন্যবাদ আপনাকে সংশ্লিষ্ট সবার জন্যl
যোগ্যতার চাইতে প্রাপ্তি বেশি হয়ে গেলে তখন সে লাগামহীন হয়ে ওঠে। এ অনেকটা মাটি ও খুঁটির মতো অবস্থা। খুঁটি শক্ত না হলে ঘর নড়বড়ে হবে আবার মাটি উর্বর না হলে খাওয়াপড়া জুটবে না। মানুষের চিন্তার সমৃদ্ধির জন্য পড়াশোনা কিংবা জ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই।
পশ্চিম মধ্য বঙ্গোপসাগরে থাকা সুস্পষ্ট লঘুচাপ নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় নিম্নচাপটি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১ হাজার ৩৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল।
কথাসাহিত্যিক ও গবেষক সিরাজুল ইসলাম মুনির সমকালীন বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে সুপরিচিত নাম। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির সমৃদ্ধ বহুমাত্রিকতা সৃষ্টি করেছে শক্তিশালী স্বতন্ত্র অবস্থান। সাবলীল শব্দ ব্যঞ্জনার প্রকাশে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন জীবন, দেশাত্মবোধ বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন মাত্রাকে।