বিডিজেন ডেস্ক
শিক্ষা আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে বর্তমান ও ভবিষ্যতের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার উদ্দেশ্য এবং ধরন সম্পর্কে কিছু মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসে। কী ধরনের শিক্ষা প্রয়োজন, কেন শিক্ষা প্রয়োজন এবং কীভাবে শিক্ষা প্রদান করা উচিত? বর্তমান সমাজ এবং ভবিষ্যত প্রযুক্তির দিকে নজর রেখে, শিক্ষাব্যবস্থার এই প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর খোঁজা অত্যন্ত জরুরি।
শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র জ্ঞান অর্জন বা পরীক্ষায় পাস করা নয়। বরং এটি একজন ব্যক্তি, সমাজ এবং জাতির অগ্রগতির জন্য একটি শক্তিশালী মাধ্যম হতে হবে। আমরা এখন একটি দ্রুত পরিবর্তিত পৃথিবীতে বাস করছি। যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং অন্য প্রযুক্তি দ্রুত নতুন দক্ষতার প্রয়োজন সৃষ্টি করছে। তাই আমাদের শিক্ষার ধরনেও এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানানসই রূপান্তর আনা জরুরি।
আজকের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকেরা সাধারণত ‘পড়তে’ ও ‘শেখাতে’ আগ্রহী। তবে ভবিষ্যতের শিক্ষায় শুধু পড়া নয়, শেখার পর তা প্রয়োগ করা বা ‘করা’ও সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তি যেমন এআই, ভার্চুয়াল রিয়ালিটি এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে শিক্ষার পদ্ধতি আরও কার্যকর ও বহুল মানুষের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম। এই প্রযুক্তি শিক্ষাকে ইন্টারেক্টিভ এবং সবার জন্য আরও অ্যাক্সেসযোগ্য করে তুলছে। অর্থাৎ শিক্ষার ধরন হতে হবে ‘দেখে, করে এবং পড়ে’—এভাবে একটি সমন্বিত পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পুরোপুরি দক্ষ হয়ে উঠবে।
বর্তমানে আমাদের সমাজের শিক্ষাব্যবস্থায় যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো ‘কর্মমুখী শিক্ষা’। তবে শুধু কর্মমুখী শিক্ষা নয়, আমাদের এমন শিক্ষা চাই যা প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত এবং সমাজের চাহিদা অনুযায়ী চাকরি বা কাজের ক্ষেত্র তৈরি করতে সহায়ক হয়। যদি সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এমন একটি কাঠামো তৈরি করতে পারে যেখানে এআই, রোবটিক্স ও ডিজিটাল লিটারেসি অন্তর্ভুক্ত থাকবে, তাহলে শিক্ষার্থীরা একটি আধুনিক ও প্রযুক্তিগত দুনিয়ার জন্য প্রস্তুত হতে পারবে।
অন্যদিকে শিক্ষকতা শুধুমাত্র একটি পেশা নয়; এটি মানবতার উন্নতির প্রতি আজীবন নিবেদন। একজন প্রকৃত শিক্ষক শুধু জ্ঞান প্রদান করেন না, বরং কৌতূহলকে উসকে দেন, চরিত্র গঠনে সহায়তা করেন এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে শেখার প্রতি গভীর ভালোবাসা ও আগ্রহ তৈরি করেন। এই মহান পেশা কোনো সমাজের অগ্রগতি ও উন্নয়নের মূল ভিত্তি। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে শিক্ষাদানের প্রকৃত লক্ষ্য অনেক ক্ষেত্রেই বাণিজ্যিকীকরণ, দুর্নীতি ও আত্মস্বার্থের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে সৃজনশীল ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের অভাব একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষকের ভূমিকা শুধুমাত্র পরীক্ষায় ভালো ফলাফল নিশ্চিত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষক সেই ব্যক্তি, যিনি শিক্ষার্থীদের হৃদয় ও মনের গভীরে স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারেন। প্রশ্ন হলো, কীভাবে আমরা এমন আদর্শ শিক্ষকদের সৃষ্টি ও সংরক্ষণ করব, যারা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সত্যিই যত্নশীল?
