বিডিজেন ডেস্ক
গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণের প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সহ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করার পক্ষে শক্ত অবস্থানের কথা তুলে ধরেছেন। তারা বলেছেন, দেশবাসীর দীর্ঘদিনের লড়াইটাই ছিল বাক্স্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য। দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পেতে হলে অবশ্যই স্বাধীন সাংবাদিকতার নিশ্চয়তা রাষ্ট্রকে দিতে হবে, সরকারকে দিতে হবে। তাই গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ ও নৈরাজ্য এখনই বন্ধ করতে হবে।
খবর প্রথম আলো অনলাইনের।
বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নিউজপেপারস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) আয়োজিত মতবিনিময় সভায় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা এ কথাগুলো বলেন। ‘আক্রমণের মুখে স্বাধীন সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান: রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়’ শীর্ষক এ মতবিনিময় সভায় অংশ নেন বিএনপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় নাগরিক কমিটি, নাগরিক ঐক্য, গণ অধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ ১৩টি দল ও সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা।
সভায় স্বাগত বক্তব্যে নোয়াব সভাপতি ও সমকাল পত্রিকার উদ্যোক্তা এ কে আজাদ ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর বিরুদ্ধে হুমকি ও চাপ প্রয়োগের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে যখন সংবাদমাধ্যমগুলোর চাপমুক্ত পরিবেশে কাজ করার কথা, তখন কোনো কোনো সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমের ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা ও হুমকি অব্যাহত রয়েছে। কর্মসূচির নামে দুটি পত্রিকা অফিস ঘেরাও, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, দেশের বিভিন্ন স্থানে অফিসে হামলা এবং পত্রিকা বিতরণে বাধা সৃষ্টির যে ঘটনা ঘটছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসবের মাধ্যমে যে ভয়ভীতির পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে, তা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য চরম হুমকি।
এ কে আজাদ বলেন, ‘একই সঙ্গে আমরা দেখেছি, বিমানবন্দরে নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক পুরোনো স্বৈরাচারী আমলের মতোই দুই দফা হয়রানির শিকার হয়েছেন। ঢালাওভাবে বাতিল হয়েছে সম্পাদকসহ সাংবাদিকদের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড।’ প্রতিটি সংবাদমাধ্যমের নিজস্ব সম্পাদকীয় নীতি ও অবস্থান থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে, কেউ কোনো পত্রিকার অবস্থানের বিরোধিতা করতে পারেন, প্রতিবাদও করতে পারেন। কিন্তু একটি পত্রিকা বা সংবাদমাধ্যমের অবস্থান কতটা যথার্থ বা গ্রহণযোগ্য, তার সবচেয়ে বড় বিচারক হচ্ছে এর পাঠক ও শ্রোতা। এর বাইরে কোনো সংবাদমাধ্যম আইনের দৃষ্টিতে কোনো ব্যত্যয় ঘটালে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে।
‘লড়াইটাই তো বাক্স্বাধীনতার জন্য’
৫ আগস্টের পর গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলতে হবে, এমনটা কখনো ভাবেননি বলে মন্তব্য করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্য আমাদের, আজকে ৫৩ বছর পরও একটা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর মিডিয়ার ওপর আক্রমণের বিষয়ে আমাদের কথা বলতে হচ্ছে। আমরা এটাকে নিন্দা জানাই, ধিক্কার জানাই।’ তিনি বলেন, দেশবাসীর দীর্ঘদিনের লড়াইটাই তো বাক্স্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য।
মির্জা ফখরুল বলেন, এখন কিছু মানুষ জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। কিছু কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো দেশকে নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এটি বন্ধ করা দরকার। না হলে যে লক্ষ্য নিয়ে ছাত্র-জনতা প্রাণ দিয়েছেন, তার সবটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘আমরা যেকোনো মূল্যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মানুষের স্বাধীনতা, ভোটের স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাব। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি এবং জনগণের সঙ্গে আছি।’
মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে, তা গণতন্ত্রের জন্য—এমন মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘কিন্তু মাঝে মাঝে হঠাৎ করে কিছু কাজ হয়, যেটা বিরাজনীতিকরণের দিকে নিয়ে যায়। এটা আমাদের সকলের সচেতনভাবে পরিহার করা দরকার।’
