logo
খবর

অনুভবের জগতে স্রষ্টার অদৃশ্য উপস্থিতি

রহমান মৃধা, সুইডেন
রহমান মৃধা, সুইডেন২ দিন আগে
Copied!
অনুভবের জগতে স্রষ্টার অদৃশ্য উপস্থিতি
প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত

প্রেম ও ভালোবাসা মানবজীবনের এক বিশেষ রূপ। দৃশ্যমান ভালোবাসায় যেমন একজন প্রিয় মানুষের প্রতি টান; দৈহিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় গভীরভাবে জড়িয়ে থাকে। এখানে আকর্ষণ, মুগ্ধতা ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ স্পষ্ট। এই ভালোবাসা মানসিক ও শারীরিক টানে প্রভাবিত হয়, যেখানে প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করার সুযোগ থাকে।

অদৃশ্য স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ ভালোবাসা

অন্যদিকে, অদৃশ্য স্রষ্টার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আকর্ষণের জায়গায় নয়, বরং কৃতজ্ঞতার জায়গায় দাঁড়ায়। স্রষ্টা নিঃস্বার্থভাবে আমাদের জীবনকে পূর্ণ করেন। আমরা তাঁকে দেখি না, তবু তাঁর দান প্রতিটি মুহূর্তে অনুভব করি। তাঁর প্রতি ভালোবাসা হলো উপলব্ধি এবং কৃতজ্ঞতার গভীর প্রকাশ। এটি কোনো চাহিদার বা প্রত্যক্ষ সম্পর্কের ভিত্তিতে নয়; বরং এটি আত্মার সংযোগ এবং ভেতরের এক অমোঘ অনুভূতির ফসল।
দৃশ্যমান ও অদৃশ্যের মধ্যে পার্থক্য।

দৃশ্যমান ভালোবাসা আকর্ষণের। যেখানে প্রত্যক্ষ অনুভবের স্থান আছে। কিন্তু অদৃশ্য ভালোবাসা চিন্তার গভীরে জন্ম নেয়। স্রষ্টাকে দেখা যায় না, কিন্তু তাঁর অস্তিত্ব অনুভবের স্তরে দৃশ্যমান। তিনি আমাদের অস্তিত্বের মূল ভিত্তি, যিনি সবকিছু নিঃশব্দে দিয়ে যান, বিনিময়ে কিছু চান না। তাঁর প্রতি এই ভালোবাসা মুগ্ধতার নয়; এটি এক ধরনের নীরব কৃতজ্ঞতা।

“না দেখাই বেশি”– অনুভবের জগতে সত্য

আমরা যা দেখি না, তা অনেক সময় গভীরভাবে উপলব্ধি করি। যেমন, বাতাসের উপস্থিতি আমরা চোখে দেখি না, কিন্তু তার ছোঁয়া টের পাই। তেমনি, স্রষ্টার অস্তিত্বও কোনো চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা নয়। তাঁর প্রতি অনুভূতি হলো সেই মেঘের মতো, যা দৃষ্টির সীমা ছাড়িয়ে অন্তরকে ভিজিয়ে যায়। ‘দৃশ্যমান ভালোবাসা আকর্ষণের, আর অদৃশ্য ভালোবাসা কৃতজ্ঞতার’—এই পার্থক্য আমাদের উপলব্ধির গভীরতাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে।

স্রষ্টাকে না দেখার মধ্যেই তাঁর উপস্থিতির সবচেয়ে বেশি গভীরতা। এই অনুভূতি আমাদের অস্তিত্বের গভীরে শিকড় গেঁড়ে বসে। স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা হলো এক নীরব অনুভূতি, যা কোনো প্রত্যক্ষ টানে নয়, বরং এক চিরন্তন সত্যে ভরপুর।
যা দেখা যায় না, তা-ই অনুভবের আলোয় সবচেয়ে স্পষ্ট।
দৃশ্যের আড়ালে অনুভব। চোখে দেখা যায় না, তবু অনুভব করা যায়—এমন এক বাস্তবতার নাম স্রষ্টা। আলো-অন্ধকারের দোলাচলে, চিন্তা আর চেতনার আঙিনায় তাঁর অস্তিত্ব যেন এক শীতল বাতাসের মতো: উপস্থিত, কিন্তু অদৃশ্য।

