

ফারহানা আহমেদ লিসা

প্রবাসে আমার কর্মস্থল একটি হাসপাতালে। আমি চিকিৎসক। ৯ ডিসেম্বর আমি হাসপাতালে ডিউটিতে ছিলাম। সেদিন ছিল মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্ম ও মৃত্যু দিন।
ওই দিন হাসপাতালে এক রোগীর ইমার্জেন্সি সার্জারি লাগবে। কল করে এক নারী সার্জনের সঙ্গে কথা বললাম। একটু পর ভাসকুলার সার্জনের সঙ্গে রোগীর বিষয়ে আলাপ ছাড়াও কবে ছুটি নেব এবং তার দিনকাল কেমন চলছে আলাপ করতে গিয়ে দেখলাম বেশির ভাগ সাব স্পেশালিটিতে অনকল এখন নারী ডাক্তাররা।
সমাজ সংস্কারক, চিন্তাবিদ, ঔপন্যাসিক বেগম রোকেয়া অন্ধকার ঘরে বসে প্রকৃত দাম না পাওয়া মেয়েদের জন্য যে পথ তৈরি করে গেছেন, আজকের এই দিনে তিনি হয়তো আমাদের দেখে অনেক খুশি হতেন।
বেগম রোকেয়া ১৯০৪ সালে লিখেছিলেন ‘সুলতানার গল্প’, যেখানে ছিল কাল্পনিক আদর্শ নারীবাদি সমাজের গল্প। রংপুরের পায়রাবন্দের শিক্ষিত জমিদার বংশের মেয়ের প্রজ্ঞা এত বেশি ছিল, বুঝে গিয়েছিলেন যোগ্য সন্মান দিলে ক্ষতি নেই। সংসার সুন্দর আনন্দময় হয়। আর ‘অবরোধবাসিনী’–তে বলে গেছেন কটাক্ষ করে কাউকে কষ্ট ও অবহেলা করলে আর যাই হোক তার হৃদয়ে ভালোবাসা আর সন্মানের জায়গা করে নেওয়া যায় না।
একই দিন দুপুরের দিকে এক বন্ধু ফোন দিল। ওর ছেলের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছে, মন খারাপ।
বললাম, ‘কেন কী বলেছে বাবু?’
বন্ধু বলল, ‘কোথা থেকে শুনে এসেছে ইসলামে চার বিয়ে জায়েজ, আমাকে বলেছে। মাত্র ১১ বছরের শিশু যদি এমন কথা বলে!’
বললাম, ‘বাবুকে বলো, মায়ের পায়ের তলায় বেহেস্ত। এতবড় সন্মানের কথা যে ধর্মে বলা হয়েছে, সে ধর্মে যেনতেন হেন কারণে চার বিয়ে জায়েজ এমন কথা সরাসরি কোথায় লেখা আছে?
