logo
খবর

বিজয়ের মাস: ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১

বিডিজেন ডেস্ক
বিডিজেন ডেস্ক১৬ দিন আগে
Copied!
বিজয়ের মাস: ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১
ছবি: অমিয় তরফদার

যৌথ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক এলাকা

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সুরক্ষিত যশোরের এদিন পতন হয়। ঝিনাইদহ ও সাতক্ষীরাও মুক্ত হয়। এদিন সিলেটেরও বেশির ভাগ এলাকা মুক্ত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পাকিস্তানি সেনারা পালাতে শুরু করে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী এগিয়ে যেতে থাকে রাজধানী ঢাকার দিকে।

যৌথ বাহিনী প্রথমে দখল করে যশোর বিমানবন্দর। তারপর সেনানিবাস। বয়রা ও বেনাপোল থেকেও যৌথ বাহিনী যশোরের দিকে এগোয়। ততক্ষণে অধিকাংশ পাকিস্তানি সেনা যশোর থেকে পালিয়েছে। শ দুয়েক সেনা ও কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা আত্মসমর্পণ করে।

ঝিনাইদহ ছেড়ে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায় ঢাকার দিকে, সাতক্ষীরা থেকে খুলনার দিকে।

সিলেটের পতন হয় যশোরের কিছুক্ষণ পর। যৌথ বাহিনী প্রথমে শালুটিকর বিমানবন্দর দখল করে। সেখানে যৌথ বাহিনীর ছত্রীসেনা অবতরণ করে। এরপর চারদিক থেকে শহরের দিকে অগ্রসর হয়। সিলেট শহর ছাড়া বিমানবন্দর ও আশপাশ এলাকা যৌথ বাহিনীর দখলে চলে আসে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পাকিস্তান সেনারা পিছু হটে মেঘনা নদীর ওপারে ভৈরব বাজারে অবস্থান নেয়।

৭ ডিসেম্বর মুক্ত হয় চুয়াডাঙ্গা, শেরপুর, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ, নেত্রকোনার কেন্দুয়া ও কলমাকান্দা, বাগেরহাটের মোংলা, বরিশালের বাকেরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের দিরাই।

এদিন দর্শনার দিক থেকে মিত্র ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনী যোগ দিয়ে চুয়াডাঙ্গার দিকে এগিয়ে যায়। যৌথ বাহিনীর আগমনের খবর শুনে পাকিস্তানি বাহিনী আগের দিন সন্ধ্যায় যৌথ বাহিনীর অগ্রযাত্রা বন্ধ করার জন্য মাথাভাঙ্গা নদীর ওপরের সেতু বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। যৌথ বাহিনী দর্শনার দিক থেকে চুয়াডাঙ্গায় এসে পৌঁছালে সন্ধ্যার মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী চুয়াডাঙ্গা শহর ও আলমডাঙ্গা ছেড়ে কুষ্টিয়ার দিকে চলে যায়।

৬ ডিসেম্বর রাতে গোপালগঞ্জ সদর থানার পাশের অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায় পাকিস্তান বাহিনী। ৭ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ শহরে ঢুকে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে মুক্তিযোদ্ধা।

৭ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের ৩টি দল কুমিল্লার বিবির বাজার, ভাটপাড়া ও বাঘেরচর দিয়ে এসে কুমিল্লা বিমানবন্দরের পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। এসময় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি সেনারা দুপুরের দিকে বিমানবন্দরের অবস্থান ছেড়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী ও মিত্র ভারতীয় বাহিনী কুমিল্লা শহর দখলের লক্ষ্যে শহরের দিকে এগিয়ে যায়।

এদিন বিকেলে পাকিস্তানি বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী ও মিত্র ভারতীয় বাগিনী সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনীর সঙ্গে বগুড়া–রংপুর সড়কের করতোয়া সেতুর দখল নিয়ে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর ৩৫ জনের মতো সেনা হতাহত হয়।

