logo
খবর

সৌদি আরবে ভিসা প্রতারণার ফাঁদে শত শত বাংলাদেশি

বিডিজেন ডেস্ক
বিডিজেন ডেস্ক১৫ অক্টোবর ২০২৪
Copied!
সৌদি আরবে ভিসা প্রতারণার ফাঁদে শত শত বাংলাদেশি
প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত

বাড়তি উপার্জনের আশায় ২০২২ সালের অক্টোবরে সৌদি আরব যান নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মেহেরনগরের রিয়াজুল ইসলাম সোহাগ। নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক করা এ তরুণ বিদেশ যাওয়ার আগে সম্পন্ন করেন ফার্মাসিস্ট কোর্সও। তাঁকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, ১৫ মাসের ইকামা বা ওয়ার্ক পারমিটের সঙ্গে ফার্মেসিতে কাজের সুযোগ দেওয়া হবে। এ প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে দালালের হাতে ৪ লাখ টাকা তুলে দেন সোহাগ। কিন্তু সৌদি আরব যাওয়ার পর তাঁকে কাজ দেওয়া হয় একটি রেস্তোরাঁয়, তা-ও আবার পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে। আর ইকামার মেয়াদ ছিল মাত্র তিন মাস। ফলে তিন মাস পরই অবৈধ হয়ে যান সোহাগ। দুই বছর ধরে অবৈধ শ্রমিক হিসেবেই সৌদি আরব আছেন তিনি।

হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা হয় সোহাগের। তিনি বলেন, ‘এখানে এসে আটকে গেছি। দিনশেষে কোথাও যেতে পারছি না। রেস্তোরাঁ থেকে বাসা, বাসা থেকে রেস্তোরাঁ; বাইরে বের হলেই পুলিশ ধরবে, দেশে পাঠিয়ে দেবে। এদিকে এতদিন যে অবৈধভাবে আছি, সেজন্য সাড়ে ৪ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে আমাকে। আর এক বছরের ইকামা করার সুযোগ পেলে সে জন্যও লাগবে প্রায় দেড় লাখ টাকা। এসব কীভাবে করব তা জানি না। দালালেরা আমাদের নিঃস্ব করেছে।’

সোহাগ জানান, মেহেরনগরের ইকবাল হোসেন, সাইফুল ইসলাম, রহমত উল্লাহ ও অলি উল্লাহর মতো অনেকেই প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এ চারজনের মধ্যে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন সাইফুল ইসলাম। সৌদি আরব যাওয়ার পর সাইফুলকে তায়েফে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কাজ দেওয়ার কথা বলে রাখা হয় একটি সুরক্ষিত জায়গায়। প্রথমে বলা হয়েছিল, কাজ না পাওয়া পর্যন্ত থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা দালালেরাই করবে। কিন্তু প্রথম ১৫ দিন তাঁকে খাবার দেওয়া হতো এক বেলা। এরপর বলা হয় একটি ভালো কাজ আছে, কিন্তু সেজন্য ১ লাখ টাকা অতিরিক্ত দিতে হবে। এ টাকা দিতে রাজি না থাকায় সাইফুলকে কয়েক দিন খাবারই দেওয়া হয়নি। এরপর দালালেরা তাঁকে একটি রেস্তোরাঁয় কাজ দেয়। সাইফুল পরে জানতে পারেন, তাঁকে দুই হাজার রিয়ালে ওই রেস্তোরাঁর কাছে বিক্রি করা হয়েছে। তাঁকে ওই রেস্তোরাঁয় প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। বেতন দেওয়া হয় সামান্য।

জানা গেছে, এ চক্রে বাংলাদেশের প্রধান দালাল হিসেবে কাজ করেন রায়পুরার আল-আমিন। তিনি নিয়মিত সৌদি আরবে যাতায়াত করেন। তাঁর সহকারী হিসেবে কাজ করেন একই এলাকার রব মিয়া, যিনি বর্তমানে পলাতক। শুধু সোহাগ বা সাইফুল নন, এমন আরও শত শত প্রবাসী এ ধরনের চক্রের হাতে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন।