প্রতিদিন সকালে আমাদের বেড টু ব্রেকফাস্ট জীবনে এই অনুভবটা হয়তো ক্ষণিকের জন্য আসে। ঘুম ভাঙার পর, নীরব ঘরে এক ফোটা সূর্যের আলো যখন জানালা ভেদ করে এসে পড়ে, তখন মনে হয় কেউ যেন মৃদু স্পর্শে জাগিয়ে দিচ্ছেন। মনে হয়— সেখানে তিনি আছেন।

শূন্যতা এবং পূর্ণতা

স্রষ্টাকে না দেখার এই শূন্যতাই যেন পরিপূর্ণতার উৎস। সকালের প্রথম নিঃশ্বাসে যখন বুক ভরে আসে অক্সিজেন, তখন কি কেউ ভেবে দেখে বাতাসের বুকে কার আশীর্বাদ ভেসে বেড়ায়? এক কাপ গরম চায়ের ধোঁয়া উঠতে উঠতে হয়তো আমাদের দৃষ্টি তাঁকে দেখে না, কিন্তু ভাবনার জগতে তিনিই সবচেয়ে দৃশ্যমান।
অনুভবের গভীরতাতেই লুকিয়ে থাকে পরম সত্য। ঠিক যেমন একটা নিস্তব্ধ কক্ষে বাতাসের ছোঁয়া টের পাওয়া যায়, কিন্তু তার চলার দৃশ্য ধরা পড়ে না।

অনুভূতির অলংকার

একটি ছোট উদাহরণ ধরা যাক। আপনি ঘরে বসে আছেন। হঠাৎ জানালার পর্দা কেঁপে উঠল। কেউ কি দেখলেন পর্দাটিকে সরিয়ে দিল? না, দেখলেন না। কিন্তু বাতাসের সেই ছোঁয়া যে অনুভব করলেন, সেটাই তো সত্য।
ঠিক তেমনি, স্রষ্টার অস্তিত্বও কোনো চোখের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। তিনি ভাবনার কোলাহলে বিরাজ করেন, অবচেতন মনে ঢেউ তুলে যান। যখন কোনো কাজ সুন্দরভাবে শেষ হয়, তখন মনে হয়— ‘এটা কার সাহায্যে হলো?’ সেই অলিখিত উত্তরটুকুতে তিনি আছেন।

শব্দের পেছনে নীরবতা

একটি মর্মস্পর্শী কবিতার শেষ চরণ পড়ে থমকে গেলে যেমন মনে হয় শূন্যতা—সেখানেও কবির উপস্থিতি থাকে। স্রষ্টার না-দেখা উপস্থিতিও তেমনি। আমাদের জীবনের শব্দ, ঘটনার ভেতরে লুকিয়ে থাকা সেই ‘নীরবতা’।
যা দেখা যায় না, তার অনুপস্থিতি নয় বরং অস্তিত্বই অনুভবের গভীরতায় প্রকাশিত হয়। যেমন অন্ধকার রাতের শূন্যতা আমাদের মনে নিয়ে আসে ভাবনার অসীম জগৎ।

বেড টু ব্রেকফাস্টের প্রতিদিনের ব্যস্ততা

জীবনের প্রতিটি দিন, বেড টু ব্রেকফাস্টের সেই যান্ত্রিক রুটিনের মাঝেই স্রষ্টা থাকেন। চোখ ধুয়ে আয়নায় তাকানোর সময়, কর্মজীবনের পথে হাঁটতে হাঁটতে—হয়তো কখনো ভীষণ ক্লান্ত মনে ভাবি, ‘কে আমার পাশে আছেন?’ উত্তর আসে ভাবনার গহীনে: ‘আমি আছি, সবসময়।’
স্রষ্টার উপস্থিতি এতটাই নীরব যে ব্যস্ত জীবনে তাঁকে আমরা অনুভব করতেও ভুলে যাই। কিন্তু নির্জনতার মুহূর্তে, ক্লান্ত দেহ আর উদ্বিগ্ন মন যখন একটু প্রশান্তির আশ্রয় খোঁজে, তখন তাঁরই অস্তিত্ব অনুভূত হয় গভীরতম সত্য হিসেবে।