একটি সংবাদপত্রের কার্যালয়ের সামনে গরু জবাই এবং রান্নাবান্নার আয়োজনকে অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় এবং উদ্বেগের বলে মন্তব্য করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। এর নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, যে বিষয়টি আলোচনায় এল না, যারা এখানে গরু দিচ্ছেন, নিয়ে যাচ্ছেন, নানা আয়োজন করছেন, তাদের সামনে কারা, পেছনে কারা। এটা বের করবে কে। নিশ্চয় এর পেছনে কোথাও উসকানি-মদদ আছে। অথচ লড়াই হয়েছিল একটা বহুত্ববাদী সমাজের জন্য।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ‘সংবাদপত্র এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ, জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনার ওপর আক্রমণ প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যতটুকু সাধ্য, তা নিয়ে দাঁড়াব।’
‘বাংলাদেশের সাংবাদিকতা তিনটি জিনিস দ্বারা পক্ষপাতদুষ্ট’ বলে মন্তব্য করেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী। তিনি বলেন, ‘সে তিনটি জিনিস হচ্ছে ইডিওলজিক্যাল, পলিটিক্যাল বায়াজড, বিজনেস বায়াজড। এ তিন জায়গা থেকে যদি আমরা একসঙ্গে বেরিয়ে স্বাধীন গণমাধ্যমের জায়গা থেকে সবাই বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারি, হয়তো আগামী দিনে এ সমস্যার সমাধান করতে পারব আশা করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘শুধু ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর সামনেই সমস্যা হয়নি, আরেকটি পত্রিকা কালবেলার সামনেও সমস্যা হয়েছিল। এই তিনটা পত্রিকার যে সমস্যা হয়েছিল, আমাকে ইন্টারনালি অনেকগুলো কাজ করতে হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে যেটা আমার অবজারভেশনে এসেছে, এখানে পত্রিকাগুলোর ওপর যাদের রাগ-ক্ষোভ-অভিযোগ অনেক কিছুই থাকতে পারে; কিন্তু যত বিভাজনই থাকুক না কেন, সমস্যাগুলো আমরা টেবিলে বসে সমাধান করতে পারি।’
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ের সামনে গরু জবাই করার ঘটনা ফাজলামি ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে সরকার কিছুই করেনি। প্রতিটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে। শত ফুল ফুটতে দেওয়ার গাছটাকে বাঁচাতে হবে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের রায় ছিল সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, মানুষের চিন্তা, বিবেক এবং বাক্স্বাধীনতা। এটার বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করা যাবে না। আগামী দিনে যে সংবিধান হবে, সেখানে এগুলো স্পষ্ট করতে হবে। তিনি বলেন, গণমাধ্যম আইনের দিক থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নয়। কিন্তু এটি রাষ্ট্রের একটি বড় স্তম্ভ। এটার ওপর জনগণ আশ্রয় খোঁজে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে কোনো আপস করা যাবে না।
গণতন্ত্রের সঙ্গে স্বাধীন সাংবাদিকতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বলে মন্তব্য করেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ। তিনি বলেন, এই (স্বাধীন সাংবাদিকতা) জায়গাকে দুর্বল করাকে তাঁরা দেখেন ষড়যন্ত্র এবং রাষ্ট্রকে দুর্বল করার পাঁয়তারা হিসেবে। এটি গণতন্ত্রের যাত্রাপথে বাধা সৃষ্টির একটি নতুন ষড়যন্ত্র, যেটা পুরোনো ফ্যাসিবাদকে ফিরিয়ে আনার রাস্তা উন্মুক্ত করবে।
জামায়াতে ইসলামী অতীতেও স্বাধীন সাংবাদিকতার পক্ষে ছিল উল্লেখ করে হামিদুর রহমান বলেন, ‘সংবাদপত্র কার্যালয়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগসহ আরও যা ঘটনা ঘটেছে, এটা দুঃখজনক। এটা আমরা সমর্থন করি না।’
ইসলামী আন্দোলনের সহকারী মহাসচিব মাওলানা ইমতিয়াজ আলম বলেন, ‘আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি এবং সহযোগিতা করতে চাই। কিন্তু গণমাধ্যমকে সতর্ক থাকতে হবে, দেশের মানুষের বোধ-বিশ্বাসের ওপর যেন কেউ কোনো আক্রমণ না করে। যখন এ আক্রমণ আসে, তখন সুযোগসন্ধানীরা এগুলোকে লুফে নিতে চায়। এ বিষয়গুলো গণমাধ্যমের বিবেচনায় থাকা দরকার।
’আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সদস্যসচিব মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘আমরা যারা রাজনৈতিক দল এখানে আছি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আমাদের কারও হাতেই নিরাপদ ছিল না। সব সময় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খণ্ডিত হয়েছে, বাধাগ্রস্ত হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বিগত আন্দোলনে গণমাধ্যমে আমরা তিনটা পক্ষ দেখেছি। একটা পক্ষ দেখেছি, যারা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমাদের সাহায্য করেছে, পাশে ছিল। এক পক্ষ বাধ্য হয়ে আমাদের পক্ষ মানে ন্যায়ের পক্ষ নিতে পারেনি। আরেকটা পক্ষ দেখেছি, যারা খুব আনন্দের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের পক্ষ নিয়েছে।’
ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেন, ১৫ বছর স্বৈরশাসনের সময় সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে যেসব পদক্ষেপ, স্বাধীন সাংবাদিকতাকে ধ্বংস করার, কণ্ঠ রোধ করার যেসব প্রক্রিয়া চলেছে, তাঁরা সেগুলোর ইতি চান। এসব যেন দেশে আর কখনো না হয়। কিন্তু এখন নতুন রূপে স্বাধীন সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। এটা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও শঙ্কাজনক। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তা কামনা করেন মাহ্ফুজ আনাম।
মতবিনিময় সভায় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন বাসদের উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান, এবি পার্টির আহ্বায়ক মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাহবুবুল হক, খেলাফত মজলিসের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব জাহাঙ্গীর হোসাইন, ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আহমদ আবদুল কাইয়ুম প্রমুখ।
সভায় নোয়াব সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নিউ এজ-এর এডিটরিয়াল বোর্ডের চেয়ারম্যান এ এস এম শহীদুল্লাহ খান, নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম, সংবাদ সম্পাদক আলতামাশ কবির, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ, দৈনিক করতোয়ার সম্পাদক মোজাম্মেল হক ও দেশ রূপান্তর সম্পাদক মোস্তফা মামুন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বণিক বার্তার সম্পাদক ও প্রকাশক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।
সূত্র: প্রথম আলো
আরও পড়ুন
গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণের প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সহ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করার পক্ষে শক্ত অবস্থানের কথা তুলে ধরেছেন। তারা বলেছেন, দেশবাসীর দীর্ঘদিনের লড়াইটাই ছিল বাক্স্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য। দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পেতে হলে অবশ্যই স্বাধীন সাংবাদিকতার নিশ্চয়তা রাষ্ট্রকে দিতে হবে, সরকারকে দিতে হবে। তাই গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ ও নৈরাজ্য এখনই বন্ধ করতে হবে।
খবর প্রথম আলো অনলাইনের।
বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নিউজপেপারস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) আয়োজিত মতবিনিময় সভায় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা এ কথাগুলো বলেন। ‘আক্রমণের মুখে স্বাধীন সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান: রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়’ শীর্ষক এ মতবিনিময় সভায় অংশ নেন বিএনপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় নাগরিক কমিটি, নাগরিক ঐক্য, গণ অধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ ১৩টি দল ও সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা।
সভায় স্বাগত বক্তব্যে নোয়াব সভাপতি ও সমকাল পত্রিকার উদ্যোক্তা এ কে আজাদ ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর বিরুদ্ধে হুমকি ও চাপ প্রয়োগের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে যখন সংবাদমাধ্যমগুলোর চাপমুক্ত পরিবেশে কাজ করার কথা, তখন কোনো কোনো সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমের ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা ও হুমকি অব্যাহত রয়েছে। কর্মসূচির নামে দুটি পত্রিকা অফিস ঘেরাও, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, দেশের বিভিন্ন স্থানে অফিসে হামলা এবং পত্রিকা বিতরণে বাধা সৃষ্টির যে ঘটনা ঘটছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসবের মাধ্যমে যে ভয়ভীতির পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে, তা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য চরম হুমকি।
এ কে আজাদ বলেন, ‘একই সঙ্গে আমরা দেখেছি, বিমানবন্দরে নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক পুরোনো স্বৈরাচারী আমলের মতোই দুই দফা হয়রানির শিকার হয়েছেন। ঢালাওভাবে বাতিল হয়েছে সম্পাদকসহ সাংবাদিকদের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড।’ প্রতিটি সংবাদমাধ্যমের নিজস্ব সম্পাদকীয় নীতি ও অবস্থান থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে, কেউ কোনো পত্রিকার অবস্থানের বিরোধিতা করতে পারেন, প্রতিবাদও করতে পারেন। কিন্তু একটি পত্রিকা বা সংবাদমাধ্যমের অবস্থান কতটা যথার্থ বা গ্রহণযোগ্য, তার সবচেয়ে বড় বিচারক হচ্ছে এর পাঠক ও শ্রোতা। এর বাইরে কোনো সংবাদমাধ্যম আইনের দৃষ্টিতে কোনো ব্যত্যয় ঘটালে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে।