‘পুরো কোরআনজুড়ে বিভিন্ন ঘটনার ঘটার পর আয়াত নাজিল হয়েছে একটা পুরো জীবনব্যবস্থা দেওয়ার জন্য। আমাদের রাসুল (সা.)–এর জীবনী আমাদের অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। যে জীবনে যুদ্ধ ছিল, হিজরতও ছিল, বিজয়ের পুরো সামর্থ থাকার পরও মক্কা বিজয় না করে ফিরে আসা এবং পরবর্তীতে মক্কা বিজয়ও ছিল। যুদ্ধে পুরুষ লোক কমে যাওয়ায় আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে দাসী, বিধবাসহ সন্মানিত নারীরা যাতে স্ত্রীর মর্যাদা পেতে পারেন সেটা বোঝানো হয়েছে। মানুষ সবাইকে সমানভাবে দেখতে পারবে না বলে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে বহু বিবাহ। ধর্মে কোথাও সরাসরি মানুষকে অসন্মান করতে বলা হয়নি, সেটা নারী বা পুরুষ যেই হোক। অসুস্থ মানসিকতা বহু বিয়ে, পরকিয়া, অনাচার বা অত্যাচার করাকে ধর্মের নামে কিছু লোক জায়েজ করার চেষ্টা করছে।
‘তাই বেগম রোকেয়া লিখে গেছেন, “ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমনীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন”।
‘বাবু বড় হলে বুঝিয়ে বলবে কাউকে অসন্মান করে জীবনে সুখী হওয়া যায় না। সৃষ্টিকর্তার কাছাকাছি যাওয়া যায় না। আর শারীরিক ক্ষমতা বা বিত্তের ক্ষমতা খুব ক্ষণস্থায়ী।’

এর মাঝে নার্স একটা কার্ড দিয়ে গেল। এক রোগীর লোক পৌঁছে গিয়েছেন হাসপাতালে। একজন প্রবল ক্ষমতাশীল লোক মারা যাবার আগে জীবনের শেষ কয়েকটা দিন একটু আরামে কাটাতে পারার জন্য আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে লিখে গেছেন খুব সুন্দর কিছু কথা। সেটা বন্ধুকে পড়ে শোনালাম। তারপর বন্ধুকে বললাম, বাবুকে বুঝিয়ে আদর করে ধৈর্য় নিয়ে বড় করতে। ও যে সিঙ্গেল মা, ওকে পারতে হবে।
কাজ করতে করতে রাত হয়ে আসছে। জানালার বাইরের অন্ধকারে মনে হচ্ছে ছোট্ট বেগম রেকেয়া মোমের আলোয় লুকিয়ে ভাইয়ের কাছে পড়ছেন, শিখছেন। ১৯০২ সাল থেকেই বিভিন্ন পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হতে শুরু করে। কুসংস্কারমুক্ত এবং মুক্ত মনের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় ইংরেজি ভাষাতেও তার দক্ষতা বাড়ে।
স্বামীর মৃত্যুর পর তার টাকায় প্রথম ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ১৯১৬ সালে মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন তৈরি করেন। ১৯৩০ সালে মুসলিম বাংলা সম্মেলনে বাংলা ভাষার পক্ষে বক্তব্য দেন। বিজয়ের মাসে বাংলাভাষী তার একজন উত্তরসুরী আমি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে আমেরিকায় বসে কাজ করছি আর তাঁকে স্মরণ করছি।
সাহিত্য কর্ম আর সমাজ সংস্কারক তাকে পরিণত বয়সে তার স্বামী দেখে যেতে পারেননি। কত আনন্দিতই না তিনি হতেন। আসলে নারী বা পুরুষ অনেকে অপরের পরিপূরক, প্রতিদ্বন্দ্বী নন, এটা যত তাড়াতাড়ি সবাই বোঝেন ততই ভালো।
মাত্র ৫২ বছর বয়সে মারা যান তিনি। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি বেগম রোকেয়াকে। রংপুরে তার স্মৃতি কেন্দ্রের গবেষণা কক্ষ, লাইব্রেরিতে ঘুরে আসার স্বপ্ন নিয়ে আজকের মতো বাসার পথে ফিরে চলেছি।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