এদিন নোয়াখালীতে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজন রাজাকারকে আটক করে মুক্তিযোদ্ধারা।

সোভিয়েত ইউনিয়নের তৃতীয় ভেটো

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে এক জরুরি আলোচনা শুরু হয়। আর্জেন্টিনা প্রস্তাব উত্থাপন করে দুই দেশকে অস্ত্র সংবরণ করে সীমান্তের দুই দিকে তাদের সেনা সরিয়ে নিতে নির্দেশ দেওয়ার কথা বলে।

নিরাপত্তা পরিষদেও অনুরূপ প্রস্তাব তোলা হয়, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো প্রয়োগ করে সে প্রস্তাব বাতিল করে দিলে প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদে পাঠানো হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন-সমর্থিত ভারতের প্রস্তাবে বলা হয়, বিষয়টি সাধারণ পরিষদের বিচার্য হতে পারে কি না, সেটা পরিষদের কার্য পরিচালনা কমিটিতে তা বিচার করে দেখতে বলা হোক।

পরিষদের সভাপতি ইন্দোনেশিয়ার আদম মালিক বলেন, শান্তির জন্য একতাবদ্ধ হওয়ার নীতির ভিত্তিতেই এই প্রস্তাব তোলা হয়েছে। তদনুসারে প্রস্তাবটি অবিলম্বে বিচার করে দেখতে হবে। ভারতের প্রস্তাবটি তিনি ভোটে দিতে চাইলে ভারত প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করে নেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জর্জ বুশ যুদ্ধের জন্য মুখ্যত ভারতকে দায়ী করে বক্তব্য দেন। এরপর বাংলাদেশ সময় রাত ১টা পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবি থাকে। আবার অধিবেশন শুরু হলে বর্তমান বিরোধের মানবিক দিক সম্পর্কে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট একটি বিবৃতি পেশ করেন।

এরপর ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সেনা অপসারণের দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এটি মানার বাধ্যবাধকতা ছিল না। প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়ে ১০৪টি, বিপক্ষে ১১টি। ১০টি রাষ্ট্র ভোট দেয়নি। কয়েকটি দেশ অনুপস্থিত থাকে। সাধারণ পরিষদের সদস্যসংখ্যা ১৩১।

ভারতের আক্রমণের প্রতি তীব্র নিন্দা জানিয়ে চীন আরেকটি প্রস্তাব আনে। সোভিয়েত ইউনিয়নও একটি প্রস্তাব আনে। কোনোটিই ভোটে দেওয়া হয়নি।

এর আগে ভারত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের জরুরি অধিবেশনে এই মর্মে দাবি জানায়, বাংলাদেশকে অবশ্যই রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে নিতে হবে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সেনা অপসারণ নিয়ে আনা প্রস্তাব সম্পর্কে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন বলেন, বাংলাদেশ সরকারের কাছে এ প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য না হলে তা বলবৎ করা যাবে না।

ভুটানের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি

ভুটান বাংলাদেশকে ৬ ডিসেম্বর স্বীকৃতি দিলেও ৭ ডিসেম্বর দিল্লিতে ভারত সরকারের একজন মুখপাত্র সংবাদটি প্রকাশ করেন। ভারতের পর ভুটানই প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল।

এদিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক ঘোষণায় জানান, তিনি কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকার গঠন করবেন। সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) সভাপতি ও দক্ষিণপন্থী জোটের প্রধান নুরুল আমিন। সহকারী প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো।

স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব: সৈয়দ নজরুল

বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এদিন এক বেতার ভাষণে বলেন, ঢাকা মুক্ত হতে আর বেশি দেরি নেই। তিনি বাংলাদেশ সরকারকে মেনে নেওয়ার জন্য দুনিয়ায় সমস্ত দেশের কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব সত্য। তিনি পৃথিবীর শান্তিকামী দেশগুলোর কাছে আবার বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য সচেষ্ট হওয়ার আহ্বান জানান।