‘লড়াইটাই তো বাক্স্বাধীনতার জন্য’
৫ আগস্টের পর গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলতে হবে, এমনটা কখনো ভাবেননি বলে মন্তব্য করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্য আমাদের, আজকে ৫৩ বছর পরও একটা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর মিডিয়ার ওপর আক্রমণের বিষয়ে আমাদের কথা বলতে হচ্ছে। আমরা এটাকে নিন্দা জানাই, ধিক্কার জানাই।’ তিনি বলেন, দেশবাসীর দীর্ঘদিনের লড়াইটাই তো বাক্স্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য।
মির্জা ফখরুল বলেন, এখন কিছু মানুষ জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। কিছু কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো দেশকে নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এটি বন্ধ করা দরকার। না হলে যে লক্ষ্য নিয়ে ছাত্র-জনতা প্রাণ দিয়েছেন, তার সবটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘আমরা যেকোনো মূল্যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মানুষের স্বাধীনতা, ভোটের স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাব। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি এবং জনগণের সঙ্গে আছি।’
মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে, তা গণতন্ত্রের জন্য—এমন মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘কিন্তু মাঝে মাঝে হঠাৎ করে কিছু কাজ হয়, যেটা বিরাজনীতিকরণের দিকে নিয়ে যায়। এটা আমাদের সকলের সচেতনভাবে পরিহার করা দরকার।’
একটি সংবাদপত্রের কার্যালয়ের সামনে গরু জবাই এবং রান্নাবান্নার আয়োজনকে অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় এবং উদ্বেগের বলে মন্তব্য করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। এর নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, যে বিষয়টি আলোচনায় এল না, যারা এখানে গরু দিচ্ছেন, নিয়ে যাচ্ছেন, নানা আয়োজন করছেন, তাদের সামনে কারা, পেছনে কারা। এটা বের করবে কে। নিশ্চয় এর পেছনে কোথাও উসকানি-মদদ আছে। অথচ লড়াই হয়েছিল একটা বহুত্ববাদী সমাজের জন্য।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ‘সংবাদপত্র এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ, জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনার ওপর আক্রমণ প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যতটুকু সাধ্য, তা নিয়ে দাঁড়াব।’
‘বাংলাদেশের সাংবাদিকতা তিনটি জিনিস দ্বারা পক্ষপাতদুষ্ট’ বলে মন্তব্য করেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী। তিনি বলেন, ‘সে তিনটি জিনিস হচ্ছে ইডিওলজিক্যাল, পলিটিক্যাল বায়াজড, বিজনেস বায়াজড। এ তিন জায়গা থেকে যদি আমরা একসঙ্গে বেরিয়ে স্বাধীন গণমাধ্যমের জায়গা থেকে সবাই বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারি, হয়তো আগামী দিনে এ সমস্যার সমাধান করতে পারব আশা করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘শুধু ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর সামনেই সমস্যা হয়নি, আরেকটি পত্রিকা কালবেলার সামনেও সমস্যা হয়েছিল। এই তিনটা পত্রিকার যে সমস্যা হয়েছিল, আমাকে ইন্টারনালি অনেকগুলো কাজ করতে হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে যেটা আমার অবজারভেশনে এসেছে, এখানে পত্রিকাগুলোর ওপর যাদের রাগ-ক্ষোভ-অভিযোগ অনেক কিছুই থাকতে পারে; কিন্তু যত বিভাজনই থাকুক না কেন, সমস্যাগুলো আমরা টেবিলে বসে সমাধান করতে পারি।’
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ের সামনে গরু জবাই করার ঘটনা ফাজলামি ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে সরকার কিছুই করেনি। প্রতিটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে। শত ফুল ফুটতে দেওয়ার গাছটাকে বাঁচাতে হবে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের রায় ছিল সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, মানুষের চিন্তা, বিবেক এবং বাক্স্বাধীনতা। এটার বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করা যাবে না। আগামী দিনে যে সংবিধান হবে, সেখানে এগুলো স্পষ্ট করতে হবে। তিনি বলেন, গণমাধ্যম আইনের দিক থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নয়। কিন্তু এটি রাষ্ট্রের একটি বড় স্তম্ভ। এটার ওপর জনগণ আশ্রয় খোঁজে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে কোনো আপস করা যাবে না।