*ফারহানা আহমেদ লিসা: সান ডিয়াগো, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র

প্রবাসে আমার কর্মস্থল একটি হাসপাতালে। আমি চিকিৎসক। ৯ ডিসেম্বর আমি হাসপাতালে ডিউটিতে ছিলাম। সেদিন ছিল মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্ম ও মৃত্যু দিন।
ওই দিন হাসপাতালে এক রোগীর ইমার্জেন্সি সার্জারি লাগবে। কল করে এক নারী সার্জনের সঙ্গে কথা বললাম। একটু পর ভাসকুলার সার্জনের সঙ্গে রোগীর বিষয়ে আলাপ ছাড়াও কবে ছুটি নেব এবং তার দিনকাল কেমন চলছে আলাপ করতে গিয়ে দেখলাম বেশির ভাগ সাব স্পেশালিটিতে অনকল এখন নারী ডাক্তাররা।
সমাজ সংস্কারক, চিন্তাবিদ, ঔপন্যাসিক বেগম রোকেয়া অন্ধকার ঘরে বসে প্রকৃত দাম না পাওয়া মেয়েদের জন্য যে পথ তৈরি করে গেছেন, আজকের এই দিনে তিনি হয়তো আমাদের দেখে অনেক খুশি হতেন।
বেগম রোকেয়া ১৯০৪ সালে লিখেছিলেন ‘সুলতানার গল্প’, যেখানে ছিল কাল্পনিক আদর্শ নারীবাদি সমাজের গল্প। রংপুরের পায়রাবন্দের শিক্ষিত জমিদার বংশের মেয়ের প্রজ্ঞা এত বেশি ছিল, বুঝে গিয়েছিলেন যোগ্য সন্মান দিলে ক্ষতি নেই। সংসার সুন্দর আনন্দময় হয়। আর ‘অবরোধবাসিনী’–তে বলে গেছেন কটাক্ষ করে কাউকে কষ্ট ও অবহেলা করলে আর যাই হোক তার হৃদয়ে ভালোবাসা আর সন্মানের জায়গা করে নেওয়া যায় না।
একই দিন দুপুরের দিকে এক বন্ধু ফোন দিল। ওর ছেলের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছে, মন খারাপ।
বললাম, ‘কেন কী বলেছে বাবু?’
বন্ধু বলল, ‘কোথা থেকে শুনে এসেছে ইসলামে চার বিয়ে জায়েজ, আমাকে বলেছে। মাত্র ১১ বছরের শিশু যদি এমন কথা বলে!’
বললাম, ‘বাবুকে বলো, মায়ের পায়ের তলায় বেহেস্ত। এতবড় সন্মানের কথা যে ধর্মে বলা হয়েছে, সে ধর্মে যেনতেন হেন কারণে চার বিয়ে জায়েজ এমন কথা সরাসরি কোথায় লেখা আছে?
‘পুরো কোরআনজুড়ে বিভিন্ন ঘটনার ঘটার পর আয়াত নাজিল হয়েছে একটা পুরো জীবনব্যবস্থা দেওয়ার জন্য। আমাদের রাসুল (সা.)–এর জীবনী আমাদের অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। যে জীবনে যুদ্ধ ছিল, হিজরতও ছিল, বিজয়ের পুরো সামর্থ থাকার পরও মক্কা বিজয় না করে ফিরে আসা এবং পরবর্তীতে মক্কা বিজয়ও ছিল। যুদ্ধে পুরুষ লোক কমে যাওয়ায় আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে দাসী, বিধবাসহ সন্মানিত নারীরা যাতে স্ত্রীর মর্যাদা পেতে পারেন সেটা বোঝানো হয়েছে। মানুষ সবাইকে সমানভাবে দেখতে পারবে না বলে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে বহু বিবাহ। ধর্মে কোথাও সরাসরি মানুষকে অসন্মান করতে বলা হয়নি, সেটা নারী বা পুরুষ যেই হোক। অসুস্থ মানসিকতা বহু বিয়ে, পরকিয়া, অনাচার বা অত্যাচার করাকে ধর্মের নামে কিছু লোক জায়েজ করার চেষ্টা করছে।
‘তাই বেগম রোকেয়া লিখে গেছেন, “ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমনীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন”।
‘বাবু বড় হলে বুঝিয়ে বলবে কাউকে অসন্মান করে জীবনে সুখী হওয়া যায় না। সৃষ্টিকর্তার কাছাকাছি যাওয়া যায় না। আর শারীরিক ক্ষমতা বা বিত্তের ক্ষমতা খুব ক্ষণস্থায়ী।’