চূড়ান্ত উপলব্ধি

স্রষ্টাকে না দেখার এই রহস্যই তাঁকে আমাদের জন্য আরও বেশি জীবন্ত করে তোলে। পর্দার আড়ালে থাকা একজন শিল্পীর মতো, তিনি আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তাঁর দান দিয়ে যান, অথচ আমাদের দৃষ্টি কখনোই তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না।
আমরা যা দেখি, তা অনেক সময় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। কিন্তু যা দেখা যায় না, তা-ই আমাদের সবচেয়ে গভীর উপলব্ধিতে টিকে থাকে। ঠিক যেমন বাতাসকে দেখা যায় না, কিন্তু তার ছোঁয়া অনুভব করা যায়। স্রষ্টার প্রতি আমাদের ভালোবাসা এমনই এক গভীর সত্য—যেখানে আকর্ষণের চেয়ে কৃতজ্ঞতার গভীরতা বড় হয়ে ওঠে।
দৃশ্যমান ভালোবাসা মুগ্ধতার, আকর্ষণের; কিন্তু অদৃশ্য স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা নির্ভর করে উপলব্ধির ওপর। এটি কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিষয় নয়, বরং এক চিরন্তন সত্যের প্রতি আত্মার নিঃশব্দ সংযোগ।

উপসংহার

না দেখাই বেশি’— কারণ যা চোখে দেখা যায় না, তা-ই অনুভূতির গভীরতম জায়গা দখল করে। অদৃশ্য স্রষ্টার ভালোবাসা আমাদের চেতনাকে এমনভাবে পূর্ণ করে, যা দৃশ্যমান বাস্তবতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তিনি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি প্রয়োজনে নীরবে পাশে থাকেন।
স্রষ্টা এমন এক সত্য, যিনি দৃশ্যমানতার বাইরেও সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর প্রতি ভালোবাসা কোনো চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা নয়, বরং এক অন্তর্নিহিত অনুভূতি। এই অনুভূতি আমাদের কৃতজ্ঞতায় সিক্ত করে এবং হৃদয়ের গভীরে শান্তির আলো জ্বালায়।
তাঁকে না দেখতে পাওয়াই যেন তাঁর অস্তিত্বের সবচেয়ে গভীর সাক্ষ্য। তাঁর এই অদৃশ্য উপস্থিতি আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ধ্বনিত হয়। কারণ, ‘দৃশ্যমান ভালোবাসা আকর্ষণের, আর অদৃশ্য ভালোবাসা কৃতজ্ঞতার।
অতএব, স্রষ্টা সেই শাশ্বত বাস্তবতা, যিনি আমাদের অনুভবের জগতে চিরকালীন। তাঁর না-দেখা উপস্থিতিই আমাদের চিন্তা, অনুভূতি এবং ভালোবাসার গভীরতম জায়গায় আলো ফেলে। এবং এই কারণেই, ‘না দেখাই বেশি।’

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
[email protected]

আরও পড়ুন

হার মানা হার

হার মানা হার

যোগ্যতার চাইতে প্রাপ্তি বেশি হয়ে গেলে তখন সে লাগামহীন হয়ে ওঠে। এ অনেকটা মাটি ও খুঁটির মতো অবস্থা। খুঁটি শক্ত না হলে ঘর নড়বড়ে হবে আবার মাটি উর্বর না হলে খাওয়াপড়া জুটবে না। মানুষের চিন্তার সমৃদ্ধির জন্য পড়াশোনা কিংবা জ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই।

১ দিন আগে

সাগরে নিম্নচাপ, ৪ বন্দরে সতর্কসংকেত

সাগরে নিম্নচাপ, ৪ বন্দরে সতর্কসংকেত

পশ্চিম মধ্য বঙ্গোপসাগরে থাকা সুস্পষ্ট লঘুচাপ নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় নিম্নচাপটি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১ হাজার ৩৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল।

২ দিন আগে

কথাসাহিত্যিক সিরাজুল ইসলাম মুনিরের সঙ্গে আলাপচারিতা

কথাসাহিত্যিক সিরাজুল ইসলাম মুনিরের সঙ্গে আলাপচারিতা

কথাসাহিত্যিক ও গবেষক সিরাজুল ইসলাম মুনির সমকালীন বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে সুপরিচিত নাম। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির সমৃদ্ধ বহুমাত্রিকতা সৃষ্টি করেছে শক্তিশালী স্বতন্ত্র অবস্থান। সাবলীল শব্দ ব্যঞ্জনার প্রকাশে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন জীবন, দেশাত্মবোধ বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন মাত্রাকে।

২ দিন আগে