গণতন্ত্রের সঙ্গে স্বাধীন সাংবাদিকতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বলে মন্তব্য করেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ। তিনি বলেন, এই (স্বাধীন সাংবাদিকতা) জায়গাকে দুর্বল করাকে তাঁরা দেখেন ষড়যন্ত্র এবং রাষ্ট্রকে দুর্বল করার পাঁয়তারা হিসেবে। এটি গণতন্ত্রের যাত্রাপথে বাধা সৃষ্টির একটি নতুন ষড়যন্ত্র, যেটা পুরোনো ফ্যাসিবাদকে ফিরিয়ে আনার রাস্তা উন্মুক্ত করবে।
জামায়াতে ইসলামী অতীতেও স্বাধীন সাংবাদিকতার পক্ষে ছিল উল্লেখ করে হামিদুর রহমান বলেন, ‘সংবাদপত্র কার্যালয়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগসহ আরও যা ঘটনা ঘটেছে, এটা দুঃখজনক। এটা আমরা সমর্থন করি না।’
ইসলামী আন্দোলনের সহকারী মহাসচিব মাওলানা ইমতিয়াজ আলম বলেন, ‘আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি এবং সহযোগিতা করতে চাই। কিন্তু গণমাধ্যমকে সতর্ক থাকতে হবে, দেশের মানুষের বোধ-বিশ্বাসের ওপর যেন কেউ কোনো আক্রমণ না করে। যখন এ আক্রমণ আসে, তখন সুযোগসন্ধানীরা এগুলোকে লুফে নিতে চায়। এ বিষয়গুলো গণমাধ্যমের বিবেচনায় থাকা দরকার।
’আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সদস্যসচিব মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘আমরা যারা রাজনৈতিক দল এখানে আছি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আমাদের কারও হাতেই নিরাপদ ছিল না। সব সময় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খণ্ডিত হয়েছে, বাধাগ্রস্ত হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বিগত আন্দোলনে গণমাধ্যমে আমরা তিনটা পক্ষ দেখেছি। একটা পক্ষ দেখেছি, যারা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমাদের সাহায্য করেছে, পাশে ছিল। এক পক্ষ বাধ্য হয়ে আমাদের পক্ষ মানে ন্যায়ের পক্ষ নিতে পারেনি। আরেকটা পক্ষ দেখেছি, যারা খুব আনন্দের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের পক্ষ নিয়েছে।’
ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেন, ১৫ বছর স্বৈরশাসনের সময় সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে যেসব পদক্ষেপ, স্বাধীন সাংবাদিকতাকে ধ্বংস করার, কণ্ঠ রোধ করার যেসব প্রক্রিয়া চলেছে, তাঁরা সেগুলোর ইতি চান। এসব যেন দেশে আর কখনো না হয়। কিন্তু এখন নতুন রূপে স্বাধীন সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। এটা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও শঙ্কাজনক। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তা কামনা করেন মাহ্ফুজ আনাম।
মতবিনিময় সভায় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন বাসদের উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান, এবি পার্টির আহ্বায়ক মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাহবুবুল হক, খেলাফত মজলিসের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব জাহাঙ্গীর হোসাইন, ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আহমদ আবদুল কাইয়ুম প্রমুখ।
সভায় নোয়াব সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নিউ এজ-এর এডিটরিয়াল বোর্ডের চেয়ারম্যান এ এস এম শহীদুল্লাহ খান, নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম, সংবাদ সম্পাদক আলতামাশ কবির, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ, দৈনিক করতোয়ার সম্পাদক মোজাম্মেল হক ও দেশ রূপান্তর সম্পাদক মোস্তফা মামুন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বণিক বার্তার সম্পাদক ও প্রকাশক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।
সূত্র: প্রথম আলো
আরও পড়ুন
যোগ্যতার চাইতে প্রাপ্তি বেশি হয়ে গেলে তখন সে লাগামহীন হয়ে ওঠে। এ অনেকটা মাটি ও খুঁটির মতো অবস্থা। খুঁটি শক্ত না হলে ঘর নড়বড়ে হবে আবার মাটি উর্বর না হলে খাওয়াপড়া জুটবে না। মানুষের চিন্তার সমৃদ্ধির জন্য পড়াশোনা কিংবা জ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই।
পশ্চিম মধ্য বঙ্গোপসাগরে থাকা সুস্পষ্ট লঘুচাপ নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় নিম্নচাপটি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১ হাজার ৩৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল।
কথাসাহিত্যিক ও গবেষক সিরাজুল ইসলাম মুনির সমকালীন বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে সুপরিচিত নাম। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির সমৃদ্ধ বহুমাত্রিকতা সৃষ্টি করেছে শক্তিশালী স্বতন্ত্র অবস্থান। সাবলীল শব্দ ব্যঞ্জনার প্রকাশে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন জীবন, দেশাত্মবোধ বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন মাত্রাকে।