এর মাঝে নার্স একটা কার্ড দিয়ে গেল। এক রোগীর লোক পৌঁছে গিয়েছেন হাসপাতালে। একজন প্রবল ক্ষমতাশীল লোক মারা যাবার আগে জীবনের শেষ কয়েকটা দিন একটু আরামে কাটাতে পারার জন্য আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে লিখে গেছেন খুব সুন্দর কিছু কথা। সেটা বন্ধুকে পড়ে শোনালাম। তারপর বন্ধুকে বললাম, বাবুকে বুঝিয়ে আদর করে ধৈর্য় নিয়ে বড় করতে। ও যে সিঙ্গেল মা, ওকে পারতে হবে।
কাজ করতে করতে রাত হয়ে আসছে। জানালার বাইরের অন্ধকারে মনে হচ্ছে ছোট্ট বেগম রেকেয়া মোমের আলোয় লুকিয়ে ভাইয়ের কাছে পড়ছেন, শিখছেন। ১৯০২ সাল থেকেই বিভিন্ন পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হতে শুরু করে। কুসংস্কারমুক্ত এবং মুক্ত মনের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় ইংরেজি ভাষাতেও তার দক্ষতা বাড়ে।
স্বামীর মৃত্যুর পর তার টাকায় প্রথম ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ১৯১৬ সালে মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন তৈরি করেন। ১৯৩০ সালে মুসলিম বাংলা সম্মেলনে বাংলা ভাষার পক্ষে বক্তব্য দেন। বিজয়ের মাসে বাংলাভাষী তার একজন উত্তরসুরী আমি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে আমেরিকায় বসে কাজ করছি আর তাঁকে স্মরণ করছি।
সাহিত্য কর্ম আর সমাজ সংস্কারক তাকে পরিণত বয়সে তার স্বামী দেখে যেতে পারেননি। কত আনন্দিতই না তিনি হতেন। আসলে নারী বা পুরুষ অনেকে অপরের পরিপূরক, প্রতিদ্বন্দ্বী নন, এটা যত তাড়াতাড়ি সবাই বোঝেন ততই ভালো।
মাত্র ৫২ বছর বয়সে মারা যান তিনি। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি বেগম রোকেয়াকে। রংপুরে তার স্মৃতি কেন্দ্রের গবেষণা কক্ষ, লাইব্রেরিতে ঘুরে আসার স্বপ্ন নিয়ে আজকের মতো বাসার পথে ফিরে চলেছি।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
*ফারহানা আহমেদ লিসা: সান ডিয়াগো, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র
সাহিত্য কর্ম আর সমাজ সংস্কারক তাকে পরিণত বয়সে তার স্বামী দেখে যেতে পারেননি। কত আনন্দিতই না তিনি হতেন। আসলে নারী বা পুরুষ অনেকে অপরের পরিপূরক, প্রতিদ্বন্দ্বী নন, এটা যত তাড়াতাড়ি সবাই বোঝেন ততই ভালো।
বুলাকআজ প্রায় ৮ হাজার ৫০০ বাংলা বই আছে। ফরাসি ও ইংরেজি অনুবাদ এবং কলকাতার বই মিলিয়ে এই সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এখানে রয়েছে—বাংলা ছাপাখানার প্রারম্ভিক বাংলা মুদ্রণ, দুর্লভ পাণ্ডুলিপি, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রকাশিত অসংখ্য গবেষণাধর্মী বই।
লন্ডন তখন ছিল প্রাণচঞ্চল—নাট্যশালা, সংগীত, কবি, রাজনীতি, শিল্প—সব মিলিয়ে এক মাথা ঘোরানো পৃথিবী। সেখানে প্রথমে উইলিয়াম খুব সাধারণ কাজ করত—কেউ বলে ঘোড়ার দেখাশোনা, কেউ বলে মঞ্চ সাজানোর কাজ। কিন্তু তার মন লিখতে চাইত, আর চোখ ছিল ভবিষ্যতের দিকে।
বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও গবেষণায় বিনিয়োগ এখনো সন্তোষজনক নয়। তবে কৃষিক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়। অন্য ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন গবেষণা থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। প্রযুক্তি, চিকিৎসা, সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ, খনিজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থাপনায় এখনো বড় ঘাটতি আছে।