এর আগে সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাসভবনে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান, চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলীসহ জাতীয় পরিষদের বেশ কয়েকজন সদস্য। অনুষ্ঠানের শুরুতে সুচিত্রা মিত্র ও অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায় অনেকের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গান। বক্তব্য দেন অন্নদাশঙ্কর রায়, মনোজ বসু, ড. নীহাররঞ্জন রায় প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, তৃপ্তি মিত্র, সন্তোষ কুমার ঘোষ প্রমুখ।

মুজিবনগরে একজন সরকারি মুখপাত্র এদিন জানান, ভারতের স্বীকৃতির পর বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার এক জরুরি বৈঠকে স্থির হয়েছে, ডিসেম্বর মাসেই বাংলাদেশ সরকারের সদর দপ্তর মুজিবনগর থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হবে। বাংলাদেশ সরকার হবে গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার।

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ-ভাসানী) প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এদিন এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের নিরপরাধ জনসাধারণের ওপর জঙ্গিশাহির নির্যাতন এবং ইয়াহিয়া প্রশাসনকে সমর্থন করার চীনের সরকারি নীতিতে দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, যে চীন অত্যাচারকে ঘৃণা করে, তারাই একেবারে চুপ করে আছে, এটি বড়ই দুঃখের বিষয়।

চীনের প্রতি সোভিয়েত সতর্কবাণী

পোল্যান্ডে কমিউনিস্ট পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেসের ভাষণে সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ বাইরের কোনো শক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়াই ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার ডাক দেন। একজন পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন, তিনি বাইরের শক্তি বলতে চীনকেই বুঝিয়েছেন।

যুক্তরাজ্যের দ্য টাইমস-এর সংবাদদাতা কলকাতা থেকে পাঠানো এক খবরে বলেন, ভারতীয় সেনাপ্রধান স্যাম মানেকশ বাংলাদেশে নিয়োজিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে বলেন, অবিলম্বে অস্ত্র সমর্পণ করাই তাদের পক্ষে মঙ্গলজনক। তাঁর বক্তব্য প্রচারপত্র হিসেবে পাকিস্তান সেনা-অধ্যুষিত এলাকায় বিমান থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ৮ ও ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১; দ্য টাইমস, ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১; স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র‍্যাডিক্যাল পাবলিকেশনস, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

আরও পড়ুন

হার মানা হার

হার মানা হার

যোগ্যতার চাইতে প্রাপ্তি বেশি হয়ে গেলে তখন সে লাগামহীন হয়ে ওঠে। এ অনেকটা মাটি ও খুঁটির মতো অবস্থা। খুঁটি শক্ত না হলে ঘর নড়বড়ে হবে আবার মাটি উর্বর না হলে খাওয়াপড়া জুটবে না। মানুষের চিন্তার সমৃদ্ধির জন্য পড়াশোনা কিংবা জ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই।

১ দিন আগে

সাগরে নিম্নচাপ, ৪ বন্দরে সতর্কসংকেত

সাগরে নিম্নচাপ, ৪ বন্দরে সতর্কসংকেত

পশ্চিম মধ্য বঙ্গোপসাগরে থাকা সুস্পষ্ট লঘুচাপ নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় নিম্নচাপটি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১ হাজার ৩৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল।

২ দিন আগে

কথাসাহিত্যিক সিরাজুল ইসলাম মুনিরের সঙ্গে আলাপচারিতা

কথাসাহিত্যিক সিরাজুল ইসলাম মুনিরের সঙ্গে আলাপচারিতা

কথাসাহিত্যিক ও গবেষক সিরাজুল ইসলাম মুনির সমকালীন বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে সুপরিচিত নাম। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির সমৃদ্ধ বহুমাত্রিকতা সৃষ্টি করেছে শক্তিশালী স্বতন্ত্র অবস্থান। সাবলীল শব্দ ব্যঞ্জনার প্রকাশে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন জীবন, দেশাত্মবোধ বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন মাত্রাকে।

২ দিন আগে