প্রবাসীদের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রতারণার শিকার কয়েক শ প্রবাসীকে মাস খানেক আগে তায়েফের একটি নির্জন পাহাড়ি এলাকায় একত্র করে দালালেরা। এরপর ভালো কাজ পাইয়ে দেয়ার আশ্বাসে তাদের কাছে আবার টাকা দাবি করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দালালের সঙ্গে কথা হয় বণিক বার্তার। তিনি বলেন, ‘দালালেরা প্রথমে কৌশলে ভিসা সংগ্রহ করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টাকার প্রলোভনে কাজটি করেন। অনেক সৌদি নাগরিক আছেন, যারা অসৎ ও অর্থলোভী। মূলত তাদের কাজে লাগান দালালেরা। এসব সৌদি নাগরিক নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ভিসা দেয়। এসব সস্তা ভিসা নিয়ে তা কয়েক গুণ টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশিদের কাছে বিক্রি করেন দালালেরা। বিক্রি করার সময় ভালো কাজ ও মোটা অংকের বেতনের প্রতিশ্রুতি দেন তারা। এরপর যখন বাংলাদেশিরা সৌদি আরবে যান, তখন না খুঁজে পান কোম্পানি, না খুঁজে পান কফিল তথা স্পন্সর। কারণ তারা অর্থ হাসিল করেই লাপাত্তা হয়ে যান। দালালেরাও চম্পট দেন।’

একজন প্রবাসী কর্মীর অনেক কিছুর নিয়ন্ত্রণ থাকে কথিত স্পন্সরের হাতে। এমনও হয়, অনেক স্পন্সর প্রবাসী কর্মীর বিরুদ্ধে বানোয়াট অভিযোগ তোলেন। ফলে এসব শ্রমিকের ভাগ্যে প্রত্যাশিত কাজ তো মেলেই না, উল্টো তারা অপরাধী হিসেবে পরিগণিত হয়ে সৌদিতে থাকার অযোগ্য হয়ে পড়েন।

অভিযোগ আছে, অনেক দালাল ১৫ মাসের ইকামা দেওয়ার কথা বলে তিন মাসের ভ্রমণ ভিসায় প্রবাসীদের সৌদি আরবে নিয়ে যান। এরপর কোনো একটি অস্থায়ী কাজে যুক্ত করে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেন তারা। ফলে তিন মাস পর এসব শ্রমিক অবৈধ হয়ে পড়েন।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, চলতি বছর আগস্ট পর্যন্ত সৌদি আরবে গেছেন ৩ লাখ ৩০ হাজার ১৩৪ কর্মী। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৬১ হাজার ৭২৬, ২০২১ সালে ৪ লাখ ৫৭ হাজার ২২৭, ২০২২ সালে ৬ লাখ ১২ হাজার ৪১৮ ও ২০২৩ সালে ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৬৭৪।

মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। দেশটিতে সবচেয়ে বেশি কর্মী যাওয়ায় সৌদির অসৎ মালিকদের যোগসাজশে শত শত বাংলাদেশিকে ভুয়া ভিসার ফাঁদে ফেলছে দালাল চক্র। বণিক বার্তার সঙ্গে কথা হয় গাজীপুরের সাব্বীর হোসেন, চট্টগ্রামের আবদুল্লাহ ও নোয়াখালীর খলিলুর রহমানের। আবদুল্লাহ জানান, তিনি ফেনীর দালাল ইস্কান্দার আলীর মাধ্যমে সৌদি আরবে যান। তারা প্রতারণার শিকার হয়ে অবৈধ শ্রমিক হিসেবে এক বছর ধরে জেদ্দার একটি রেস্তারাঁয় কাজ করছেন।

ভিসা প্রতারণার আরও অনেক ধরন রয়েছে। কোম্পানির পরিবর্তে ব্যক্তিগত ভিসায় যারা সৌদি যান, তাদেরও ভুগতে হয়। এসব ক্ষেত্রে দালালরা প্রথমে হাউজ ড্রাইভিং ও গৃহস্থালির কাজের জন্য ভিসা দেন। কিন্তু পরে দেখা যায়, যাদের বিপরীতে ভিসা নেয়া হয়, তাদের কোনো ড্রাইভার বা গৃহকর্মীর প্রয়োজনই নেই। ফলে এসব ভিসা নিয়ে যারা যান, তারা মূলত বেকার থাকেন। এ ভিসায় অন্য কোথাও কাজ করা আবার দণ্ডনীয় অপরাধ। তখন এ ধরনের প্রবাসী শ্রমিকদের মাধ্যমে নতুন প্রতারণা শুরু করে দালালেরা। তারা এসব প্রবাসীকে নামমাত্র বেতনে কঠিন পরিশ্রমের কাজে বাধ্য করান।