আমার বড় ভাই প্রফেসর ড. মান্নান মৃধা, সুইডেনের কেটিএইচ রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক। তাঁর শিক্ষাদর্শন একটি অনুপ্রেরণার উদাহরণ। তাঁর অভিজ্ঞতা প্রকৃত শিক্ষাদানের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
আমার বড় ভাইয়ের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, কীভাবে একজন শিক্ষক প্রচলিত পাঠদানের সীমাবদ্ধতাকে ভেঙে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসতে পারেন। তার পদ্ধতিতে বিষয়ের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি এবং আবেগের সংযোগ তৈরির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শেখার অভিজ্ঞতাকে আনন্দময় ও অর্থবহ করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ, তিনি বাস্তব জীবনের উদাহরণ ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের জটিল বিষয়গুলো বোঝান। এটি তাদের কৌতূহল ও সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনাকে উৎসাহিত করে। তাঁর পদ্ধতিগুলো দেখিয়েছে, কীভাবে একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক শিক্ষার্থীর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলতে পারেন।
তবে, শিক্ষা শুধুমাত্র চাকরি বা কর্মমুখী শিক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। সামাজিক ও ব্যক্তিগত উন্নতিও গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরকারের উচিত জনগণের করের টাকা খরচ করে যে শিক্ষার্থীদের পাঠানো হচ্ছে, তাদের জন্য শিক্ষার একটি বাস্তব ও টেকসই উদ্দেশ্য তৈরি করা। তারা যে শিক্ষা গ্রহণ করছে, তা কীভাবে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগবে, সেটি ভাবা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে, এআই-এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি কেবলমাত্র শিক্ষার মান উন্নত করতে সাহায্য করবে না, বরং শিক্ষার্থীদের নিজস্ব গতি এবং ক্ষমতা অনুযায়ী শিক্ষা প্রদান করে তাদের প্রকৃত প্রতিভা বিকশিত করতে সহায়তা করবে।
শিশুদের প্রথম পাঠ শুধুমাত্র বইয়ের পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়; বরং তাদের স্বপ্ন, কল্পনা ও স্বাধীন চিন্তাকে বিকশিত করতে হবে। আমার শিক্ষক বড় ভাইয়ের মতে, শৈশব থেকেই যদি শিশুদের শেখার আনন্দ না দেওয়া হয়, তবে তাদের ভবিষ্যৎ সৃজনশীলতা বাধাগ্রস্ত হয়। তাঁর মতামত থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা বলতে পারি:
ক. শিশুশিক্ষায় মজার উপায়ে পাঠদান করা জরুরি।
খ. খেলাধুলা, গল্প বলা ও ব্যবহারিক উদাহরণ শেখার অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করতে পারে।
গ. শিশুর কৌতূহল ও ব্যক্তিগত আগ্রহকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু আমার শিক্ষক বড় ভাই দেখিয়েছেন যে, এটি মজার মাধ্যমে সম্ভব। তার কিছু উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি—
ক, খেলাধুলার মাধ্যমে শেখানো: পাঠ্যবিষয়ের ধারণাগুলোকে খেলার সঙ্গে যুক্ত করা।
খ. ব্যক্তিগত আগ্রহ আবিষ্কার: শিক্ষার্থীদের নিজস্ব প্রবণতা ও ক্ষমতাকে কাজে লাগানো।
গ. বাস্তব উদাহরণ: ক্লাসরুমের তত্ত্বের বাইরে বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধানে শিক্ষার্থীদের জড়িত করা।
আজকের শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষামুখী কাঠামো এবং মুখস্থ নির্ভরতা শিশুদের সৃজনশীলতাকে দমন করছে। বড় ভাইয়ের উদাহরণ আমাদের শেখায়—
ক. শিক্ষকদের সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী হতে হবে।
থ. প্রযুক্তির সাহায্যে শিক্ষাকে আরও আধুনিক করতে হবে।
গ. পরীক্ষার চাপে শিক্ষার্থীদের দমিয়ে না রেখে তাদের প্রকৃত দক্ষতার মূল্যায়ন করতে হবে।
বড় ভাইয়ের মতো আদর্শ শিক্ষকেরা শিক্ষাদানকে আনন্দময় ও বাস্তব জীবনের উপযোগী করে তোলেন। এই ধরনের শিক্ষকেরা প্রমাণ করেছেন যে, শিক্ষাদান কেবল একটি পেশা নয়, এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ার একটি মহান দায়িত্ব। তারা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার নতুন পথ দেখানোর অনুপ্রেরণা।
একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শিক্ষার্থীদের সহজ শর্তে পড়াশোনার জন্য ঋণ (স্টাডি লোন) প্রদান। এটি বিশেষভাবে দরকার বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য। যেখানে অধিকাংশ শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষার জন্য বাবা-মার ওপর নির্ভরশীল। দেশের সরকার যদি খুব অল্প সুদে পড়াশোনার জন্য ঋণ প্রদান করে, তবে শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনার খরচ নিজেই মেটাতে পারবে এবং কর্মজীবন শুরু করার পর তারা ধীরে ধীরে এই ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হবে। এই ব্যবস্থা কেবলমাত্র শিক্ষার্থীদের আত্মনির্ভরশীলতা বাড়াবে না, বরং তারা দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার সময় ঋণ পরিশোধের মাধ্যমে রাষ্ট্রের পুনঃবিনিয়োগের সুযোগও সৃষ্টি করবে। এভাবে, ‘বার্নিং বাই আর্নিং’ কনসেপ্ট কার্যকর হবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের পরিশ্রমের মাধ্যমে রাষ্ট্রের খরচ ফিরে আসতে সহায়ক হবে। এতে শিক্ষার আউটকাম শুধু কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং বাস্তবায়িত হবে।
উন্নত দেশে পরিণত হতে সরকার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একযোগে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, ভবিষ্যতে আমাদের দেশের জনগণের প্রয়োজনীয়তা কী হবে? আমাদের দেশে কোথায় কোথায় দক্ষ জনবল প্রয়োজন? কেমন দক্ষ জনবল প্রয়োজন তা আমরা কীভাবে নিশ্চিত করতে পারি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করার জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে বর্তমান বিশ্বের চাহিদা এবং ভবিষ্যতের অগ্রগতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে গড়ে তুলতে হবে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও উন্নত ও কার্যকর করতে হবে। শুধু পাঠ্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, ছাত্রদের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তা, সৃজনশীলতা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা তৈরি করা আবশ্যক। এটি নিশ্চিত করতে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও পেশাগত উন্নয়ন অপরিহার্য। তাদেরকে আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি, প্রযুক্তি, এবং উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষকেরা যদি শিক্ষার্থীদের মানসিক ও বুদ্ধিগত বিকাশে অবদান রাখতে পারেন, তাহলে কেবলমাত্র তারা আগামী দিনের সেরা নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। আজকের শিক্ষকেরা, যারা শিক্ষার্থীদের শুধু পঠন-পাঠন শেখান, তাদের জন্য শিক্ষকতার কাজ এক ধরনের দায়িত্ব, যা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই কারণে, শিক্ষককে শুধুমাত্র জ্ঞানী হতে হবে না, তাকে একজন অনুপ্রেরণাদায়কও হতে হবে। একজন আদর্শ শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের শুধু পাঠ্যবিষয়ে সাহায্য করেন না, তিনি তাদের মানসিক বিকাশ, আত্মবিশ্বাস, এবং জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য অনুপ্রাণিত করেন।
এ ছাড়া, সরকার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত শিক্ষাব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশন ও আধুনিকীকরণে আরও বিনিয়োগ করা, যাতে একদিকে শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তিগত দক্ষতায় উন্নতি করতে পারে, অন্যদিকে শিক্ষকেরা তাদের পদ্ধতিতে উদ্ভাবনী ধারণা প্রয়োগ করতে সক্ষম হন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদেরও ডিজিটাল শিক্ষার সুবিধা প্রদান করা জরুরি, যাতে তারা শহরের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারে।
এটি শুধু সরকারের নয়, আমাদের সবার দায়িত্ব, যেন ভবিষ্যত প্রজন্ম একটি উন্নত, প্রযুক্তি-সচেতন এবং নৈতিকভাবে শক্তিশালী সমাজে পদার্পণ করতে পারে।
