বাংলাদেশের ফুটবলে এক ধরনের পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এক সময়ের আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তার ফুটবল নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আকর্ষণ হারাতে শুরু করেছিল। মাঝের সময়টা খেলাপ্রেমীদের মানসপটের প্রায় আড়ালে যাওয়া ফুটবল আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। ইংলিশ ফুটবলে শেফিল্ড ইউনাইটেডে খেলা বাংলাদেশি ফুটবলার হামজা চৌধুরী বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের জার্সিতে খেলার ব্যাপারটিই আসলে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে ফুটবলের।

জাতীয় ফুটবল দলের পারফরম্যান্স বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রবাসী বাংলাদেশি অরিজিন ফুটবলারদের দলে টানার প্রক্রিয়া আসলেই ফুটবলের পালে হাওয়া দিয়েছে। গত ডিসেম্বরে লেস্টার সিটির হয়ে এফএ কাপ জেতা হামজাকে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে খেলার জন্য অনুমতি দেয় ফিফা। এরপর থেকেই ফুটবলপ্রেমী, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ এখন দেশের ফুটবল নিয়ে। গত মার্চে এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে দেশের জার্সিতে অভিষেক হয় হামজার। মেঘালয়ের শিলংয়ের সেই অ্যাওয়ে ম্যাচে হামজার উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ভারতকে হারিয়ে দিতেই পারত। কিন্তু সহজ গোলের সুযোগ নষ্ট করে, সেটি হয়নি। তবে ভারতের বিপক্ষে সে ম্যাচ নিয়ে দর্শকদের যে উত্তুঙ্গ আগ্রহ ছিল, সেটি বাংলাদেশের ফুটবলের বড় টার্নিং পয়েন্টই। মার্চে ভারতকে হারাতে পারলে তা হতো ফুটবলের সত্যিকারের গেম চেঞ্জার।

হামজা চৌধুরীর পর বাংলাদেশের ফুটবলের প্রতি আগ্রহী হয়েছেন আরও কয়েকজন প্রবাসী ফুটবলার। এপ্রিলে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছেন কানাডা জাতীয় দলের হয়ে ২ ম্যাচ খেলা, সে দেশের প্রিমিয়ার লিগের দল ক্যাভালরি এফসির মিডফিল্ডার শমিত সোম। শমিতের ব্যাপারে দেশের ফুটবলপ্রেমীদের আগ্রহ অনেক দিন ধরেই ছিল, সেই আগ্রহের ফল তাঁর বাংলাদেশের হয়ে খেলা। ফিফা এরই মধ্যে তাঁর ব্যাপারেও সম্মতি দিয়ে দিয়েছে। হামজা-শমিতদের সঙ্গে আছেন ইতালির সিরি ‘ডি’র দল অ্যালবিওর আরেক উইঙ্গার ফাহমিদুল ইসলাম। বাংলাদেশের হয়ে ভবিষ্যতে খেলবেন ইংলিশ ফুটবলের তৃতীয় স্তরের দল সান্ডারল্যান্ডের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ফরোয়ার্ড কিউবা মিচেল। সব মিলিয়ে প্রবাসী অরিজিন ফুটবলারদের কারণেই দেশের ফুটবল নিয়ে মানুষের আগ্রহ এখন তুঙ্গে। বয়সভিত্তিক পর্যায়েও বেশ কয়েকজন ভালো মানের প্রবাসী অরিজিন ফুটবলার আছেন, যাঁরা এদেশের ফুটবলের ভবিষ্যতের কান্ডারি হতে পারেন বেশ ভালো ভাবেই।

আগামী ১০ জুন ঢাকা স্টেডিয়ামে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের দ্বিতীয় গ্রুপ ম্যাচ বাংলাদেশের। ম্যাচটি বিশেষই। এ ম্যাচ দিয়েই দেশের মাটিতে জাতীয় দলের হয়ে প্রথম খেলবেন হামজা। এ ম্যাচেই জাতীয় দলে অভিষেক হওয়ার বড় সম্ভাবনা আছে শমিত সোম ও ফাহমিদুল ইসলামের। ফাহমিদুল মার্চে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে বাংলাদেশ দলের প্রাথমিক স্কোয়াডে ছিলেন। সৌদি আরবে জাতীয় দলের অনুশীলন ক্যাম্পেও যোগ দিয়েছিলেন। তবে তাঁকে চূড়ান্ত স্কোয়াডে রাখেননি কোচ হাভিয়ের কাবরেরা। সে সময় ফুটবলপ্রেমীরা এ নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন। বাফুফের সামনে বিক্ষোভও করেছেন। একজন ফুটবলার, যিনি কখনোই জাতীয় দলে খেলেননি, কখনোই দেশের মাটিতে খেলেননি, তাঁকে নিয়ে বিক্ষোভ দেশের ফুটবলের নতুন ঘটনাই ছিল। যাই হোক, সেই ফাহমিদুলের খেলার সম্ভাবনা আছে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচে। হামজা-শমিত-ফাহমিদুলদের কারণে অবশ্যই, ভারতের বিপক্ষে জাতীয় দলের সামগ্রিক পারফরম্যান্সই আসলে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচ নিয়ে সাধারণ দর্শকদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করেছে।