বণিক বার্তার সঙ্গে কথা হয় ভুক্তভোগী আহমাদ নাকীবের। তিনি বর্তমানে তায়েফের মিক্কাত সেইল আল কাবিরে হকার হয়ে ওমরা সামগ্রী বিক্রি করছেন।

নাকীব সৌদি আরব যান লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার দালাল তামিনুল ইসলাম নাদিমের মাধ্যমে। নাকীব বলেন, ‘অবৈধ হয়ে পড়া প্রবাসীরা তাদের পরিস্থিতির ব্যাপারে কথা বলতে গেলেই শুরু হয় দালালদের নির্যাতন। তারা গালাগালি করে, মারধর করার হুমকি দেয়। বাংলাদেশে থাকা স্বজনদের ফোন করে হুমকি দেওয়া হয়।

নাকীব জানান, তাঁর ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতিও হয়েছে যে তাঁর পরিবারকে দালাল ফোন করে বলেছে যে আজ রাতের মধ্যে তাঁকে চুরির অপবাদে পুলিশে দেওয়া হবে, যেন জেল থেকে বের হতে না পারে।

বণিক বার্তার সঙ্গে কথা হয় রিক্রুটিং এজেন্সি উজ্জল এভিয়েশনের। এ এজেন্সির মাধ্যমেই কাগজপত্র তৈরি করেন প্রতারণার শিকার হওয়া সোহাগ। এ এজেন্সির কর্মী সুমন জানান, তারা শুধু কাগজপত্র প্রস্তুত করে দেন। কোন ভিসায় গেল, গিয়ে কী কাজ পেল, তা তাদের দেখার বিষয় নয়। এটার সমাধান করতে হলে মূল যিনি ভিসি দেন, তাকে ধরতে হবে।

অভিবাসন ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দূতাবাস সহায়তা করুক বা না করুক, প্রবাসীদের উচিত সেখানে অভিযোগ জানানো। সম্ভব হলে বিএমইটিতেও করতে হবে। একটি হেল্প লাইন আছে সেটাতেও চেষ্টা করা উচিত। যদিও আমরা শুনি এগুলো খুব বেশি কাজে দেয় না।’

তিনি বলেন, ‘এসব ঘটনার ক্ষেত্রে বিএমইটির তদন্ত করা উচিত। দূতাবাসেরও তদন্ত করা উচিত। এ ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত, সৌদিতে কারা জড়িত, দেশে কারা জড়িত, এগুলো বের করা উচিত। এ ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতাও জরুরি।’

আসিফ মুনীর মনে করেন, ‘প্রতারণা কমাতে ভবিষ্যতের জন্য পুরো প্রক্রিয়াই অনলাইনের অধীনে আনা দরকার। অনেকে দেশেই তা হচ্ছে। অনলাইনভিত্তিক হলে যেখানেই গলদ থাকুক না কেন, তা শনাক্ত করা যায়।’

সূত্র: বণিক বার্তা (প্রতিবেদন: শফিকুল ইসলাম), ১ অক্টোবর ২০২৪

আরও পড়ুন

৭ দলের সঙ্গে আগামীকাল বৈঠক করবেন প্রধান উপদেষ্টা

৭ দলের সঙ্গে আগামীকাল বৈঠক করবেন প্রধান উপদেষ্টা

আগামীকাল মঙ্গলবার (২ আগস্ট) আরও ৭টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় এ বৈঠক হবে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

১৪ মিনিট আগে

বিএনপির ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ

বিএনপির ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ ১ সেপ্টেম্বর। এ উপলক্ষে আলোচনা সভা, শোভাযাত্রাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে দলটি। সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের এই দিনে বিএনপি গঠন করেন। তিনি ছিলেন দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।

৩ ঘণ্টা আগে

হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি আখতারুজ্জামানের পদত্যাগ

হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি আখতারুজ্জামানের পদত্যাগ

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামান পদত্যাগ করছেন। আজ রোববার (৩১ আগস্ট) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে নিজ স্বাক্ষরযুক্ত পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন তিনি।

১ দিন আগে

যমুনায় ৩ দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার জরুরি বৈঠক আজ

যমুনায় ৩ দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার জরুরি বৈঠক আজ

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এ পরিস্থিতিতে আজ রোববার (৩১ আগস্ট) বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে বিশেষ বৈঠক করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

১ দিন আগে