সবশেষে, আমরা যদি শিক্ষা ও শিক্ষকতার মাধ্যমে সমাজের প্রকৃত অগ্রগতি নিশ্চিত করতে চাই, তবে আমাদেরকে একটি সুশৃঙ্খল, সহনশীল, এবং সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে প্রতিটি শিক্ষার্থী নিজের সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করে এবং সে অনুযায়ী আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
—রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
ইমেইল: [email protected]
শিক্ষা আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে বর্তমান ও ভবিষ্যতের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার উদ্দেশ্য এবং ধরন সম্পর্কে কিছু মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসে। কী ধরনের শিক্ষা প্রয়োজন, কেন শিক্ষা প্রয়োজন এবং কীভাবে শিক্ষা প্রদান করা উচিত? বর্তমান সমাজ এবং ভবিষ্যত প্রযুক্তির দিকে নজর রেখে, শিক্ষাব্যবস্থার এই প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর খোঁজা অত্যন্ত জরুরি।
শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র জ্ঞান অর্জন বা পরীক্ষায় পাস করা নয়। বরং এটি একজন ব্যক্তি, সমাজ এবং জাতির অগ্রগতির জন্য একটি শক্তিশালী মাধ্যম হতে হবে। আমরা এখন একটি দ্রুত পরিবর্তিত পৃথিবীতে বাস করছি। যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং অন্য প্রযুক্তি দ্রুত নতুন দক্ষতার প্রয়োজন সৃষ্টি করছে। তাই আমাদের শিক্ষার ধরনেও এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানানসই রূপান্তর আনা জরুরি।
আজকের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকেরা সাধারণত ‘পড়তে’ ও ‘শেখাতে’ আগ্রহী। তবে ভবিষ্যতের শিক্ষায় শুধু পড়া নয়, শেখার পর তা প্রয়োগ করা বা ‘করা’ও সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তি যেমন এআই, ভার্চুয়াল রিয়ালিটি এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে শিক্ষার পদ্ধতি আরও কার্যকর ও বহুল মানুষের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম। এই প্রযুক্তি শিক্ষাকে ইন্টারেক্টিভ এবং সবার জন্য আরও অ্যাক্সেসযোগ্য করে তুলছে। অর্থাৎ শিক্ষার ধরন হতে হবে ‘দেখে, করে এবং পড়ে’—এভাবে একটি সমন্বিত পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পুরোপুরি দক্ষ হয়ে উঠবে।
বর্তমানে আমাদের সমাজের শিক্ষাব্যবস্থায় যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো ‘কর্মমুখী শিক্ষা’। তবে শুধু কর্মমুখী শিক্ষা নয়, আমাদের এমন শিক্ষা চাই যা প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত এবং সমাজের চাহিদা অনুযায়ী চাকরি বা কাজের ক্ষেত্র তৈরি করতে সহায়ক হয়। যদি সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এমন একটি কাঠামো তৈরি করতে পারে যেখানে এআই, রোবটিক্স ও ডিজিটাল লিটারেসি অন্তর্ভুক্ত থাকবে, তাহলে শিক্ষার্থীরা একটি আধুনিক ও প্রযুক্তিগত দুনিয়ার জন্য প্রস্তুত হতে পারবে।
অন্যদিকে শিক্ষকতা শুধুমাত্র একটি পেশা নয়; এটি মানবতার উন্নতির প্রতি আজীবন নিবেদন। একজন প্রকৃত শিক্ষক শুধু জ্ঞান প্রদান করেন না, বরং কৌতূহলকে উসকে দেন, চরিত্র গঠনে সহায়তা করেন এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে শেখার প্রতি গভীর ভালোবাসা ও আগ্রহ তৈরি করেন। এই মহান পেশা কোনো সমাজের অগ্রগতি ও উন্নয়নের মূল ভিত্তি। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে শিক্ষাদানের প্রকৃত লক্ষ্য অনেক ক্ষেত্রেই বাণিজ্যিকীকরণ, দুর্নীতি ও আত্মস্বার্থের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে সৃজনশীল ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের অভাব একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষকের ভূমিকা শুধুমাত্র পরীক্ষায় ভালো ফলাফল নিশ্চিত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষক সেই ব্যক্তি, যিনি শিক্ষার্থীদের হৃদয় ও মনের গভীরে স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারেন। প্রশ্ন হলো, কীভাবে আমরা এমন আদর্শ শিক্ষকদের সৃষ্টি ও সংরক্ষণ করব, যারা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সত্যিই যত্নশীল?