বাফুফে গত ২৪ মে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর ম্যাচের টিকিট ছেড়েছিল অনলাইনে। সেই টিকিট বিক্রির ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছিল বলেই অভিযোগ। দুই দিন টিকিট বিক্রি বন্ধ থাকার পর ২৬ মে সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে বাফুফে। তবে টিকিট না পাওয়া ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে পুরো ব্যাপারটি নিয়ে এক ধরনের সন্দেহ দেখা দিয়েছে। সব মিলিয়ে ঢাকায় অতীতে বহু আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এমন আগ্রহ আর কখনোই দেখা যায়নি। ম্যাচ টিকিট নিয়ে ফুটবলপ্রেমীদের হাহাকার, ক্ষোভ, বিক্ষোভ বাংলাদেশের ফুটবলে নতুন এক ঘটনাই।

হামজা-শমিত সোমদের মতো ফুটবলাররা কীভাবে দেশের ফুটবলের দিগন্ত বদলে দিচ্ছেন। দর্শক আগ্রহের বিষয়টি তো আছেই। এই তারকাদের আগমন, দেশের ফুটবলে দীর্ঘ দিন ধরে চলা ‘তারকা খরা’র অবসান হতে চলেছে। একটা সময়, মানে সত্তর, আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকে দেশের ফুটবল ছিল তারকায় ঠাসা। হাফিজউদ্দিন আহমেদ, এনায়েতুর রহমান, কাজী সালাহউদ্দিন, মনোয়ার হোসেন নান্নু, বাদল রায়, শেখ আসলাম, কায়সার হামিদ, ইমতিয়াজ সুলতান জনি, মোনেম মুন্না, রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বির, ওয়াসিম ইকবাল কিংবা রিজভি করিম রুমিদের পর এসেছেন জুয়েল রানা, মাসুদ রানা, আরমান মিয়া, আলফাজ আহমেদ, ইমতিয়াজ নকীবরা। কিন্তু এরপর দেশের ফুটবলে তারকার মস্ত বড় সংকট। এমন কোনো নাম ছিল না, যাঁদের খেলা দেখতেই স্টেডিয়ামে ভিড় করবেন দর্শকেরা। হামজা, শমিত, ফাহমিদুলদের দিয়ে সেই ঘাটতি কিছুটা পূরণের চেষ্টা চলছে, তাতেই জেগে উঠেছে ফুটবল। হামজা-শমিতদের উপস্থিতি ফুটবল বাণিজ্যেও বদলের হাওয়া দিচ্ছে। জাতীয় ফুটবল দলের জার্সি পার্টনার, বাফুফের বল পার্টনার, জাতীয় দলের স্পনসর—ধীরে ধীরে আসা শুরু করেছে, যে জায়গাটায় দীর্ঘ দিন ধরেই বড় শূন্যতা ছিল। বড় বড় কর্পোরেট হাউজগুলো ফুটবলের চেয়ে ক্রিকেটের প্রতিই ঝুঁকে ছিল। হামজা-শমিতদের কারণে তারাও আসছে ফুটবলে। ফুটবল-বাণিজ্য প্রসার লাভ করছে। সিঙ্গাপুর ম্যাচ সেটিরই বড় উদাহরণ।

তবে এর অন্য দিকটাও আছে। ফুটবলের সুদিনের টানে ভিড় করাদের কারণে ফুটবলের দুঃসময়ের স্টেকহোল্ডারদের অবহেলা করলে চলবে না। সে ব্যাপারটি বাফুফে কর্তাদের মাথায় রাখা জরুরি। একই সঙ্গে জাতীয় দল কেন্দ্রিক আগ্রহকে সামাল দিতে গিয়ে দেশের ঘরোয়া লিগকে উপেক্ষা করলে চলবে না। বরং হামজা-শমিতদের কারণে পালে যে হাওয়া লেগেছে, সেটিকে ব্যবহার করে ঘরোয়া লিগকে আরও আকর্ষণীয় ও শক্তিশালী করা, ক্লাব ফুটবলের অবকাঠামো উন্নয়ন, তৃণমূল থেকে ভালো ফুটবলার গড়ে তোলা—এসবই বেশি জরুরি।

হামজা-শমিতরা এসে মাঠের বাইরের পরিস্থিতি অনুকূলে নিয়ে এসেছেন। হামজা-শমিতদের কারণে জাতীয় দলের মাঠের পারফরম্যান্স যদি বদলে যায়, সেটিই হবে ফুটবলের সত্যিকারের ঘুরে দাঁড়ানো।