আমার বড় ভাই প্রফেসর ড. মান্নান মৃধা, সুইডেনের কেটিএইচ রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক। তাঁর শিক্ষাদর্শন একটি অনুপ্রেরণার উদাহরণ। তাঁর অভিজ্ঞতা প্রকৃত শিক্ষাদানের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
আমার বড় ভাইয়ের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, কীভাবে একজন শিক্ষক প্রচলিত পাঠদানের সীমাবদ্ধতাকে ভেঙে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসতে পারেন। তার পদ্ধতিতে বিষয়ের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি এবং আবেগের সংযোগ তৈরির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শেখার অভিজ্ঞতাকে আনন্দময় ও অর্থবহ করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ, তিনি বাস্তব জীবনের উদাহরণ ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের জটিল বিষয়গুলো বোঝান। এটি তাদের কৌতূহল ও সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনাকে উৎসাহিত করে। তাঁর পদ্ধতিগুলো দেখিয়েছে, কীভাবে একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক শিক্ষার্থীর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলতে পারেন।
তবে, শিক্ষা শুধুমাত্র চাকরি বা কর্মমুখী শিক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। সামাজিক ও ব্যক্তিগত উন্নতিও গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরকারের উচিত জনগণের করের টাকা খরচ করে যে শিক্ষার্থীদের পাঠানো হচ্ছে, তাদের জন্য শিক্ষার একটি বাস্তব ও টেকসই উদ্দেশ্য তৈরি করা। তারা যে শিক্ষা গ্রহণ করছে, তা কীভাবে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগবে, সেটি ভাবা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে, এআই-এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি কেবলমাত্র শিক্ষার মান উন্নত করতে সাহায্য করবে না, বরং শিক্ষার্থীদের নিজস্ব গতি এবং ক্ষমতা অনুযায়ী শিক্ষা প্রদান করে তাদের প্রকৃত প্রতিভা বিকশিত করতে সহায়তা করবে।
শিশুদের প্রথম পাঠ শুধুমাত্র বইয়ের পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়; বরং তাদের স্বপ্ন, কল্পনা ও স্বাধীন চিন্তাকে বিকশিত করতে হবে। আমার শিক্ষক বড় ভাইয়ের মতে, শৈশব থেকেই যদি শিশুদের শেখার আনন্দ না দেওয়া হয়, তবে তাদের ভবিষ্যৎ সৃজনশীলতা বাধাগ্রস্ত হয়। তাঁর মতামত থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা বলতে পারি:
ক. শিশুশিক্ষায় মজার উপায়ে পাঠদান করা জরুরি।
খ. খেলাধুলা, গল্প বলা ও ব্যবহারিক উদাহরণ শেখার অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করতে পারে।
গ. শিশুর কৌতূহল ও ব্যক্তিগত আগ্রহকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু আমার শিক্ষক বড় ভাই দেখিয়েছেন যে, এটি মজার মাধ্যমে সম্ভব। তার কিছু উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি—
ক, খেলাধুলার মাধ্যমে শেখানো: পাঠ্যবিষয়ের ধারণাগুলোকে খেলার সঙ্গে যুক্ত করা।
খ. ব্যক্তিগত আগ্রহ আবিষ্কার: শিক্ষার্থীদের নিজস্ব প্রবণতা ও ক্ষমতাকে কাজে লাগানো।
গ. বাস্তব উদাহরণ: ক্লাসরুমের তত্ত্বের বাইরে বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধানে শিক্ষার্থীদের জড়িত করা।
আজকের শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষামুখী কাঠামো এবং মুখস্থ নির্ভরতা শিশুদের সৃজনশীলতাকে দমন করছে। বড় ভাইয়ের উদাহরণ আমাদের শেখায়—
ক. শিক্ষকদের সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী হতে হবে।
থ. প্রযুক্তির সাহায্যে শিক্ষাকে আরও আধুনিক করতে হবে।
গ. পরীক্ষার চাপে শিক্ষার্থীদের দমিয়ে না রেখে তাদের প্রকৃত দক্ষতার মূল্যায়ন করতে হবে।
বড় ভাইয়ের মতো আদর্শ শিক্ষকেরা শিক্ষাদানকে আনন্দময় ও বাস্তব জীবনের উপযোগী করে তোলেন। এই ধরনের শিক্ষকেরা প্রমাণ করেছেন যে, শিক্ষাদান কেবল একটি পেশা নয়, এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ার একটি মহান দায়িত্ব। তারা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার নতুন পথ দেখানোর অনুপ্রেরণা।
একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শিক্ষার্থীদের সহজ শর্তে পড়াশোনার জন্য ঋণ (স্টাডি লোন) প্রদান। এটি বিশেষভাবে দরকার বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য। যেখানে অধিকাংশ শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষার জন্য বাবা-মার ওপর নির্ভরশীল। দেশের সরকার যদি খুব অল্প সুদে পড়াশোনার জন্য ঋণ প্রদান করে, তবে শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনার খরচ নিজেই মেটাতে পারবে এবং কর্মজীবন শুরু করার পর তারা ধীরে ধীরে এই ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হবে। এই ব্যবস্থা কেবলমাত্র শিক্ষার্থীদের আত্মনির্ভরশীলতা বাড়াবে না, বরং তারা দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার সময় ঋণ পরিশোধের মাধ্যমে রাষ্ট্রের পুনঃবিনিয়োগের সুযোগও সৃষ্টি করবে। এভাবে, ‘বার্নিং বাই আর্নিং’ কনসেপ্ট কার্যকর হবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের পরিশ্রমের মাধ্যমে রাষ্ট্রের খরচ ফিরে আসতে সহায়ক হবে। এতে শিক্ষার আউটকাম শুধু কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং বাস্তবায়িত হবে।
উন্নত দেশে পরিণত হতে সরকার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একযোগে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, ভবিষ্যতে আমাদের দেশের জনগণের প্রয়োজনীয়তা কী হবে? আমাদের দেশে কোথায় কোথায় দক্ষ জনবল প্রয়োজন? কেমন দক্ষ জনবল প্রয়োজন তা আমরা কীভাবে নিশ্চিত করতে পারি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করার জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে বর্তমান বিশ্বের চাহিদা এবং ভবিষ্যতের অগ্রগতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে গড়ে তুলতে হবে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও উন্নত ও কার্যকর করতে হবে। শুধু পাঠ্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, ছাত্রদের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তা, সৃজনশীলতা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা তৈরি করা আবশ্যক। এটি নিশ্চিত করতে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও পেশাগত উন্নয়ন অপরিহার্য। তাদেরকে আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি, প্রযুক্তি, এবং উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষকেরা যদি শিক্ষার্থীদের মানসিক ও বুদ্ধিগত বিকাশে অবদান রাখতে পারেন, তাহলে কেবলমাত্র তারা আগামী দিনের সেরা নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। আজকের শিক্ষকেরা, যারা শিক্ষার্থীদের শুধু পঠন-পাঠন শেখান, তাদের জন্য শিক্ষকতার কাজ এক ধরনের দায়িত্ব, যা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই কারণে, শিক্ষককে শুধুমাত্র জ্ঞানী হতে হবে না, তাকে একজন অনুপ্রেরণাদায়কও হতে হবে। একজন আদর্শ শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের শুধু পাঠ্যবিষয়ে সাহায্য করেন না, তিনি তাদের মানসিক বিকাশ, আত্মবিশ্বাস, এবং জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য অনুপ্রাণিত করেন।
এ ছাড়া, সরকার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত শিক্ষাব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশন ও আধুনিকীকরণে আরও বিনিয়োগ করা, যাতে একদিকে শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তিগত দক্ষতায় উন্নতি করতে পারে, অন্যদিকে শিক্ষকেরা তাদের পদ্ধতিতে উদ্ভাবনী ধারণা প্রয়োগ করতে সক্ষম হন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদেরও ডিজিটাল শিক্ষার সুবিধা প্রদান করা জরুরি, যাতে তারা শহরের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারে।
এটি শুধু সরকারের নয়, আমাদের সবার দায়িত্ব, যেন ভবিষ্যত প্রজন্ম একটি উন্নত, প্রযুক্তি-সচেতন এবং নৈতিকভাবে শক্তিশালী সমাজে পদার্পণ করতে পারে।
সবশেষে, আমরা যদি শিক্ষা ও শিক্ষকতার মাধ্যমে সমাজের প্রকৃত অগ্রগতি নিশ্চিত করতে চাই, তবে আমাদেরকে একটি সুশৃঙ্খল, সহনশীল, এবং সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে প্রতিটি শিক্ষার্থী নিজের সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করে এবং সে অনুযায়ী আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
—রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
ইমেইল: [email protected]
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে ভারতের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ।
দাবি মেনে নেওয়ায় গাজীপুর নগরের কোনাবাড়ী এলাকায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক থেকে বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছে শ্রমিকেরা। এর ফলে প্রায় ৪ ঘণ্টা পর সোমবার বেলা দেড়টার দিকে সড়কটিতে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
বন্ধ ঘোষণা করা ২টি কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে গাজীপুর মহানগরের কোনাবাড়ী এলাকায় বিক্ষোভ এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করেছেন শ্রমিকেরা।
যোগ্যতার চাইতে প্রাপ্তি বেশি হয়ে গেলে তখন সে লাগামহীন হয়ে ওঠে। এ অনেকটা মাটি ও খুঁটির মতো অবস্থা। খুঁটি শক্ত না হলে ঘর নড়বড়ে হবে আবার মাটি উর্বর না হলে খাওয়াপড়া জুটবে না। মানুষের চিন্তার সমৃদ্ধির জন্য পড়াশোনা কিংবা জ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই।